স্বয়ম্বরা (৯ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
৯
আজ চতুর্থ দিন। মার্চের এক তারিখ। আমার বন্দীদশার আরও দুদিন বাকী। আসিফ এখন কিচেনে। আজকের লাঞ্চের আয়োজন করছে। আমি নিজের রুমে ফিরে এসেছি। দরজা লাগিয়ে পায়চারী করছি। একটু আগে, লিভিং রুমে আসিফ নতুন যে গল্পটা আমাকে বলল, সেটা চটকদার হলেও পুরোপুরি বিশ্বাস করার মত না। বেশ কিছু খটকা আছে।
মনে মনে তাই আরেকবার পুরো ব্যাপারটা সামারাইজ করলাম। ইমতিয়াজ আঙ্কেল দেশে এসে আমাকে দেখে পছন্দ করেন। বন্ধুকে কথাটা জানান আর নিজের ছেলের জন্য আমার পাণি প্রার্থনা করেন। বিয়ের এই প্রস্তাব আমি রিজেক্ট করি। প্রত্যাখাত হওয়ার পরে ছেলেটি ব্যাপারটাকে প্রেস্টিজ ইস্যু বানায়। সিদ্ধান্ত নেয়, এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। রাস্তা হিসেবে বেছে নেয়, ‘রাবন ফর্মুলা’। কিডন্যাপ করে হুমকি দিয়ে বিয়েতে মত আদায় করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিডন্যাপ করতে ভাড়া করে এক প্রফেশনালকে। যে আমেরিকা প্রবাসী একজন বাঙ্গালি। প্রাক্তন কলিগ এবং হ্যাকিং জিনিয়াস। এই জিনিয়াস ছবি দেখে প্রেমে পড়ে যায় আর আমার সাথে কয়েকটা দিন কাটাবার লোভে কিডন্যাপ করতে রাজী হয়ে যায়। আপাততঃ এই হচ্ছে কাহিনী। প্রশ্ন হচ্ছে কাহিনীর কি এন্ডিং তারা এক্সপেক্ট করছে? এখান থেকে একবার ছাড়া পেলে আমি যে বেঁকে বসব, দে নোজ ইট। এর সমাধান হচ্ছে একটাই, আমি যদি ইশতিয়াকের প্রেমে পড়ি। আর ইশতিয়াকের ভাষ্যমতে, এই ছয়দিনে আমি প্রেমে পড়ে যাব। এর অংশ হিসেবে, কিছুক্ষণ আগে, আসিফ গল্পটা শোনায়। যেন ইমতিয়াজের ব্রিলিয়ান্ট ক্যারিয়ারের কথা শুনে, আমি মত পাল্টাই। প্ল্যান খারাপ না।
তবে এই প্ল্যান তথা গল্পে বেশ কিছু খটকা আছে। গল্পটা তাই ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড বিশ্বাস করিনি। আসলে কোন কাহিনীতে খুব বেশি ড্রামাটিক ইভেন্ট থাকলে, সেই গল্প আমি সাধারণতঃ বিশ্বাস করি না। দুই কলিগের রাইভালরী অস্বাভাবিক না, বাট ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে। ইমতিয়াজ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে, যে পরিমাণ জেলাসী আসিফের চোখে থাকার কথা ছিল, সেটা ছিল না। কেন? পার্ট অফ ডিল? না অন্য কোন ব্যাপার? খটকা নাম্বার ওয়ান।
গল্পের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে আসিফের আমার প্রেমে পড়া। যদিও এনিয়ে খুব বেশি সন্দেহ নেই, বাট… ইট ওয়াজ নট অ্যাট ফার্স্ট সাইট। প্রথম যেদিন আসিফকে দেখি, সেদিন ঐ চোখে প্রেম ছিল না। ভাল লাগা ছিল, বাট নট লাভ। তাছাড়া আমার প্রেমে পড়ে থাকলে, নিজের জন্যই কিডন্যাপ করত। সো প্রেমের গল্পটা পুরোপুরি বানানো না হলেও গোলমেলে। আর এভাবে প্রেমের কাহিনী বলার কারণ কি? বুঝে ফেলেছে, আমি ওকে ইউজ করতে চাই? টোপ দিল? খটকা নাম্বার টু।
পুরো কাহিনীটার খুঁটিনাটি শেষবারের মত মনে মনে আবার চেক করলাম। যে যে অংশ বিশ্বাস করা যায়, সেগুলো আলাদা করলাম। ইশতিয়াক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, নো প্রব্লেম। ভাল চাকরী করে, দারুণ উন্নতি করেছে, এটা নিয়েও সমস্যা নেই। রিজেক্ট হওয়া আর সেকারণে ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া, এটাও স্বাভাবিক। এরপর থেকে কাহিনী বেশ এলোমেলো টাইপ। এমন হাইলি এডুকেটেড ফ্যামিলির একটা ছেলে, প্রাক্তন এক ক্রিমিন্যাল বন্ধুকে ভাড়া করল, কিডন্যাপিংয়ের জন্য? আর যাকে করল সেও প্রেমে পড়ে গেল? আর নায়িকার সাথে ছটা দিন একসাথে থাকতে পারার লোভে এই কাজে রাজী হয়ে গেল? গল্পের এই অংশ মেনে নেয়া কষ্টকর। এই অংশে ঘাপলা আছে।
— খাবার রেডি। আসুন।
রুমের স্পিকারে কথাটা ভেসে উঠল। চিন্তায় ছেদ পড়ল। মনে হচ্ছে কোন এক খেলার গুটি হিসেবে আমাকে ইউজ করা হচ্ছে। কে খেলছে? ইশতিয়াক? না আসিফ?
উঠে দাঁড়ালাম। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বাইরে বেরিয়ে এলাম। আসিফ ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। একটু আগে লিভিং রুমে গল্পটা বলে ও আর বসেনি। কাজ আছে বলে কিচেনে চলে গিয়েছিল। ওর দিকে তাই একনজর তাকালাম। মাথা নীচু করে আছে। মনে হল আমার সাথে চোখ মেলাতে চাইছে না। অন্যদিনের মত স্মাইল দিয়ে ডাইনিং টেবিলে ওয়েলকাম করল না।
আমিও রিয়াক্ট করলাম না। এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ খেতে বসলাম। স্বাভাবিকভাবে নিজের পাতে খাবার নিলাম। এসময় সাধারনতঃ আমি খাবার সম্পর্কে পজেটিভ কিছু কমেন্ট করি। আজ সেটা করা হল না। ব্যাপারটা বোধহয় লক্ষ্য করল আসিফ। কিংবা হতে পারে পরিস্থিতি সহজ করতে চাইল। জিজ্ঞেস করল
— এনিথিং রং?
চুপ করে থাকলাম। এ ধরনের ভন্ডামী টাইপ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মুড নেই।
— আপনার দুল?
অবাক লাগল। এব্যাটা এতো খুঁটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে? কানের দুলটা শাওয়ার নেয়ার সময় খুলেছিলাম, আর পড়া হয়নি। ইউজুয়ালি অমন হয় না। কান আমি কখনই ফাঁকা রাখি না। আজকে কিভাবে যেন… দুলটা হয়তো বাথরুমেই আছে।
স্মিত একটা হাসি দিলাম। এর মানে, তেমন কিছু না। ইশারায় আমার বেডরুমের দিকে দেখালাম। মুখে কিছু বললাম না। খেতে লাগলাম। মাথা নিচু করে থাকলেও বুঝতে পারছি, আসিফ আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। বোঝার চেস্টা করছে কি হয়েছে আমার। মন বলছে, অ্যাপলজী জানিয়ে এখনই কিছু একটা বলবে। কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে না। একটাই উপায়, কিছু একটা বলা।
— মাছটা সুন্দর হয়েছে।
আসিফের দিকে তাকালাম। আসিফও আমার দিকে তাকাল, কিলিং স্মাইলটা নেই। দৃষ্টিটাতেও কনফিডেন্সের অভাব। কিছু বলল না। মাথা ওপর নীচে করে প্রসংসাটা গ্রহণ করল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম দুজনই। খাওয়া আমার প্রায় যখন শেষ ঠিক তখন কথাটা বলল আসিফ। জিজ্ঞেস করল
— আমার গল্পটা বিশ্বাস হয়নি, তাই না?
খুব শান্তভাবে আসিফের দিকে তাকালাম। স্পস্ট স্বরে বললাম
— পুরোটা না। তবে পার্টলি বিশ্বাস করেছি।
আসিফ একটা স্মাইল দিল। এটা কেমন অন্যরকম। কিলার টাইপ না। কিছুটা কনফিউসড হাসি। আসিফকে কেন যেন এখন আর আগের মত কনফিডেন্ট লাগছে না। এই কদিন যেমন কিছু বলার আগেই বুঝে যাচ্ছিল, আজকে কেমন যেন, সব কিছু জিজ্ঞেস করে জানছে। বলল
— আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। গল্পটা আসলেই বেশ উদ্ভট।
কিছুক্ষণ আসিফের দিকে তাকালাম। এরপরে বললাম
—’গল্পটা উদ্ভট, সেকারণে অবিশ্বাস করিনি’, ব্যাপারটা আসলে তেমন না।
— তাহলে?
