স্বার্থ,পর্ব-২ শেষ পর্ব

0
1404

স্বার্থ_২
শেষ পর্ব

আম্মার লাশের উপর দিয়ে আমি চলে যাবো, তাও শুধু বউয়ের মায়ের এক রাতের ঘুম নষ্ট হবে বলে? ইফতির মাথায় বিচ্ছিন্ন সব ভাবনা এলোমেলো ঘুরতে থাকে।

– মুনা, এসব কি ফাজলামো শুরু করলে বলছ তুমি? আমার মা মারা গেছে, আমি জানাযায় থাকব না?

-যে যাবার গেছে তো, এখন তাকে নিয়ে পরে থেকে যারা আছে তাদের বরবাদ করবে?

– তুমি একটা…। তুমি বাসায় যাও, আমি কাল সকালে আসব।

– মানে আবার তুমি এখানে থাকা শুরু করলে? উনি তো নেই, তাহলে থেকে কি করবে? বিয়ের পর সকাল হতো তোমাকে বিছানায় না পেয়ে। কোথায় গেছে? আম্মার কাছে, বাহ্! বিয়ে করা ছেলে সারা রাত কেনো বউ এর সাথে ঘুমালো, তার জন্যে সকালে মায়ের কাছে গিয়ে শুতে হয়। সূরা পড়ে কপালে ফূ দিতে হয়। নইলে আম্মাজানের মন খারাপ হয়। নোংরা একটা।

– মুনা, ওসব ভুল ছিলো। আম্মা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করত। জানোই তো সব। এখন বলে কি লাভ? আম্মা তো নাই আর। তুমি বাসায় যাও। আমি গাড়িতে আসলাম ভাইকে দিয়ে নামিয়ে দিতে বলেছি। আমার কালকে গাড়ি লাগবে।

– তোমাদের ফ্যামিলির আদিখ্যেতা আরেকটু দেখে যাই। সাহানা তো এমন ভাবে কান্নাকাটি করছে, যেন নিজের মা মারা গেছে। হুহ,সব নাটক। ওনার জন্য কোন মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে? আর ভাবী তো দুলে দুলে সুর করে সুরা পড়ছে। বাপরে, পারও নাটক করতে তোমরা।

ইফতি পুরোটা চেপে যায়। মুনার মধ্যে মায়া দয়া কম। নিজের স্বামীকেই ওর বোঝা মনে হয়। বিয়ের এত বছর পর, দুটো বাচ্চা হবার পরেও ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়, তাকে কিছু বলার থাকে না। সংসারে সব ব্যাপারে অনেক ছাড় দিতে হয়। আপন করতে হয়, ত্যাগ করতে হয়।

মুনার সাথে আম্মার করা আচরণ গুলো যেমন নোংরা ছিলো, তেমন নোংরা মুনার এখনকার আচরণ। ইফতি চাইলেও কিছু বলতে পারেনা। মুনা তালাকের ভয় দেখায়। জেল জরিমানার ভয় দেখায়। মুনাকে বা বাচ্চাদের ছাড়া ইফতি এক মুহূর্ত ভাবতে পারেনা। অশান্তি ও চায় না। তাই, চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মেনে নেয়।

দৃশ্যপট – ১০

জানাজা শেষে বরফ আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল সকাল লাশবাহী গাড়ি রওয়ানা দেবে। রাতেই লাশবাহী গাড়ি এসেছে। লাশ কাফন পড়ানোর পর গাড়িতে পাঠাতে সব আত্মীয়রা মতামত দিয়েছিলো। তীব্র আপত্তি জানালো সনন্তানেরা।

একটা মানুষ, মরে গেলেই লাশ হয়ে গেলো? বেঁচে থাকতে কোনদিন তাকে রাতে এসি গাড়িতে রাখত সবাই? আজ তার শ্বাসহীন শরীরটাকে শুধু পঁচনের হাত থেকে বাঁচাতে, বাড়ি থেকে গাড়িতে পাঠিয়ে দেবে সবাই। রাতে রাতে বরফের ব্যবস্থায় বাসায় মরদেহ রাখা হয়েছে

পালা করে সবাই লাশের পাশে কোরআান শরীফ পড়বে। মাটির ঘরে যাবার আগ পর্যন্ত সন্তানদের সাথে থাকবেন রাদিয়া আক্তার। এটুকু হক, সম্মান তাকে দিতেই হবে, মা হিসেবে। যে শরীর ছিড়ে চারটি সন্তান তিনি পৃথিবীতে এনেছেন, যে স্তনের দুধ পান করে তারা বড় হয়েছে, সেই মাকে একা রুমে ফেলে রাখা পাষন্ডতা।

সাহানা প্রচন্ড ক্লান্তিতে কিচেনে সিংকের পাশের টুলে বসে পরে। গোসলের সময় দরদর করে গড়িয়ে পরা চোখের পানি মিলেমিশে আম্মা শেষ গোছল করেছেন। চোখে সুরমা পরিয়ে কাফন পরানোর সময় সাহানা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেছিলো। এত শাড়ি ছিলো যার, একদিন করে পরলেও সব শেষ করতে বছর তিনেক লাগবে। সেই মানুষটা আজ একটা সাদা কাপড়ে চলে যাচ্ছে।

