স্বপ্নছায়া পর্ব-১৯,২০

0
1663

স্বপ্নছায়া
পর্ব-১৯,২০
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৯তম_পর্ব

বিকেল ৪টা,
খা খা রোদে ঢাকা শহর ঝাঝরা হয়ে যাচ্ছে। আকাশে একদল কালো মেঘ ভিড় করেছে কিন্তু তাদের মতিগতি আজ ভালো না। তারা শুধু দল বেধে ঘুরে বেড়াবার মতলব ই এটেছে। ক্ষণে ক্ষণে গরম বাতাস বইছে। তাতে গরম কমার বদলে আরোও বেশি গরম লাগছে। এই উত্তপ্ত গরমে রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ পিউ শাড়ির কুঁচিটা বেশ সুন্দর করে ধরে হাটছে৷ গরম লাগছে কিন্তু হাটতে বিরক্ত লাগছে না পিউ এর। পিউ এর হাতটা এখনো নীলের হাতের মুঠোয় রয়েছে৷ নীলাদ্রি খুব আগলে আগলে হাটছে। হাটতে হাটতে হঠাৎ পিউ হাতটা ছাঁড়িয়ে নিলো নীলাদ্রির হাত থেকে। পিউ এর এরুপ কাজে কিছুটা নীলাদ্রি বেশ অবাক হলো৷ পাশে তাকাতেই দেখলো পিউ পাশে নেই। নীলাদ্রি হন্যে হয়ে পিউ কে খুজতে লাগলো৷ পাগলের ন্যায় রাস্তায় ছুটতে লাগলো। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। একটু আগেও তো মেয়েটা তার পাশেই ছিলো। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে হাত ছাড়িয়ে মেয়েটা কোথায় চলে গেলো। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পা জোড়া আটকে গেলো তার। রাস্তার অপজিটে একটা ফুচকা ওয়ালা ফুসকা বেঁচছে। তার ঠিক সামনে একটা নীল শাড়ি পড়া নারী মোহনীয় ভাবে ফুসকা খাচ্ছে। ফুসকার ঝালে তার ফর্সা নাক এবং মুখ লাল হয়ে উঠছে। চোখ থেকে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে তবুও তার খাওয়া থামছে না। হৃষ্টচিত্তে মুখে পুড়ছে ঝাল ঝাল ফুসকা। পিউকে দেখে যেনো জানে পানি এলো নীলাদ্রির। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো৷ হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো সে। এক ছুটে পিউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ হুট করেই একজন আখাম্বার মতো মানুষ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আতকে উঠে পিউ৷ হাতে থাকা ফুচকা টা টুপ করে প্লেটে পড়ে যায়। মাথা তুলে নীলাদ্রি লাল হয়ে থাকা চোখ দেখে গলা শুকিয়ে যায় পিউ এর৷ শুকনা ঢোক গিলে বোকা হাসি হেসে বলে,
– খাবেন?
– হু, খাবো তো! তোকে আস্তো চিবিয়ে খাবো। আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার। কিন্তু ম্যাডামের কি সেই খেয়াল আছে, তার তো পেটপুজো করতে হবে।

নীলাদ্রির হুংকারে খানিকটা চুপসে গেলো পিউ। মাথা নিচু করে বললো,
– আসলে ফুচকা দেখে লোভ সামলাতে পারি নি। আপনাকে বলতাম, কিন্তু ফুচকা মামা চলে যাচ্ছিলেন। তাই বলার সুযোগ পাই নি। সরি।

নীলাদ্রি চুপ করে আছে। কোনো সারা না পেয়ে মাথাটা তুলে পিউ। তখন নীলাদ্রি যা করলো তার চিন্তার বাহিরে৷ রাস্তার মাঝে, শত লোকের ভিড়ে সে আচমকা পিউ কে জড়িয়ে ধরলো। পিউ এর কাধে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ভয় পেয়েছিলাম, ভেবেছি তোকে বুঝি হারিয়ে ফেললাম! আমার দম বন্ধ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মরে গেলাম। তুই এতোটা অবুঝ কেনো! কেনো বুঝিস না আমাকে! ভালোবাসি তো, তাই হারয়ে ফেলার ভয় ও পাই!

