হতে পারি বৃষ্টি ❤️,পর্বঃ৯
লেখনীতেঃ মৌশ্রী রায়
রোদ্দুর ঝলমলে আকাশের বুকে পেঁজা পেঁজা মেঘ।সাদা মেঘের নিদারুণ ছড়াছড়িতে নীল আকাশ আজ সেজে উঠেছে নব রুপে।
আশ্বিন মাসের এই অনন্য রুপে প্রকৃতিও যেন নিজের শোভা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে নিরন্তর।অনাথ আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী।রোদের আলো পড়ে তার প্রতিটা স্রোতধারা চিকচিক করে জ্বলে উঠছে হীরক খন্ডের ন্যায়।
নদীর পার ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি কাশ।দৃষ্টি সীমানা যতদুর যায় সবটা জুড়েই সেই সাদা কাশের রাজত্ব।মনে হচ্ছে যেন কেউ খুব যত্ন করে আকাশের বুক থেকে মেঘ কুড়িয়ে এনে সাজিয়েছে এই সুন্দর নদীর তীর।সেই মর্তমান মেঘেরাই যেন এই শুভ্র কাশের রুপ।
প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যময় অনন্য রুপরাশিই দুচোখ ভরে দেখে যাচ্ছে একটি মেয়ে।তার পরণে শুভ্র জামদানী, দুহাত ভরা সাদা কাচের চুরি।কোমড় অবধি ছড়িয়ে পড়ে আছে কৃষ্ণ কালো কেশরাশি। শারদ হাওয়ায় তা দুলেও উঠছে ক্ষণে ক্ষণে,দুলছে সাদা আচলও।কাঁপছে চোখের পাতাও।
কেবল স্থির মেয়েটির দৃষ্টি।তা একধ্যানে নিবদ্ধ নদীর স্বচ্ছ পানিতে,পারে চিকচিক করা বালিতে,বাতাসের স্পর্শে দুলে ওঠা কাশের ভীড়ে,আর ঐ দুর নীলাচলে।
প্রকৃতির এই রং রুপ পর্যবেক্ষণে মেয়েটি যখন মগ্নপ্রায়, তখনই তার শাড়ির আচলে টান অনুভব করতেই চকিতে পিছু ফেরে সে।স্থির দৃষ্টি ভিজে আসে ক্ষণেই।
টালমাটাল পা ফেলে এগিয়ে যায় সামনে।দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নেয় একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে।তার মেয়েকে,তার রায়াকে।
মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে আন্নদে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঐশীর মুখশ্রী।
রায়ার চেহারাতেও ফুটে উঠেছে তৃপ্তি। মায়ের কোলের মিষ্টি ঘ্রাণে তার মন শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। আহা,আজ কতদিন পরে সে তার মায়ের এত কাছে এলো,তাকে জড়িয়ে নিল।
এর চেয়ে শান্তির কি আর কিছু হতে পারে?বোধ হয় না।
তাঁদের থেকে কিছুটা দুরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের এই আত্মিক মিলন দু চোখ ভরে দেখে যাচ্ছে সায়াহ্ন। তার দুচোখে প্রিয়জনকে নিজের কাছে পাওয়ার, তার সাথে কথা বলার তীব্র বাসনা।
কিন্তু সে যে অপারগ।তার যে সে অধিকার নেই। নেহাতই একটা ভুল বোঝার পরিণতি স্বরুপ আজ তার জীবনে এইদিন দেখতে হচ্ছে।
সায়াহ্ন ডুব দিল তিনবছর আগের সেই বাদল সন্ধ্যায়।অতীতের পদচারণায় পুনরায় প্রবেশ করলো সেখানে যেখান থেকে আজকের ঘটনাপ্রবাহের সূচনা ঘটেছিল।
সেদিন বৃষ্টির পরে সায়াহ্নর কথার অর্থ ধরতে পারেনি ঐশী। সে যা নয় তা নিজেকে প্রমাণ করতে চায় একথার মানেও তার ছোট মাথায় বোধগম্য হয়নি।তাই বিষয়টা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি ঐশী। সে রাতের খাবার বানাতে চলে যায় নিচে।রান্না করতে করতে সায়াহ্ন চা দিতে বললে তার জন্য এককাপ চা করে নিয়ে ঘরে আসে ঐশী। এসে দেখে সায়াহ্ন বাথরুমে।
তাই চায়ের কাপটা বেডসাইড টেবিলের পাশে রেখে বেড়িয়েই যাচ্ছিলো সে,তখনই হঠাৎ তার চোখ জোড়া আটকে যায় বিছানায় এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাইলের মাঝে থাকা একটা ডায়েরিতে।ডায়েরিটা দেখে ঐশীর চিনতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনা যে সেটা তারই ডায়েরী।যাতে নিজের বাবা মায়ের সাথে গোপনে বলা মনের কথা গুলো জমিয়ে রাখে সে!