ভাত নামিয়ে গরু আর সবজিটাও জ্বালিয়ে, ভুনা ডালে জিরার গুড়ো ছিটিয়ে চাক করে কাটা পেয়াজ আর লেবুর প্লেটা সহ টেবিলে দেয় সাহানা। রাত গহীনে, এতক্ষণ ধরে মানুষ গুলো বসে আছে। খাবার সামনে থাকলে নিয়ে খেয়ে নেবে। মানুষ বলতে লায়লা ভাবী, আরশাদ ভাই, ইফতি ভাই, আফিয়া আপা আর রাকিব। মুনা ভাবী তখনই চলে গেছেন। বাচ্চাদের নিয়ে লায়লা ভাবীর আম্মা ও বিদায় নিয়েছেন। লুপা- তূর্যটাও ঘুমিয়েছে। চুলায় চা’র পানি ঢিম’চে দিয়ে একটা শাওয়ার নেয় সাহানা। মাঝ রাত্রে এশার সালাত আদায় শেষে জায়নামাজে বসে থাকে। এই পৃথিবীটা কি প্রচন্ড স্বাথপর!

দৃশ্যপট -১১

দিন – রবিবার

ড্রয়িংরুমে খতম শেষে হুজুর মুনাজাত তুলেছেন। মরহুম রাদিয়া আক্তারের মৃত্যুর আজ ঠিক অষ্টম দিন। কুলখানির জন্যে ফখরুদ্দীন এর স্পেশাল কাচ্চি ভেতর বাড়ির আত্মিয় স্বজনদের জন্য আনা হয়েছে। সাথে মাথা পিছু রোস্ট আর শেষ পাতের জন্য মুনা এক বিশাল স্পেশাল রোজ পুডিং বানিয়ে নিয়ে এসেছে। মুনার আম্মাও তালপাটালির পায়েস করে এনেছেন, সাজটাও বেশ সুন্দর। বড় বড় মাটির রঙিন হাড়িতে মুখে সরাচিত্র আঁকা, সোনালী আর রূপালী রঙে মাখানো পাটের দড়ি দিয়ে নকশী কাটা বন্ধনে বাঁধা। রাদিয়া খানমের আপন ভাই, সাহানার বোন জামাই সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। দুজনেই বেশ গ্রামীণ মিষ্টান্ন গুলো পছন্দ করেন।

– আপু, কাচ্চির আলুটা কিন্তু জোস না?

– হুম ব্রো, বাট আমি আলু বোখারার চাটনি মিস করছি।
কাচ্চি উইদ আউট আলু বোখারা চাটনি হলো পুরাই ক্রাক ।

– মামী? তুমি কি একটু আলু বোখারার চাটনি ম্যানেজ করতে পারবা? আই মিন, মাম্মা, ইউজ টু কল ইউ ‘জিনি’। মানে কিভাবে যেন সবার সব কিছু তুমি বুঝে যাও। কার কি লাগবে। প্লিজ প্লিজ, একটু দাও না মামী। খাবারটায় ঠিক হাইপ পাচ্ছি না।

সাহানা টেবিলের চেয়ার ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। – ‘আচ্ছা দেখছি’ বলে ফ্রিজ থেকে আচারের বোয়ামটা বের করে লাবনীকে দেয়। ইংলিশ মিডিয়াম একটা বিজাতীয় সংস্কৃতি ছেলেমেয়েদের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে অনেক আগে থেকে। লাবনীর আজকের আচরণটা তারই বহিঃপ্রকাশ। আদব কায়দা বলে একটা বিষয় এই মাধ্যমে শেখানো হয় না বললেই চলে। সাহানার নিজের ছোট বোনটা ও একই পথের পথিক।

– মামী, আমাকে একটু কোক দেবে? এই গ্লাসে না, তুমি যে আমার জন্য মিনি ম্যাউস গ্লাস কিনেছো ঐ গ্লাসে।

– মৌরী মনি,এখন এটায় দেই, দোয়া হচ্ছে তোমার নানুর জন্য। দোয়া শেষ করে ওতে দেব মা।

আফিফা কাচ্চীর সাথে সাহানার হাতের খাসির কোরমায় মাত্র কচকচে একটা হাড্ডিতে আয়েশ করে কামড় বসিয়েছে। সাহানার কথা শুনে ওর পিত্তি জ্বলে গেলো। মৌরি একটা আবদার করেছে। মামার বাড়ি,কই তার মেয়েকে প্রাধান্য দেবে তা না? আম্মার দোয়া শেষ, এখনো ওসব নিয়ে ঢং দেখানো, লোক দেখানো বন্ধ হচ্ছে না এই মেয়ের। শয়তান মেয়েছেলে একটা, আম্মার সব জিনিষপত্র নিশ্চিত এর মধ্যে বাপের বাড়ি পাচার হয়ে গেছে। আম্মার পেতলের পানদান টা আসার পর থেকে খুঁজে যাচ্ছে সে। নাহ, কোথাও নেই। পাচার হয়ে গেছ, সব পাচার।

– ও ছোটমানুষ, ওরে আগে কোক দাও। দোয়া শেষ এখন আবার মুনাজাত তুলছ কেন?

