স্বপ্নছায়া
পর্ব-২,৩
মুশফিকা রহমান মৈথি
২য়_পর্ব
বেশ লম্বা, শ্যাম বর্ণের সুঠাম দেহী, সুদর্শন পুরুষটি তার স্বামী ব্যাপারটি ভাবতেই ঐন্দ্রিলার মনে একটা শিহরণ জেগে উঠলো। কিন্তু ভালো লাগাটা খুব একটা সময় স্থায়ী হলো না যখন, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি ভনিতাবিহীনভাবে সুস্পষ্টস্বরে বললো,
– বিয়েটা কেবল বাবার সম্মান রক্ষার্থেই আমি করেছি। এটা আমার কাছে কেবল ই একটা ডিল। যেখানে তুমি এবং আমি উভয়ই দুটি পার্টি। প্রতিটি ডিলের মতো আমার ও কিছু কন্ডিশন রয়েছে। তোমার যদি কোনো আপত্তি থাকে আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
ঐন্দ্রিলা ফ্যালফ্যালিয়ে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার মনে হতে লাগলো একটা রোবটের সাথে সে কথা বলছে। কোনো অনুভূতির বালাই নেই মানুষটির মধ্যে। ঐন্দ্রির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অভ্র আবার বলা শুরু করলো। নির্বিকার চিত্তে বলতে লাগলো,
– আমার কথাবার্তা শুনে হয়তো তোমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি মানুষটা বরাবর ই খুব ক্যালকুলেটিভ। লাভ লোকশানের হিসেবটা বেশ ভালো করেই বুঝি। বিয়ে, সংসারের মোহ আমার কোনো কালে ছিলো না। আমার কাছে এগুলো ওয়েস্ট অফ টাইম মনে হয়। অহেতুক মায়ায় জড়ানো। আর যখন এই মায়া কেটে যায় তখন সব কিছু বিষাক্ত হয়ে যায়। আমি চাই না আমাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক তৈরি হোক। বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে সুতরাং এখন পিছিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই৷ আমার মতে বিয়েটাকে একটা ঝামেলা না মনে করে একটা কন্ট্রাক্ট এর মতো ট্রিট করা উচিত। যেখানে তুমি একটি পার্টি, আর আমি একটা পার্টি। আমাদের মাঝে কিছু রুলস থাকবে যা আমরা মেনে চলবো৷
ঐন্দ্রিলা তীর্যক দৃষ্টিতে অভ্রকে দেখছে। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ হচ্ছে৷ মন চাচ্ছে অভ্রকে ঠাটিয়ে একটা চড় মারলে হয়তো রাগটা পড়ে যেতো। কিন্তু এতে অভ্রের কোনো ভ্রুক্ষেপ হল না৷ সে বেশ নির্লিপ্তভাবে বিছানায় বসলো, পকেটের থেকে একটা পেপার বের করে ঐন্দ্রিলার দিকে ইশারা করলো। ঐন্দ্রি একটু এগিয়ে কাগজটা হাতে নেয়। কাগজে ১,২,৩…. করে মোট ছখানা পয়েন্ট লেখা৷ অভ্র গলা খাকারি দিয়ে বলে,
– আমরা স্বামী স্ত্রী হলেও কখনোই নিজেদের স্পেসের ভেতর ঢুকবো না। তোমার একটা আলাদা লাইফ, আমার একটা আলাদা লাইফ। আমি তোমার কাছে কখনোই কোনো কিছুর জবাবদিহিতা করবো না। তোমার যখন যা দরকার আমি সব প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবো। তবে টিপিক্যাল বউ দের মতো লুতুপুতু ভালোবাসা আমার থেকে তুমি এক্সপেক্ট করবে না। কারণ আমার কাছে সেগুলো অহেতুক ন্যাকামি বলে বলে হয়৷
-…………
– এই বিয়েতে সবচেয়ে ইমপোর্টেন্ট শর্ত, আমি চাই না আমাদের কোনো বাচ্চা হোক। কারণ আমার একমাত্র সন্তান দিশান। দিশানকে কেউ অবহেলা করুক আমার সহ্য হয় না। আমি তোমাকে বলবো না ওর মা হতে। কারণ তুমি সেটা পারবে না, এবং এটা অন্যায় হবে। তবে আমার ছেলেকে কখনো অবহেলা করবে না, তার সাথে কোনো রকম মিসবিহেভ আমি মেনে নিবো না। একটা বাচ্চার যেমন ছেলেবেলা পাওয়া উচিত আমি চাই দিশানও তাই পাক।
-………….
