স্বার্থ পর্ব-1

0
1787

স্বার্থ
পর্ব-1

রাদিয়া আক্তার মৃত্যু বরণ করছেন । এখনো তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখের পাতা তিরিতির কম্পমান। ডান হাতের তর্জনী নির্দেশে পশ্চিম দিকে নির্দেশিত। কন্ঠস্বরের শেষ উচ্চারণের ‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহার’ – ‘হ’ বর্ণের একটা ক্ষীণ ধ্বনি চেষ্টা করলে হয়ত ইথারে ধরা সম্ভব।

সারা শরীর শীতলতার চাদরে ঢাকা। পায়ের পাতা ঠান্ডা হয়ে গেছে মিনিট দশেক, হাতের তালু থেকে বুকের উপরিভাগ প্রচন্ড শীতল। যে বুকটা গত বাহাত্তর বছর ধরে বিশ্বস্ততার সাথে ভালোবাসা বিলিয়ে গেছে সরবে বা নীরবে তার সন্তান ও নাতি নাতনিদের, সেটাই আজ প্রচন্ড রকমের অবিশ্বস্ততা করেছে তার নিজের সাথে।

মরে গেছেন রাদিয়া বেগম, তার স্থির চোখের হালকা ঘোলাটে মনি থেকে আর কখনো দু’ফোঁটা নোনা জল, জায়নামাজের বিশুদ্ধতম জমিনের উপর সন্তান- সন্ততির মঙ্গলাকাঙ্খায় গড়িয়ে পড়বে না। রাদিয়া আক্তার ঠিক মাত্রই মারা গেলেন।

দৃশ্যপট -১

সাহানার ডান হাত অবশ লাগছে। তার তীক্ষতম জ্ঞান বারবার জাগ্রত করছে, শ্বাশুড়ি আর নেই। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মারা গেছেন তারই হাতের উপর মাথা রেখে।চোখের মনি দুটো এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকানো। যেমনটা গত রাতেও ডায়াপার বদলানোর সময় এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিলো। যেমন করে হাসপাতালে প্রতিবেলা খাবার খাওয়ানোর সময় তাকিয়ে থাকতেন। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর গোসলের সময়, রাতে শেষ ঔষধ খাওয়ানোর সময়, অথবা সম্পূর্ণ নিজের হাতে খেতে পারার আগ পর্যন্ত, প্রতিবেলা খাবার খাওয়ানোর সময়।

সাহানার পরের ধাপটা হয় দ্রুত। দু’হাতে রাদিয়া আক্তারের বুক চাপতে থাকে। নাক বন্ধ করে মুখে কৃত্রিম শ্বাস -প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে। বুক চেপে নামিয়ে দেয় নিচের দিকে। টানা কতক্ষণ করল মনে নেই, কেবল ঘরের কাজের মেয়েটা তাকে সরিয়ে নিয়ে পাশের সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। শ্বশুড় বাড়ির দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়িচালক আসলাম, নতুন গাড়ি চালক সাহেদ দুজন মিলে রাদিয়া আক্তারকে উত্তর শিথান করে দিচ্ছে। পায়ের কাছে গুটিয়ে থাকা চাদরটা দিয়ে রাদিয়া আক্তারের মুখ ঢাকতে যেতেই সাহানা চিৎকার করে ওঠে,

— মুখ ঢাকবেন না…

দৃশ্যপট – ২

আরশাদ চরম বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। আজকে সারা দিন আম্মার সাথে কাটিয়ে মাত্রই বাসায় এসে ছেলের পড়া ধরতে বসেছে। ছেলেটা ক্লাস টুতে পড়ে। করোনার জন্যে অনলাইনে ক্লাসের ফাঁকে টিচাররা পড়া তো দিচ্ছেই, ভিডিও কলে পরীক্ষায়ও নিচ্ছে। ছেলের মা ব্যাংকে চাকুরীরত। তাই সপ্তাহে ছেলে মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্বটা দুজন ভাগ করে নেয়া। বড় মেয়েটা আজকে সারাদিন দরজা বন্ধ করে ছিলো। একটা নতুন সেল ফোন লাগবে। বাবার পুরনো ফোন দিয়ে আর চলছেনা। সাথে ফোনটা ভাইয়ের সাথে ভাগাভাগিতেও আপত্তি।

— রাহা, তুমি যা চাইছো তার জন্য। আরো বছর দুয়েক অপেক্ষা করো।
— বাবা, সেল ফোন লাগবে না।
— লক্ষী মেয়ে, চলো খেয়ে নিবে।
— বাবা, আমার একটা ট্যাব লাগবে।
— কি? ট্যাব লাগবে কেনো?
— আইপ্যাড লাগবে, সবাই আজকাল এটা ইউজ করে। প্লিজ বাবা।

লায়লা সারাদিন মেয়ের কথা শুনেছে। মেয়েকে বুঝাতে তার ভালো লাগছে না। এগুলো হলো বংশের জেদ। রক্তের খারাপ দোষ। সে বুঝিয়ে কি করবে। নিজের স্বামীকে বোঝাতে বোঝাতেই তার নিজের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মেয়েও হয়েছে বংশের মতন।

— মেয়ে ট্যাব চাচ্ছে, বুঝতে পারছো না?
— এটা কি? এতটুকু মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে, ও ট্যাব দিয়ে কি করবে?
— এত টুকু মেয়েকে বোঝাও তাহলে।
— তুমি বোঝাও, আমি সারাদিন বাইরে ছিলাম। তুমি তো বাসায়।
— এখন এসব কথা না বললে হয় না।
— এত বছর পরে রিয়ালাইজেশন হয়ে বলছ? মেয়েকে সামলাতে পারলে সামলাও। আমি পারব না। এসব জিদ তোমার মায়ের ছিলো, পেটে নিয়ে যা দেখেছি, তাই হয়েছে। জিনের মধ্যে আছে না? কোথায় যাবে সেগুলো?

ইনকামিং কলটা কেটে দিয়ে আরশাদ চুপ করে থাকে। আসলেই তার কিছু বলার নেই। লায়লার প্রতিটা কথা সত্য। মধ্যবয়সে এসে এখন সত্যিকার ভাবে সে তার মাকে চিনতে পারে। কৈশরে কোন বন্ধু হতে দেয়নি মা। সব সময় নিজের সাথে আটকে রেখেছে। যৌবন শুরুতেও একই চিত্র। বিনোদন বলতে ভিসিআর বা ওয়াক ম্যান এ গান শোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে নিতুর সাথে পরিচয়। ভালো লাগাটা ভালোবাসায় বদলে যেতেই বাসায় জানানো বিয়ে করতে চায় তারা।

আরশাদ ভাতের প্লেট ঠেলে উঠে পর। মুখের খাবার গুলো তেতো লাগছে। দুঃসহ অতীতের কথা যতটা সম্ভব সে এড়িয়ে চলে। প্রথম জীবনের যে বিভৎসতা তাকে স্পর্শ করেছিলো, সেটা কাটিয়ে উঠতে চেয়েও পারেনি। একটা ট্রমার মত সারা জীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। আম্মার বিরুদ্ধবাদ করতে চেয়ে সরে এসেছে। দায়িত্ব থেকে সরতে পারেনি। অতটা অমানুষ হয়ে উঠার মত রক্ত শরীরে জন্মায়নি এখনো। সেল ফোন বন্ধ করার আগে সাহানার ফোনটা রিসিভ করে আরশাদ। চার ভাই বোনের মধ্যে ছোট ভাইয়ের বউটা আম্মার সাথেই আছে এখন।

— আম্মা, আর নেই ভাইয়া।

দৃশ্যপট – ৩

রাকিব ল্যাপটপ শাট ডাউন করতেই লিজা হৈহৈ করে উঠল। এখনি যাওয়া হবে না। আজ র‍্যাডিসনে প্রোমোশন পার্টি আছে। সবাই কাপল সহ যাচ্ছে, একমাত্র রাকিব একা। এসব পার্টিতে সাহানার কখনোই যাওয়া হয় না। একে তো সাহানার ইচ্ছে হয় না। দুই, আম্মা ভালো ভাবে নেয় না। শরীর খারাপের পর সাহানা নিজের থেকে আরো গুটিয়ে গেছে। ছোট ছেলেটা বুকের দুধ ছাড়ার পরে সাহানার মিন্সট্রেশন সাইকেলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, আম্মার দেখভাল করার করার বিষয়টা তাকে একা করতে হয়। অফিস থেকে ফিরে মায়ের কাছে কিছু সময় বসে থেকে রাকিব পরের দিনের কাজ গোছায়। বড় মেয়েটা বাপ নেওটা। দাদীর ঘরে বসে থাকে, বাবাকে সারাদিনের আঁকা ছবি দেখায়। আম্মা সুস্থ থাকার সময়ে এই বিষয় গুলোতে বেশ বিরক্ত হতো।

— তোমার আব্বা তো যাবেই একটু পর তোমাদের রুমে। এখন তুমি অন্য দিকে যাও তো বুবলী। আমার ছেলে সারাদিনের পর একটু রুমে এসে বসে। এ সময়টায় বিরক্ত করো কেনো।

–দাদু, আমার আব্বার কাছে আমি বসে থাকব। তোমার ছেলে আমার আব্বা না? খালি তোমার ছেলে?

— এগুলাই শেখায় তোর বউ, দেখলি? আমার কথা শোনেনা। মুখে মুখে কথা বলে।

— আম্মা, তোমার কাছে অন্য সময় যখন বসে তখন তো আদর করো। বাসায় ফিরে অল্প তোমার কাছে বসি, মেয়েটা এ সময়টায় বাবার কাছে থাকতে চায়। এসব বন্ধ করো। বাকি দুই ভাই তোমার জ্বালায় ঘর বাড়ি ছেড়েছে।

–বল, আরো বল, এসব ঐ তাবিজের গুন। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর চায়ে আলাদা চিনি পড়া মেশায়। ফুঁ দেয়া পানি খাওয়ায় তোকে। তুই সহজ সরল, বুঝিস না কিছু।

রাকিব শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে যেত। সে আজ সাড়ে সাত বছর ডায়বেটিক পেশেন্ট। চা কেন, সেমাইতেও সে চিনি খায় না। সাহানা দুধ ঘণ করে সর তুলে তা দিয়ে সেমাই রান্না করে দেয়। সেখানে এক দানা চিনি মিশালেও সে ধরতে পারবে। আম্মার এই মিথ্যাচার গুলো আগে বুঝতে না পারলেও, যত দিন যাচ্ছে তত এই মিথ্যে গুলো চোখে গুতো দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

