হতে পারি বৃষ্টি ❤️,পর্ব-৩

0
2729

হতে পারি বৃষ্টি ❤️,পর্ব-৩
লেখনীতে-মৌশ্রী রায়

পুরো রুমজুড়ে পিনপতন নিরবতা।আধখোলা ব্যালকনির দরজা দিয়েই থেকে থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঐশীকে।সেই সাথে তাদের মৃদু আন্দোলনে কিছুটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে জানালার পাশ ঘেষে ঝুলে থাকা মখমলের পর্দা।

ঐশীর ঠিক সামনেই অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বসে আছে মিস্টার ও মিসেস রহমান।আর তাঁদের দিকেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঐশী।

সায়াহ্ন বেরিয়ে যেতেই রায়াকে খেলতে পাঠিয়ে সে তার শশুর শাশুড়িকে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল,রায়া সায়াহ্নর মেয়ে হলে সায়াহ্নর রায়ার প্রতি এমন ব্যবহারের কারণ কি?আর ওনারাই বা কেউ কেন রায়ার ব্যাপারে বিয়ের আগে ঐশীকে জানান নি??
ঐশীর প্রশ্নে ওনারা খানিকটা লজ্জিত বোধ করেন হয়তো।তাই উত্তর না দিয়েই বসে থাকেন চুপচাপ।

ওনাদের মুখের গাম্ভীর্য আর নিরবতা দেখে ঐশী আবারও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই মিসেস রহমান খানিকটা ইতস্তত কন্ঠে বলে ওঠেন,
“আমাদের ক্ষমা করে দিস মা।হয়তো আমরা তোর সাথে অন্যায় করেছি।সায়াহ্নর সাথে এভাবে তোকে জুড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি আমাদের।কিন্তু কি করব বল!নিজের নাতনীটার কথা ভেবে এই অন্যায়টাই করতে হল। ও যে বড্ড দুঃখী রে মা।!”

এটুকু বলেই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন মিসেস রহমান।ঐশী কিছু বললনা।নীরবে সবটা কেবল শুনে গেল।
এরপর আবার বলতে আরম্ভ করলেন উনি,
“আসলে সায়াহ্ন আর রিধি মার মেয়ে হলো রায়া। রিধি সায়াহ্নর প্রথমা স্ত্রী। ”

কথাটা বলে ভীত দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন ঐশীর দিকে।তবে তার ধারণা মতো ঐশীর চেহারায় কোন রুপ রাগ বা বিস্ময়ের আভাস পাওয়া গেলনা।বরং ঐশী আগের মতোই স্থির ও মনোযোগী ভঙ্গিতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল ওনাদের সামনে।যেন যা ঘটেছে তা খুব স্বাভাবিক। এতে অবাক বা রাগ হবার কোন জায়গা নেই।

