#স্বপ্ন_কেনার_দামে,০৪,০৫
#রুকসাত_জাহান
#পর্ব৪
অভিমানে অরণীর কেমন কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সবাই বলে অরণী অনেক লক্ষী মেয়ে, বড় খালাতো সবসময়ই ওনার মেয়েদের বলেন, “অরণী আপুর মতো হও, যেমন লক্ষী তেমন মেধাবী।”
যেই দাদী সারাক্ষণ সবার ভুল ধরে, সেই দাদীও বলেন, “আমার নাতনির মতো আর কেউ নাই, ফুফুগো মতো সুন্দর আর গুণী হইছে।” দাদীর কাছে সেরার মাপকাঠি হলেন দুই ফুপু।
অথচ রিদম তাকে কতগুলো শক্ত শক্ত কথা বলে ফেললো। এই যে ওর এই নরম স্বভাব, চঞ্চল হলেও বেপরোয়া নয়, বাবা মায়ের আদুরে শুধু নয়, আজ্ঞাকারী মেয়ে এটাই তো সবার ভালো লাগে। বন্ধুর মায়েরা বলে অরণীর মতো হও, আত্মীয় স্বজনেরা বলল অরণীর মতো হও। মাঝেমাঝে অতিরিক্ত সতর্ক চোখের পাহারা অরণীর খারাপ লাগলেও, সবার এইসব প্রশংসা বাক্যে যে সে তার খুশি খুঁজে নিয়েছে।
রিদমও কত বলে, “অরণী, তোমার মতো মেয়ে এখন বিলুপ্ত প্রজাতি জানো। এত মিষ্টি মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে পোষাবে না, আমার বৌ বানাতে হবে তাড়াতাড়ি।”
আর আজ সেই অরণীকে রিদম কেমন করে বকে দিল। অরণী মাথানিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ইচ্ছে করছে এখুনি বাসায় চলে যেতে, বাসায় গিয়ে মাকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে দেবে যে আজ আর ক্লাস হবে না। মা সহজ সরল মানুষ, এত কিছু খোঁজ নিতে যাবে না। ভয় হলো বাবাকে নিয়ে, ক্লাস হয়নি শুনলে অনেক প্রশ্ন করবেন। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না অরণী।
নাকি কলেজে চলে যাবে, যে কয়টা ক্লাস পায় করবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাছাড়া আগে কখনো একা এতদূর আসা হয়নি, একা একা পার্ক থেকে বের হতেও অস্বস্তি লাগবে। অরণীর চোখে এবার সত্যিই পানি চলে আসে, আসলেই তো ও এত ভীতু কেন হলো! ওর বান্ধবীরা সমস্ত ঢাকা চষে বেড়ায়, আর অরণীর দৌঁড় কলেজ থেকে বাসা, বড়জোর কলেজের কাছে ফাস্টফুডের দোকানগুলো।
হঠাৎ রিদম এসে একদম পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে যায়, “মাফ করে দাও অরু, কী বলতে কী বলে ফেলেছি। প্রথম ডেটিং এ এসেছি তো, অনেক নার্ভাস। জানোই তো নার্ভাস থাকলে প্যানিক এটাক হয়। প্লিজ কেঁদো না। আই অ্যাম স্যরি অরু।”
ভালোবাসার তীব্র আবেগের সময় রিদম ওকে অরু করে বলে, তখন রিদমকে মায়ের মতোই কাছের কেউ আর আপন কেউ মনে হয় অরণীর। একটু আগেও ভাবছিল চলে যাবে। কিন্তু এখন রিদম এমন চেহারা করে তাকিয়ে আছে, ক্ষমা চাইছে যে অরণীর শক্ত ভাবটা শিথিল হয়ে যায়। রিদম অরণীর হাত ধরে বসিয়ে দেয়। জোর করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করায় অরণীর নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে কান্নার দমকে, লম্বা সময় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রাখায় নিচের ঠোঁটটা লাল রঙ হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে তাড়াহুড়োয় অরণী কোনরকমে চুল আঁচড়ে বের হয়েছিল। অথচ এখন এই প্রসাধন বিহীন, সিধে সাধা মুখটাই লাবণ্যময় লাগছে রিদমের। অরণী মাথা নিচু করে বসে আছে। রিদম হঠাৎ মুখটা তুলে ধরে গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট বসানোর সাহস হয় না। কিন্তু এতেই অরণী ছিটকে সরে যায়, ও বিশ্বাসই করতে পারে না এইমাত্র কী হলো।