– আর আর একটি কথা, তোমার যদি আমার সাথে না থাকতে ইচ্ছে করে তবে আমাকে সরাসরি বলতে পারবে৷ আফটার অল আমার মতো একটা মানুষের সাথে থাকাটা কোনো মেয়ের ই কাম্য নয়। একটা সম্পর্ককে জোর করে টানার কোনো মানে নেই। সো ডোন্ট ওয়ারি। পেপারস এ সাইন করে দিও৷ আর তোমার কোনো কিছু বলার থাকলেও তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
অভ্র ঐন্দ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে কখন ঐন্দ্রি কিছু বলবে৷ এদিকে ঐন্দ্রিলা কাগজটা উলটে পালটে দেখছে। একটা সম্পর্ক শুধু কাগজের কয়েকটা লাইনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ভাবতেই হাসি পাচ্ছে ঐন্দ্রিলার। হয়তো এটাই তার ভাগ্যের নির্মম প্রহার_____
শওকত সাহেব চিন্তিত চিত্তে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার আজ ঘুম আসছে না। ঘুমাতে গেলেই হাজারো চিন্তা তাকে ঘিরে ধরছে। হঠাৎ পিঠে কারোর স্পর্শ পেতেই ঘুরে তাকান তিনি। শারমিন বেগম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
– ঘুমাবেন না?
– ঘুম আসছে না। চিন্তা হচ্ছে।
– সব তো মিটেই গেছে৷ এখন আবার কিসের চিন্তা?
– আহাশের জন্য বন্ধুর কাছে এমনেই ছোট হয়ে গিয়েছি৷ না জানি অভ্র কি করে?
– চিন্তা যে আমার হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু যা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে। একটা বাচ্চা মা ছাড়া আর কতোদিন থাকবে বলুন তো?
– কিন্তু শারমিন, দিশানের সত্যিটা জানলে ও কেনো, কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। আমরা কি মেয়েটার সাথে অন্যায় করে ফেললাম? তার জীবনটা সাজাতে গিয়ে আরোও যেনো এলোমেলো করে দিয়েছি৷
শওকত সাহেবের উদ্বিগ্নতার কারণ বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন শারমিন বেগম। কিন্তু এখন সবকিছুই সময়ের কাছে ছেড়ে দেওয়া ব্যাতীত উপায় নেই। একবার তীর ছুড়ে দিলে তা আর ফেরত আনা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনই একবার ভুল হয়ে গেলে তা শুধরানো সত্যি ই অসম্ভব। তবুও শারমিন বেগম আশাবাদী। তার আশা ঐন্দ্রিলা ঠিক তার অনুভূতিশুণ্য ছেলেটার জীবনের অনুভূতি জাগাতে পারবে।
অভ্র ফ্রেস হয়ে এসেছে। কোর্ট প্যান্ট ছেড়ে বেশ টিশার্ট এবং ট্রাওজার পড়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। চুল মুছার মাঝে এক পলক ঐন্দ্রিলার দিকে নজর দেয় সে। মেয়েটা এখনো কাগজটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে রয়েছে। অভ্রের খানিকটা বিরক্ত বোধ হলো। অহেতুক সময় নষ্ট তার মোটেই পছন্দ নয়। গলা খাকারি দিয়ে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– সাইন করা কি হয়েছে? এতো সময় নষ্ট করার কি আছে তো বুঝলাম না?
– আমি যতটুকু জানি একটা ডিলে দুই পক্ষের বক্তব্যই রাখা হয়। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র আপনার বক্তব্যগুলোই রয়েছে। আপনার মনে হয় না আপনি আমার উপর শর্তগুলো চাপিয়ে দিচ্ছেন?
