স্বপ্নছায়া
পর্ব-২৯,৩০ অন্তিম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৯তম_পর্ব
রাত আটটা,
বদরুল সাহেবের রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিউ। দুপুরের খাবারের পর থেকে নীলাদ্রির দেখা মিলে নি আর। মামার সাথে কিছু একটা কানাগোসা করছিলো সে। তারপর হনহনিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছে। ফোনটাও বন্ধ। দুবার ফোন দেবার পর ও নট রিচেবেল দেখিয়েছে। তাই পিউকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। একটু পর ও বাড়ি থেকে ফোন আসবে। ওরা হ্যা বলে দেবার আগেই মামাকে সব খুলে বলা জরুরি। বুকে ফু দিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করবে, তখন ই তার কানে এলো,
– আরিফ ভাই ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার ছেলের সাথে আমি আমার ভাগ্নীর বিয়ে দিতে চাই না। আমার ভাগ্নী এ বিয়েতে রাজী নয়। আমার তাড়া আছে ঠিক ই, কিন্তু এতোটাও নেই যে তার অমতে আমি তার বিয়ে দিবো।
-………….
– আশ্চর্য তো! আপনাদের ছেলেকে আমাদের ভালো লাগে নি। তাই বিয়েটা কেঁচে দিচ্ছি। এতে এতোটা অভিমান করার কি আছে ভাই?
-……….
– ভালো ছেলের অভাব নেই! আপনার ছেলের সাথে বিয়ে না হলে আমার ভাগ্নীর বিয়ে হবে না এটা কেমন কথা! আর বিয়ে না হলে তো আরোও ভালো,, আমি আমার ভাগ্নীকে আমার কাছে রেখে দিবো। এটা ভালো নয় কি!
বদরুল সাহেবের কথায় হয়তো আরিফ সাহেব চটে গেছেন। তিনি ফোন রেখে দিয়েছেন হয়তো খট করে। বদরুল সাহেব তার ফোনটি রেখে গা এলিয়ে দিলেন বিছানাতে। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠেকালেন। পিউ এতোক্ষন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে তার আরিফ সাহেবের সাথে পুরো কথোপকথনটা শুনেছে। তার মাথায় ঢুকছে না বদরুল সাহেব তার অপছন্দের ব্যাপারটা জানলেন কি করে! খানিকটা ইতস্ততবোধ ও হচ্ছে। দ্বিধা হচ্ছে এখন ভেতরে যাওয়া টি ঠিক হবে নাকি!
– বাইরে দাঁড়িয়ে নখ না কেটে ভেতরে আয়
বদরুল সাহেবের বাজখাই কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো পিউ। ধীর পায়ে সুরসুর করে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে পিউ। তাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বদরুল সাহেব আবারো বলে উঠেন,
– আকাম করার সময় মনে থাকে না? এখন মাথা নিচু করে রাখসিস কেনো?
– সরি মামু
– তোর সরি দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো আমি? চেয়ারটা টেনে বয়।
পিউ ছোট্ট করে “হু” বলে চেয়ারটা টেনে বদরুল সাহেবের সামনে বসে। লজ্জায় মামুর দিকে তাকাতে পারছে না সে। বুকের ভেতর একটা অশান্তি কাজ করছে। হয়তো এটা অপরাধবোধের কারণে হচ্ছে। মামুর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে সে। বদরুল সাহেব পিউ এর নত মস্তক দেখে হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
– নাম কি ছেলেটার?
– হ্যা?
– যাকে ভালোবাসিস বলে দাবী করছিলি, নাম কি?
– তুমি রাগ করবে না তো?
– আমাকে দেখলে কি তোর জল্লাদ মনে হয়? বল নাম কি সেই ছেলের!
– নীলাদ্রি আহসান।
– নীলাদ্রি মানে আমাদের নীলাদ্রি?
পিউ মাথা নাড়ালো। বদরুল সাহেবের ভ্রু খানিকটা কুঞ্চিত হলো। তিনি চিন্তায় পড়ে গেছেন। পিউ আড়চোখে তার মুখভঙি অবলোকন করতে লাগলো। মামার মনে কি চলছে সেটা জানার ব্যার্থ চেষ্টা লাগালো। নিস্তব্ধতা ভর করলো রুমে। বদরুল সাহেবের মুখ থেকে একটা শব্দ ও বের হলো না। এদিকে পিউ এখনো চেয়ারেই বসে রয়েছে। অপেক্ষা করছে মামার প্রতিক্রিয়ার। হয়তো তার মামু এতোটাই হতবাক হয়েছেন যে কি প্রতিক্রিয়া দিবেন ভুলে গেছেন।
নীলাদ্রি যখন বাসায় ফিরলো তখন রাত বারোটা। দরজা খুলতেই আতকে উঠলো ঐন্দ্রিলা। তার মনে হলো তার সামনে কোনো বিধ্বস্ত, পরাজিত মানব দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তার শার্ট টা কুচকে আছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বললো,
– ভাইয়া কি হয়েছে?