“স্যরি অরু, তোমাকে এত মায়া লাগছিল যে নিজেকে সামলাতে পারিনি। বিশ্বাস করো এরমাঝে কোন নোংরা উদ্দেশ্য নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই কাছে টেনেছি। আর এতটুকু তো প্রেমে চলেই। বাকিটুকু বিয়ের পর।”
অরণীর কানে কোন কথা ঢুকে না, তাই উত্তরও দেয় না। কান ঝা ঝা করছে। অনেকক্ষণ ধরেই চলে যাবে ভাবছিল। এখন আর বসে থাকার মানে হয় না। উঠে যাবে এমন সময় দুইজন টোকাই ধরনের লোক সামনে চলে আসে, “কী ভাই জায়গা লাগবনি, সামনে ঝোপের পিছনে ব্যবস্থা আছে। পলিথিন লাগলে বইলেন।”
অরণীতো বটেই রিদমও হচকচিয়ে যায়, “আমাদের কিছু লাগবে না, আমরা এখনি উঠছি” রিদম কণ্ঠে জোর নিয়ে বলে। অরণীর হাত ধরে উঠেও যায়। কিন্তু লোক দুটো বাজে ভাবে হাসতে থাকে। এর মাঝে আরও দু’জন লোক এগিয়ে আসে। তার মানে জায়গাটা নিরিবিলি মনে হলেও ঝোপের আড়ালে এমন মাদকাসক্ত বখাটেরা ঠিকই লুকিয়ে থাকে। চারজন লোককে দেখে অরণী আর রিদম দু’জনই ভয় পেয়ে যায়। পেপার পত্রিকায় পড়া দুনিয়ার সব কাহিনি অরণীর মাথায় চলে আসে। কী করবে এই লোকগুলো! এখন তো দিনের আলো, গায়ে হাত টাত দেবে না তো! এমন কিছু হলে অরণী মারাই যাবে। অরণীর ফ্যাঁকাসে রক্তশূণ্য মুখ দেখে রিদমের ভীষণ খারাপ লাগছে, অরণীর কোন ক্ষতি হলে যে সে নিজেকে মাফ করতে পারবে না, ওকে যে সেই এখানে নিয়ে এসেছে।
“দেখেন ভাই, আপনারা কী চান? এখানে আসেপাশে লোকজন আছে, পুলিশ আছে, আমরা চিত্কার করে লোক জড়ো করবো। আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি, রাজনীতি করি, ফোন দিলে আমার ছেলেপেলেরা চলে আসবে এখনি।” কণ্ঠ যতটা স্বাভাবিক রেখে ফোন বের করে কল করার ভঙ্গি করে রিদম। মেডিকেল পড়ে, এই পরিচয় দিলে এরা দু’পয়সার ভয় পাবে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলে, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনলে সবাই কিছুটা হলেও সমীহ করে। অরণী বুঝতে পারে কেন রিদম এমনটা বলছে। রিদমের শার্ট খামছে ধরে সেও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, এদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে ভয় পেয়েছে।
লোকগুলোর মুখের ভাবভঙ্গি একটু পরিবর্তন হলেও রিদমকে খুব একটা পাত্তা দেয় না তারা, দলনেতা গোছের লোকটা বলে “আরে দেখলাম চুম্মাচাটি করতাছেন। তাই একটু সাহাইয্য করতে আইলাম। উল্টা দেখি পুলিশের ডর দেখান, পোলাপান আনার ডর দেখান। পোলাপান আমগো কম আছেনি। আপনে আনার আগে আমগো লোক আইবো। আর পুলিশ আইবো সবার শ্যাষে। তাই কই ঝামেলাত আপনেও না যান, আমরাও না যাই। মজা করতে আসছেন করেন, এই তো বয়স আমনেগো। আমগোও কিছু চা পানি খাওয়ার টাকা দ্যান আমরাও যাই গা।”
অরণী ইশরায় রিদমকে টাকা দিতে বলে,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও এখান থেকে বের হতে চায়। রিদম একশো টাকার একটা নোট বের করে দেয়। কিন্তু লোকগুলো হাতে নেয় না। “কী দিলেন, ভিক্ষা? তাই তো কই মাইয়া নি হোটেল না যাইয়া জঙ্গলে আইলেন ক্যান। ফকির পাইছেননি? পাঁচশো দ্যান, আমরা পাঁচজন আছি।”
“পাঁচজন কই, চারজন আপনারা। আর একশো টাকা কম হলো নাকি?”