ঐন্দ্রিলার শান্ত গলার এরুপ উত্তরে খানিকটা চমকে যায় অভ্র। মেয়েটিকে যতটা দূর্বল মনে হয়েছিলো ততটা দূর্বল সে নয়৷ অভ্র মুচকি হেসে বলে,
– যাক তুমি তো কথাও বলতে পারো। তাহলে তোমার শর্তগুলোও বলে ফেলো।
অভ্রের কথায় ঐন্দ্রিলা ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– আমার কনসার্ন ব্যাতীত আমাকে স্পর্শ করবেন না। আমার পরবর্তিতে মাস্টার্স করার ইচ্ছে রয়েছে তাতে বাধা দিবেন না।আর একটা কথা, স্ত্রী হিসেবে আমি আপনার জীবনে ততটাই হস্তক্ষেপ করবো যতটা একজন স্ত্রী তার স্বামীর জীবনে করে থাকে। আমার যদি আপনার কোনো কাজে আপত্তি থাকে আপনি সেটা করবেন না।
– তোমাকে আমি বসতে বলেছি, তুমি তো দেখি মাথায় উঠে নাচছো।
– কিছুই করার নেই, ডিল ইজ এ ডিল। আমি তো আপনার ন্যায় ক্যালকুলেটিভ নই। আমার জীবনটা লাভ লোকশানের হিসেব করে কাটে না। সুতরাং আমার শর্ত আপনাকে মানতে হবে। আর আমি কখনো আপনাকে ডিভোর্স দিবো না। সুতরাং এই ডিলটা আমৃত্যু আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
অভ্র দাঁতে দাঁত পিষছে। তার সামনে একটি নারী দাঁড়িয়ে আছে যে কিনা তার স্ত্রী। আজ অবধি কম নারীর সাথে সে সম্পর্কে জড়ায় নি, কিন্তু সম্পর্কগুলো শুধু সময়ের চাহিদা মাত্র৷ কারোর প্রতি কোনো অনুভূতিতার জন্মায় নি কারণ অতীতের কালো অধ্যায়টি তার জীবনটিকে অনুভূতিশুন্য করে দিয়েছে। অভ্র কখনো চিন্তাও করে নি, যে অভ্র চৌধুরীর শর্তে মানুষ চলে তাকেই কিনা শর্তের জালে আটকে দিয়েছে এই নারী। অভ্রের রাগ হচ্ছে কিন্তু কোথাও না কোথাও কৌতুহল ও হচ্ছে। কৌতুহলটি কেবলই এই নারীটিকে ঘিরে___________
২.
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নীলাদ্রি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের রাগগুলো উড়াতে ব্যাস্ত সে৷ রাত কয়টা বাজে তার ঠিক নেই। সে জানতেও চায় না। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর থেকেই ছাঁদে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনো খাওয়া হয় নি তার। বাবার উপর অত্যধিক মেজাজ খারাপ। একটা ছেলের সম্পর্কে সব কিছু জেনে শুনে তার সাথে কিভাবে ঐন্দ্রির বিয়ে দিতে রাজী হলেন তিনি। অভ্র নামক ছেলেটির চরিত্রের কোনো ঠিক নেই, বিয়ে করে নি অথচ একটি বাচ্চা অবধি আছে। অথচ সেই ছেলেটাই কিনা তার বোনের স্বামী৷ ভাবতেই রাগ যেনো দ্বিগুন হয়ে যাচ্ছে নীলাদ্রির। সব জানা স্বত্তেও নীলাদ্রি কিছু করতে পারছে না। নিজের চোখের সামনে তার বোনকে এমন একজন পুরুষের সাথে সংসার করতে দেখতে হবে, কথাটা ভাবতেই রেলিং এ জোরে আঘাত করে নীলাদ্রি৷
– যা হবার তাতো হয়েই গেছে, এখন এই নির্জীব রেলিংটার উপর রাগ দেখিয়ে আর নিজের ফুসফুসটাকে পুড়িয়ে কি লাভ?
কন্ঠটি কানে আসতেই চমকে উঠে নীলাদ্রি। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরতেই দেখলো……….