নীলাদ্রি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। ঐন্দ্রিলাকে পাশ৷ কাটিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বললো,
– এক গ্লাস লেবুর শরবত দে তো। গলা টা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ঐন্দ্রিলা হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেলো। মিনিট দশেক পর এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে ফিরে গেলো। গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
– কি হয়েছে এবার তো বল! এরকম বিধ্বস্ত লাগছে কেনো তোকে? তুই কি মারপিট করে এসেছিস? তুই পারভেজ কে মেরেছিস তাই না? কথা বলছিস না কেনো?
– চেঁচাচ্ছিস কেনো? একসাথে এতো গুলো প্রশ্ন করলে আমি কেনো কেউ ই উত্তর দিতে পারবে না।
– ভাই সত্যি করে বল, কি আকাম করে এসেছিস তুই!
– আমাকে কি গুন্ডা মনে হয়? আমি কি শুধু মারপিট ই করি?
– তাহলে কোথায় ছিলি এতোক্ষন! সেই বিকেলে বের হয়েছিস! তারপর থেকে তোর ফোন অফ! জানিস কতোটা চিন্তা হচ্ছিলো!
– অহ! ফোনটা ভেঙ্গে গেছে! তাই হয়তো বন্ধ ছিলো!
– ফোনটা ভাঙ্গলো কিভাবে?
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হচ্ছে নীলাদ্রি। তার একেবারেই ভালো লাগছে না, অহেতুক প্রশ্নোত্তরের খেলা খেলতে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
– প্যান প্যান শেষ হয়েছে তোর? আর তুই এতো জেরা করছিস কেনো রে? আমি তোর বড় ভাই ভুলে যাস না! ভালো লাগে না যতসব। আমি রুমে গেলাম, আমাকে আর জ্বালাতে আসবি না বলে দিলাম।
বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। ঐন্দ্রিলা দৃষ্টি সরু করে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে। কেনো যেনো আজকে নীলাদ্রিকে অন্যরকম লাগছে। জীবনের উপর যেনো তার বিতৃষ্ণা জেগেছে। রুমের দিকে যেতে যেতে থেমে গেলো সে। নিচু গলায় বললো,
– দিশাকে বলিস, বিয়েটা ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই। যেটা যেমন চলছে, চলুক।
বলেই নিজের রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা দিয়ে দিলো নীলাদ্রি। ঐন্দ্রিলা হতবাক দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। নীলাদ্রি কি এতো তাড়াতাড়ি হার মেনে নিলো! সে কি নিজের ভালোবাসাকে মাঝপথেই ছেড়ে দিবে!
সুগাঢ় অন্ধকারে বসে রয়েছে নীলাদ্রি। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে সিগারেটের ধোয় মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের অস্থিরতা, যন্ত্রণাগুলো গলা অবধি এসে দলা পাকাচ্ছে। ভালোবাসার বিষাক্ত অমৃত পান করেছে সে! এমনটা তো হবার ই ছিলো। যতদিন এই ভালোবাসাটা সুপ্ত ছিলো ভালোই ছিলো, কোনো আকাঙখা ছিলো না। হৃদয়টা লোভী ছিলো না। কিন্তু এই ক দিনে সেটা অত্যধিক লোভী হয়ে উঠেছে, স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। এজন্যই তো পিউ এর সুখের দিকে তার নজর ই গেলো না। নীলাদ্রির নিজেকে আজ পরাজিত মনে হচ্ছে, নিজের ব্যর্থতা তাকে জানান দিচ্ছে তুমি পিউ এর যোগ্য নও। বিকেলে এক ফাঁকে বদরুল সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ পারভেজকে দেখিয়ে বলেছিলেন,
– ছেলেটাকে কেমন লাগলো তোমার? পিউ এর সাথে মানাবে না? আমার কিন্তু বেশ পছন্দ৷ ভালো চাকরি করে, বাইরে স্যাটেল লাইফ। পিউ কে সুখে রাখবে। আর কি চাই বলো! অনাথ ভাগ্নীটা আমার এবার সকল দিক থেকে সুখী হবে। তাই না?
বদরুল সাহেবের চোখ চকচক করছিলো। নীলাদ্রি কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সত্যি ই তো পারভেজের তুলনায় সে কিছুই না। আজকাল ভালোবাসা দিয়ে আর যাই হোক ঘর চলে না। নীলাদ্রি বেতন পয়ত্রিশ হাজার টাকা। এভারেজ বাঙ্গালীর আদর্শ বেতন, চলার জন্য যথেষ্ট থেকে উপরে। কিন্তু পারভেজের তুলনায় সেটা নগন্য। নীলাদ্রির বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাবার চিকিৎসাতে। বাকি যা থাকে তা নিয়ে তাদের মাসটা চলে যায়। নিজেদের বাসা হওয়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তাকে। কিন্তু পিউকে সে সকল ধরনের আর্থিক সুখ দিতে পারবে না। পিউ কে কষ্ট করতে হবে, হয়তো চাকরিও করতে হতে পারে। তবে মেয়েটিকে সে প্রচুর ভালোবাসা দিতে পারবে। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে পারবে সে মেয়েটিকে। হয়তো প্রতিদিন মাংসভাত খাওয়ানো সম্ভব হবে না তার জন্য। তবে মোমের আলোতে ভর্তাভাত খাওয়াতে খুব একটা অসুবিধাও হবে না। হয়তো গাড়িতে চড়াতে পারবে না। কিন্তু সিএনজিতে করে কোথাও নিয়ে যেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না তার। ঈদে চাঁদে ভালো পোশাক কিনে দিতে পারবে সে, মাসে একবার সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে, এভাবেই জীবন পিউকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু পারভেজের ক্ষেত্রে এই কমপ্রোমাইজ গুলো পিউ কে করতে হবে না। বরং তার জীবনে বিলাসিতার অভাব হবে না। পিউ আর্থিক ভাবে সুখী হবে। পিউ কষ্টবিহীন জীবন কাটাবে। এটা কি ভালো নয়! ভালোবাসা দিয়ে আর যাই হোক পেট তো ভরে না! কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে নীলাদ্রির। এতোবছরের ভালোবাসাটা শেষমেশ অপূর্ণই থেকে যাবে! ভাগ্য এতোটা নির্মম কেন হয়! কেনো আমরা যা চাই সেটা পাই না! নীলাদ্রি সিগারেটে টান দিলো। চোখ থেকে বিষাধ সিন্ধুর একটা স্রোত নেমে এলো_______________
মাথার উপর ভনভন করে ফ্যানটা ঘুরছে। কিন্তু তাতে গরম হার মানছে না। ভাদ্র মাসের চরা গরম শরীর যেনো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহাশ বসে আছে তার রুমে। একমাস হয়েছে কলেজে চাকরি নিয়েছে। জীবনটাকে বেশ চমৎকার করে সাজিয়ে নিয়েছে সে। আজকাল জীবনটাকে ভালোবাসতে লেগেছে। শওকত সাহেবের সাথে সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়ে উঠেছে৷ এখন আর শওকত সাহেব তাকে এড়িয়ে চলেন না। ঐন্দ্রিলার সাথে সম্পর্কটা ঠিক না হলেও খুব একটা খারাপ ও নেই। সেদিন মেয়েটা শারমিন বেগমের সাথে দেখা করতে এসেছিলো। তার কাজিনের বিয়ে তাই সেখানে তাকে থাকতে হচ্ছে। তখন তার সাথে আহাশের দেখা হয়েছিলো। মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে মিষ্টি করে বলেছিলো,
– ভালো আছো?
উত্তরে আহাশ ও বলেছিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ।
এইটুকুই কথা হয়েছিলো তাদের মাঝে। বিকেলে চলে যাবার সময় তাকে বলেছিলো,
“আসি”
আহাশের জড়তা খানিকটা হলেও কেটে গিয়েছিলো। অতীত নিয়ে ঐন্দ্রিলা তার সময় নষ্ট করছে না। বরং অভ্রের সাথে একটা সুন্দর জীবন বেঁছে নিয়েছে সে। তাহলে আহাশের ও উচিত নিজেকে জড়তার মধ্যে না রাখা। সে যা করেছে তা ক্ষমার যোগ্য নয়, কিন্তু ঐন্দ্রিলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তাকে মুক্ত করে দিয়েছে। সুতরাং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবার অধিকার তার ও আছে। সেটাই করছে সে। নিজেকে পালটে ফেলার অদম্য চেষ্টা তাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না। বাবা-ভাইয়ের উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করা ছেড়ে দিয়েছে সে। এখন আহাশ মুক্ত।
বিকেল ৫টা,
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হলদে রোদ পিউ এর গায়ে আছড়ে পড়ছে। নীলাদ্রির দৃষ্টি শুন্যের দিকে। আর পিউ এর অগ্নিদৃষ্টি তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। নীলাদ্রি তার অগ্নিদৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললো,
– বিয়েটা করে নাও পিউ। তোমার জন্য ভালো হবে……….
চলবে
স্বপ্নছায়া
অন্তিম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
বিকেল ৫টা,
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হলদে রোদ পিউ এর গায়ে আছড়ে পড়ছে। নীলাদ্রির দৃষ্টি শুন্যের দিকে। আর পিউ এর অগ্নিদৃষ্টি তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। নীলাদ্রি তার অগ্নিদৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বললো,
– বিয়েটা করে নাও পিউ। তোমার জন্য ভালো হবে৷ খালু খুব ভালো একটা ছেলে তোমার জন্য বেঁছেছেন। সুখে থাকবে, দেখো
– আপনি কি ভেবে কথাগুলো বলছেন নীলভাই?