পিউ তাকে বাঁধা দিলো না। লোকটা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে, পিউ এর মনে হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তার নীলাদ্রিকে বাধা দিতে ইচ্ছে করছে না। যতই হোক এই পাগল লোকটাকেই অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতই হোক এই পাগল লোকটাই তার প্রেমিক৷ এই পাগল লোকটার এই পাগলামি ই তাকে বিভোর করে রাখে। পিউ প্লেট টা এক হাতে রেখে অন্য হাতে নীলাদ্রির পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে লাগলো সে আছে, সে ঠিক আছে। মুচকি হেসে মনে মনে বললো,
“বুঝি তো! তাই তো এই খচ্চর, রাগী, অসহ্যকর, পাগল লোকের প্রেমে পড়ে গেছি। এই প্রেমজাল থেকে যে আমার মুক্তি নেই” ___________

১০.
মাথার উপর ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে। আহাশের দৃষ্টি ফ্যানের দিকে। গা টা খাটের উপর এলিয়ে রেখেছে। হাতটা বিছানার বাহিরে। তার দু আঙ্গুলের মাঝে একটি জ্বলন্ত সিগারেট জ্বলছে। ধীরে ধীরে এই সিগারেটের লাল আভাটা সিগারেটটিকে ছাই এ পরিণত করছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে তার চিন্তায় মগ্ন। চিন্তাগুলো বেশ এলোমেলো।যেকোনো এক চিন্তাতে স্থির হতে পারছে না সে। অবশ্য তার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে আছে। বাসায় ফিরেছে আজ দশ দিন হয়ে গেছে। ভেবেছিলো বাসায় আসার পর জীবনটা আগের মতোই থেকে যাবে। কিন্তু তেমনটা হয় নি। রুম থেকে বের হলেই ঐন্দ্রিলার সাথে তার দেখা হয়। ঐন্দ্রিলা তার দিকে চেয়ে বিনয়ের হাসি দেয়। তার হাসিমুখটা দেখে গ্লানিতে মাথা নত হয়ে যায় আহাশের। ঐন্দ্রিলার সাথে দু-তিনবার কথা বলার ও চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ঐন্দ্রিলা একবারো সেই সুযোগ তাকে দেয় নি। প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। শওকত সাহেব এখনো তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন না। কথায় কথায় তার অপারগতার খোঁটা খেতে হয় আহাশকে। আহাশের পরিণতি এমন যে, সে কারোর সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারে না। একটা সময় সে যে কাউকে পছন্দ করেছিলো বা কাউকে নিজের মনোমন্দিরে জায়গা দিয়েছিলো সেটাই সে ভুলতে বসেছে। হাতে গরম অনুভুতি হতেই চিন্তার ঘোর কাটে তার। সিগারেট টা এশ ট্রে তে ফেলে দিলো। নতুন একটা নিকোটিনের দলায় আগুন জ্বালালো সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের অপদার্থ মনে হচ্ছে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে তার হাতে গোনা তিনটি এচিভমেন্ট আনলোক হয়েছে তার, এক. সে তার পড়াশোনা শেষ করে জার্মানীতে ভিসা পেয়েছে। দুই. সে বিয়ের দিন সন্ধ্যায় বিয়ের ভয়ে পালিয়ে গেছে। তিন. একজন প্রতারক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে নিজের সর্বোচ্চ খুইয়ে এখন বাবা এবং ভাইয়ের উপর খাচ্ছে। আহাশের চিৎকার৷ করে নিজের ভেতরের আগুনটাকে বার করছে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সেটা করলে সবাই তাকে পাগল ভাববে। তাই চরম অপারগতার প্রমাণ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের ফুসফুস জ্বালাতে লাগলো।