চলবে
#স্বপ্নছায়া
#৩য়_পর্ব
নিজের চোখের সামনে তার বোনকে এমন একজন পুরুষের সাথে সংসার করতে দেখতে হবে, কথাটা ভাবতেই রেলিং এ জোরে আঘাত করে নীলাদ্রি৷
– যা হবার তাতো হয়েই গেছে, এখন এই নির্জীব রেলিংটার উপর রাগ দেখিয়ে আর নিজের ফুসফুসটাকে পুড়িয়ে কি লাভ?
কন্ঠটি কানে আসতেই চমকে উঠে নীলাদ্রি। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরতেই দেখলো তার পেছনে একজন নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নারী পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নারীটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রি৷ জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোতে নারীটিকে আরোও বেশি মোহনীয় লাগছে তার কাছে। রোদ্রতপ্ত দুপুরের একপশলা বৃষ্টির ন্যায় শীতল অনুভূতি হয় এই নারীটি উপস্থিতিতে। নীলাদ্রির তর্জনী এবং মধ্যমার ভেতরকার নিকোটিনের উৎসটি জ্বলছে। কিন্তু তার সেদিকে মন নেই, সে এক দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চব্বিশ বছরের রমনীকে দেখে যাচ্ছে। মেয়েটিকে ছোট বেলা থেকে দেখছে, অথচ যতবার মেয়েটি তার দৃষ্টির সামনে আসে সে ততবার সে থমকে যায়। মেয়েটি একটু এগিয়ে এলো, নীলাদ্রির থেকে পাঁচ কদম দূরে দাঁড়িয়ে রেলিং এর উপর হাত রাখলো৷ নীলাদ্রির দৃষ্টি এখনো মেয়েটির দিকে স্থির। হাতের সিগারেটটা জ্বলতে জ্বলতে যখন আঙ্গুলিকে হালকা ছ্যাকা দিতে লাগলো তখন স্বম্বিত ফিরলো তার। দৃষ্টি সরিয়ে কালো আকাশটির দিকে তাক করে হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– রাতবিরাতে শাকচুন্নির মতো চুল ছেড়ে ধেই ধেই না করে ঘুমালে তো পারিস! কয়েক মিনিটের জন্য আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিলো।
– এতোই যখন ভয় পান তো রাত বিরাতে আপনাকে ছাঁদে থাকতে কে বলেছে? নিজের রুমে বসে এইসব ছাইপাস টানলেই পারেন! আর হার্ট অ্যাটাকের কথা বলছেন, কিছুদিন পর এমনেই সেটা হবে যখন আপনার ফুসফুসটা অকেজো হয়ে যাবে।
– আজকাল দেখি আমাদের পিউরানীর মুখে খই ফুটছে। তা আমার জন্য এতো চিন্তা করতে তো আগে দেখি নি, আজ সূর্য বুঝি পশ্চিম থেকে উঠেছে?
নীলাদ্রির ঠেস মারা কথায় উত্তর দিলো না পিউ। শুধু আড়চোখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে নীলাদ্রির দিকে তাকালো। মেয়েটির নাম পিউ, নীলাদ্রির খালু বদরুল সাহেবের একমাত্র ভাগ্নী। পিউ এর বাবার মৃত্যুর পর থেকে বদরুল সাহেব তার বোন রত্না বেগম এবং ভাগ্নী পিউকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা রত্না বেগম কিছু বছরের মাঝে পৃথিবী মোহ ত্যাগ করেন। তারপর থেকে পিউ বদরুল সাহেবের কাছেই মানুষ। পিউ যখন বদরুল সাহেবের বাসায় থাকা শুরু করে তখন থেকেই ঐন্দ্রিলার সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। পিঠাপিঠি হবার কারণে তাদের মাঝে সম্পর্কটাও অনেক গভীর। একই সাথে বড় হওয়া যাকে বলে। একই বিল্ডিং এর দোতালায় বদরুল সাহেব এবং তিনতালায় শরীফ সাহেব থাকেন। সেই সুবাদেই নীলাদ্রির সাথে পরিচয় পিউ এর। লোকটির এই ঠেস মারাকথা একেবারেই সহ্য হয় না পিউ এর। বয়সে বড় হবার কারণে নীলাদ্রিকে ভয়ের চোখেই দেখে এসেছে সে। হয় লোকটি মানুষ ঠেস মেরে কথা বলবে নয় হুংকার ছেড়ে ঘর মাথায় করবে। এছাড়া যেনো কিছুই পারে না এই লোক। দৃষ্টি বাহিরের দিকে দিয়ে অভিমানী কন্ঠে প্রতিবাদ করে উঠলো পিউ,
– আমার বয়েই গেছে অহেতুক আপনার জন্য চিন্তা করতে।
– জানি তো, তোর মতো স্বার্থপর মেয়ে কি আমার চিন্তা করবে! আসলে কি বলতো, সব জায়গায় বড় বড় ভাব নিয়ে কথা বলে বোঝানো দরকার যে তুই বড় হয়ে গেছিস!