পিউ এর কন্ঠ কাঁপছে। রাগে, উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাঁপছে৷ এমনটা খুব কম হয়েছে তার সাথে। নীলাদ্রিকে তার বিরক্ত লাগে। কিন্তু আজ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। গা জ্বলছে লোকটার কথা শুনে। অথচ সেদিক যেনো নীলাদ্রির খেয়াল নেয়। তার দৃষ্টি পশ্চিমের সূর্যটার দিকে। রেলিং এর উপর হাত রেখে একটু ঝুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তখন পিউ হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– তা এই কদিন আমাদের মাঝে কি ছিলো নীল ভাই? সেটার পরিণতি কি তবে বিচ্ছেদ? আপনি না বলেছিলেন আমাদের গল্পের ইতি সুখময় হবে। তাহলে আজ কেনো অন্য সুর টানছেন!
– পাগলামী ছিলো ওগুলো। লজিক্যালি ভেবেই দেখি নি কখনো। লজিক্যালি ভেবে দেখলে তোর ও মনে হবে আমি ঠিক বলছি। পিউ জীবনটা না ভালোবাসা দিয়ে চলে না, আবেগ দিয়ে চলে না। জীবনের মূলমন্ত্র শান্তি৷ আর সেই শান্তি আসে মানসিক ভাবে। প্রতিটা মাসে টানাটানি করে সংসার চালাতে তুই সত্যি হাপিয়ে উঠবি। দেখা যাবে তোকেও অর্থের পেছনে ছুটতে হবে। পারভেজ কে বিয়ে করলে এদিক থেকে কখনো কষ্ট পাবি না তুই। নিজের স্বার্থের জন্য তোকে নিজের কাছে আটকে রাখবো এতোটা স্বার্থপর নই আমি।
পিউ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। সজোড়ে নীলাদ্রির গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো সে। তার হাত জ্বলছে, চোখ লাল হয়ে আছে। নীলাদ্রি খানিকটা থমকে গেলো পিউ এর এরুপ আচারণে। শান্ত মানুষ রেগে গেলে ভয়ানক রুপ ধারণ করে, পিউ তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তীব্র কন্ঠে পিউ বললো,
– আমি কি পুতুল? আমার কি মন নেই? নাকি আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই? কি পেয়েছেন কি আপনি? ইচ্ছে হলো আমার উপর অধিকার প্রয়োগ করবেন আর ইচ্ছে হলেই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবেন। এটাই কি আপনার ভালোবাসা? যদি আমাকে মাঝরাস্তায় ছেড়েই দিতে হতো তাহলে হাত ধরতে এসেছিলেন কেনো শুনি। আমার ই ভুল আবেগের তারণায় একটা কাপুরুষকে ভালোবেসেছি। তবে কান খুলে শুনে রাখেন, আমি আপনাকে ছাড়বো না। আপনার খুব মহৎ সাজার শখ হয়েছে না? এই মহৎগিরি আমি বের করবো। এক সপ্তাহ, এক সপ্তাহের ভেতর যদি আপনাকে নাকানি চুবানি না খাওয়িছি, আমার নাম পিউ নয়।
বলেই হনহন করে হাটা দিলো পিউ। নীলাদ্রি এখনো বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পিউ এর এমন রুদ্র রুপ এই প্রথম দেখছে সে। ছোটবেলা থেকেই বড্ড ইমোশনাল, শান্ত স্বভাবের মেয়ে সে। কিন্তু নীলাদ্রির মনে হলো পিউ এর ঘাড়ে যেনো ঐন্দ্রিলার ভুত উঠেছে। বুকের বা পাশ চিনচিন করতে লাগলো নীলাদ্রির। বেহায়া হৃদয় আবারো প্রেমে পড়েছে পিউ এর। কিভাবে সহ্য করবে সে পিউ এর বিরহ!!!!
পেপারে মুখ গুজে রয়েছেন বদরুল সাহেব। পাশের টেবিলে রাখা চা টা ঠান্ডা হচ্ছে। ধোঁয়া উঠানো চা খেতে পারেন না তিনি। তাই সেটাকে ঠান্ডা করতে রেখেছেন তিনি। এর ই মাঝে তড়িৎ গতিতে তেড়ে আসলো পিউ। রুদ্র কন্ঠে বলে উঠলো,
– মামু বিয়ের প্রস্তুতি নাও। বিয়েটা আমি করছি।
পিউ এর কথা শুনে বেকুবের মতো তাকালেন বদরুল সাহেব। পিউ এর এলোমেলো চুলো, ঠোঁটের উপর জমে থাকা ঘাম এবং রক্তলাল চোখ জোড়া জানান দিচ্ছে তার মানসিক পরিস্থিতি। কিন্তু হঠাৎ কেনো মেয়েটা এতোটা উম্মাদের মতো আচারণ করছে সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। শান্ত গলায় বললেন,
– কি হয়েছে পিউ মা?
পিউ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো। চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি নোনাজলের স্রোত মুক্তি পাবে আঁখিজোড়া থেকে___________
১৫.
আগামীকাল শুক্রবার, জুম্মাবাদে পিউ এর বিয়ে। বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে। কিন্তু বিয়ের আয়োজনটা বেশ সাদামাটা। কোনো হলুদ সন্ধ্যে নেই, কোনো সাজগোজ নেই। আগামীকাল দুপুরে শুধু বরের পক্ষের দু-পাঁচজন লোক আসবে। বিয়ে পড়ানোর পর বরকে রেখে তারা চলে যাবে নিজেদের বাসায়। অবশ্য পিউ এর এতে আপত্তি নেই। বরং এতোটা সাদামাটা বিয়ের আবদার তার ই ছিলো। পারভেজ নাকি আগামী সপ্তাহে বিদেশ চলে যাবে। অফিস থেকে এবছর ছুটি পায় নি সে। তাই পিউ কে এবছর উঠিয়ে নিবেন না তারা। আগামীবছর সব অনুষ্ঠান করে, ধুমধাম করে বউ উঠিয়ে নিবেন তারা। বদরুল সাহেব চেয়েছিলেন পারিবারিক ভাবে কিছু অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু সেটায় বাধ সাধলো পিউ। এটা যে খুব স্বাভাবিক তাও সবার জানা। নীলাদ্রি সিদ্ধহস্তে পিউ এর বিয়ের কাজে হাত লাগাচ্ছে। দিশা এবং ঐন্দ্রিলা খানিকটা রেগে গেলেও সে পাত্তা দিচ্ছে না। এই সুযোগ বারবার আসে না। প্রেমিকার বিয়েতে কাজ করাটা সকল ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিকের আদর্শ কাজ। এই কাজটা না করলে যেনো ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক হওয়া যায় না। তাই নীলাদ্রিও সেই রুল ফলো করছে। কিন্তু ক্লান্ত হৃদয় অশান্ত হয়ে পড়েছে। বুকের ছাইচাপা আগুনের লকলকে শিখাটা ধীরে পুড়াচ্ছে হৃদয়টাকে। ছাঁদের কোনায় দাঁড়িয়ে আধারে নিমজ্জিত আকাশটির দিকে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রি। হিনহিনে বাতাস বইছে তবুও যেনো শান্তি পাচ্ছে না নীলাদ্রি। আগামীকাল তার পিউ একেবারে অন্যকারোর হয়ে যাবে। সে কি সত্যি ই কাপুরুষ!
– সিগারেট খাবে? ভালো লাগবে।
হঠাৎ গম্ভীর একটা পুরুষ কন্ঠে কানে আসতেই চমকে উঠলো নীলাদ্রি। পেছনে ফিরতেই চোখ কুচকে আসলো তার। অভ্র বেশ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। নীলাদ্রি বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠলো,
– মজা নিতে এসেছো?
– না, একটা হেরে যাওয়া প্রেমিকের দুঃখ বিলাপ দেখতে এসেছি। তা এতোটাই যদি কষ্ট হয় তাহলে জোর গলায় কেনো বলছো না, সে শুধু তোমার। কেনো বাধা দিচ্ছো না এই বিয়েতে?
– ওর সুখে যে আমার সুখ।
– তুমি নিশ্চিত ও সুখী হবে?
-…….
– নীলাদ্রি সুখ না টাকায় তোলা যায় না। একটা সময় ছিলো আমি এতোটা অর্থের মালিক ছিলাম না। কানাডায় একটা ছাপোষা ইংরেজের আন্ডারে কাজ করতাম। ইনকাম টা দিয়ে খুব কষ্টে সংসার চলতো। আমি কিন্তু তখন সুখী ছিলাম। কারণ ওই সময় আমার পাশে আমার আপনজন ছিলো। একদিন আমি যখন তাকে হারিয়ে ফেললাম, তখন আমার কাছে প্রচুর বিত্ত এলেও আমি সুখী ছিলাম না। কারণ বুকের একটা জায়গা ফাঁকা হয়েছিলো। তারপর আমার জীবনে সুখ রুপে ঐন্দ্রিলা এলো। ঐন্দ্রিলা আমার জীবনকে পূর্নতা দিয়েছে। তাই তো আজ আমি সত্যি একজন সুখী মানুষ। নীলাদ্রি, তুমি হয়তো সারাটাজীবন বিয়ে করবে না। কারণ তোমার কাছে পিউ এর স্মৃতি থাকবে। কিন্তু পিউ কিভাবে বাঁচবে বলতো? প্রতিনিয়ত ভালোবাসার অভাবে সে ক্লান্ত হয়ে যাবে। ওই মানুষটা যখন তাকে পিসবে তখন সে নিজের অস্তিত্বটুকুও হারিয়ে ফেলবে। এই রকম সুখী জীবন তুমি তাকে দিতে চাও? তুমি কি পিউ কে অর্থে জড়ানো প্রাণহীন পুতুল হিসেবে দেখতে চাও? যদি তোমার উত্তর না হয় তবে আগামীকাল সবার সামনে নিজের পিউ কে নিজের করে নিও। মেয়েটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিও না।
অভ্রের কথা শেষ হলে নীলাদ্রি ধীর কন্ঠে বললো,
– লাইটার আছে?