মেঝেতে বই এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে। বই এর শেলফটা আজ পরিষ্কার করেই দম নিবে ওন্দ্রিলা। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। বই কিনতে হচ্ছে অসংখ্য। এবার এম.বি তে ভর্তি হয়েছে ঐন্দ্রি। লক্ষ্য খুব ভালো রেজাল্ট করে যে কোনো ব্যাংকে জবের জন্য এপ্লাও করা। বর্তমানে মেয়েদের জন্য ব্যাংকিং এবং টিচিং এরিয়াটা প্রফেশন হিসেবে সর্বোত্তম। সেখানে নিজের যোগ্যতা অনুসারে তারা নিজেকে এগিয়ে নিতে পারে, শুধু তাই নয় সেফটির ব্যাপারটা ও যথেষ্ট ভালো থাকে। ঐন্দ্রির ও ইচ্ছে একটা ভালো সরকারি ব্যাংকের জব পাওয়া। সে শুধু মিসেস অভ্র চৌধুরী হিসেবে থাকতে চায় না। আত্ননির্ভরশীল হওয়াটাই তার লক্ষ্য। তাই পড়াশোনার গতি প্রথম থেকেই বাড়িয়ে রেখেছে। অভ্রের শেলফটাতে বিয়ের পর থেকে কখনো হাত দেওয়া হয় নি ঐন্দ্রিলার। এই প্রথম নিজের বইগুলোর জন্য জায়গা করতেই এই কান্ড। অভ্রের যখন বই, ফাইল এক এক করে নামাচ্ছে সে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস থাকলে সেটার স্থান হবে একটা লেক্সাসের কার্টুন৷ আসন গেড়ে মাটিতে বসলো ঐন্দ্রিলা। এই এক মাসে অভ্রের অভ্যাস এবং স্বভাব ভালোভাবেই রটা হয়ে গেছে ঐন্দ্রিলার। অভ্র কোন বই গুলো পড়ে এবং কোন বই গুলো অহেতুক পড়ে পড়ে ধুলো খায় তা ঐন্দ্রিলার জানা। একে একে সকল বই পত্র গুলো দেখতে শুরু করলো সে। হঠাৎ তিনটি খয়েরি মলাটের ডাইরি হাতে পড়লো ঐন্দ্রির। ডাইরিটি খুব চমৎকার দেখতে। মোটা খয়েরি কালারের মলাট, উপরে গোল্ডেন ইটালিয়ান ফন্টে “2017”, ” 2018″, “2019” লেখা। ঐন্দ্রি পাতলা কাপড়টা দিয়ে ডাইরিগুলোর উপরের ধুলো সরিয়ে দিলো। ধুলো সরালেই সেখানে ছোট করে সোনালি রঙের ইটালিয়ান ফন্টে “Do not look” লেখাটা দেখতে পেলো। ডাইরিগুলো লক সিস্টেম। খুব চমৎকার খয়েরি রঙ্গের তালা ঝুলছে ডাইরিটিগুলোর গায়ে। যেহেতু এটা অভ্রের বই ফাইলের ভেতর পাওয়া গেছে তাই বলা যেতেই পারে ডাইরিটি অভ্রের। কিন্তু অভ্রের চরিত্রের সাথে ডাইরি লেখার ব্যাপারটা ঠিক যায় না। ডাইরিটাকে উলটে পালটে খুলে দেখার পৈশাচিক সুপ্ত লালসা ঐন্দ্রির মনে উঁকি দিতে লাগলো। মানুষের সর্বদাই “না” শব্দের প্রতি আকর্ষণ বেশি। বারণ করা যেকোনো কাজ করার ইচ্ছে যেনো প্রবল হয়ে যায়। কোথাও যেতে বারণ করলে মানুষ সেটা আরোও বেশি করবে।কোনো কাজ করতে মানা করলে সেটা আরোও বেশি করে করলে। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রেও তাই হল। ডাইরির “Do not look” এবং তালাটি৷ তাকে নিজের দিকে বেশি আকর্ষণ করছে। তাই একটা পেপার ওয়েট দিকে প্রথম ডাইরিটির তালাটা সে ভেঙ্গে ফেললো। ডাইরিটি খুলতেই একটা ছবি তার সামনে আসলো। ছবিতে তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। একটি মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে একটি ছেলে। ছবির ছেলেটিকে ঐন্দ্রিলা চিনে। কারণ এই ছেলেটি তার স্বামী। কিন্তু তার পাশের মেয়েটিকে সে চিনে না। তবে আন্দাজ করতে খুব একটি কষ্ট হলো না তার। শ্বেত বর্ণের গোলগাল চেহারা মেয়েটির। অনেকটাই দিশানের মতো। চুল গুলো ব্রাউন কালার। অনেকটা ডায়েরির রঙ্গের। মেয়েটির সবথেকে সুন্দর তার মনোমুগ্ধকর হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব খুশি। ঐন্দ্রিলা বুঝতে পেরেছে এই ডাইরিটা কার। এটা জ্যানিফারের ডাইরি। তাইতো, অভ্র শেলফে গুছিয়ে রেখেছে ডাইরিগুলো। কিন্তু এতোটা অযত্নে কেনো রেখেছে সেই উত্তরটা ঐন্দ্রি পাচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি তো সযত্নে রাখে মানুষ। তবে জ্যানির ডাইরিগুলো এভাবে ধুলো লেপ্টানো কেনো। ঐন্দ্রিলা পাতা উল্টায় ডাইরির। পাতা উল্টিয়ে বেশ অবাক হলো ঐন্দ্রিলা। ডাইরির প্রতিটা পেজে কিছু না কিছু লেখা। ইটালিয়ান ফন্টে ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখা। সকল লেখা ইংরেজি তে। লেখা গুলো বাংলা করলে যা দাঁড়ায়,

৮ জানুয়ারি, ২০১৭
আজ আমি বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছি। বাংলাদেশ খুব ঘনবসতি দেশ, এখানে ঠান্ডা ও ততোটা নয়। তবে এখানের মানুষেরা অনেক অদ্ভুত।

৯জানুয়ারি, ২০১৭
আজ আমি সকালে এখানের বিখ্যাত মালাই দেওয়া চা খেয়েছি। আমার শরীরটা পুরো চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শিহরণ হয়েছে চা টা খেয়ে।

ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো প্রতি পেজেই দু-তিনটা লাইন করে লেখা। ঐন্দ্রিলা একের পর এক পেজ উল্টাতে লাগলো। হঠাৎ একটা পেজে আটকে গেলো।

৩১শে আগষ্ট, ২০১৭
আজ আমি প্রেমে পড়েছি। হ্যা, আমি প্রেমে পড়েছি। প্রেম অনুভূতিটা এতোটা মধুর এটা আগে জানা ছিলো না। আমার মনে হচ্ছে আমি ধীরে ধীরে এই প্রেমের প্রতি আসক্ত হচ্ছি। কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে………………..

চলবে

#স্বপ্নছায়া
#২০তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো প্রতি পেজেই দু-তিনটা লাইন করে লেখা। ঐন্দ্রিলা একের পর এক পেজ উল্টাতে লাগলো। হঠাৎ একটা পেজে আটকে গেলো।

৩১শে আগষ্ট,
আজ আমি প্রেমে পড়েছি। হ্যা, আমি প্রেমে পড়েছি। প্রেম অনুভূতিটা এতোটা মধুর এটা আগে জানা ছিলো না। আমার মনে হচ্ছে আমি ধীরে ধীরে এই প্রেমের প্রতি আসক্ত হচ্ছি। কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে। ও একজন মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে। আর আমি ক্যাথেলিক। আমাদের সম্পর্কটা বাবা মেনে নিবে না। আমাদের নিয়তি ভেবে আমার খুব কষ্ট লাগছে। তবে জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি এতোটা আকর্ষিত হয়েছি। আমি বর্তমানে থাকতে চাই। বর্তমানে বাঁচতে চাই।

ঐন্দ্রিলা “কিন্তু এই প্রেমই যে আমার মৃত্যুর কারণ হবে এটা আমার জানা আছে।”___ লাইনটি দুবার পড়লো। লাইনটি জ্যানিফার কেনো লিখেছে তার উত্তর খুজে পাচ্ছে না সে। ঐন্দ্রিলা ব্যাস্ত হাতে ডাইরির পাতা গুলো উল্টাতে লাগলো। যত পাতা উল্টাচ্ছে যতই তার হৃদস্পন্দন তীব্র হচ্ছে।

৫ সেপ্টেমবর, ২০১৭,
মানুষটা আজ আমাকে রমনা পার্কে নিয়ে গিয়েছে। আমি আজ প্রথম শাড়ি পড়েছি। শাড়িতে কোনো নারীকে এতোটা চমৎকার লাগে আমার জানা ছিলো না। আশ্চর্য হলাম মানুষটার জন্য আজ আমি আমার পোশাক ছেড়ে শাড়ি পড়েছি। প্রেম মানুষকে কতোটা বদলে দেয় তাই না। অভ্র আমার জন্য একটা বেলীফুলের মালা নিয়ে আসবে। ও বলেছে, ও নিজ হাতে আমার চুলে খোপা করে দিবে।

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
এখন রাত ১০টা বাজে, কিছুক্ষণ আগে লোকটা আমার জন্য মুড়িমাখা, ফুচকা এবং দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে এসেছে। কারণ আমি তাকে মিটিং এর সময় বলেছিলাম, আমার কদিন ধরে মুড়িমাখা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কাজের চাপে সময় ই হচ্ছে না। আমার পাগল প্রেমিক তাই আজ এমন একটা কান্ড ঘটিয়েছে। আমার খুব হাসি পাচ্ছে, আবার বুকের মাঝে এক তৃপ্তির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
অভ্র তার বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছে আজ। তার মা আমাকে চা বানিয়ে খাওয়িছেন। আমরা ঘন্টা খানেক গল্প ও করেছি। আহানা মেয়েটা অনেক কিউট। আমার প্রচন্ড ভালো লেগেছে তাদের৷ কিন্তু তাদের আমাকে কেমন লেগেছে আমার জানা নেই।

১ অক্টোবর, ২০১৭,
আগামী ৭তারিখ, আমি কানাডা ব্যাক করবো। বাংলাদেশে আমার কাজ শেষ। এখন থাকার কোনো মানে নেই। অবাককর ব্যাপার হলো আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার বিরক্ত লাগছে। অভ্রকে ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গতকাল অভ্র আমাকে একটা বই দিয়েছে, “Notebook” বই টা আমার খুব ই পছন্দের। এর আগেও বইটা আমার বেশ কয়েকবার পড়া হয়েছে। তবুও গতকালের পর থেকে এই পর্যন্ত মোট চারবার আমি বইটা পড়েছে। হয়তো আমাকে মানুষ পাগল ভাববে। তবে এতে আমার কিছুই যায় আসে না। মাঝে মাঝে পাগলামি করতেও ভালো লাগে। এই সাতটা দিন আমি খুব পাগলামী করবো। এই সাতদিনের পাগলামী হবে আমার ভবিষ্যতের পুঁজি। এতে করে অভ্র ব্যাতীত
জীবন কাটানো সহজতর হবে। আমি জানি আমি একবার এখান থেকে চলে গেলে আর ফিরবো না। যদিও অভ্র আমাকে কথা দিয়েছে, আমি যেখানেই থাকি না কেনো সে আমাকে খুজে বের করবে। আমাকে সারাটাজীবন সে ভালোবেসে যাবে। যদি আমাদের গল্পের পরিণতি মন্দ ও হয় সে আমাদের গল্পটাকে সুখময় সমাপ্তিতে পরিণত করবে। দেখা যাক ও ওর কথাটা রাখে কিনা।

ঐন্দ্রিলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কেনো তার জানা নেই। ঈর্ষা নাকি আফসোস! জ্যানিফারের আবেগগুলো এলোমেলো ভাষায় ডাইরিতে লেখা। আবেগগুলো তার স্বামীকে নিয়ে লেখা। প্রতিটা পাতায় ছোট করে হলেও তার স্বামীর উপস্থিতি রয়েছে। যদি অভ্রকে মন না দিয়ে বসতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এতোটা বুকে ফুটতো না। প্রতিটা পাতা সুই এর মতো বুকে ফুটছে। কিন্তু ডাইরিটা রেখেও দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ঐন্দ্রিলা চোখটা মুছে নিলো। কাঁপা হাতে আবার পৃষ্ঠা পাল্টাতে লাগলো৷