– আচ্ছা আপনি এমন কেনো নীল ভাই? আমার পেছনে না লাগলে বুঝি আপনার শান্তি হয় না? আর আমার ই ঘাট হয়েছে, কি ভেবে যে আপনাকে কথাটা বকতে গেলাম কে জানে!
পিউ এর মেজাজ অত্যধিক খারাপ হচ্ছে। এই নীলাদ্রি নামক ব্যাক্তিটিকে হয়তো জন্মের সময় মধুর বদলে করলার রস খাওয়ানো হয়েছিলো। তাই তো সারাক্ষণ এতো তেতো কথা বলে। আগে যদি জানতো লোকটি ছাদে রয়েছে তবে কখনোই পিউ ছাদের ত্রিসীমানাতেও ভিড়তো না। একটা জিনিস কখনোই বুঝে না এই নীলাদ্রি নামক ব্যাক্তিটি তাকে এতোটা অপছন্দ কেনো করে! সেই ছেলেবেলা থেকে দেখছে হয় বকাঝকা করবে, নয়তো ঠেস মেরে টিককারি দিকে; আজকের কথাই ধরা যাক। সে কি তাকে খারাপ কিছু বলেছে কিন্তু সেই কথার বিনিময়ে আরোও পাঁচটা কথা শুনিয়ে দিলো। পিউ কোনো কথা বললো না। উলটো দিকে ফিরে দরজার দিকে হাটা দিলো৷ পিউ কে চলে যেতে দেখে নীলাদ্রি আকুল কন্ঠে বললো,
– চলে যাচ্ছিস?
– হ্যা, দাঁড়িয়ে থেকে আপনার টিটকারি মারা কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে। এমনিতেই ঐন্দ্রি যাবার মনটা ভালো লাগছে না। তাই ছাদে এসেছিলাম দু দ্বন্দ ঠান্ডা হাওয়া খেতে। আপনি আমার এই ইচ্ছের তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
মুখ ফুলিয়ে কথাটা বললে হাটা দিল পিউ। নীলাদ্রি পিউ এর যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা বড্ড অবুঝ, তাই তো নীলাদ্রির অনুভূতিগুলো কখনোই তার চোখে পড়ে না। নিঃশব্দে হাসলো নীলাদ্রি এই ভেবে শেষে কিনা একটা অবুঝ মেয়ের কাছে হৃদয় হারালো সে। পকেট থেকে আরো একটি সিগারেট বের করলো নীলাদ্রি, আগুন জ্বালিয়ে সুখটান দিলো। দমকা হাওয়ার মতো এসে হৃদয়ের জ্বলন্ত আগুনটাকে একেবারেই শান্ত করে দিয়ে মেয়েটি। হয়তো একারণেই মেয়েটির কাছে বারবার হেরে যায় নীলাদ্রি_________________
সকাল ৮টা,
সূর্যের তীর্যক দৃষ্টি চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে ঐন্দ্রিলার। টিপটিপ করে চোখ খুলে উঠে বসলো সে। আশেপাশে চোখ বুলালো। না ঘরে কেউ নেই, বিছানাটাও ঠান্ডা। যতটুকু মনে পড়ে অভ্র তার পাশেই শুয়েছিলো। অবশ্য কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়, গত কাল রাতে ঐন্দ্রিলার পালটা উত্তর শুনে গজগজ করতে করতে বিছানায় শুতে চলে গিয়েছিলো লোকটা। ঐন্দ্রির শরীরটাও ক্লান্ত ছিলো তাই কোনো বাধ বিচার না করেই তার পাশে শুয়ে পড়ে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজের ও মনে নেই। অভ্রের মুখে ঝামা ঘষে অবশ্য একটা সুপ্ত তৃপ্তি অনুভূত হয়েছে তার। হয়তো একারণেই ঘুম ভালো হয়েছে। দেরি না করে ফ্রেস হয়ে এলো ঐন্দ্রিলা। শ্বশুর বাড়ি বলে কথা, এখানে সে বাবার আদুরে মেয়ে কিংবা ভাইয়ের কলিজার টুকরোটি নয়। যদিও শারমিন বেগম অর্থাৎ ঐন্দ্রির