– আম্মার সাথে আব্বার জন্য এক খতম পড়ানো হয়েছে আপা।

– বাহ্ ভালো তো, এই বুদ্ধি কার? নিশ্চয়ই তোমার। আত্মীয়রা সবাই দেখল বাড়ির বউ কত ভালো, আমরা ছেলে মেয়েরা চামার সব বেহায়া, বেত্তমিজ, বাপ মায়ের জন্য কিছুই করিনা।

– আপা, এভাবে বলছেন কেনো? আমি তো ভালোর জন্য বলেছি। আপনি পারলে আপনিও পড়ান, হুজুর তো আছেই।

ডাইনিং থেকে কিচেনে ঢুকে আর্জিনাকে খাবার দেয় সাহানা। আফিফা আপা সাথে করে ওকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা জীবনে প্রথম বোধহয় এই খাবার খেলো, মুখে দিয়েই মশলার জন্য খেতে পারল না ঠিক, বাচ্চাদের জন্যে নিয়ে নিলো। আর্জিনারকে গরম ভাতে তরকারী নিয়ে খেতে বলতেই কেঁদে দিলো মেয়েটা। আজব তো! আফিয়া আপা নাকি ভাত প্লেট দিয়ে মেপে খেতে দেয়। চাল জমিয়ে কি করবে এত আপা? কবরে নিয়ে যাবে?

দৃশ্যপট – ১২

– দইটা কি লোকাল রাকিব? বাচ্চারা আবার এসব জায়গার জিনিষপত্র খায় না। ঐ মন্ডাটা দাও।

– মুনা ভাবী, মন্ডা না ওটা, ওটাই লোকাল লাড্ডু, দই আমি বগুড়া থেকে আনিয়েছি। আপনি কি মিষ্টিতেও আজকাল ব্রান্ড খান?

দেবরের খোঁচাটা হজম করে মুনা। আজকেই তার এ বাসায় শেষ আসা। এরপর আসবে যেদিন বাড়িটা ভাঙা শুরু করে। একগাদা বাজে স্মৃতি এই বাড়ি ঘিরে তার রয়েছে। লায়লা ভাবীর মতামত জেনে নিলে ভালো হতো। কুলখানী উপলক্ষে পরা হোয়াইট কারচুপির ড্রেসটা এখন চুকাচ্ছে। একটা ম্যাক্সি পেলে হয়। সাহানার কাছে নিশ্চয়ই থাকবে একটা এক্সট্রা।

আরশাদকে মন্ডা আর দই একসাথে বাটি করে দেয় আফিয়া। ভাইয়া দই মিষ্টি একসাথে খেতে পছন্দ করে। দরকারী কথা আজকে বলে ভাইদের মত নিয়ে রাকিবের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাতে হবে। লুপা- তূর্যের জন্য জামা ও নিয়ে এসেছে এজন্যে। আরশাদ নিঃশব্দে বাটি নেয়। আফিয়ার হাতে মায়ের বালা গুলো খেয়াল করেছে সে। এগুলো আফিয়ার হাতে কি করছে?

লায়লার খারাপ লাগে। এই বাড়িটা তার শ্বশুড়ের নিজের হাতে গড়া। যে ক বছর এখানে সে ছিলো, সুখের চেয়ে অশান্তি হতো বেশী, তবু ভালো লাগত। গাছপালা আর মায়ায় জড়ানো। ছেলে নিয়ে সীমাহীন আধিখ্যেতা না থাকলে এখানে একসাথে থাকা গেলে মন্দ হতো না। একটা সংসার মানুষ তিল তিল করে গোছায়। সেখানে নতুন একটা মানুষকে জায়গা দিতে হয়। তেমনি জায়গা করে নিতে হয়।

লায়লা আর আরশাদের আম্মা দুজনই দুজনের কাছে সব সময় ভালোটা খুজেছে। একে অপরের দোষে দোষারোপ করেছে, এগিয়ে এসে মিটিয়ে নেয় নি। আজকের এই ক্লান্ত বিকেলে একলা ছাদে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে কেঁদে ফেলে লায়লা। আরেকটু সহনশীল সে হতেই পারত। তারও একটা ছেলে আছে। বছর কুড়ি পর আরেকটি মেয়ে এসে তার হাতে তৈরী সংসারের মালিকানা চাইলে সে নিজে কতটুকু পারবে, সেই মেয়েটিকে বুকে টেনে নিতে?

মুনা অনেক খুঁজে শেষে ছাদে এসে লায়লাকে দেখতে পায়। হুম ছাদটা বেশ সুন্দর করে গুছিয়েছে সাহানা। একপাশে বসার চেয়ার। তার পাশ ঘিরে টাইলস বাঁধানো বসার বেঞ্চ। অন্যপাশে একটা তেপায়ার উপর টং দোকানের চায়ের কাপ। পাশেই একটা বড় প্লাস্টিকের বক্সের ভেতর বই। এ জায়গাটা ছাউনি দিয়ে ঘেরা। বৃষ্টির সময় এখানে বসেই গান করেন তাহলে উনি। বাড়ির দখল এভাবেই একটু একটু করে নিচ্ছে বদমাশ মেয়েটা। আফিফা আপাকে এভিডেন্স সহ দেখাবে বলে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় ঝটপট। লায়লা বসে আছে একটা মোড়ায়, পেছন ফিরে, শরীরটা কাঁপছে মৃদু। হাসির কোন মুভি একলাই দেখছে মনে হয়, লায়লার কাছে এগিয়েই ঘোর কাটে মুনার। নিঃশব্দে কাঁদছে লায়লা, হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো কর, অস্ফুট একটা বাক্য শোনা যাচ্ছে,

_ আম্মা, ক্ষমা করবেন…

দৃশ্যপট – ১৩

— ভাইয়া, আমাদের আলোচনা শুরু করা দরকার। দুপুর গড়িয়ে কিন্তু বিকেল হয়ে গেছে। কাল সকালে স্কুল, বাচ্চাদের হাউস টিউটরকে আজ না করেছি, কাল তো দেখি স্কুল বন্ধ করতে হবে, এমন হলে।

— মুনা, একদিন স্কুল না গেলে কিছু হবে না। এত তাড়াহুড়ো করো না। রাহার ও এক্সাম চলছে। আমি স্কুল থেকে পারমিশন নিয়েছি ওর গ্রান্ড মম মারা গেছেন বলে।

— আপনাদের কি মনে হয়, ভাগাভাগির বিষয়গুল আজকে ফাইনাল করে গেলে ভালো। তাহলে সময় নষ্ট কম হয়।

— চা হয়ে এলো। একবারে রাতে খেয়ে যান। ওবেলায় এত খাবার রয়ে গেলো। বাবুরাও তো বেশ মজা করে খেলো। কত আনন্দ নিয়ে খেলছে কাজিনরা মিলে। একবার ছাদে গিয়ে দেখে আসুন, সব গোল হয়ে বসে গল্প করছে, লুডু খেলছে, দাবার বোর্ড দিয়ে আর্জিনাকে পাঠিয়েছি। ওহ, আফিফা আপা, আর্জিনাকে কিছু খাবার দিলাম, আর কিছু টাকা, আম্মার কয়েকটা শাড়ি দিব যাবার সময়। খুব অভাবী মনে হলো।

মুনা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাহানার দিকে। এই মেয়েটা এত বেশী কাজ করে কেনো? ওকে কে বলেছে দাতা হাতেম তাই সাজতে? শয়তান চালাক একটা। এত বদমায়েশ মেয়ে, তলে তলে সব গুছানো শেষ, এখন ছোটলোককে হাত করে আপার মনে জায়গা করে দল ভারী করার ফন্দি এঁটেছে। আফিফা আপাও গাধা না হলে ধমক দেবে। আরেক জনের বাসার লোককে যে তার পারমিশন না নিয়ে কিছু দিতে হয় না এটা শেখেইনি এই মেয়ে।

আফিফার গা কিটকিট করে রাগ বেয়ে পরছে। শয়তানের জাত শয়তান। বদের হাড্ডি, আর্জিনার কাছে মালিককে খারাপ করে নিজে সাধু সাজা হচ্ছে। আর্জিনাকে বাড়ি নিয়ে টাইট দিতে হবে ভালো মতন।

— সাহানা, আমার লোককে তোমার এত দরদ দেখানো লাগবে না। আমিই যথেষ্ট ওর জন্য। আমার ধারটা শোধ হলে ওকে লাত্থি দিয়ে বের করে দেবো। তখন দরদ দেখিয়ে তোমার বাড়িতে ওকে ফ্যামিলি সহ নিয়ে এসো। এসব থার্ড ক্লাস লোকজনের জন্য তোমার মন এত নরম হয় কেনো? আত্মীয় স্বজন তো সব ভালো ভালো। আজ দেখলাম মমতার মা কে ডেকে প্লেটে খাবার দিচ্ছো। ওর যে যক্ষা জানো? নিজে মরবে ভালো, মরো না। আমরা থাকতে এসব নোংরা বাসায় ঢুকাবে না। একদম না।

— আপা, উনি তো আপনাকেই কোলে পিঠে মানুষ করেছে, আম্মা বেঁচে থাকতেও ওনাকে সাহায্য করতেন। আজকে উনি নাই, সেজন্য ঢুকতে দেবো না? বদদোয়া দিলে?

— শোনো, বাসাটা তোমার না, আমারদের। নিজের মত কম চালাবা। এত পকর পকর নিজের বাসায় করবা। আম্মা মরছে মানে তো এই না, তুমি মালিক হয়ে গেছো। মুনার কাছে শুনলাম, ছাদে নাকি কি সব বসিয়েছো। এগুলা করলা কখন। আবার দেখি আজকাল গার্ডেনিং টিপস দেও। এসবই তো করছো, আম্মাকে আর দেখছো কখন? সব কাজের লোকজন করলো। মাঝে নিজের নাম কামায় নিলা।

সাহানা স্তব্ধ হয়ে শোনে। জবাব দিতে গিয়ে ও চুপ করে যায়। এত ঘেন্না কেনো এই মহিলার মনে তার জন্য? রাকিব আর তার লাভ ম্যারেজ বলে? বিয়ের দিন থেকে এর জিহ্বার অত্যাচারে সে কষ্ট পেয়েছে। মাঝে মাঝে আম্মা মাফ চেয়েছেন নিজের মেয়ের ব্যবহারে। মেয়েকে মানুষ করতে পারেননি। ইফতি ভাইয়ের উপর আক্ষেপ নিয়ে মরেছেন। জীবন এত ছোট, মানুষের মন ও এত ছোট, তবু জীবনে মানুষেরা হোলি খেলে আপন রক্তের বন্ধন নিয়ে।

আরশাদ খুব গম্ভীর মুখে ড্রইং রুমে ঢোকে। পেছনে রাকিব আর তার পরেই ইফতি। ভাইরা এতক্ষণ আলোচনা করে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আব্বার মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি ভাগ হলেও পৈত্রিক এই বিশ কাঠার বাড়িটার ভাগাভাগি হয় নি। আম্মার নামে মালিকানা থাকায় তারাও কেউ বিষয়টা নাড়া দেয় নি।

আম্মা পছন্দ করতেন না বাড়ি ভাগাভাগির বিষয়টা। ভাগ করার বিষয় এলেই এড়িয়ে গেছেন বারবার। ইফতি তো রাগ করে বলেই ফেলল, বুড়ি ঝামেলা পাকিয়ে গেলো। “বুড়ি”? আরশাদ কিছু বলতে গিয়েও থেমে থেকেছে। রাকিবের হাতের পেশীর টানটানে হয়ত মেরেই বসত ইফতিকে। তবু কিছু না বলে আরশাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো রাকিব। রুমে ঢুকতে ঢুকতে আফিফার কথা গুলোও কানে এসেছে তার।

— আম্মা যেহেতু কোন উইল করে যান নাই, আমরা ভাইরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়ি ভেঙে ডেভলাপার কে দেবো।ওটা ওয়ারিশান সূত্রে ভাগ হবে। তারপর জমি ও বাড়ি ভাগ করে মুরুব্বীরা সহ বসে আমরা যে যার অংশের মালিকানা বুঝে নেবো।

— আমি ওয়ারিশান টোয়ারিশান মানি না। সমান ভাগ করবা। আমি মেয়ে বলে আমাকে কম দিবা কেনো? এসব টাল্টিবাজি করবা না ভাইয়া। নিজের বউ এর সম্পত্তির বেলায় সমান ভাগ, আর বোনের বেলায় ওয়ারিশান! এগুলা সব তোমার শাশুড়ির বুদ্ধি না? চিকন বুদ্ধির মহিলা, ভালোই বুঝাইছে তোমাকে। আর ভাবী, তুমিও কেমন, নিজের বেলায় সমান নিলা, আমাকে দিলা ওয়ারিশান? এইটাই তোমার জেন্ডার ইকুয়ালিটির শিক্ষা না?

— আফিফা! থামবে তুমি? ছিঃ ছি, এত নোংরা তোমার মনে জমে ছিলো? কোন সাহসে আমার আম্মাকে নিয়ে কথা বললে তুমি? তুমি না গভমেন্ট সার্ভিস করো, এত ভালো পদ, এত কিছু, তারপরেও লোভ কেনো তোমার। তোমার জামাই কে তো আসতেও দাও না কোন গ্যাদারিং এ। আজকেও বাহানা বানিয়ে রেখে আসছো। যদি তোমার উপরে কথা বলে বসে?

মুনা খুব কষ্টে চুপ করে ছিলো। রাত আটটায় তার স্কুলের ভাবীরা নেটে ফেন্সী ড্রেসের পার্টি করবে। সেটা লাইভ হবে কিচিরমিচির লেডিস গ্রুপে। এসব হচ্ছে লাইম লাইটে আসার বিষয়। কত দিন ধরে এই লাইভের এ্যারেন্জমেন্ট করেছে সে। বাসার একটা কর্ণার লাইভের মত করে সাজিয়েছে। ওয়াল পেপার থেকে সোফা পর্যন্ত বদলে একটা নতুন গোল্ডেনের উপর ব্লু কাজ করা রয়েল লুক ডিভান নিয়েছে। সাইডে টার্কিশ ল্যাম্প, প্লান্টস। উফ, আজকে তো আসতোই না। শুধু ইফতি খুব রাগ করে বসবে, বাঘা বাঘা লোকজন আসবে, আর সম্পত্তির হিসাব টা তার উপস্থিতিতে বুঝে নিতে হবে।

— আমার এত কথা শুনে কাজ নেই। আমাকে বলেন কবে থেকে কাজ শুরু হবে। আর বাড়ি আপাতত ফ্লোর ধরে ভাগ করে দেন। আমি আমার ফ্লাট ভাড়া দিয়ে ডেভলাপার পাবার আগ পর্যন্ত ভাড়া খাই। আরশাদ ভাইয়া, আমি উপর তলা নেবো। এখানে ফিটিংস সব পুরনো। আর বাসার ডিজাইন ভালো না। আপনারা তার উপরের টা নেন। এটা আফিয়া আপাকে দিয়ে দেন।

— সব নতুন ফ্লাট নিজেরা নিয়ে আমাকে বস্তা পঁচাটা গছাচ্ছো কেনো মুনা। তোমার এত খাইখাই তুমিই নাও। আমাকে যেটা দেবে, আমি ওটায় অফিস বসাবো। ভাড়া বেশী, লাভ বেশী। আব্বা – আম্মার এটা মরতে নেবো নাকি? সব পাল্টে নতুন লাগাতে হবে। উঁহু, দেখিত কে দেয় আমাকে পুরানো ফ্লাট।

ইফতি বসে বসে ছোটবেলার এ্যালবাম দেখছিলো। একটা ছবিতে আম্মার কোলো আফিফা আপা, হাতে আরশাদ ভাইকে ধরে রেখেছে। আপা একটা হাত দিয়ে আরশাদ ভাইয়ার জামা খামচে আছে। আম্মার মুখে কি সুন্দর হাসি। আব্বা পাশে মোড়ায় বসে হাসছেন। অন্য ছবিটায় নিম গাছের ছায়ায় ইফতি আর রাকিব একটা বোলের মধ্যে পানিতে বসে আছে, পাশেই আম্মা বসে মগ হাতে বসেছেন। এখনি দু’ভাইকে গোসল দেবেন।

অন্য ছবিটায় আব্বা আম্মার ইউরোপ বেড়াবার ছবি। ইউরোপ ট্যুর থেকে ফিরেই আব্বা চলে গেলেন। আব্বার মুখটা এখনো ভাসে। কর্মঠ, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৎ থাকা একটা মানুষ, হাসি হাসি মুখ। তারপরেই তাদের চার ভাই বোনের হাত ধরাধরি করে কক্সবাজারে তেলা একটা ছবি। সবার জন্য পেছনে শামুকের মালা আর বার্মিজ আচার কিনে বসে থাকা আব্বা- আম্মাকে কি হাসি খুশী দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, সে মরে গেলেও কি তার মেয়েরা সম্পত্তির সংঘাতে, স্বার্থের ভারে ভুলে যাবে তাদের বাবা, একটা প্লেটে নিয়ে ভাত মেখে খাওয়াতো দু বোনকে?

দৃশ্যপট- ১৪

রাকিব একমনে এক জোড়া বুলবুলি পাখির বাসা বানানো দেখছে। মেয়ে পাখিটা কি সুন্দর ঠোঁটে সেলাই করে নিচ্ছে বাসাটা। ছেলে বুলবুলি শুকনো গাছের ডাল, তাজা ঘাস তুলা, ঘাস ফুল এনে দিচ্ছে। অবিশ্রান্ত গতিতে একের পর এক উপকরণ যোগান দিচ্ছে বউ পাখিকে। ছেলে পাখিটা বাসার সামনে একটা করে উপকরণ এনে অপেক্ষা করে। মেয়ে বুলবুলি বাসা বানাতে বানাতে ক্লান্ত, সেও মুখ বাড়িয়ে যাচাই করে নতুন ঘাসটি। পছন্দ না হলেই মুখ ঘুরিয়ে আবার কাজে লেগে পরে। ছেলে পাখিটি ব্যর্থ মনোরথে কিছু সময় বাতিল ঘাসটি নিয়ে এদিক সেদিক চায়। তারপর মুখ থকে ফেলে দিয়ে আবার উড়াল দেয়, — ফুড়ুৎ!

বাসাটা ভাগাভাগি নিয়ে সবাই দরকষাকষি করে চলেছে। সে বা সাহানার কথা একবার কেউ ভাবছেনা। সাহানা মেয়েটার জন্য মায়া হয় রাকিবের। একটা মানুষ পরপর দুটো মৃত্যু চোখের সামনে দেখে কতটা বদলে যেতে পারে, সাহানাকে দেখলে বোঝে সে। সাহানকে হাতে কাগজ নিয়ে বসার ঘরে যেতে দেখে পিছু নেয়।

— সাহানা, আমরা কেউ এই ফ্লোর নিচ্ছি না। এখন তোমরা যদি চাও তো উপর তলা নিতে পারো। আফিয়া, ইফতি বাকি গুলো নেবে। আমি এটা নেবো। ডেভলাপার বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্লাট করলে তখন ভাবা যাবে।

— বাড়ি তো ভাঙা হচ্ছে না ভাইয়া। এ বাড়ির মালিক এখন আমি। আমার এ বাড়ি ডেভলাপারকে দেবার ইচ্ছে নেই। এই ফ্লাট কেনো, সব ফ্লাট ও আমার। আপনাদের মা বাবার ঘর, আসা যাওয়া করবেন, ভাইয়ের বাড়ি আসবেন। কিন্তু এখানে আপনাদের এক কানা কড়িও নেই। ওহ, আরশাদ ভাই আপনাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছে আম্মা। সেটা দেখতে প্রতি মাসে আপনার আসলেই চলবে।

আফিফার মাথায় বজ্রপাতের মত কিছু একটা অদৃশ্য ভাবেই ভেঙে পরেছে। বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে আফিয়া,

— লোভী, জোচ্চর। রাকিব, তোর বউ এই জন্য এত দিন আম্মার পিছে পিছে চলেছে। এতদিনে ফললো তো আমার কথা। নিমকা শয়তান মেয়ে। বাবারে বাবা, কি চালু মেয়েরে। আমরা ছেলে মেয়ে পর হয়ে গেলাম, আর তুমি মালিক হয়ে যাবা। এত সহজ না সাহানা, আমি মামলা করব। বলব, আমার আম্মাকে ফুসলায় তুমি জায়গা বাড়ি হাতায় নিসো।

মুনা কিছুটা শকড এবং অপ্রস্তুত হয়েছে। এই মেয়ে বলে কি? এই সাহানকে তার শাশুড়ি সব দিয়ে গেছে? এমন জানলে গ্লভস পরে না হয় মুনাই কয়দিন এসে বমি কাঁচাত। এখন কি হবে, ভবিষ্যতের সব প্লান ভেস্তে যেতে দিবে না মুনা। দরকারে এখানে এসে জবরদস্তি করে উঠে যাবে, মামলা করবে। কোটি টাকার সম্পদের জন্য না হয় থাকলো কিছু দিন এই বাজে জায়গায়। আফিফার সাথে মামলা করবে সে। এবার এক হাত দেখে নিতে হবে চালাক শয়তানটাকে।

— এখনি চলেন আফিফা আপা, আমার সব বোঝা হয়ে গেছে। আম্মাকে জোর করে সাইন নিয়েছে এই মেয়ে। এই মেয়ের চিমসা পেটে হাজার হাজার বুদ্ধি। ওরে বাব্বা, ডেকে দাওয়াত দিয়ে শেষে এই বাড়ির ওয়ারিশানদের বলছে, তোরা ভাগ? এ বাড়িতে তোদের কোন ভাগ নেই? কূটনীতিবিদ একটা। এজন্যই এত দিন সেবার করার নাটক করেছে। আমার তো শুরু থেকে সন্দেহ ছিলো। আম্মার গলা চেপে এসব হাতিয়েছে কিনা তাই দেখেন।