৭ অক্টোবর, ২০১৭,
আজ ভোর ৪টায় আমার ফ্লাইট। অভ্র আজ সারাটা দিন আমার সাথেই ছিলো। বোকা ছেলেটা আমার হাত ধরে বসেছিলো। আমার খারাপ লাগছিলো খুব। কিন্তু আমি অপারগ। ও যখন আমার কোমড় আকড়ে না যাওয়ার জিদ করছিলো আমিও নিজেকে আটকাতে পাড়ি নি। একটা ভুল করেই বসেছি। অবশ্য এই ভুলে আমার কোনো আফসোস নেই। যখন নিজেকে অভ্রের বুকে আবিষ্কার করেছিলাম লজ্জায় আমার মুখ চুপসে গিয়েছিলো। আমরা আজ নিজেকে নিজের মাঝে উজার করে দিয়েছি। দুজন ব্যাস্ত হয়ে সুখ কুড়িয়েছি। ক্ষণিকের এই সুখটা আমার সারাজীবনের কালবিষ হয়ে দাঁড়াবে আমি জানি তবুও অভ্রের স্মৃতিটুকু আমার ভেতরে আকড়ে ধরেই আমি আমার শেষ দিনগুলো পাড় করবো। অভ্রের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকালেই বুকটা ছটফট করে উঠে। এই পাগল ছেলেটাকে ফেলে কিভাবে যাবো আমি!

পাতাটা পড়েই থমকে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার মাথাটা ভনভন করছে। আর পড়তে পারছে না সে। কোনো স্ত্রী এতোটা ও সাহসী হয় না যে সে তার স্বামীর প্রাক্তনের সাথে কাটানো আবেগপ্রবণ মূহুর্ত গুলোর সাক্ষী হবে। সত্য তিক্ত হয় সেটা ঐন্দ্রিলার জানা ছিলো কিন্তু এতোটা তিক্ত হয় সেটা আজ বুঝতে পারছে সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। ডাইরিটা বন্ধ করে দিলো ঐন্দ্রিলা। ডাইরিগুলো গুছিয়ে নিজের আলমারির এক কোনায় রেখে দিলো সে। শেলফটা গুছাতে যাবে তখনই রুমে অভ্র প্রবেশ করে। ঐন্দ্রিলাকে ধুলোর মধ্যে বসে থাকতে দেখে ছুটে তার কাছে যায়। হাটু গেড়ে বসে শান্ত কন্ঠে বলে,
– এগুলো কি করছো তুমি?
– বই গুলো রাখা জায়গা করছিলাম।
– শরীফাকে বলতে। ও করে দিতো।
– আজ শরীফা আসে নি।
– তুমি কাঁদছিলে?

অভ্রের এমন প্রশ্নে সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় ঐন্দ্রিলা। সে ভালোভাবেই চোখ মুছেছে। তাহলে অভ্র কিভাবে বুঝলো সে কেঁদেছিলো! ঐন্দ্রিলা গলা খাকারি দিয়ে বললো,
– না তো! আসলে ডাস্ট এলার্জির কারণে হাছি হচ্ছিলো।
– তবুও তুমি এখানে বসে আসো?
– হু, কাজটা তো শেষ করতে হবে। আচ্ছা এখান থেকে অনেক পুরোনো এবং অকেজো জিনিস পেয়েছি। ধুলোর আস্তরণ জমেছে। দেখুন তো যদি আপনার প্রয়োজন হয়!
– যেখানে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে সেটা ফেলে দেওয়াটাই শ্রেয়। অবহেলায় পড়ে থেকে জায়গা নষ্ট করার চেয়ে সেখানে নতুন জিনিসের আবির্ভাব ঘটানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
– জ্যানিফারের স্মৃতি গুলো কি তবে জায়গা নষ্ট করছে?
– অনেকটা তাই। যেগুলোকে তুমি স্মৃতি বলছো সেগুলো জড় পদার্থ৷ সেটা থাকা বা না থাকায় আমার কিছু যায় আসে না। ওর জীবন্ত স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়ায়৷ এবং এখনো সেটায় ধুলো জমে নি। প্রতিনিয়ত এখনো সেই স্মৃতি আমার মন-মস্তিস্কে বিচরণ করে।