শ্বাশুড়ি মানুষটা বরাবর ই অসম্ভব নমনীয় প্রকৃতির মানুষ। নয়তো যেখানে অন্যেরা তার গায়ের রঙ কে ছিঃ ছিঃ করে মুখ বেঁকিয়ে হাঁটা দিতো, সেখানে এই নারী তাকে প্রথম দেখাতেই কপালে চুমু একে আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য যার জন্য আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই ব্যাক্তিটি ভরা আসরে তাকে নাকোচ করে চলে গেলো। আহাশের চিন্তাটা মাথায় আসতেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটিকে নিপুন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ঐন্দ্রিলা। লোকটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো বললে মিথ্যে হবে, তবে যখন জানতে পেরেছিলো লোকটা তাকে পছন্দ করে কথাটা ভাবতেই বুকের স্পন্দন বেড়ে গিয়েছিলো তার। মনের মাঝে মরীচিকার দিবাস্বপ্নের উদ্ভব হতে লেগেছিলো। তার মতো নারীকেও কেউ ভালোবাসতে পারে, কথাটা ভাবতেই এক অন্যরকম শিহরণ হয়েছিলো হৃদয়ে। কিন্তু ওই যে দিবাস্বপ্ন, ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে আহাশের প্রত্যাখানে। না ভেঙ্গে পড়লে চলবে না ঐন্দ্রির। জীবন থেমে থাকে না, সে এখন কারোর স্ত্রী, একটা ছোট নিস্পাপ ছেলে তাকে “মাম্মাম” বলে সম্বোধন করে; সুতরাং তাকেও তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে, ভাগ্যের নির্মমতাকে কঠোর হস্তে কলাগাছ দেখাতে হবে। এটা যে তাকে পারতেই হবে।
রুম থেকে বের হতেই বসার ঘরের দিকে চোখ গেলো ঐন্দ্রিলার। শওকত সাহেব পেপারে মুখ গুজে বসে আছেন। আহানা দিশানকে খাওয়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। শারমিন বেগম থমথমে মুখে বসে আছেন। পরিবেশটা বেশ শান্ত, অনেকটা গুমোট বলা যেতে পারে। আত্নীয়রা একে একে বিদেয় নিয়েছেন। বিয়েবাড়ির গুমোট অবস্থাটা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না ঐন্দ্রিলা। কাজের মেয়েটি দৌড়ে এসে বললো,
– আম্মা, নাস্তা রেডি।
শারমিন বেগম মুখ তুলে তাকাতেই দেখলেন ঐন্দ্রিলা বসার ঘরের কোনায় চুপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই শারমিন বেগমের মুখে আরোও চিন্তার ঢল নেমে এলো। দিশান ছুটে এসে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিও তাকে কোলে তুলে শ্বাশুড়ির পাশে গিয়ে বসলো। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু হয়েছে মা?
– আসলে কিভাবে বলবো বুঝছি না!
কথাটা শুনে ঐন্দ্রিলা শওকত সাহেবের দিকে তাকায়। বেঁচারার মুখখানা ও বেশ শুকনো লাগছে। ঐন্দ্রিলা শারমিন বেগমের হাত ধরে বলে,
– আমি তো আপনার মেয়ের মতো মা, আমাকে নির্দ্বিধায় বলুন।
– তোমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানটি হবে না মা………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি