স্বপ্ন,পর্বঃ- ০৬

0
695

স্বপ্ন,পর্বঃ- ০৬
সাদিয়া_সৃষ্টি

আরেকটি নতুন দিনের সূচনা। শহর হওয়ায় পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙার ঘটনা এখানে খুব কমই দেখা যায়। মূলত যানবাহনের শব্দ বিশেষ করে রিকশা-গাড়ির হর্ন কিংবা সকাল সকাল পাওয়ার লাইনের মোটা মোটা তারে বসে থাকা কাকের ডাকেই ঘুম ভেঙে যায়। অলিগলিতে মানুষের সংখ্যাধিক্যের জন্য তাদের চলার শব্দ যেন কান পর্যন্ত পৌঁছানোর উপক্রম। প্রতিদিনের মতো একই সময়ে ঘুম ভাঙলেও ছুটির দিন বলে আবার শুয়ে পড়েছিল বৃষ্টি। আর শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। এর মাঝে একবার ঘুমের ঘোরের মধ্যেই মায়ের ডাক কানে ভেসে এসেছিল তার। মায়ের কথার সারাংশ ছিল এই যে বাবা-মা আর বিভোর মিলে তাদের এক মামার বাড়িতে যাচ্ছে। সে চাইলেও যেতে পারে। কিন্তু ঘুমের কারণে “না” করে দিয়েছিল সে। তাই আপাতত একাই আছে বাড়িতে। কিছুক্ষণ আগেই হাত মুখ ধুয়ে খাবার খাওয়া শেষ করল। এখন ফোনে গেমস খেলতে বসেছে সে। খেলতে বসার পরই নিশান্তের কোথা মনে পড়ল। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির সাথেই যাওয়া আসা করছে সে। প্রথমদিকে নিশান্তকে যেন ভেবেছিল, তেমন না ছেলেটা। তার কাঁধে কোন দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটা যেকোনো মূল্যে পালন করে সে। এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় নি তার। তবে ছেলেটার একটা নেগেটিভ দিক হলো অতিরিক্ত ফ্লার্ট করে মেয়েদের সাথে। বৃষ্টির সামনেও অনেকগুলো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছে, তবে অস্থায়ীকালের জন্যই। দুই তিন দিন কোথা বলে আবার বোন বানিয়ে ফেলে কিংবা জাস্ট ফ্রেন্ড। আবার সুযোগ পেলেই বৃষ্টির সাথেও। কিন্তু বৃষ্টি তার সাথে তাল মেলায়নি আজ পর্যন্ত। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে শুধু দুজনের মাঝে। নিশান্তের কোথা মনে হতেই নিশান্তের ঘরে উঁকি দিল। দরজা খোলা থাকলেও সেখানে নেই কেউ। সে ফোন তুলে নিল হাতে। কিন্তু গেম শুরু করার আগেই বাড়ির কলিং বেলের আওয়াজে সেটা আর হলো না। বিলম্ব না করে দরজা খুলে দিতেই সামনে আবিরকে দেখতে পেল বৃষ্টি। আবির সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বৃষ্টি হুট করে এমন ঘটনা ঘটায় চমকে গেলেও সেটা প্রকাশ করল না। মুখ স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করল,

— “এভাবে দরজা বন্ধ করলে কেন আবির ভাইয়া? মৌটুসি কোথায়?”

আবির বৃষ্টির প্রশ্নে মনোযোগ দিল না একটুও। শুধু বৃষ্টির ভাব-ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করল চোখ ছোট ছোট করে। তারপর বৃষ্টির অবস্থা আন্দাজ করতেই বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তার মনে। আবিরকে হাসতে দেখে আবার ভড়কে গেল বৃষ্টি। এই হাসির অর্থ সে জানে না। আর না এখন বুঝতে পারছে। নিজের প্রশ্নটা আবার করতেই আবির দেরি না করেই উত্তর দিল,

— “আমাকে কি একেবারেই ভুলে গিয়েছ তুমি বৃষ্টি? ভুলতে পেরেছ আমাকে?”

বৃষ্টি এবার আবিরকে দেখে নিল। তাকে দেখলে মনে হচ্ছে এক চিন্তিত প্রেমিক তার প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে আবেদন জানাচ্ছে। বৃষ্টির মাথায় সাথে সাথে এলো ফুফুর বলা সেদিনের কথাটা।

“এতদিন তো মৌটুসি মৌটুসি করে পাগল করে দিয়েছিল। বিয়ে করলে না কি তাকেই করবে আর কাউক…”

চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আবিরকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না বলেই মনে হলো তার। তাছাড়া যার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তাকে নিয়ে এতো কিসের পিছুটান? এমনিই আবিরের বিয়ের পরও প্রতি রাতে আগের মতো ম্যাসেজ পাঠানো বা কল করায় অতিষ্ট হয়ে নাম্বার ব্লক করেছে দুদিন হলো। কিন্তু এতো দ্রুতই যে আবির সরাসরি বাড়ি পর্যন্ত চলে আসবে, সেটা সে ভাবতে পারেনি। অবশ্য পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়ায় এমনিই একটা ভয় কাজ করত। আবিরের থেকে লুকিয়েই থাকার চেষ্টা করত সে। আবির নিজের কাজে যাওয়ার সময় কিংবা বাড়ি ফেরার সময় দরজার কাছে আসতো না সে। কতদিন বা এমন করে চলা যায়! তাছাড়া আবির যেটা করছে সেটাও ঠিক না। আবার কাজ পরিবার ফেলে এখান থেকে হুট করে চলে যাওয়াও যাবে না। বলতে গেলে সাবধান থাকাই ছিল একটা পথ। আবিরের সংস্পর্শে না থেকে নিজের মধ্যে বৃষ্টি যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল সেটা বোঝাও হয়নি এখনো তার।

— “সত্যিই কি তুমি আমাকে ভালবাসতে বৃষ্টি?”

আবিরের এহেন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল বৃষ্টি। এর উত্তর তার জানা নেই। বড্ড অদ্ভুত লাগে এই প্রশ্ন যখন সে নিজেকে নিজেই করে। তার মন বলে “না” আর মস্তিষ্ক বলে “হয়তো”। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কি উত্তর দেওয়া উচিত সেটা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। অন্যদিকে আবির বৃষ্টির উত্তরের আশায় থেমে নেই। সে নিজের মতো নানান কোথা বলে চলেছে। বৃষ্টির মস্তিষ্কে কথাগুলো আঘাত করতেই সে বুঝতে পারল এসব কোথা আবির আগেও বলেছিল। তার বিয়ের আগের সময়গুলোতে। বৃষ্টি এই কথাগুলো শুনলেই ঘোরের মধ্যে চলে যায়। তার খেয়াল থাকে না চারপাশের। বৃষ্টির কাছে মনে হয় সে কথাগুলো মস্তিষ্ক না খালি, একেবারে মনে গিয়ে পৌছায়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে চায়। নিজের ভারটা ধরে রাখতে পারবে না মনে হতেই হাতে টান লাগে। চোখ পিটপিট করেই সেদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে আবির তার হাত ধরে রয়েছে। কিঞ্চিৎ সচল মস্তিষ্ক বলে ওঠে, “আবির কখন ধরল ওর হাত?” কিন্তু উত্তর আসে না।

এর আগেও এমন পরিস্থিতি হয়েছে, কিন্তু তখন আশেপাশের খেয়াল হয়নি কোনোদিন। আজ হলো। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু হাতটা নড়ল না। আবিরের কথাগুলো এখনো কানে আসছে। অদ্ভুত ভাবে মস্তিস্কেও পৌছাচ্ছে স্পষ্টভাবে। কিন্তু নিজের শরীরের নিস্তেজ ভাবটা কাটছে না।