– আছে।
– তাহলে সিগারেটটা দাও
বলেই হাত এগিয়ে দিলো। অভ্র সেই সিগারেটে আগুন ধরালো। নীলাদ্রি চোখ বুজে সিগারেটে সুখটান দিলো৷ প্রথমবার অভ্রের উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করছে না। বরং মনে হচ্ছে কোনো বন্ধুর সাথে নিঝুম রাতে সিগারেটের ধোয়ায় আড্ডা দিচ্ছে। হয়তো এটাই জীবনের ধর্ম। কঠিন কঠিন সময়ে বিরক্তিকর মানুষকে পরম বন্ধু মনে হয়__________
জুম্মার নামাজ পড়ে এসেছে মুরুব্বিরা। কাজী সাহেব ও উপস্থিত। একটু বাদে বিয়ে পড়ানো হবে। কিন্তু গোল বাঁধলো এখনো পারভেজ এবং তার পরিবার হাজির হয় নি। তাতে অবশ্য বদরুল সাহেবের মাথা ব্যাথা নেই। তিনি বাকি আয়োজনে ব্যাস্ত। নীলাদ্রি কাল সারারাত অনেক চিন্তা করেছে। একটা কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে সে। জীবনের এই মূহুর্তে সে শেষবারের মতো স্বার্থপর হতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। বুকে ফু দিয়ে বসার ঘরে উপস্থিত হলো সে। বদরুল সাহেবকে ধীর কন্ঠে বললো,
– খালু, আপনার সাথে আমার কথা রয়েছে। একটু আসবেন?
– এখানেই বলো, সবাই আমরা আমরাই তো।
– আসলে একটু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো।
– আরে বাবা বলোই না।
বসার ঘরের সবার নজর নীলাদ্রির উপর। নীলাদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাজলজ্জার মাথা কেটে বলে উঠলো,
– আমি পিউকে ভালোবাসি খালু। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। প্লিজ এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। দরকার হলে আমি এই মূহুর্তে ওকে বিয়ে করবো। আমি কথা দিচ্ছি পিউ কে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না আমি। হয়তো পারভেজের মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই আমার, কিন্তু আমার ঘরে পিউ এর ভালোবাসার অভাব হবে না। আমাকে একবার বিশ্বাস করে দেখুন খালু। প্লিজ পিউকে কেড়ে নিবেন না আমার থেকে।
বদরুল সাহেবের চোখ মুখ কুচকে গেলো। তার মুখের ভাব পালটে গেলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– তুমি কি ভেবে বলছো নীলাদ্রি। পরে আফসোস করবে না তো?
– না খালু, আমি কখনোই আফসোস করবো না। আমি যা বলছি মন থেকে বলছি।
– আলহামদুলিল্লাহ। কাজী সাহেব অবশেষে বরের মাথায় সুবুদ্ধি হলো।
বদরুল সাহেবের এরুপ কথা শুনে নীলাদ্রির মুখ হা হয়ে যায়। অবাক নয়নে তার দিকে তাকালে বদরুল সাহেব বলেন,
– পারভেজের সাথে বিয়েটা আমি সেদিন ই ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। পিউ আর পারভেজের কথোপকথন রেকর্ড করে দিশা আমাকে শুনিয়েছিলো। তাই বিয়েটা সেই রাতেই আমি ভেঙ্গে দি। এর মধ্যে পিউ এসে আমাকে সব খুলে বলে৷ আমি প্রথমে খানিকটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু তোমার মতো ছেলে আমি হাজার খুজেও পেতাম না। তাই নিজের চিন্তাধারা বদলাতেই হলো। কিন্তু তুমি যে এতোটা গাধা তা তো আমার জানা ছিলো না। তুমি কিনা পিউকে পারভেজকে বিয়ে করতে বলে দিলে। পিউ মা তো রেগেমেগে একাকার। তাই এই নাটকের আয়োজনটা আমার ই করতে হলো৷ কি নীলাদ্রি! নাটকটা কেমন লাগলো?