“না দিলে আমরাও লোক ডাকুম, বলুম পার্কে নোংরা কাম করতাছিলেন, আমরা হাতেনাতে ধরছি। ছবি তুইল্লা নেটেও ছাড়ি দিমু।”
অপমানে আর লজ্জায় অরণীর মনে হচ্ছে মাটির সাথে মিশে যাবে। রিদমও ঘামছে। এত টাকা তার কাছে নেই। পকেটে সম্ভবত আর পঞ্চাশ টাকা আছে। অরণীর কাছে পাঁচশো টাকার নোট আছে, সকালেই বাবা দিয়েছিল, আর কিছু খুচরো টাকা হবে। বাসায় যেতে ভাড়া লাগবে কত কে জানে, কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হতে চায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে পাঁচশো টাকা বের করে দেয়। টাকা নিয়ে লোকগুলো সালাম দিয়ে চলে যায়। অরণী গেটের দিকে দৌঁড়াতে থাকে, জীবনে এত খারাপ দিন তার কখনো আসেনি, কী ভেবে এসেছিল আর কী হলো!
রিদমও পেছন পেছন দৌঁড়ায়, “অরু, দাঁড়াও, আমি বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। অরু।”
“একটা কথা বলবা না আমার সাথে। তোমার জন্য আজ আমাকে এতকিছু শুনতে হলো। ছিঃ”
কাঁদতে কাঁদতে রিকশায় উঠে অরণী, রিদম উঠতে চাইলেও দেয় না। রিদমেরও অনেক রাগ ওঠে, অরণী ওভার রিয়াকশন দেখাচ্ছে মনে হয়। “শালা এমন সেনসেটিভ মেয়ের সাথে প্রেম করাই ভুল” মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে সেও উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে।
#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৫
অরণী কলিংবেল টিপেই যাচ্ছে। তর সইছে না যেন। হুমায়রা বেগম অবাক হোন, সবে বাজছে সাড়ে এগারোটা, এই সময় কে আসবে! কাজের সহকারী কাপড় ধুচ্ছিল, তাই নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
“অরণী, তুই এখন? ক্লাস হয়নি আজ?”
“ক্লাস হচ্ছে আম্মু, আমি চলে এসেছি।”
“কেন? শরীর খারাপ নাকি? আর তুই কান্নাকাটি করছিস নাকি? চোখমুখ ফোলা ফোলা লাগে।”
“আম্মু আজ ভাইবা পরীক্ষা ছিল। ভালো হয় নাই, ম্যাডাম সবার সামনে বকা দিয়েছেন, তাই কান্না করছি। ভালো লাগছিল না দেখে চলে এসেছে।”
“আরে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে কেন? আর বাকি ক্লাস যে না করে চলি আসলি সেটা সমস্যা হবে না? কলেজে কী বলবে?”
“আম্মু, এখন তো স্কুলে পড়ি না যে হঠাৎ চলে আসলে টিচাররা অস্থির হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। অনেকেই পছন্দ মাফিক ক্লাস করে।”
“তোর আব্বু এসব একদম পছন্দ করে না অরণী। পছন্দ মাফিক ক্লাস করা মানে কী? সব ক্লাস করবি। এইসব ফাঁকিবাজি করছিস দেখে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে।”
মা মেয়ের কথার মাঝে অরণীর দাদী মোমেনা খাতুন এসে দাঁড়ান, “জামিলের বৌ, তোমার অসুখ বিসুখের জ্বালায় মাইয়ার লেখাপড়া মাথাত উঠছে। এখন মেয়েরে বকো ক্যান। সকালেও বিছানাত পইড়া ছিলা, আমার নাতনি নাস্তা রেডি কইরা কলেজ গেল। অথচ আগে ঘুম থেইক্কা উঠলে একটু পড়তে বসতো। এখন বাসার কাম কইরা কুল পায় না, পড়বো কী। এইটুকু মাইয়ারে রান্ধন বান্ধনে লাগাই দাও। আসলে ডাক্তারি পড়ার মূল্য তুমি কী বুঝবা, তোমগো বংশে কেউ ডাক্তারি পড়ছেনি।”
“আম্মা, আপনি আর আপনার ছেলে কিছু হইলেই খালি আমাকে দোষ দেন। ছেলেমেয়েগুলো যখন ভালো রেজাল্ট করে তখন বাবার ব্রেন পাইসে, ফুপুদের মতো হইছে। আর খারাপ করলে আমার বংশ নিয়ে টানাটানি। ডাক্তারি না পড়লেও আমার দুইভাই মাস্টার্স করছে। বকলম না কেউ।”