ভীড় ঠেলে নেমেই এম্প্লয়ি এসি বাসের জানালা বরাবর একটা সিট পেয়ে বসে পরে রাকিব। খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পাচ্ছে। একটা এই ফাঁকে খাওয়া যায়। পার্টিতে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া। এরপর সিগার খেলে সাহানাকে চুমু খেতে গেলেই টের পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করবে মেয়েটা। এখন খেয়ে নিলে গন্ধ থাকবে না মুখে। গায়েরটা কাটিয়ে দেবে মুস্তাফিজের নাম করে। বেনসন ধরিয়ে একটা টান দিতেই লিজা পাশে এসে বসে।

— এ মা? আপনি বেনসন খান? আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় আকিজ টাকিজ ট্রাই করেন। যে ঠান্ডা মানুষ! মাপা মাপা কথা, মাপা হাসি। দরকার না পরলে চোখ টা তুলে দেখেন না। কিরে ভাই, হলাম ই না হয় ভাবীর থেকে কম সুন্দরী। তাই বলে দেখা যায় না? একটু তাকালে ও কি ভাবী অফিসে এসে খেয়ে নেবে? বাবারে বাবা, কি রাকিব ভাই, আপনার বংশে মুনি ঋষি আছে নাকি বলেন তো?

— লিজা, এখানে মুস্তাফিজ বসবে। তুমি আপাদের সাথে গিয়ে বসো। এসব জোক আমার ভালো লাগে না। শায়ান, সোম ওরা আছে। তোমার বয়সের সাথে মানায়, ওদের সাথে করো। আমি বয়সে, অফিসিয়াল ডেকোরামে তোমার সিনিয়র। এসব পছন্দ করি না।

— আমি কি ঈগল যে আঁচড়ে দেবো আপনাকে। একটু জোক ও নিতে পারেন না ভাইয়া। এত রাগ করেন যে কেনো। মন খারাপ করে দিলেন কিন্তু আমার।

মুস্তাফিজ নিঃশব্দে বসে পেছব ফিরে লিজার চলে যাওয়াটা দেখে। জিনিষটা ভালো, নতুন, কচি,গায়ে পরা ওভার স্মার্ট এ যুগের, এই জেনারেশনের পারফেক্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ। আর ভীষণ প্রেজেন্টেবল আর এট্রাকটিভ। ওড়নাটা গলায় কম হাতেই থাকে বেশী। উদ্ভিন্নযৌবনা বক্ষদেশের প্রেমে বুড়ো থেকে ছুড়ো কেউ বাদ পরেনি। বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে ভাইবা বোর্ডে কোম্পানির ডিরেক্টরদের শরীরের নিন্মাংশের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই মেয়েকে কিনা কাজ করতে হচ্ছে রাকিবের মতন বরফের ডিপার্টমেন্ট এ।

— এই প্রথম দেখলাম, বরফের কাছে আগুন ঘোরে, বরফ গলে না। আল্লাহর দুনিয়ায় এক পিস রাকিব ভাই। আল্লায় বানাইছে আপনেরে।

— তোর ভাল্লাগলে তুই নিয়ে ঘোর বেটা। আমার দরকার পরে নাই ছাটা জিনিস ঘাটতে।

— জিনিষ থাকবে কিন্তু আজকে ট্রাই করবেন নাকি? পিউর বিদেশী। প্রফিট রেইজ আপে বস ভালো পানি আনাইছে। একদিন খান না মিয়া ভাই। এক চুমুক দিয়া দেইখেন।

— তুমি খায়া, বোতলে কইরা বাসায় নিয়া বউ সহ খাইও। শালা পাগল, নতুন বিয়ে করছ, বাসায় থাকবা তা না। বউ বাপের বাড়ি দিয়া রাস্তায় পোতাইন্না মুড়িতে ঝালমুড়ির মজা খুঁজো।

হাতের ফোনটায় সাহানার একটানা ফোন ভালো লাগছেনা। আম্মা হয়ত আবার বমি করেছে। মুছতে মুছতে টিস্যু শেষ। কাপড়ে মুছে আর কুলানো যায় না। সাহানা বেশী সমস্যা না হলে ফোন দেয় না। মেয়েটা এখন এত শান্ত হয়ে গেছে, ভাবতে অবাক লাগে রাকিবের। অথচ, এই মেয়েটাই এক সময় আম্মার সম্পর্কে নিয়মিত কমপ্লেন করত। আম্মার অসুস্থতায় কেমন যেন বদলে গিয়ে বউ কম মেয়ে হয়ে উঠেছে।

–হ্যাঁ বলো, কি শেষ? বাবুর ডায়াপার না আম্মার টিস্যু। তুমি কেমন জানি হয়ে গেছো সাহানা। এসব ছাড়া আর কোন কথা বলো না। আচ্ছা শোনো, কয়টা দিন চলো ঘুরে আসি। ভাইয়াদের বলব এসে থাকতে, তুমি গুছায়ে…

— আম্মা মারা গেছে রাকিব। ভাইয়া, আপারা রওয়ানা দিসে। হ্যালো রাকিব, শুনতে পাও? আম্মা আর নাই।

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে প্রায় নিঃশব্দে বাস থেকে নেমে যাবার সময় লিজা পাকড়াও করে রাকিবকে। এই লোক পালাচ্ছে কোথায়? আজকে একে মজা দেখাবে সে। এমন সব সেল্ফি নেবেনা, বাপ বাপ করে কফি ডেটে নিয়ে কনফেস করে সরি বলবে। বেটা ঘাঘু! কত দরবেশ এলো গেলো, আর উনি নতুন সত্য যুগের রাম ঠাকুর এসেছেন সীতা নাম জপতে।

— কই যান রাকিব ভাই? ভাবী টাইট দিল নাকি, হাহা, দেন দেন ফোনটা দেন, সাইলেন্ট করে দেই। আসেন তো, উপরে আসেন। আরে আমার উপরে না বাসের উপরে। হাহাহা।

ভয়ংকর একটা চড়ের শব্দে বাসের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছে প্রায় জনা তিরিশেক এম্প্লয়ি। গালে হাত দিয়ে অসাড় দাঁড়ানো লিজা। গলায় পেচানো ওড়নাটা একপাশে মাটিতে পড়ে আছে। আর সামনে সিনা টান টান করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে রাকিব,

— আমার মা মারা গেছে। বুঝতে পারছো অসভ্য মেয়ে? মা বোঝো তুমি? মা আছে তোমার? শিক্ষা দীক্ষা কিছু দিলে এমন বেলেল্লা হয়ে ঘুরতা না। মেধা আর কাজ দিয়ে দুনিয়া চালাইতা। জানোয়ার একটা, নোংরা মেয়ে। করলাম না চাকরী। মা ই তো নাই আামার, দুনিয়ার আর কি করব?

–রাকিব ভাই ঠান্ডা হন। বাসায় যান। এই লিজা, যাও বাসে ওঠো। সিনিয়র সবাই এক না। তুমি বর্ডার ক্রস করে ফেলেছো কিন্তু। সব সময় সবাই ফাজলামি নেয়ার সিচুয়েশনে থাকে না। এটাও না বুঝলে কিসের কর্পোরেট জব করো। ওনার মা মারা গেছে, কানে ও শুনো না নাকি বাবা? যাও যাও। রাকিব ভাই যান, বাসায় যান। আমি আসতেসি আপনার বাসায়। একা নারে আপনি। সবাই আছি সাথে ভাই।

আজাদ সাহেবের গাড়িতে করে রওয়ানা দিয়েছে রাকিব। চোখের কোলে জল গড়াচ্ছে অবিরত ধারায়। ভাগ্যিস, স্যার সময় মত এসেছিলো। নয়ত লিজা মেয়েটাকে হয়ত আরো কিছু বলে বসত রাকিব। আম্মা নেই! এই কথাটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না, কিভাবে চলে যায় আম্মা? যেখানে তার আয়ুর সমান আয়ু যেন আল্লাহ তার মাকে দেন, সেই দেয়া প্রতি ওক্তের নামাজে করে চলেছে সন্তান হিসেবে রাকিব? পৃথিবীর সব হারিয়ে যাওয়া মেনে নেয়া যায়, পৃথিবীতে জান্নাত পেয়েও হারিয়ে ফেলার মত দুর্ভাগ্যজনক সত্যিটা মেনে নেয়া যায় কি?

দৃশ্যপট- ৪

— মাম্মীই ই ই, ছোট মামী ফোন করেছে। ধরব?

আফিফা মাত্র অফিস থেকে ফিরে মাথায় তেল লাগিয়ে গরম তোয়ালে পেঁচিয়েছে। চোখে ঠান্ডা টি ব্যাগ দিয়ে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে উঁচু করে শুয়ে, ‘কৃষ্ণকলি’ সিরিয়ালের জমজমাট রহস্য খোলসা পর্বটা দেখা শুরু করেছে। বাসায় ঢুকে কাজের মেয়েটাকে আচ্ছা মত ধমকেছেন, কাঁধে ব্যাগ রেখে। ‘হারামজাদি’ তখন লোন না দিলে তো জামাই জেলে পঁচে মরত। এখন রাতে রাতে জামাই সোহাগ খাওয়ার মজাটা টের পেতি, বান্দির জাত বান্দি,বলে কি না, শুক্কুরবার ছুটি চাই! হেহ্ আমি সারা সপ্তাহ চাকরী করি, শুক্রবার দিনটা ঘুমাই, আর তুই ও শুক্রবার দিন ছুরি চাস। এর মধ্যে লাবনী চিল্লালো। মাথা উচিয়ে মেয়োকে মানা করে দেয় আফিফা।

— না না, ধরার দরকার নেই। আজকে তোর মামার অফিস পার্টি আছে। তোর নানীকে দেখার জন্য মনে হয় আমাকে ডাকছে। খবরদার, ধরবি না। কি একটা কাজ করে! বাসায় বসে খায়। দুইটা বাচ্চা পয়দা করে একেবারে মহারানী। ফাঁকের ওপর আম্মাকে একটু ডাক খোঁজ করে। এর জন্য ও আবার ওনার পার্টিতে যাওয়া লাগবে না। সারা বছরই তো পার্টি। করত আমাদের মতন চাকরি। একবার বাইরে ঠেলো। আবার ঘরে এসে ঠেলো।

— খালাম্মা, আমি যাই এখন, আপনি আয়া পরছেন। সকালের রুটি ভাজি কইরা টেবিলে বক্স কইরা রাখছি। রাইতের খাওন টেবিলে লাগান আছে।

— এই দাঁড়া দাঁড়া, দু কাপ চা করে রেখে যা তো। আমি আবার রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাতে পারব না। মৌরির জন্য একটা টোস্ট করে দে। দুপুরের তরকারী গুলো রেখেছিস? না সব খেয়ে খালি করেছিস?

আর্জিনা রুমের দরজা থেকে সরে আসে। এই বাড়ির বেগম সাহেবের থেকে নগদ তিরিশ হাজার টাকা বিপদের সময় লোন নিয়ে সে সত্যিকার বিপদে পরেছে। তার বাড়ির জমির দলিল বন্দক রেখে টাকা নিয়েছিল। এখন না পরছে শোধ করতে, না পারছে চাকরি ছারতে। সকাল নয়টা থেকে রাতের আটটা পর্যন্ত। এক প্রকার বন্দী হয়ে এই বাসার মধ্যে কাটাতে হয়। মাঝে ছেলে মেয়ে দুটো আসলে, সকালে তার নাস্তার রুটি দুটো, আর তরকারীটা পলিথিনের ব্যাগে করে দোতলার বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। সেটাও সিসি টিভিতে দেখে খালাম্মা হুঁশিয়ারী দিয়েছে, রুটির সাথে এটা ওটা যেনো না সরায়।

গাধাও বিশ্রাম পায়। এ বাসায় বসে থাকার সুযোগ নেই। প্রতিদিন গ্রিল মোছা, ফার্নিচার সহ দু বেলা ঘর মোছা সব করতে হয়, সাথে তিন বেলার রান্না, জলখাবার। দুপুরে একটা বিস্কিট আর পানি খেয়ে, খাবারটা বাসায় নিয়ে যায়। বাচ্চা গুলো কুকুরের মত অপেক্ষা করে। চোখ মুছে চা বানিয়ে দরজা ভিড়ায় আর্জিনা। আপা ও চাকরী করে, বেতন পায়, ছুটিও পায়। সেও তো মানুষ। না হয় করে কথ্য ভাষায়। ‘কাজের বেটি’র কাজ, মাসে একটা দিন কি, একবেলা তাকে এই সুন্দর, ভদ্র, শিক্ষিত, সভ্য সমাজ ছুটি দিতে পারেনা?

দৃশ্যপট – ৫

লাবিবার স্কুলের সাইন্স প্রজেক্ট কমপ্লিট করার আজ লাস্ট ডেট। একটা সৌরমন্ডলের মাঝে সূর্য আর চাঁদ প্রদক্ষিণের বিষয়টা কর্কশিট, রঙ, গোল বল দিয়ে তৈরী করে দিচ্ছে ইফতি। আজকাল স্কুলে কত রকমের ঝামেলার কাজ শেখায়। কেন রে বাবা। আমরাও তো এসব হাবিজাবি বাননো ছাড়া পাশ করে এসেছি। আমরা কি সৌরমন্ডল শিখিনি। এগুলো নাকি এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজ। ‘বুল শিট’।

আম্মা আজকে সারা দিন ফোন দিয়েছে। সাহানা নাকি ঝাল ঝাল গরু, সাদা পোলাও আর কোপ্তা রান্না করেছে। ইফতি যেন অফিস থেকে গুলশান যাবার পথে একবার এসে খেয়ে যায়। ইফতি ও ভেবেছিলো যাবে, পরে মুনার ফোনে আর যাওয়া হয়নি। বউ এর কথার উপর মত দেয়ার দুঃসাহস নেই ইফতির। রাজাবাজার ঘুরে আবার গুলশান আসা মানে রাজ্যের দেরী। বড় মেয়ের স্কুলের কাজ সহ ছোট মেয়ের টিউশন টা বাসায় এসে তাকেই দিতে হয়। সন্ধ্যার পর রান্নার বুয়া আসে। তাই মুনা সন্ধ্যাটা রান্নাঘরের কাটায়। সকাল থেকে দুই মেয়ের স্কুল, ড্রয়িং ক্লাস, নাচের ক্লাস, সব মিলিয়ে মুনা আর মেয়েদের পড়া দেখাতে পারে না।

— তোমার মা আমাকে ফোন দেয় কেনো? তুমি মানা করে দেবে ওনাকে। লজ্জা নাই ওনার। কত কিছু করেছে,যেন সংসারটাই না হয়, ভুলে গেছি? আমি ওসব পুরান জায়গায় বাচ্চা নিয়ে যাবো না। ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নেই, কোচিং নেই। মানুষ থাকে এখন ওখানে? কত করে বল্লাম, তোমার ফ্লাট টা বিক্রি করে টাকা এনে আব্বুর বিজনেসে দাও। মাসে মাসে লাভ আসবে। তা না, কি এক সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে আছো, আম্মা আছে, এখন কিছু বেচব না। আরে তোমার মা মরুক, দেখবে, তোমার ভাই আর বোন মিলে তোমাকে এক কানা পয়সা দেবে না।

— মুনা, তোমাকে তো গিয়ে থাকতে বলছিনা। আম্মার সাথে থাকা অসম্ভব ছিলো। তোমার আমার সংসারই ভেঙে যায় যায়, এখানে আসলাম নয় বছর, একদিনের জন্যও তোমাকে ঐ বাসায় রাতে থাকতে বলিনি। এসব বার বার বলোনা।

— কেনো বলব না। চাকরী ছাড়িয়েছো, এম এ পাশ করিনি তোমার আম্মার কথায়। জামাই থেকে বউ শিক্ষিত হয়ে যাবে। কি কথা!, দা এর থেকে ডাট বড় হয়ে যাবে। তা উনি যে তোমার বাপের চেয়ে বেশী চাকরী করলো, তখন কিছু হলো না? সব কেবল ছেলের বউদের বেলায় না?