বসার ঘরে সবাই হাসছে। আর নীলাদ্রি মাথা নিচু করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ লজ্জা লাগছে তার। আড়চোখে দিশা আর ঐন্দ্রিলার দিকে তাকালো সে। তারা মিটিমিটি হাসছে। অর্থাৎ সবাই ই জানে শুধু সে বাদে। পিউটা নাকে আচ্ছা নাকানিচুবানি খাওয়িছে। অবশেষে পিউ এবং নীলাদ্রির বিয়েটা হলো। নীলাদ্রির অশান্ত মনটা যেনো একেবারেই শান্ত হয়ে গেলো। বুকের দহনের এক পশলা বৃষ্টি নামলো। এখন অপেক্ষা কখন পিউকে একান্ত করে পাবে।
রাত দশটা,
অবশেষে বোনদের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেলো সে। অবশেষে ঘরে ঢুকবার সুযোগ হল তার। পিউ তখন লাল বেনারসি পড়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। পূর্ন চন্দ্রমায় মেয়েটাকে যেনো সদ্য ফোঁটা শিউলি ফুলের ন্যায় লাগছে। মেয়েটির গভীর নয়নে বারবার আহত হয় নীলাদ্রি। পিউ তখন চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। গলা খাকারি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো সে। তাতে পিউ এর কোনো হেলদোল হলো না। সে এখনো বাহিরের শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। নীলাদ্রি এবার তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, ধীর কন্ঠে বললো,
– কথা বলবি না?
-……..
– এখনো রাগ করে থাকবি? কান ধরছি এবার ক্ষমা করে দে।
-…. …..
– পিউ, আজ আমাদের বাসর রাত।
– তো আমি কি নাচবো?
– না, নাচতে বলি নি।
– আপনাকে যে ঘরে ঢুকতে দিয়েছি এটাই অনেক না? আরোও কিছু লাগবে?
– লাগবে তো!
– আমার বয়ে গেছে তাতে। বলেছিলাম না, সহজে আপনাকে ছেড়ে দিবো না। এতো সহজে ক্ষমা করে দিলে জাতির কাছে কি মুখ দেখাবো আমি?
এবার নীলাদ্রি পিউকে হ্যাচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পিউ এর মুখমন্ডলে আছড়ে পড়ছে। ধীর স্বরে বললো,
– আরোও শাস্তি বাকি রয়েছে বুঝি?
– আমি তো সবচেয়ে কঠিন শাস্তিটা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম পারভেজকেই বিয়ে করবো। কিন্তু মামু সেটা করতে দিলেন না।
– আমি হতে দিলে তো?
– তাই বুঝি? তাই তো আমাকে বলেছিলেন বিয়েটা করে নিতে।
মুখটা ঘুরিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো পিউ। নীলাদ্রি তার মুখটাকে আগলে ধরে তুলে ধরলো। কপালে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বললো,
– তুই শুধু আমার কথাটাই মনে রাখবি। আমি যখন কথাগুলো বলছিলাম আমার মনে হচ্ছিলো কেউ যেনো আমার গলা টিপে ধরেছে। আমার মনে হচ্ছিলো কেউ ভোঁতা ছুরি দিয়ে আমার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিলো। তাই তো আজ সবার সামনে তোর হাত চেয়ে বসলাম খালুর কাছে। জানিস কতোটা ভয়ে ছিলাম আমি! ভেবেছিলাম এই বুঝি খালু আমাকে মেরে বসেন। তোর মামুকে তো চিনিস না, মাঝ রাস্তায় কান ধরে উঠবোস ও করাতে পারতেন তিনি।
– হাহ! এসব মন গলানো কথা বলে লাভ নেই। শাস্তি তো পেতেই হবে।
– বেশ তোর সকল শাস্তি মাথা পেতে নিবো আমি। সারাটাজীবন তো তোর নামেই করে দিলাম। যেমন খুশি শাস্তি দিস। তবে আজ রাতটা না, আজ রাত আমি তোকে একান্ত করে পেতে চাই। যেখানে কোনো বাধা থাকবে না, কোনো ভয় থাকবে না। থাকবে শুধু ভালোবাসা। থাকবো শুধু তুই আর আমি। অনুমতি আছে?
পিউ কোনো কথা বললো না। শুধু নীলাদ্রির বুকে মুখ লুকানো। মানুষটাকে যে খুব ভালোবাসে সে। তাই তো জেদ ঠান্ডা করে বদরুল সাহেবের প্লানে সম্মতি দিয়েছিলো সে। জীবনটা তো একটাই, সেই জীবনে যদি ভালোবাসার মানুষটা পাশে না থাকে তবে সে জীবনটা অপূর্ন থাকে। সুখটা কেবল স্বপ্নছায়াই হয়ে যায়_____________
অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ। প্রকৃতির তেজ, প্রকোটতা খানিকটা শান্ত হয়েছে। নীল আকাশটা কালো হয়ে আসছে। অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি হয়ে দেখা যায় না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। কোথাও যেনো কিছু অভিমানের বাসা বেধেছে। মুখ কালো করে থাকা মেঘেরা একত্রিত হচ্ছে বিলাপ করবে বিধায়। দমকা হাওয়া ছেড়েছে। সেই হাওয়ায় উড়ছে ঐন্দ্রিলার চুল। মাটিতে গড়াচ্ছে তার লাল আঁচল৷ চোখ বুজে প্রকৃতির উম্মাদনা অনুভব করছে সে। এই একটা সময় তার একান্ত নিজের। সুরালো কন্ঠে গান তুলে সে,
“প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
সুন্দর এসে ফিরে যায়
তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়”
হঠাৎ খেয়াল করলো একজোড়া শীতল হাত তার কোমড় আকড়ে ধরেছে। মাতাল কড়া গন্ধ নাকে আসছে। ঐন্দ্রিলা মুচকি হেসে মাথাটা এলিয়ে দিলো সুঠাম বুকে। গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কখন এলেন?