অরণী আসলে পথে আসতে আসতে ভাবছিল কী বলবে। তাছাড়া মা একনজর দেখলে বুঝে যাবে যে অরণী কান্না করেছে। একটু কাঁদলে অরণীর চোখমুখ ফুলে যায়। শেষে ঠিক করে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলবে। মা হয়তে একটু বকবে কিন্তু কান্না আর অসময়ে বাসায় আসার বিষয়টা সামলে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাও সহজ সমাধান ছিল না। দাদী এই কথা বাবাকে অবশ্যই বলবে। আজ বাসায় একটা অশান্তি হবে। এই একটা জিনিস অরণীর অসহ্য লাগে, এই বাসায় কোন কিছু যেন কেউ সহজ করে গ্রহণ করতে পারে না। তার কত ক্লাসমেট আইটেম আর কার্ড ফাইনালে পেন্ডিং খায়, মেডিকেলে তো এগুলো মামুলি ব্যাপার, কত মানুষ বছর বছর সাপ্লি খেয়ে পাঁচ বছরের কোর্স সাত আট বছরে শেষ করছে। স্যার ম্যামদের কাছে পাশ করার চেয়ে ফেল করা সহজ। সবাই বলে ডাক্তারি পাশ এত সহজ নয়। কিন্তু অরণীর বাসায় কোন কিছু সহজে গ্রহণ করবে না। এখনো রেজাল্ট হলে বাবা জিজ্ঞেস করবে কত মার্কস পেয়েছে, রোল কত হলো, আরও ভালো হলো না কেন। যেখানে পাশ মার্কসই একশোতে ষাট, সেখানে একবারে প্রফের পুলসিরাত পার হওয়াই এভারেস্ট জয়ের আনন্দের মতো। কিন্তু বাসায় কেউ বোঝে না। একশোতে সত্তর কেনো পেয়েছে, নব্বই কেনো পেলো না, এই নিয়ে যেন অসন্তোষ। অরণী বোঝাতে পারে না যে এটা তো স্কুলের লেখাপড়া না। এই যে আজ এই পরীক্ষা কান্ড শেষ পর্যন্ত কই যায় কে জানে।
“দাদী, আপনি আম্মুকে দোষ দেন কেন? আমি নিজেই পড়ি নাই। রাতে তো পড়তে পারতাম, আমিই পড়ি নাই। ছোট পরীক্ষা ছিল, ভাইবা দশ মার্কসের। এত জরুরি কিছু না। আমাদের প্রতিদিনই কোন না কোন আইটেম থাকে। এটা এত চিন্তার কিছু না।”
হুমায়রা বেগম আর মোমেনা খাতুন তাও শান্ত হোন না। অরণীর এবার সত্যি চিন্তা হচ্ছে। এদিকে সাইলেন্ট ফোনে একের পর এক ম্যাসেজ এসে জমছে। ম্যাসেজর রিপ্লাই না পেয়ে রিদম ফোন করা শুরু করছে। অরণী ফোনটা বন্ধ করে দেয়।
****
অরণীর উপর রাগ করে রিদম তখন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলেও একটু পর মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় অস্থিরতা। বারবার মনে হচ্ছে অরণীকে অতগুলো কড়া কথা না বললেও হতো। অরণী কেমন পরিবারের মেয়ে তাতো তার অজানা নয়। ফয়সালের উপর রাগ হয়, শালা কয়দিন ধরে বন্ধুরা ক্ষেপাচ্ছিল যে কী প্রেম করিস, এখনো রুম ডেটতো দূর হাতও ঠিক মতো ধরতে পারলি না। শুরুতে রিদম কানে নিতো না। কিন্তু ইদানীং ফয়সাল বোঝাচ্ছে যে একদম ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়, দু একটা প্রেমের প্রমাণ হাতে রাখতে হয়, না হলে অরণীর মতো বাবা মায়ের কথামতো চলা গুড গার্লরা হঠাৎ পল্টি খায়, আর সুন্দরমতো বাবা মায়ের পছন্দের ছেলে বিয়ে করে অন্যের ঘরণী হয়ে যায়। বেচারা প্রেমিকগুলো না বৌ পায়, না প্রেমিকা, কারণ প্রেমের সময় এই মেয়েগুলো এত নেকু থাকে যে হাতও ধরতে দিতে চায় না। খামোখা সময়, টাকা আর ইমোশন নষ্ট।