ইফতি আর কথা বাড়ায় না। মাইশাকে ভাত খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। মেয়েটা আবার মুরগী ছাড়া খায়না। ভাতের ওপর ফার্মের মুরগীর পেঁপে সহ তরকারী নিতে গিয়ে কান্নাই আসে ইফতির। আজকেও মুনা এক তরকারী রান্না করেছে। আম্মা তাকে কাজের লোক দিয়ে কত কিছু করে খাওয়ায়, আর বউকে কিছুই বলা যায়না। তেরো চোদ্দ বছর আগের ঘটনা নিয়ে এখন কথা শোনাতে থাকে। অশান্তি চায় না ইফতি। সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বউ এর দুটা গালি খেয়েও মুখ বুজে থাকে। তবু শান্তির মা ঘরে থাকুক।

আরশাদের ফোনটা ধরে ইমোশোনালি হ্যালো বলে ইফতি। ভাইয়ার সাথে কত দিন পর কথা হচ্ছে। একই শহরে থেকেও তারা দূরে।

— ইফতি, আম্মা নাই, নাই মানে নাই, আমি বাসায় আসছি, তুমি আসো। কবর দিতে হবে।

দৃশ্যপট – ৬

রাহা আর মুহাম্মাদ কে তৈরী করে গাড়িতে উঠেছে লায়লা। আসলাম চলে এসেছে নিজেদের গাড়ি নিয়ে। আরশাদ পৌছে গেছে রাজাবাজার। লায়লার সাথে ওর বাবা মা ও রওয়ানা হয়েছেন। দাদীকে ছেলেমেয়েরা শেষ দেখা দেখে, আবার নানা নানীর সাথে চলে আসবে বাসায়। পুরনো দিনের কথা মনে হয়ে মন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তবু মৃত মানুষের জন্যে নাকি মনে কষ্ট রাখতে নেই। চোখ মুছে রাহা, মুহাম্মাদকে দোয়া পড়তে বলল লায়লা। আজ মাসের ছয় তারিখ। এই মাসটাও খুব স্পেশাল। আজই তার আর আরশাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো। দুজন মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলো এক সাথে চলার। চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতিরা বিদ্রোহ করে বসে।

বিয়ের পরপর রাদিয়া আক্তারকে বুঝতে অনেকটা সময় চলে গিয়েছিলো লায়লার। একে তো উচ্চশিক্ষিত, বনেদী পরিবারের চাকুরীজীবি শাশুড়ি, তার উপর লায়লাও চাকুরীজীবি বউ। আরশাদ তখনো স্ট্রাগলিং। দুজনের দিক থেকে একটা নিশ্চুপ মানিয়ে নেবার চেষ্টা কাজ করত সব সময়। আরশাদের আড়ষ্টতা আর আগের প্রেমিকার জন্যে দুঃখবোধ সবটা মিলিয়ে দুজনেই যখন দিশেহারা, রাদিয়া আক্তারের ভালোমানুষী রূপটায় ভালোর থেকে খারাপই হতো বেশী। সেসব দিনের কথা কেন আজ এভাবে মনে পরছে? যে চলে গেলো, সেই মানুষটা যেমনি হোক, এখন মৃত। তাকে ঘিরে থাকা কষ্টের স্মৃতি গুলোই কেন বারবার ভেসে উঠছে লায়লার মনে? তবে কি লায়লা খুব খারাপ মানুষ নাকি রাদিয়ার সব ভালোবাসা, দোয়া আদর ছাপিয়ে তার কিছু কর্ম আজ ফলবান বৃক্ষের মত কষ্টের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে লায়লার মনে।

–মাম, চলে এসেছি। নামি?

— নানু, তোমরা নেমে ভেতরে চলে যাবে। লুপা আর তূর্যের সাথে খেলবে। দাদুকে দেখে আর বাইরে আসবে না কিন্তু।

–রাহা, কেঁদোনা আম্মু, মুহাম্মাদ দোয়া পড়। তোমার দাদুর এখন দোয়া দরকার।

— লায়লা, তোর শাশুড়ি দেখলি, পারলো খেয়ে যেতে? চলেই তো গেলো। এত অহংকার, এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মানুষকে করে, বউ গুলোকে কষ্ট দিয়ে, কি পেলো।

–আম্মু থামো। এগুলো এখন বলছো কেনো। সবাই শুনবে। দোয়া করো। ওজিফা দেই পড়। আমি ওনাকে মাফ করে দিলাম। আর কোন ক্ষোভ নেই আমার। তুমিও মাফ করে দাও।

নিথর রাদিয়া আক্তার শুয়ে আছেন। চোখ বুজে ঘুমন্ত। নাতি নাতনিদের হাসির ফোয়ারার আওয়াজে এখনি তার ঘুম ভাঙবে, যেন এখনি উঠে বলবেন,

— আজকে আমার বাড়িতে ঈদের চাঁদের খুশি এলো। এই বুয়া পোলাও বসাও, আলু ভাজো, আরশাদ খাবে। মুরগীর দোঁপেয়াজী করো, রাকিবের পছন্দ। বড় বড় গলদা চিংড়ি মালাইকারী করো, লায়লা খাবে। এই আসলাম ইলিশ মাছ আনো, ইফতির বউটা খায়।আর বুয়া, গরুর মাংস ভুনা ভুনা করো, আমার ইফতিটা কতদিন পরে আসছে, ও খাবেতো!

