স্বপ্নছায়া,সূচনা পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১.
কবুল বলার পর পরই একটি আড়াই-তিন বছরের ছেলে দৌড়ে এসে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো। আদো আদো ভাষায় বলে উঠলো,
– মাম্মাম, তুমি এখন আমাল সাথে আমাল বালিতে থাকবা।
বাচ্চাটির এরুপ “মাম্মাম” সম্বোধনে ঐন্দ্রিলার ঠিক কেমন ভাবে রিয়েক্ট করা উচিত তা তার জানা নেই। তার জীবনের ঘটনাগুলো এতোটাই দ্রুত হচ্ছে যে, নিজেকে সামলে নেবার সময়টুকু পাচ্ছে না সে। বিয়ে নামক ঘটনাটি মিনিট পাঁচেক পূর্বেই ঐন্দ্রিলার জীবনে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার জন্য মোটেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো না ঐন্দ্রিলা। এক ঘন্টার মাঝেই তার জীবনটা ৩৬০° ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গিয়েছে।
এক ঘন্টা পূর্বে,
লাল রঙ্গের বেনারসিতে বউ সেজে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। অবশেষে বিয়েটা তার হচ্ছে। পাত্রপক্ষের কাজ থেকে “না” সূচক শব্দটি শুনতে শুনতে বিয়ের আশাটি ই ছেড়ে দিয়েছি ঐন্দ্রি। কারণ গুনের চেয়ে তার গায়ের রঙটা বেশি তাদের চোখে পড়ে। তবে শরীফুল আহমেদের কাছে তার মেয়ে হিরের টুকরা। মা মরা মেয়েটিকে কখনোই আদরের কমতি রাখেন নি। তিনি কখনোই নীলাদ্রী এবং ঐন্দ্রিলাকে আলাদাভাবে দেখেন নি। দু ছেলে মেয়ে সমান শিক্ষা এবং ভালোবাসার সাথে মানুষ করেছেন। কিন্তু ঐ যে সমাজ, মেয়ে শিক্ষিত কি না বা গুনবতী কিনা তাতে তাদের যায় আসে না; বয়সটা পঁচিশ পেরিয়েছে তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। বিবাহযোগ্য মেয়ে হলে বাবাদের চিন্তা যেনো দ্বিগুন হয়ে যায়। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নি। ঐন্দ্রিলার অনার্স শেষ হবার পর থেকেই শরীফ সাহেব সৎপাত্রের সন্ধানে জুটে পড়লেন। মেয়ে তার লাখে একজন, তিনি মনের মতো একজন পাত্রের হাতে মেয়েটিকে তুলে দিতে চান। কিন্তু আবার সমাজ ই তাতে বাধ সাধে। ঐন্দ্রিলার শ্যামবর্ণটা যেনো গলার কাঁটার রুপ নেয়। পাত্রপক্ষের একটাই কথা,
” মেয়েটি একটু কালো নয়!”
হ্যা, ঐন্দ্রিলার রঙ্গটা একটু চাঁপা, কিন্তু শরীফ সাহেবের কাছে তার মেয়ে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর নারী৷ কারণ মেয়ের মাঝে তিনি তার মৃত স্ত্রী চাঁদনী বেগমের অবয়ব দেখতে পান৷ অবশেষে ঐন্দ্রিলার বিয়েটা ঠিক হয়৷ শরীফ সাহেবের বন্ধু শওকত সাহেবের ছোট ছেলের আহাশের সাথে। সম্বন্ধটি শওকত সাহেবের পক্ষ থেকেই আসে। শরীফ সাহেব ও দ্বিমত করলেন না। ভেবেছিলেন, মেয়েটি সুখের মুখ দেখবে, কারণ ছেলেটি তাকে পছন্দ করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতার কাছে সবার হার মানতে হয়। আহাশ একটি চিঠি ফেলে চলে গিয়েছে৷ আহাশের এক বন্ধু বিয়ের আসরে চিঠিটি শওকত সাহেবের হাতে তুলে দেন। চিঠিতে লেখা ছিলো______
বাবা,
আমাকে ক্ষমা করবেন, এই বিয়েটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি সে মেয়েটি ঐন্দ্রিলা নয়। আমি মেয়েটিকে ঐন্দ্রিলার সাথেই দেখেছিলাম। তাই নামটি গুলিয়ে ফেলেছি। যখন জানতে পারলাম আমি যাকে ভালোবাসি এবং যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে একই মেয়ে নয় তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই একটি সপ্তাহ বারংবার এই কথাটা বলার চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু পারি নি। তবে আজ বিয়েটা করার মতো সাহস আমার নেই৷ আমি ঐন্দ্রিলাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না বাবা। তাই আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না। আমায় ক্ষমা করবেন।
ইতি
আহাশ
আহাশের চিঠিটা কোনো বোমার চেয়ে কম ছিলো না। বিয়ের আসর থেকে বর পালিয়ে গেছে ব্যাপারটা, মেহমানদের জন্য কানাঘুষা করার সুযোগ করে দিয়েছে। শরীফ সাহেবের কানে কথাটা আসতেই তিনি ধপ করে বসে পড়লেন৷ তার ব্লাড প্রেসার বাড়তে লাগলো। আসমা বেগম অর্থাৎ ঐন্দ্রিলার খালা বলতে লাগলেন,
– দুলাভাই শান্ত হোন। আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমাদের মেয়ের কি হবে?