নিশান্তকে গত রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল বৃষ্টির পুরো পরিবার মিলে তাদের মামার বাড়িতে যাবে। সাথে বাড়ির অতিরিক্ত চাবিটাও তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজের জন্যই বের হয়েছিল আজ সে। তাও খুব সকাল করেই। কারো সাথে দেখা করতে দূরে যেতে হত। কিন্তু মাঝপথে এসে জানতে পারে সে আজ আসতে পারবে না। বাড়িতে যেহেতু কেউ নেই তাই ফিরে যাওয়ার জন্যই নিজের বাইক ঘোরালো নিশান্ত। এর মাঝে বৃষ্টির ঘরেও সুযোগ বুঝে ঢুঁ মেরে দেখা যাবে।

পৌঁছানোর পর চাবি দিয়েই ধীরে ধীরে দরজা খুলল। চাবি থাকায় আর অকারনে বেল বাজানোর প্রয়োজনবোধ করেনি সে। তবে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার সময় বাইরে থাকা জুতো জোড়া নজর এড়ায়নি তার। ভ্রূ কুঁচকেই ঘরে ঢুকে আবার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। সারা রাস্তা ভেবে এসেছে বৃষ্টির ঘরে উঁকি দিবে। তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে নিঃশব্দে সেদিকেই এগিয়ে গেল। অভ্যাস বশত আগে চৌকাঠের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখে নিল সে। দেখতেই তার চোখ কপালে উঠার উপক্রম। প্রথমত আবিরকে বৃষ্টির সাথে এক ঘরে দেখে রাগ উঠলেও পরে বৃষ্টিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করল। বৃষ্টিকে ধরে থাকতে দেখতে আর বৃষ্টির নিভু নিভু চোখের দিকে তাকিয়েই বিষয়টা বুঝতে দেরি হলো না নিশান্তের। তারপর নিজের সবচেয়ে অপছন্দের কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ করল সে। ওদের কথা-বার্তা শোনার চেষ্টা। আবিরের সেই মায়া মাখান কথাগুলো শুনে নিজের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গের উৎপত্তির খবর পেলেও চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। যেহেতু তার হাঁটাহাঁটি সময় বা অন্যান্য কাজ নিঃশব্দে হয় তাই আবির টের পেল না নিশান্তের উপস্থিতি। সে নিজের কাজে ব্যস্ত।

আড়াল থেকেই আবিরকে বৃষ্টিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতে দেখে মাথায় রাগটা ধপ করে জ্বলে উঠল নিশান্তের। নিজের এমন আচরণে অবাক হলেও বেশি চিন্তা করল না এই নিয়ে। হুট করে রাগারাগি করা তার স্বভাব না কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রাগের আগুনে সে নিজে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে। তবে এর পরের ঘটনায় সেই রাগ নিভে গেল। আনির কিছুই করেনি বৃষ্টির সাথে। শুধু সেখান থেকে সরে এলো। নিশান্ত নিজের রুমে গিয়ে সুরক্ষিত জায়গায় দাঁড়াল যাতে বাইরে থেকে তাকে কেউ সরাসরি দেখতে না পারে। আবিরও তেমন কিছু করল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল আর যাওয়ার আগে দরজা লক করে দিল।

নিশান্ত বের হয়ে আবার বৃষ্টির কাছে ফিরে এলো। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, নিশ্চিন্তে। এখন হয়তো জানেও না একটু আগে তার সাথে কি কি হয়েছে। চোখ একেবারে বন্ধ হয়েই ছিল তখন, হয়তো আবিরের বলা কথাগুলো শুনতে পারেনি। নিশান্ত নিজের হাত বাড়িতে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দেখতে গিয়েও হাত পিছিয়ে নিল। তারপর সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেল। বাকিটা সময় আর ঘর থেকে বের হলো না। আবির আবার কি কা কি করে বসে সেই চিন্তায়।