সাহানার বাড়ানো কাগজটা মন দিয়ে পড়ে আরশাদ। সাইনটা আম্মার। সুস্থ অবস্থায় সাইন করেছেন। সাক্ষী হিসেবে সব পরিচিত মানুষ। যে সকল শর্তাদী আরোপ করেছেন তার একটাও সাহানা বাদে অন্য কারো পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। লায়লার দিকে তাকায় আরশাদ। কাগজটা পড়ার উদগ্রীব বাসনা ওর চোখে মুখে। লায়লাকে কাগজটা দিয়ে প্রচন্ড অপ্রস্তুত বাকি দুভাই, ইফতি আর রাকিবকে টেনে অন্য ঘরে নিয়ে যায় আরশাদ।

ভাইদের সাথে বোঝাপড়াটা সে এবার একা করবে। সংসারে সাপ মাথা তোলার আগেই লাঠি না নামলে বটবৃক্ষের গোড়ায় তার শিকড় ছেদ্র করে ক্ষয় শুরু করে। কাল সাপের খোড়া সুড়ুঙ্গে মাথা ঢোকায় অজগর। তার পর সার বেঁধে জড়ো হয় স্বর্ণলতা। চুষে খেয়ে নেয় বটবৃক্ষের রস। মাথা তুলে লতানো স্বর্ণ, সাপের বিচরণ ভূমি। অন্তঃ সার শূণ্য বটের খোঁয়াড় মৃত কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অবহেলায়।

— আফিফা, তুমি পড়বে? মুনা পড়তে চাও? পড়ে দেখলে ভালো। নয়ত মামলা করতে পারো তোমরা। তাইতো, সাহানা খুব বড় দাও মেরে দিলো।

— কিছু পড়তে হবে না ভাবী। আমি উকিলের চেম্বার হয়ে বাসায় যাবো। এই মুনা, তোমার ছাগল জামাই, আমার গাধা ভাইটাকে নিয়ে আসো। এসব জিনিস টাটকা ধরতে হয়। দুইটা কেসে ফাসাবো ওরে আমি। আপনাদের সবাইকে হকের সম্পত্তি যদি না দেই আমার নাম ও আফিফা না।

সাহানা নিঃশব্দে হাসে। এমন কিছু হবে আগেই জানত সে। সব সময় এই পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই ভয় পেয়ে এসেছে। আজকে একটু ভয়ও লাগছে না। বেশ দেখার মত হয়েছে, আপা আর মুনা ভাবীর চেহারাটা। মুখের সামনে এতদিন ধরে জমানো কথা গুলো আজ বলে দিলো,

— নিজের মায়ের হকটা আদায় করতে কয় বার এসেছিলেন আপা অসুস্থতার সময়ে? যখন আসতেন, তার আগে ফোন করে হুকুম, আপনার মেয়ে রুই মাছ গরম ভাজা খাবে, আপনি তেলাল কৈ। নিজের সংসারে একদিনের জন্য নিজের বাবা মাকে রাখতে পারেননি। স্বামীকে চালান মুনি মজুরের মতো। রাকিবকে বুদ্ধি দেন, আমাকে যেন মেপে টাকা পয়সা দেয়। নয়ত আমি উড়নচন্ডি বউ হয়ে যাবো। আম্মা আপনার কাছে একদিন রসবড়া খেতে চাইলো। কি করলেন আপনি? আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনতে পাঠালেন। সামান্য এক কেজী মিষ্টি কিনতেও মায়ের জন্য যে মেয়ের হাত শুকিয়ে যায়, সে কোন মুখে এত বড় কথা বলে?

দম নেয় সাহানা। আজকে তার মুখের বাঁধ খুলে গেছে। পর্দা সরিয়ে তিন ভাই কখন এসে থমকে তার কথা শোনা শুরু করেছে খেয়াল করল না সাহানা। লায়লার হাত থেকে কাগজটা নেয়।

— এই যে মুনা ভাবী, খুব তো ক্লাসি মানুষ আপনি। কথায় কথায় ক্লাস। বেগুনে ক্লাস, পটলে ক্লাস, মেয়েদের ও এমন ক্লাসি বানিয়েছেন, আপন দাদী মরে গেলেও দেখতে আসা যাবে না। আমি তো খুব খারাপ। সব স্বার্থের জন্য করেছি। তা আপনি কেন একবেলা এই বুড়োবুড়িকে এক কাপ চা ও খাওয়াতে পারলেন না আপনার সংসারে?

— মুখ সামলাও সাহানা, চোরের মার বড় গলা, আজকে পুরা কালপ্রিট বানাবা আমাকে ঠিক করে রেখেছো না? লায়লা ভাবী আপনি বিচার করছেন না কেনো? আমরা ভাগ চাওয়াতে এই মেয়ে তেড়ে আসছে?

— আপনাদের ভাগ মেরে দিয়েছি আমি? আপনি যে ওনাদের জ্বলজ্যান্ত ছেলেটাকেই পর বানিয়ে গায়েব করে আঁচলে গিট্টু মেরে রাখলেন। তখন গুনাহ হলো না? আমি গার্ডেনিং করে বাড়ির ছাদ দখল করেছি, বিচার দিলেন সবার কাছে।এখন যদি বলি, আপনিই দুঃখ দিয়ে মেরে ফেলেছেন ওনাকে?