দিনের পর দিন ফয়সালের বয়ান শুনে রিদমের ব্রেনওয়াশ হয়ে গিয়েছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই রিদম অরণীকে বাইরে নিয়ে পার্কে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছিল। কোন দামী রেস্টুরেন্টে নেওয়া এই মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব না। পকেটের অবস্থা ভালো না, তবে শান্তি এটাই যে অরণী এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি কখনো। দামি উপহার, ভালো রেস্তোরাঁ এসব নিয়ে কখনোই চাপ দেয়নি। রিদমের সাথে টঙের দোকানের চা সিঙ্গারায় সন্তুষ্ট থাকে। তারপরও ফয়সালের কথায় মনে হয় আসলেও তো এখনও অরণী এত বাবা মায়ের ভয়ে অস্থির থাকে, এই মেয়েকেতো একটু চাপ দিলেই সুরসুর করে বিয়ে করে ফেলবে। রিদমের অরণীকে চাই, ভালোবাসা না অবসেশন ও জানে না। কিন্তু অরণী তারকাছে এক মাদকের নেশার মতো। সেই টোল পড়া হাসি সে আর কারও সাথে ভাগ করতে চায় না, অরণীর একমাথা চুলে যদি কেউ নাক ঢুবিয়ে শ্বাস নেয়, তবে তা রিদমই হবে। এই শ্যামল বরণ মায়াবী মেয়েটার চোখের কাজলে শুধু তারই নাম লেখা থাকবে। আর তারজন্য যদি অরণীকে একটু চাপ দিতে হয় তাও দিতে রাজি।
তাই তো ফয়সাল যখন বলে, “শোন অরণী নরম ধরনের মেয়ে। তুই ওকে একটু হাতে নিতে পারলে আর তোকে ছাড়তে পারবে না।”
“দোস্ত আমি অরণীকে যতটুকু ভালোবাসি, ও আমাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমার চেয়ে বেশি বিয়ের কথা অরণীই বলে।”
“আঁতেলে মতো কথা বলিস না তো রিদম। তুই শালা ওই চোখে দেখে মন ভরাবি, মা* নিয়ে টান দিবে অন্য কেউ”
“ফয়সাল, মুখ সামলে কথা বল।”
“আচ্ছা স্যরি। আরে আমার মুখ দিয়ে এসব কথা এমনি বের হয়। তুই রাগতেছিস কেন। শোন একটু ঘনিষ্ঠ ছবিটবি হাতে থাকলে ভালো। ও তোকে কোন নু*স পাঠিয়েছে আজ পর্যন্ত? পাঠায়নি তাই না? তারমানে ও তোকে বিশ্বাসই করে না।”
“আমি ওকে কখনো পাঠাতে বলিও নাই। প্রযুক্তির কোন বিশ্বাস আছে? আমার ফোন চুরি হলে এইসব ছবির কী হবে জানিস?”
“আচ্ছা ছবি বাদ দে। তোর সাথে সেলফি তে তুলতে পারিস।”
“ও ভয় পায়, ফেসবুকে দিলে কেউ দেখে ফেললে ওর বাসায় সমস্যা হবে।”
“তাহলে তোর কাছে প্রেমের প্রমাণ কী আছ? ঐ চ্যাটবক্স? শোন ভবিষ্যতে সব অস্বীকার করে বলবে আইডি হ্যাক হইছে। না হলে বলবে শুধু বন্ধু ভাবতো তোকে। সময়ে সময়ে এই সব নিরীহ মেয়েরা শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত হয়।”
অতঃপর ফয়সালের কথায় একসম রিদমের মনে হয়, আসলেও তো টুকটাক ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা বলাতো প্রেমে অন্যায় কিছু না। চেষ্টাও করেছিল, দু একটা ফোনকল রেকর্ডও করে রাখবে ভেবেছে। কিন্তু অরণীর সাথে এসব কথা আগায় না। আর যেসময় এসব কথা আগানো যায়, অর্থাৎ গভীর রাতে, তখন অরণী ফোনই ধরে না, চ্যাটও করে না। পার্কে যাওয়ার জন্য বলতে বলতেও অরণী সাহস করে না। ভেবেছিল পার্কে একসাথে সময় কাটাবে, কিছু ছবি তুলবে। তাই তো আজ প্ল্যান করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। যখন থেকে মাথা ঠান্ডা হয়েছে অরণীকে ফোন আর ম্যাসেজ করে যাচ্ছে। অরণী বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না এমনটাই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন ফোন বন্ধ পাওয়ায় রিদমের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।
****
সন্ধ্যার পর বাসায় একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। জামিল সাহেব বাসায় ঢুকতেই মোমেনা বেগম অরণীর পরীক্ষায় খারাপ করার কথা জানালেন। জামিল সাহেব অরণীকে শাসন করার আগে হুমায়রাকে নিয়ে পড়লেন। কথায় কথায় কথা এতদূর বেড়ে গেলো যে হুমায়রার হাঁপানির টান উঠে গিয়েছে।
(চলবে)