দৃশ্যপট- ৭

— আম্মার হাতের চুড়ি গুলা তোমার হাতে কেনো সাহানা? এগুলা তো আম্মা আমাকে দিবে বলছিলো। শেষ মুহূর্তে আম্মার কাছে ছিলা মানে তো এই না, যা গায়ে ছিলো আম্মার সব তোমারে দিয়ে গেছে। আমি আম্মার একমাত্র মেয়ে, আমি হকদার তোমার আগে। আমার মেয়ের বিয়েতে আম্মা বেঁচে থাকলে এই চুড়ি গুলা দিতো। আমাকে কতবার বলছে। এখন দেখি তুমি হাতে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো?

সাহানা নিঃশব্দে হাত থেকে চুড়ি জোড়া খুলে আফিয়ার হাতে দেয়। গত সপ্তাহে লুপা, তূর্যের হাতে একটা একটা করে মা পরিয়ে দিয়েছিলো। সোনার গহনার প্রতি তার মোহ নেই, বিয়েরগুলোই কালে ভাদ্রে পরে। সেখানে আড়াই ভরি করে পাঁচ ভরির গহনা গুলো তার ছেলে মেয়েকে দাদী দিচ্ছে দেখে এক প্রকার প্রতিবাদ করেছিলো সাহানা। কোন কথা শোনেননি আম্মা, সাহানা কাছে টেনে বসতে বলেছিলেন। কিছু কথা বলে কয়েকটা অনুরোধ করেছিলেন।

— খালাম্মার গোছল সহ যাবতীয় কাজের জন্যে মহিলা লাগবে। আপনারা ভীড় কমান, লাশ পাকার উপ্রে নেয়া হবে।

— ওনাকে আমি গোসল দেবো। বাড়ির ভেতররে ঘরে গোসল হবে। মহিলার লাশ, খাটিয়ায় করে নিচে নেবো না। এই ঘর বাড়ি ওনার। এখন লাশ ধোয়াতে পাকা লাগবে কেনো? আপনি কাফনের কাপড় সহ বাকি সব এনে দিন।

— সাহানা, তুমি হুজুরের মুখের উপ্রে কথা বললা কেনো? উনি যা বলে তাই করো। এখানে কি লাশ ধোয়াবা? ঐ রুমে আমরা বসছি আছি না? তোমার রুম খুলে দাও, সবাই ওখানে বসি। নিজের রুম পরিষ্কার রেখে আমাদের খেদাচ্ছো। আম্মাকে নিচে নিয়ে যাক। আলমারির চাবিটা দাও তো। তোমার কাছে নাকি সব চাবি? আম্মার ট্রাঙ্কের চাবিটাও দাও। আমাকে কিছু শাড়ি দিবে বলছিলো।

দাঁতে দাঁত চেপে আফিয়ার কথাগুলো সহ্য করে সাহানা।এই মহিলা নিজের মায়ের একটা খবর বেঁচে থাকতে নেয় নাই। মরার খবরটা পর্যন্ত তার স্বামী মারফত তাকে দিতে হয়েছে। আল্লাহ এমন সন্তান যেন শত্রুকেও না দেয় । আঁচল থেকে চাবিটা খুলো আফিয়াকে দেবার আগে লায়লা ভাবীকে ডেকে নেয় সাহানা। আলমারিতে কি আছে সে জানে না। আফিয়া আপা ওনার মন মতন জিনিষ সরিয়ে দোষ সাহানার নামে দিয়ে দিতে পারবেন। নূন্যতম ঈমান এই মহিলার নেই।

মৌলভীকে বাকি কাজের কথা বলে রাকিবের কাছে যায় সাহানা। ছেলেটা সর্বহারার মত মাটিতে বসে আছে। বাসায় ফিরে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত খায়নি। লুপাটা কান্নাকাটি করে এখন ভাই বোনদের সাথে আছে। ছোট ছেলেটাকে এক ফাঁকে খাইয়ে নেয় সাহানা। ঘুমিয়ে গেছে বাচ্চাটা। সকাল হলেই দাদুর রুমে যাবার বায়না ধরবে। খাটে শুইয়ে দিলে দাদুর হাত নিয়ে খেলত। কাল থেকে কার সাথে এই আনন্দ গুলো ভাগ করবে বাচ্চারা? ভেবেই বুকটা মুচড়ে ওঠে সাহানার। আরশাদ ভাই পাগলের মত এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাথা নাড়িয়ে ‘ সব শেষ, সব চলে গেলো, একদম এতিম হয়ে গেলাম’ বলছেন। ইফতি ভাই এখনো পৌছায়নি।

— আল্লাহর বিচার বুঝলেন আপা। দিন থাকতে ছেলেদের কুক্ষিগত করে রাখছে, এইজন্য মরার সময় একটা ছেলের হাতের পানিও জোটে নাই। এইসব থেকে শিক্ষা নিতে হয়।

— খালাম্মা, এসব এখন বলার বিষয় না তো। দোয়া করেন, আম্মার আত্মার জন্য। আন্টি জানাযা দেয়া হবে। রাত হয়েছে, বাকি আপনার যারা আছেন, মুরুব্বীরা দোয়া করবেন। ভিড় কমালে ভালো হয়।