চিৎকার করতে করতে সিড়ি বেয়ে নেমে যায় আফিফা আর মুনা। দুজনেই উকিল ঠিক করে নিজেদের সম্পত্তি বুঝে নেবে। বাচ্চা গুলো মাদের পেছন পেছন নেমে যায়। খোলা ছাদের শীতলপাটিতে বেছানো লুডুর ঘরে, একসাথে দুটো গুটি অজগরের মুখে পরেছে। দাবার বোর্ডের লাল গুটিটা আরেকটা শটে কর্ণারে পাঠানো দরকার। দাগ কাটা এক্কা দোক্কার ঘর গুলো, ঝেঁপে আসা বৃষ্টির মিহি ফোঁটায় একটু একটু করে ধুঁয়ে যাচ্ছে। Rain rain go away come again another day, রাইমসটা তালে একা একা মাথা দোলাচ্ছে তূর্য। সিড়িতে মমতাজ আহমেদ – রাদিয়া আক্তারের যুগল ছবিটি হাসি – হাসি মুখে দৃশ্যত, অদৃশ্য অদৃষ্টে তারা আপাতত কেমন আছেন সন্তানদের স্বার্থের সংঘাতে তা অবশ্য বোঝা যায় না।

পরিশিষ্ট :

রাদিয়া মঞ্জিলে আজ ভীষণ খুশীর দিন। লুপা – লাবিবা, মাইশা, লাবনী, মৌরি, রাহা, মুহাম্মাদ লনে খেলছে। বাড়ির সামনে কিছু গাড়ির ভীড়ে সাধারণ পথচারী বেশ কৌতুহলী হয়ে উঁকি দিতে চাইলেও গেটে দাঁড়ানো নিরাপত্তা রক্ষীদের কারনে পারছে না। একপাশে দর্শনার্থী সহ আত্মীয়দের ভীড় জমে আছে।

কমবয়সী এক আত্মীয়ের কাছে বেশ হাত মুখ নাচিয়ে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে মুনাকে। লাইট ইক্কাতের মাঝে কন্ট্রাস্ট গঙ্গা যমুনা পাড়ের শাড়িটা সে কালই দর্জিবাড়ি ডিজাইনার হাউস থেকে কিনেছে। ইফতিকে এত চেষ্টা করল কুর্তি সেট পরাতে, ইফতির সাথে এখন কথা বলতে ভয় লাগে মুনার। সেদিনের পর বাসায় গিয়ে উল্টো ওকেই ওর বাবা মায়ের সামনে ভরন পোষণ দিয়ে ছ মাসের সময় দিয়ে দিলো! এ বয়সে সংসার হারা হলে ভাবীরা কি বলবে? সোসাইটির কাছে জামাইকে নিয়ে কত গর্ব মুনার। ওর নিজের কখনো লেখাপড়ার দিকে ঝোঁক ছিলোনা। সংসারের বাহানা দিয়ে ইফতিকে কব্জা করে রেখেছে সবসময়। হাতের পাশাটা হাত ছেড়ে বেরোবার আগে সামলে নেয়া ভালো। বাচ্চাদের হারাতে চায় না সে।

“ঘর- একটি বয়সী শিশু পূনর্বাসন কেন্দ্র ” রাদিয়া মঞ্জিলের নতুন নামের উদ্বোধন করা হয়েছে। শাটারের ঘণ ঘণ ফ্লাসে তূর্যের মায়ের কোলে বেশ সমস্যা হলেও, সাহানা ছেলেকে চেপে রেখেছে বুকের কাছে। এ শহর এখন স্বার্থের হাতে প্রতি ক্ষণে বন্দী। মৃত্যুর আগেই সন্তানদের চেহারা চিনে যাওয়া রাদিয়া আক্তার সম্পূর্ণ বাসস্থান উইলকৃত সম্পদের মালিকানা হস্তান্তরে সাহানার হাওলায় শর্তাদী আরোপে দিয়ে গেছেন। এ বাড়ির এক তৃতীয়াংশ বানিজ্যিক কাজে ভাড়া খাটানো হবে। বাকি এক চতুর্থাংশে গড়ে উঠবে বয়স্ক আশ্রয় কেন্দ্র। ভাড়া লব্ধ মাসিক আয়ের থেকে ব্যয় কৃত অর্থের সাথে সাহানার নামে একটি মাসিক স্যালারী একাউন্ট খোলার নির্দেশনা রাখা হয়েছে। আরশাদের তত্বাবধানে লেনদেনের সামগ্রিক হিসাব রাখা হবে।

আফিফা তার কয়েকজন সহকর্মী সহ অনুষ্ঠানে এসেছে। আজ স্বামী মৃধা সাহেবকেও সঙ্গে এনেছে আফিফা। আপাতত, এ বাড়িটা গেলেও পূবাইলের একটা জমি ভাগাভাগি বাকি। ওটার মালিকানা থেকে নিজের নামটা বাদ পরুক চায় না। দিন দুনিয়ার ঠিক নেই। স্বার্থপর সময়ের স্বার্থবাজ মানুষের আপাত দৃষ্টির চিরস্থায়ী সুখের ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায়, শ্বাসের গ্যারান্টির মালিক উপর ওয়ালা। তাই নিজ স্বার্থটা গুছিয়ে ভালো মানুষ সাজার শুরুটা করে দিচ্ছে আফিফা। কে জানে? তাকে না আবার কবে এই সাহানার গড়ে তোলা তারই মায়ের বাড়ির বৃদ্ধ আশ্রয় কেন্দ্রে বসত গাড়তে হয়!

শেষ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here