মুহূর্তেই ঐশীর গোটা পৃথিবী টলে ওঠে।সায়াহ্নর ধীরে ধীরে তার প্রতি ব্যবহারে ঘটা পরিবর্তনের কারণ এই ডায়েরিটা।আর সে কিনা কি সব আকাশকুসুম ভেবে গেছে এই কদিনে!
সে তো ভেবেই বসেছিল, সায়াহ্নর মনে হয়তো তার জন্য কিছুটা অনুভূতি কাজ করছে।ভালোবাসা না হোক অন্তত সায়াহ্ন তাকে সম্মান করে এটা ভেবেই তো সে খুশি ছিল।
কিন্তু সে যে বড্ড বোকা।সম্মান তো দুরের কথা, সায়াহ্নর মনে যে তার জন্য দয়া ছাড়া আর কিছুই নেই।তার ডায়েরির ভাজে ভাজে জমে থাকা তার সুপ্ত কষ্টগুলোকে জানার পর সে সায়াহ্নর দৃষ্টিতে ঘৃণার পাত্রী থেকে দয়ার পাত্রীতে পরিণত হয়েছে! এটুকুই যা।এতে তার পদোন্নতি তো অবশ্যই হয়েছে তবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে নিজের তীব্র আত্মসম্মান।
আজীবণ মাথা উঁচু করে বাঁচা ঐশী সায়াহ্ন, যে কি না তার ভালোবাসা,তার দয়া সহ্য করতে পারেনি।
সায়াহ্ন যখন বাথরুম থেকে ফিরে দেখতে পেল যে ঐশী বিধ্বস্ত চেহারায় দুহাতে তার ডায়েরিটা আকড়ে অনুভুতি হীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখন সে ঐশীকে কিছু বলবে তার আগেই ঐশী তাকে বলে ওঠে,
“আমি জন্ম থেকেই দুঃখ নিয়ে বাস করি সায়াহ্ন। কষ্ট,ক্লেশ,ঘৃণা,অবহেলা সবটা পাবার অভ্যেস আমার সেই জ্ঞান হবার পর থেকেই হয়ে গেছে।বাবা মা ছাড়া এই মস্ত পৃথিবীর সব জটিলতাও দেখেছি আমি।তবে কি জানেন ভালোবাসা যে পাইনি তা কিন্তু না।অনাথ আশ্রমের প্রতিটা সদস্য, আপনার বাবা,মা,রায়া এদের সবার থেকেই অনেক ভালোবাসা পেয়েছি আমি।এতটা যা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
হ্যাঁ আমার জীবনে আপনার একটু ভালোবাসার চাহিদা অবশ্যই ছিল,তবে আপনার ঘৃণাতেও আমি দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছিলাম।ভেবেছিলাম বাকিটা জীবন এই ঘৃণা নিয়েই কাটিয়ে দেব,তবুও আপনার সাথে,আপনার পাশে তো থাকা হবে!সবাই নাহয় ভালোবাসার সংসার করে,আমি নাহয় আপনার একবুক ঘৃণা নিয়েই সংসার করব।কিন্তু তা আর হবার না।আমি আপনার ঘৃণা তো মানতে পারব সায়াহ্ন তবুও আপনার দয়া মানতে পারব না।