— গল্পটার সাথে যতটা নিখুত অ্যাক্টিং জরুরী ছিল, আপনি সেটা করতে পারেননি। আপনার অ্যাক্টিং নেহাত বাজে হয়েছে।
আসিফ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকাল। কিছুটা ফ্যাকাসে হল বলে মন হল। তবে দ্রুতই সামলে নিল। সম্মতি সূচক মাথা ঝুকিয়ে বলল
— কোথায় কোথায় ভুল করেছি?
— রাইভালরির গল্পটা বানানো। জেনুইন রাইভালরি হলে, আপনার চোখে সেটা দেখা যেত। ছিল না।
— কি ছিল?
— প্রশংসা। সেটা পার্ট অফ ডিল হতে পারে, তবে আমার ধারণা, আপনি আর ইমতিয়াজ রাইভাল নন। মোস্ট লাইকলি, উনি আপনার বেশ ভাল একজন বন্ধু। কিংবা, জাস্ট ক্লায়েন্ট।
ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মত ফ্যাকাশে একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল আসিফ। এই প্রথম ওকে ক্যাবলা টাইপের একটা ক্যারেক্টার মনে হল। নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে পরের প্রশ্নটা করল
— আর?
— প্রেমে পড়ার গল্পটা।
কথাটা শুনে আসিফ বেশ অবাক হল। জানতে চাইল
— কেন?
এবার আর আসিফের দিকে তাকালাম না। থালার খাবার নাড়তে নাড়তে বললাম
— মেয়েদের একটা স্পেশাল ইনস্টিংক্ট থাকে। প্রেমে পড়া বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
কথাটা শেষ করে আসিফের দিকে তাকালাম। যা এক্সপেক্ট করেছিলাম, মুখে বেশ খানিকটা অবিশ্বাস ফুটে উঠল। বলল
— মানে? প্রেমে প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা আমি মিথ্যে বলেছি?
আসিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললাম
— আমি তা বলিনি।
— দেন?
— ইট ওয়াজ নট লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। আর এজন্য আপনি কাজটা নেননি। কাহিনী অন্য কিছু।
আসিফের দৃষ্টিতে কিছুটা প্রশংসা ফুটে উঠল। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিল। বুঝে গেলাম, আই অ্যাম স্পট অন। এর আরেকটা মানে হচ্ছে, আসিফের এই গল্প শোনানো, কোন একটা প্ল্যানের অংশ। কি সেটা?
একসময় খাওয়া শেষ হল। থালা হাতে নিয়ে উঠলাম। আসিফ বারণ করল না। প্রথমবারের মত। অবাক হলাম। অবশ্য প্রথম বারের মত আসিফকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছি মনে হল।
কিচেনে গিয়ে থালা ধুয়ে র্যাকে রাখলাম। ফিরে এসে দেখি আসিফ তখনও বসে আছে। মনে হল, হিসেব কষছে, কি করবে। একসময় হিসেব শেষ হল। ধীরে ধীরে চোখ তুলল। আমার দিকে সরাসরি তাকাল। আসিফকে দেখে মনে হল, এবার রিয়েল কনফেশান করবে। বলল
— কিভাবে বুঝলেন?
— কোনটা?
— প্রেমটা যে ফার্স্ট সাইটে ছিল না।
আসিফের দিকে তাকালাম। এরপরে বললাম
— সেটা এই মুহুর্তে জরুরী কিছু না। জরুরী ব্যাপার হচ্ছে, এটা আপনার প্ল্যানের অংশ কি না।
আসিফের চেহারার পরিবর্তনটা এবার টের পেলাম। ও বুঝে গেছে, প্ল্যান ফেইল করছে। আমাকে যতটা বোকা ভেবেছিল, আমি ততোটা ছাগল না। আসিফ বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এরপরে বলল
— ওকে। লেটস টক স্ট্রেইট। বলুন কি জানতে চান।
— আপনি আসলে কে? ইশতিয়াক? না ওর ফ্রেন্ড আসিফ?
চলবে