_____

বৃষ্টির ঘুম ভাঙল একেবারে কয়েকজনের কথা বলার আওয়াজে। মাথা হালকা ব্যথা করায় কিছুটা সময় বিছানায় বসে থেকেই কাঁটাল সে। আওয়া শুনে বুঝতে পারল ওর বাবা-মা বিভোর আর নিশান্ত এর কণ্ঠ এগুলো। পুরো পরিবার ফিরে এসেছে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ঘুমানোর আগের কথাটা মনে করার চেষ্টা করল। আশেপাশে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছে সন্ধ্যার শেষ ভাগ এটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিতেও ইচ্ছা করল না, সেজন্য মাথা উঁচু করতে হবে তাই। সেটুকু করতে গেলেও মনে হচ্ছে মাথা ব্যথাটা বাড়বে তার। সে সোজা গেল মুখ ধুয়ে ঘুম তাড়াতে। তারপর বাইরে এসে বাবা মায়ের সাথে কথায় যোগ দিল। নিশান্তকে দেখে অবাক হলো। বাবা মা সামনে থাকলেও নিশান্ত কখনো এতো শান্ত থাকেনি। কিন্তু আজ কোন কথাই বলছে না সে।

_____

আকাশে চাঁদের দেখা মিলেছে খুব সহজেই। পূর্ণিমা নাহলেও কাছাকাছি সময় হয়তো। তাই তো আকাশের বুকে বিশাল চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। সন্ধ্যার পরেও এই চাঁদটা দেখে রুটি বলেই মনে হচ্ছিল, কিন্তু এখন আবার সাদা রং ধারন করেছে সে। সেদিকেই মন বৃষ্টির। সন্ধ্যার পর ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে মাথা ব্যথাটা কমে যাবে, তাই হয়েছে কিন্তু পরিমাণে খুব কম। ব্যথাটা এখনো ভালোই আছে। ওষুধ খাওয়া পছন্দ না হওয়ায় খুব বড় কোন কারণ না হলে বৃষ্টি ওষুধের ধারের কাছেও যায় না। আজও এরকমই হয়েছে। ভাবল ছাদে গিয়ে ঠাণ্ডা পরিবেশে থাকলে অন্তত মাথা ব্যথার কোথা ভুলে থাকতে পারবে না হয়তো। তাই চুপি চুপিই চলে এসেছে এখানে। এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস যখন তার শরীর ছুঁয়ে গেল তখন মনে পড়ল ছোট কালে কারো কাছে শোনা একটি কথা। “ঠাণ্ডা পানি মাথায় অতিরিক্ত পরিমাণে লাগলে মস্তিষ্ক জমে যায় বরফের মতো”। কথাটা কোনোদিন সঠিক কি না যাচাই করে দেখেনি সে আজ পর্যন্ত। তবুও শুনলেই মাঝে মাঝে হাসি পায়, আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় পরীক্ষা করে দেখার। কিন্তু শীতের ভোরের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় বরফ সম পানি মাথায় ঢালার সাহস তার নেই।

গুনগুন শব্দ ভেসে আসতেই পিছনের দিকে তাকাল সে। নিশান্ত দাঁড়িয়ে আছে। আঁচ করতে পেরেছিল সে। কিছু বলল না। নিশান্ত তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— “এতো রাতে এখানে? খারাপ লাগছে?”

— “মাথা ব্যথা করছিল একটু।”

নিশান্তের ভ্রূ কুঁচকে এলো আবার। তবে সে থেমে না থেকে প্রশ্ন করল,

— “সন্ধ্যা থেকে দেখছি তোমার মুখে ক্লান্তির ছাপ। এতক্ষণ মাথা ব্যথা থাকে তোমার?”

— “জানি না।”

— “আচ্ছা, একটা জিজ্ঞেস করি?”

— “হঠাৎ প্রশ্ন করছেন? আগে তো অকারণেই নানা কথা বলতেন।”

— “তোমাকে প্রায় সময় ক্লান্ত দেখায়, পরিমানের তুলনায় অধিক। সেদিন আমি তোমার বাড়িতে প্রথম আসলাম, তারপর অফিস থেকে মাঝে মাঝে ফেরার পথে, খেয়াল করেছি তোমায়। কিন্তু কারণ ধরতে পারিনি।”

— “ভাবুন, প্রতিবারের মতো যুক্তি দাঁড় করান। আমিও শুনি কি কি ভেবেছেন আপনি।”

— “আমার থেকে লুকাচ্ছ কিছু? কিংবা আমাদের সবার থেকেই?”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here