আমি অবাক হয়েছিলাম,হঠাৎ আমার প্রতি আপনার অনুভুতির পরিবর্তন ঘটাতে,ভেবেছিলাম হয়তো মায়া জন্মাচ্ছে আমার ওপর,বিশ্বাস করুন তাহলেও মেনে নিতাম,কিন্তু না,আপনি তো আমাকে দয়া করলেন।শুধুই দয়া।আমার জীবনের আড়ালের অতীতটা জেনে আমি আপনার কাছে দয়ার পাত্রী হয়ে রইলাম।আমি এই দয়ানচাইনা সায়াহ্ন। সারাটা জীবন আমি শত কষ্টেও মাথা উঁচু করে বেঁচেছি,কখনো মাথা নোয়াইনি,আর আজ নিজের ভালোবাসার কাছে মাথা নত করব?পারবো না।ক্ষমা করবেন।আপনার দয়া কুড়িয়ে এ বাড়িতে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব না।
আমি তো আমার কথা রেখেছি,রায়াকে তার বাবা, তার হারানো খুশি ফিরিয়ে দিয়েছি।এবার আমার ছুটি।আমি আজই এবাড়ি ছেড়ে চলে যাব সায়াহ্ন। ভালো থাকুন।”
সায়াহ্ন বহুবার ঐশীকে পিছু ডেকেছে,তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে,কিন্তু ঐশী শোনেনি,মানেনি কোন বাঁধা।আজীবন স্থায়ী তার প্রবল আত্মমর্যাদাতে পাওয়া আঘাত তাও নিজের প্রিয়জনের কাছ থেকে তা সে মানতে পারেনি।
আহত বাঘিনীর ন্যায় এক কাপড়েই বেড়িয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে। রায়ার কান্না,অনুরোধ,বারণও সেদিন থামাতে পারেনি তাকে।সায়াহ্নর পিছুডাকে দু একবার যখন পদক্ষেপ স্লথ হয়ে আসছিল,তখন রায়াকে উদ্দেশ্য করে ঐশী এক অভাবনীয় কথা বলে ওঠে।রাগ জেদে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে আচমকাই বলে বসে,
“আজকের পর আর কখনো আমার সাথে যেন তোমার বাবা যোগাযোগের চেষ্টা না করে রায়া।কোনদিনও যেন আমাকে নিজের মুখ না দেখায়।আমি ওনার মুখ আর দেখতে চাইনা,আর নাতো ওনার সাথে কোন কথা বলতে চাই।আমি কথাটা সবাইকে উদ্দেশ্য করেই বলছি।এরপরেও যদি তোমরা আমার কথা না শোন,তবে আমি নিজেকে শেষ করে দেব।হ্যাঁ,ওনাকে আর কখনো আমার চোখের সামনে দেখলে,এমনকি ওনার কন্ঠস্বরও যদি আমার কর্ণগোচর হয় তবে আমি নিজেকে শেষ করে দেব সেই মুহূর্তেই!কথা দিচ্ছি। আশা করি আমাকে যে এতদিন দয়া করে যাচ্ছিলো,সে আমার জীবনের ওপরেও দয়া করবে।আসছি!”