নীলাদ্রি রাগে গজগজ করতে লাগলো। তার বোনকে কি ফেলনা ভেবে রেখেছে! যখন যা ইচ্ছে হয়েছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, আবার ইচ্ছে হলো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেছে। এটা মামা বাড়ির আবদার চলছে! শওকত সাহেব এবং শারমিন বেগমের মাথা লজ্জায় নিচু হয়ে গেছে। তাদের ছেলে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেই পারেন নি তারা। অনেক ভেবে শওকত সাহেব একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন। শরীফ সাহেবের হাতখানা ধরে বললেন,
– তোর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমার বড় ছেলের সাথে ঐন্দ্রি মায়ের বিয়েটা দিতে চাই আমি!
শওকত সাহেবের কথা শুনে বেশ রোষের সাথে নীলাদ্রি বলে,
– আংকেল আমাকে ক্ষমা করবেন, হয়তো বেয়াদবি হয়ে যাবে। কিন্তু আমার বোনটি ফেলনা নয়। আপনার বড় ছেলের কিচ্ছা জানে না এমন কেউ নেই। সেই ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে হবে কিভাবে ভাবলেন। আপনার ছোট ছেলে একেই আমার বোনকে সমাজের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করবার জন্য রেখে গেছে। এখন আপনি আপনার বড় ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ের কথা বলছেন! যার একটি ছেলে রয়েছে। আপনাদের চোখে আমার বোনের কোনো দাম নাই থাকতে পারে তবে আমার কাছে আছে!
– নীল বাবা তুমি ভুল বুঝছো! আমি ঐন্দ্রির খারাপ মোটেই চাইবো না। ও আমার মেয়ের মতো। শরীফ তুই অমত করিস না। আমার ছেলেটা এতোটাও খারাপ নয়।
ঐন্দ্রিলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শরীফ সাহেবের চিন্তাটা কাটলো না। কিন্তু সমাজের মুখ ও তিনি আটকাতে পারবেন না। মেয়েটাকে অহেতুক সবার কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই তিনি অবশেষে শওকত সাহেবের বড় ছেলে অভ্রের সাথে ঐন্দ্রিলার বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। ঐন্দ্রিলাকে যখন বিয়ের ব্যাপারটা জানানো হয় তখন তার বলার কিছু থাকে না। বাবা ভাই এর সম্মানের কথা ভেবে সেও চুপচাপ বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। ব্যাস এভাবেই অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা নাম দুটো একই সুতোয় বাধা পড়ে।
বর্তমান,
রাত ১০টা,
অভ্রের ছোট বোন আহানা ঐন্দ্রিলাকে এই রুমে নিয়ে এসেছে। ঘরটায় একেবারেই সিমসাম। কোনো বাড়তি সাজসজ্জা নেই। অবশ্য এটা অবাক হবার মতো কোনো ব্যাপার নয়, কারণ ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রের বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। ঐন্দ্রিলার কোলে বাচ্চাটি ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটির নাম দিশান। ভেঙ্গে ভেঙ্গে কথা বলে৷ পুরোটা রাস্তা ঐন্দ্রিলার কোলে ওর গায়ের সাথে লেপ্টে ছিলো, একটা সময় ঐন্দ্রিলার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে। খুব তাড়াতাড়ি ই ঐন্দ্রিলার সাথে মিশে গিয়েছে দিশান। ঐন্দ্রিলার ভাবতেই অবাক লাগছে, স্ত্রী হবার পূর্বেই মা হয়ে গেলো সে। তবে যার জন্য দিশানের সাথে তার সম্পর্ক সেই মানুষটি ঐন্দ্রিলার কাছে অপরিচিত। আহানা ঐন্দ্রিলার কোল থেকে দিশানকে নিলো। মেয়েটা তার থেকে বেশ ছোট, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে মাত্র। মেয়েটি বেশ মিষ্টি এবং হালকা বাঁচাল প্রকৃতির। ঐন্দ্রিলার সাথে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে তার৷ ঐন্দ্রিলার কোল থেকে দিশানকে নিতে নিতে বললো,
– তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও ভাবী। কম তো ধকল গেলো না তোমার উপর।
– দিশান কোথায় ঘুমাবে?