ঐন্দ্রিলা খানিকটা রোশের সাথে বললো,
– ঈর্ষা অত্যন্ত খারাপ জানেন তো, অনেকটা স্লো পয়জনের মতো। ভেতর থেকে আপনাকে প্রতিনিয়ত জ্বালাবে, পুড়াবে। একটা সময় আপনাকে শেষ করে দিবে।
– আমার বাঘিনী ঈর্ষাকেও হার মানাবে, আমি জানি। আমি চাই তুমি আমাকে সব কিছু জেনে তারপর ভালোবাসো। জ্যানিফারের ডাইরিগুলো আমাদের সম্পর্কের পান্ডুলিপি, আর আমার অতীতের ভুলের গননাখাতা। তুমি সময় নাও। হয়তো ডাইরির শেষপাতায় এসে আমাকে অসহ্য লাগবে তোমার। তোমার প্রেম আমার প্রতি উবে যাবে। আমাকে বিরক্ত লাগবে। তবে আমাকে একবার বলো
– বললে কি করবেন?

ঐন্দ্রিলার কন্ঠের রোষ বাড়ছে। অভ্রের ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি। স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
– তাহলে মুক্তি দেবো…..

অভ্রের কথাটা শেষ হবার পূর্বেই ঐন্দ্রিলা তার সামনে। তার চোখ যেনো কোনো অগ্নিকুন্ডু। এরপর যা করলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না অভ্র। অভ্রের শার্টের কলার টেনে নিজের পাতলা ঠোঁট জোড়া তার ঠোঁটে ডুবিয়ে দিলো ঐন্দ্রি। অভ্রের চোখ বিস্ফোরিত আকার নিলো। ঐন্দ্রি এরুপ কাজ করবে সেটা কল্পনাতেও ভাবে নি সে। মেরুদন্ড বেয়ে যেনো রক্ত ছলকে উঠলো। আবেশে হাতটা ঐন্দ্রির কোমড় আকড়ে ধরলো। এভাবে কতো মূহুর্ত কেটে গেলো সেদিকে খেয়াল নেই তার। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিলো। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– বড্ড বেশি বকেন কি না। এটাই তো সমস্যা।

ঐন্দ্রির কথায় ফিক করে হেসে ফেলে অভ্র। ধীর কন্ঠে বলে,
– এটা কি আমার বকবকানো কমানোর উপায়?
– যা ভাববেন তাই! তবে আরেকবার যদি এই মুক্তির ব্যাপারটা শুনি তো দেখেন আমি কি করি!
– এর থেকেও খারাপ কিছু করবে নাকি?
– জানি না।
– তাই বুঝি!

অভ্র চোখ বুঝে ঐন্দ্রিলার নাকে নাক ঘষে। ঐন্দ্রিলা তখন ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– দিশান, আপনার এবং জ্যানিফারের ছেলে। তাই না?

অভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মাথাটা নিচু হয়ে যায়। ধীর কন্ঠে ছোট্ট করে বলে,
– হ্যা।

অভ্রের মুখে “হ্যা” শুনেই ঐন্দ্রিলা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এই সত্যটা অনেক আগ থেকে আন্দাজ করেছিলো সে। দিশানের চোখের সাথে অভ্রের চোখের অসম্ভব মিল। সে ভেবেছিলো অভ্রের মুখে সত্যটা জানলে এতোও কষ্ট লাগবে না। কিন্তু সে ভুল ছিলো। তার মনে হচ্ছে অসংখ্য সুচ তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। এটাকেই হয়তো বিষাক্ত ভালোবাসা বলে। ঐন্দ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে অভ্র প্রশ্ন করে,
– কি হলো? রাগ করলে? ঘৃণা হচ্ছে আমার প্রতি? সত্যিটা কি দিশানের প্রতি তোমার ভালোবাসাটাকে ম্লান করে দিলো?

ঐন্দ্রিলা অভ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সে এখনো অভ্রের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here