ঐশীর কথা শুনে সকলেই চমকে গিয়েছিল।ঐশীর মতো নরম,শান্ত স্বভাবের মেয়ের এমনভয়ানক জেদী রুপ দেখে সবারই কথা বলার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল যেন।তবুও তার কথা শুনেই কেউ আর আটকায়নি তাকে।কারণ সবাই জানে নিজের আত্মমর্যাদায় আঘাত পেলে যে কেউ প্রতিবাদি হয়ে উঠবে।কেবল যাবার আগে রায়া কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠেছিল,
“মা,আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ?আমি কি করে থাকবো তোমাকে ছাড়া? ”
ঐশী রায়ার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“রায়া,মা,আমি তো তোমার মা।আর কেউ ভালো না বাসুক,তুমি যে মাকে ভালোবাসো তা মা জানে সোনা।তাই মায়ের কাছে যাবার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে মা।তুমি যখন খুশি আমার কাছে চলে এসোআমার কাছে আসতে তোমার কোন বাঁধা নেই তো!”
মিস্টার রহমান অভিমানী স্বরে বলে ওঠেন,
“আমরা কি কখনো তোমাকে ভালোবাসিনি আম্মু?আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ!”
ঐশী সহাস্যে উত্তর দেয়,
“তোমরা তো আমার বাবা মাই গো।আব্বু আম্মু কি তা বোঝার আগেই তো তাদের হারিয়েছি আমি।ওনাদের অভাব তো তোমরাই পুরণ করেছ আমার জীবনে।তোমাদের ছেড়ে কি আমি যেতে পারি?আমি জানি তোমরাও ভালোবেসেছিলে আমায়।তাই তোমরাও আমার সাথে যখনই দেখা করতে যেতে ইচ্ছে করবে,তখনই চলে এসো আমার কাছে।
আমার সব বাঁধা কেবল একজনের জন্যই বাবা।সে যেন কখনো আমার সামনে না আসে।মনে রেখ শুধু এটুকু।আসলাম!”
ঐশীর চলে যাবার মাঝেই মিসেস রহমান আবার বলে ওঠেন,
“কিন্তু তুই কোথায় যাবি মা?সেটা তো বলে যা!”
ঐশী ম্লান হেসে জবাব দেয়,
“আমি আর কোথায় যাব মা?পুরোটা জীবন যেখানে কাটিয়েছি সেখানেই।আমার অনাথ আশ্রমে।ওখানে ছাড়া তো আর কোথাও যাবার জায়গা নেই আমার মা।”
আর কেউ ঐশীকে আটকায়নি।তাকে চলে যেতে দিয়েছে।আর সমস্ত ঘটনাটা নিরবে দেখে গেছে সায়াহ্ন। সে কি করত,ঐশী যে বলেছে তার কন্ঠস্বরটাও শুনতে অনিচ্ছুক সে।তবে কি আর সায়াহ্নর কোন অধিকার আছে তাকে আটকানোর?না নেই।
তারপর সেভাবেই কেটে গেছে তিন তিনটা বছর।ঐশী আর কখনো সায়াহ্নর মুখোমুখি হয়নি,না তো ফিরেছে রহমান নিবাসে।
সায়াহ্ন যদিও আড়াল থেকে বহুবার একপলক দেখে এসেছে ঐশীকে তবে তা ঐশীর দৃষ্টির অগোচরে।
রায়া মাঝেমাঝেই যায় ঐশীর সাথে দেখা করতে, সারাদিন থাকে তার সাথে, আবার রাতে ফিরে আসে।
কথাগুলো ভেবেই একটা ভারী নিশ্বাস বেরিয়ে আসে সায়াহ্নর বুক চিরে।
তার কথাগুলো যদি সেদিন একটাবারের জন্যও ঐশী শুনতো,তবে হয়তো আজ আর এই পরিস্থিতিতে তারা কেউ থাকতো না।আজ তার ঐশীরাণীর জন্মদিনটাও জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিনের কাতারে সাজাতে পারতো সে।কিন্তু ঐ যে,চাইলেই সব পাওয়া যায়না।আমাদের জীবনের সব ঘটনাও যে আমাদের ইচ্ছে মতো পরিচালিত হবে তেমনটাও না।
তবুও সায়াহ্নর মনে হয়, ইশশ!একটাবার যদি ঐশী তার কথা শুনতো।কিন্তু তা কি আর কখনো সম্ভব?কে জানে?
চলবে