– ও আমার সাথেই থাকুক আজ। এমনিতেও ও আমার কাছেই থাকে।
দিশানকে নিয়ে অনেক কৌতুহল ঐন্দ্রিলার মনে। তাই মুখ ফচকে বলেই ফেললো,
– দিশানের মা কোথায়?
প্রশ্নটি শুনে চুপ হয়ে যায় আহানা। হয়তো কি উত্তর দিবে তা জানা নেই। অভ্র চৌধুরী, ব্যাক্তিটি ঐন্দ্রিলার কাছে একটি রহস্য। লোকমুখে তার সম্পর্কে অনেক কিছু শোনা যায়। বত্রিশ বছর বয়সে সে শওকত সাহেবের বিশাল ব্যাবসা একই হাতে সামলাচ্ছে। এক বছর আগে বিদেশ থেকে এসেছে সে। সে যখন দেশ ফিরে তখন দিশানের বয়স মাত্র দু বছর। দিশানের মা কে! কোথায় আছে! কেনো সে অভ্রের সাথে নেই এই প্রশ্নগুলো কেবল ই রহস্য! আহানার ইতস্ততবোধ হচ্ছে বিধায় ঐন্দ্রিলা মুচকি হেসে বললো,
– উত্তর না দিতে চাইলে সমস্যা নেই। তুমি যেতে পারো।
আহানা দিশানকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঐন্দ্রিলার।
রাত গভীর হচ্ছে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে রুমের নিস্তব্ধতা ও বাড়ছে। ঘড়ির কাটা বারোটা ঘরে এসে ভিড়েছে। এখনো রুমে অভ্রের আগমন হয় নি। বিয়ের বেনারসি শাড়িটা খুলে একটি নীল শাড়ি পড়েছে ঐন্দ্রিলা। ঘরের দক্ষিণে একটি বেলকনি রয়েছে। বেলকনি থেকে রাতের আকাশটা আরোও স্পষ্ট দেখা যায়। আজ বেশ চমৎকার চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঐন্দ্রিলা এক দৃষ্টিতে সেই চাঁদটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চাঁদের আলো তার গায়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু এই জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোটুকু বিষাক্ত লাগছে ঐন্দ্রিলার কাছে। আজকের দিনটি তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো। এমন একজন ব্যাক্তির সাথে তার বিয়ে হয়েছে যার সাথে এখনো অবধি কথাটুকু হয় নি ঐন্দ্রির। শুধু সেই ব্যাক্তির স্ত্রী সে তা নয় এখন তার সন্তানের মা সে। চোখটা জ্বলছে, হয়তো এখনই টপটপ করে ধারা বইবে। নিজের ভাগ্যের নির্মমতার কাছে নিজেকে অসহায় লাগছে ঐন্দ্রিলার। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে স্বম্বিত ফিরলো ঐন্দ্রিলার। পেছনে ফিরতেই দেখলো, কালো কোর্ট, সাদা শার্ট পড়া একজন পুরুষ তার রুমে প্রবেশ করেছে। গাড়িতে পাশাপাশি বসে থাকলেও ঐন্দ্রিলা তার মুখখানা দেখে নি। কারণ তখন সে দিশানকে কোলে নিয়ে বাহিরের দিকে দৃষ্টি তাক করে ছিলো। এখন যখন লোকটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাই ঐন্দ্রিলা তাকে সূক্ষ্ণ নজরে দেখে নিলো। লোকটি একেবারে সাউথে হিরোদের মতো দেখতে। বেশ লম্বা, শ্যাম বর্ণের সুঠাম দেহী, সুদর্শন পুরুষটি তার স্বামী ব্যাপারটি ভাবতেই ঐন্দ্রিলার মনে একটা শিহরণ জেগে উঠলো। কিন্তু ভালো লাগাটা খুব একটা সময় স্থায়ী হলো না যখন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি ভনিতাবিহীনভাবে সুস্পষ্টস্বরে বললো,
– বিয়েটা কেবল বাবার সম্মান রক্ষার্থেই আমি করেছি। এটা আমার কাছে কেবল ই একটা ডিল। যেখানে তুমি এবং আমি উভয়ই দুটি পার্টি। প্রতিটি ডিলের মতো আমার ও কিছু কন্ডিশন রয়েছে…………
চলবে