— চলে যাবো? আমরা ও গোসলে ধরি। তুমি কমবয়সী মেয়ে, আফিয়া বলছিলো, তোমার আম্মা নাপাক না থেকে যায়। জানো তুমি সব নিয়ম? দেখো মুর্দা গোসল কিন্তু যেনতেন বিষয় না। হেলাফেলা করে করলে গুনাহ হয়। কাফন পরানো সহ দূয়া পড়া লাগে।

— চাচী কিভাবে কি করতে হয়? দূয়াটার মাঝের লাইনটা মনে নেই, একটু বলে দেন আমাকে। আচ্ছা, আগে কি পায়ে পরাবো কাপড়? লোবান কখন মিশাবো? বলতে পারছেন না তো। দুনিয়ার প্রথম কবর জানাযা ছাড়া হয়েছিলো এটা জানেন? আফিয়া আপাকে বলেন না গোসল দিতে। মরা বাড়িতে এসব না বললে হচ্ছে না।

বেশ মনক্ষুন্ন হয়ে প্রতিবেশী মহিলা দূয়া পড়া শুরু করলেন। পাড়ার বয়স্ক মহিলাদের সাথে মাত্র গল্পের ঝাঁপ খুলেছিলেন, এই বেয়াদপ মেয়েটা বন্ধ করে দিলো। কত কত মানুষ, আত্মীয়- স্বজন, এদের সামনে শুধু সাহানার নাম হবে কেনো? তারও একটু নাম হোক, লোকে ভালো বলুক!

দৃশ্যপট-৮

মুনা নাক মুখ কুচকে লোকজন দেখছে। গুলশান এরিয়ার স্ট্যান্ডার্ডেও এরা পরেনা। এত ন্যাস্টি লোকজন। আবার কতগুলো মৌলভী একপাশে বসে খতম দিচ্ছে। এসব মাসজিদে করলেই তো পারত। উফ রাবিশ! তার বাচ্চারা আসেনি ভালো হয়েছে। মরেই তো গেছে বুড়ি। শেষ দেখার কি আছে, যত্তসব লোকাল কালচার। ছবি তুলে নিয়ে যাবে, আর একটা বড় ছবি বাঁধিয়ে দেবে ইফতির স্টাডিতে। বাইরে থেকে কেউ আসলে বলা যাবে, ওর আম্মা মরার পর এটা ওকে বাঁধিয়ে দিয়েছি। ভাবীরা অবশ্যই সো সুইট বলে, ‘ওপেন মাইন্ডেড লেডি’ র খেতাবটা এই একটা কাজেই পেয়ে যাবে।

ফেসবুকে একটা দুখী দুখী চেহারা করে সেলফি তুলে নিলো শাশুড়ির লাশের সাথে মুনা। “Seeking Prayers” – দিয়ে ছবিটা এটাচ করে অবশেষে শান্তি লাগলো। ইফতি কান্নাকাটি করছে। করুক, জয় তো তারই হয়েছে, একদিনের জন্যেও ছেলেকে আসতে দেয়নি বুড়ির কাছে। বুড়ির নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে রাখত। বাচ্চাদের বেশী আনেনি দাদাবাড়ি, যদি মায়া জন্মে যায় ওদের। এত খোলামেলা বিশাল বাড়ির আলাদা আনন্দ বাচ্চাদের কাছে এটা মুনা বোঝে। উহু, বাচ্চাদের সে তার পক্ষের সৈনিক করে বানিয়েছে। এখানে ছাড় চলবে না। ফ্লাট সহ জমি বিক্রির টাকা দিয়ে গুলশানে একটা আলিশান ফ্লাটের বুকিং দেবে।

ইন্টেরিয়র করাবে রুমিকে দিয়ে। ফেসবুকে Rumi’s Interior Collection, পেজটার দারুণ ভক্ত মুনা। রুমি মনে হয় গে। ওকে দিয়ে লাইভে এসে ফ্লাটের ইন্টেরিয়রটা করালে, সবাই হুমড়ি খেয়ে পরবে। বেশ কয়েকদিন একটা আলোচনায় থাকা যাবে। ইফতি কে পটাতে হবে। এই সাহানাটাকে নিয়ে হয়েছে যত যন্ত্রনা। পড়াশোনা করা মেয়ে,কোথায় জামাই নিয়ে আলাদা হয়ে নিজের মত থাকবে, তা না, এখানে থেকে পতিভক্তি দেখিয়ে মহান সেজেছে। ফাজিলের হাড্ডি একটা, শয়তান মেয়ে। সারা দুনিয়া কে ভগিচগি দিলেও মুনাকে ধোঁকা দিতে পারবে না। বুড়ি মরে শান্তি হয়েছে। নয়ত আত্মীয় স্বজনের জেরার মুখে পরতে পরতে বিরক্তি ধরে গিয়েছিলো।

— ইফতি,আর কতক্ষণ এখানে থাকবো? বাসায় বাচ্চারা একা, আম্মুর ও তো ঘুমাতে হবে। তুমি কি সারা রাত থাকার প্লান করেছো? নো ওয়ে। আমি লাশ দেখেছি, দোয়া পড়েছি। আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা হয়েছে। এবার যাবো। মরা পোড়ার আশে থাকলে আমার চলবে না।

মৃত্যুর মত কঠিন সত্যটাও মুনার কাছে মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা, ইফতি যখন মরে যাবে, তখনো কি লাক্ষনৌ সাদা ড্রেসের ওড়নাটায় একটা দাগের জন্য বাতিল করে, সাদা মাসলিনের শাড়িটা জড়াবে মুনা!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here