– যখন তুমি সুর তুলছিলে!
– আজকাল এতোটা আস্তে হাটেন যে আপনার পায়ের শব্দটুকু কানে আসে না।
– বেশ এরপর ঘর কাঁপিয়ে আসবো।
– সেটাই ভালো! বিড়ালের মতো গুটিপায়ে না চলে বাঘের মতো আসবেন। আপনার পার্সোনালিটির সাথে যায় কিন্ত!
– একটা কথা ভাবছিলাম
– কিহ!
অভ্র ঐন্দ্রিলার নরম হাতখানা নিজের হাতে নিলো। তালুকে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো,
– ভাবছি দিশানের একটা খেলার সাথী দরকার। ছেলেটার বয়স চার বছর হতে চলেছে। একটা বোন পেলে মা ঘেষা স্বভাবটা কমবে। তাই ভাবছিলাম, একটা ছোট ঐন্দ্রিকে আনার ব্যাবস্থা করলে কি খুব মন্দ হবে?
– সে কি! আপনি ই তো শর্ত দিয়েছিলেন, আমার কাছ থেকে আপনার বাচ্চা চাই না। কি জানে বলেছিলেন, “আমি চাই না আমাদের কোনো বাচ্চা হোক”। তা সেই শর্তের কি হবে!
– তুমি এখনো সেই শর্ত নিয়েই পড়ে রয়েছো?
– বাহ রে! শর্ত তো শর্তই। যতই হোক বলেছিলেন তো।
ঐন্দ্রিলার কন্ঠে বিষন্নতা আঁছড়ে পড়লো। অভ্র খানিকটা লজ্জাও পেলো। ঐন্দ্রিলাকে আরোও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বললো,
– আমি মানুষটা নিজের ভুল স্বীকার করতে পিছ পা হই না কখনোই। সে রাতে আমি তোমাকে প্রচুর আঘাত করেছিলাম। আমি সত্যি ই লজ্জিত। তবে একটা কথা কি জানো ঐন্দ্রিলা! আমি হয়তো কখনোই বদলাতাম না, অতীতের শিকলে নিজেকে আটকে রাখতাম হয়তো সারাজীবন। আমাকে বদলেছো তুমি! তাই তোমার অংশকে অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। আর যে আসবে সে তো শুধু শারিরীক সঙ্গমের ফল হবে না, হবে আমাদের ভালোবাসার বীজ। সেই বীজটিকে আমি প্রান দিয়ে হলেও আগলে রাখবো। দিন শেষে আমার সকল ক্লান্তির অবসান ঘটবে ওই ছোট্ট জানটাকে কোলে নিয়ে। সে যে তোমার প্রতিচ্ছবি হবে। তোমার অংশ, আমাদের ভালোবাসার অস্তিত্ব। তাকে না চেয়ে উপায় আছে?
– তবে কি আপনি তাকেই বেশি ভালোবাসবেন? আমাকে ভুলে যাবেন?
– তুমি যে আমার রক্তে মিশে আছো। আমার বেঁচে থাকার খোরাক তুমি। যেদিন তোমাকে ভুলে যাবো, সেদিন হয়তো আমার প্রাণটাই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।
– নতুন জীবনের আগমনে এসব অলুক্ষনে কথা না বললে কি নয়?
ঐন্দ্রিলার অভিমানী কন্ঠ শুনে হেসে উঠলো অভ্র। কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললো,
– একটা গান শোনাবে? যেটায় শুধু আমি থাকবো?
ঐন্দ্রিলা ঘুরে অভ্রের বুকে মাথা রাখলো। বাহিরে বৃষ্টি নেমেছে। ঝুমঝুম করে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝে ঐন্দ্রিলা সুর তুললো,
“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি,
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে
বলো কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি?
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে
রং মিশে যায় রুক্ষ দুপুরে
সেই রং দিয়ে তোমাকেই আঁকি
আর কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি
প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।”
অভ্র চোখ বুঝে ঐন্দ্রিলার গান শুনে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছিটা আছড়ে পড়ছে তাদের গায়ে। কিন্তু তাতে তাদের হেলদোল নেই। তারা একে অপরের মাঝে লেপ্টে রয়েছে পরম অনুরাগে, এটাই তাদের স্বপ্নছায়ার পূর্ণতা_________
সমাপ্ত