ঐশীর মাঝে কোনরুপ ভাবান্তর না দেখে মিসেস রহমান আবার বলতে শুরু করলেন,
“আজ থেকে সাত বছর আগে আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয় রিধি আর সায়াহ্নর।ওদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও ওদের দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে অনবদ্য বন্ডিং।রিধি বরাবরই ভীষণ সংসারী মেয়ে,ঘর কন্নার কাজ করে,আমার আর তোর বাবার সাথে গল্প করেই সারাদিন হেসে খেলে কাটিয়ে দিত ও।বাচ্চা রিধির খুবই পছন্দের ছিল।ওর জেদের কাছে মাথা নুইয়েই বেবি প্ল্যানিং করতে বাধ্য হয় সায়াহ্ন। সে হিসেবেই বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় কন্সিভ করে রিধি।ওরা আর আমরা সবাই খুশি ছিলাম এতে।বাড়িতে নিউ মেম্বার আসবে,সবার এ নিয়ে আনন্দই ছিল আলাদা। তবে রিধি যখন ফোর মান্থ প্রেগনেন্ট তখনই হঠাৎ ওর প্রেগন্যান্সিতে কিছু কম্প্লিকেশনস দেখা দেয়। শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে, কিছু খেতেও পারতোনা ঠিকঠাক, খেলেই বমি করে দিত।এভাবেই কেটে গেল আরো দুটো মাস।ওর হেল্থ কন্ডিশন দিনদিন আরো খারাপ হতে লাগলো।এরপর ছ মাসের মাথায় গিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হল।রিপোর্টে ধরা পড়লো সব নরমাল,মা-বাচ্চা দুজনেই সুস্থ। শুনে আমরাও কিছুটা স্বস্তি পেলাম।সাতমাসে গিয়ে হঠাৎ একদিন লেবার পেইন উঠল রিধির।এত তাড়াতাড়ি লেবার পেইন ওঠাতে আমরা সবাই ঘাবরে গেলাম।ওকে হসপিটালে অ্যাডমিট করানো হল। ডক্টর বললেন ওটি তে নিতে হবে।সায়াহ্ন পাগলের মতো করতে লাগলো,বললো,যেখানে,নিন,যা খুশি করুন ওকে বাঁচান।ওর কিছু হলে আমি বাঁচবোনা।ডক্টর আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন।টানা তিন ঘন্টা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করার পর অবশেষে অপারেশন থিয়েটারের সামনে জ্বলতে থাকা লাল আলোটা দপ করে নিভে গেল।সে সাথে কেঁপে উঠল আমাদের সবার বুক।ডক্টর বেড়িয়ে এলেন,হাতে একটা ফুটফুটে শিশু, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে হাত পা নাড়ছে সে।সায়াহ্ন খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডক্টরের দিকে এগিয়ে গেল। কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো,রিধি কেমন আছে, ঠিক আছে কিনা।ডক্টর নত মুখে হতাশার সুরে জবাব দিল ওনারা রিধিকে বাঁচাতে পারেননি।
সায়াহ্ন কথাটা শুনেও যেন শুনলো না।পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, কি বললেন।ডক্টর তার বলা কথার আবার পুনঃউচ্চারণ করা মাত্র আমার ছেলেটা পাগলের মতো শুরু করে দিল।ডক্টরের কলার শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে পাগলের মতো বলতে লাগলো ওর রিধির কিছু হতে পারেনা।সে ওকে ছেড়ে যেতে পারেনা। অনেক করেও যখন ওকে শান্ত করা গেল না তখন ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হল ওকে।
ডক্টরের কাছে পরে আমরা জানতে পারলাম রিধি অনেক আগে থেকেই জানতো সে বা তারঁ বাচ্চার মধ্যে থেকে যেকোন একজনকে বাঁচানো যাবে।ওর প্রেগন্যান্সি কমপ্লিকেশনস আল্ট্রাসনোগ্রামেই ধরা পড়েছিল। কিন্তু ও ডক্টরের কাছে অনেক রিকুয়েষ্ট করে রিপোর্ট পাল্টে নেয়,লুকোয় আমাদের থেকে সবটা।ডক্টরকেও ডেলিভারির আগ মুহুর্ত অবধি কাউকে কিছু না জানাতে বলে।কারণ ও জানতো সায়াহ্ন কোন কিছুর বিনিময়েই রিধিকে হারাতে চাইবেনা।তাই সবটা জানলে ও বাচ্চাটার না,রিধির প্রাণই বাঁচাতে চাইবে।তাই সবটা লুকিয়ে রিধি ওর বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়।
কিন্তু এসবটা শোনার পর রায়ার প্রতি সায়াহ্নর মনে জন্ম নেয় তীব্র বিতৃষ্ণা, মনে মনে রিধির মৃত্যুর জন্য রায়াকেই দায়ী করতে থাকে ও।
কখনোই রায়ার দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকায়নি, মেয়েটাকে কোলেও নেয়নি আজ অবধি।
যত দিন যেতে থাকে রায়াকে দেখে তত বেশি রেগে যেতে থাকে ও।শেষমেশ না পেরে সাড়ে চার বছর বয়সেই রায়াকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিই আমরা। আর ছোট্ট থেকে বাবার থেকে এত অবহেলা,বিতৃষ্ণা পেতে পেতে মেয়েটা এত শক্ত হয়ে গেল যে বিনা বাক্যে রাজিও হয়ে গেল বোর্ডিংয়ে যেতে,এমনকি খুব দ্রুত মানিয়েও নিল সেই পরিবেশে নিজেকে।
ঐ যে সৃষ্টিকঅতা একদিক থেকে কেড়ে নিলে অন্যদিক দিয়ে ঠিকই ভরিয়ে দেন উজার করে।রায়ার ক্ষেত্রেও উনি তেমনটাই করেছেন। শৈশব থেকে মা-বাবার সান্নিধ্য না পেলেও তাই অশেষ ধৈর্য পেয়েছে মেয়েটা।যার ফলে নির্দ্বিধায় যেকোন পরিবেশে মানিয়ে চলার অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছে ও।”

ঐশী মিসেস রহমানের প্রতিটা কথা শুনলো,মনে মনে নিজের মতো করে তাদের বিশ্লেষণও করলো,সে বুঝতে পারলো তখন সায়াহ্ন রিধি রিধি করে চেচিয়ে কেঁদে কার কথা বলছিল,অকারণে ল্যাপটপটা টুকরো হবার কারণটাও খানিকটা আন্দাজ করলো।সায়াহ্ন কেন তাকে মেনে নিতে পারছেনা সেটাও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার কাছে।তার মনে যে অন্য কারো বাস,সেখানে তার অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলেই তো তার প্রতি এই ক্রুদ্ধতা প্রকাশ করছে সায়াহ্ন।

তবে সব কিছু বুঝেও একটা কেন থেকেই গেল তার মনে। বিয়ের আগে এ বিষয়ে কেন জানানো হলো না তাকে??

মনে আসা প্রশ্ন বাস্তব জগতে প্রকাশ পেতেই এবার মুখ খুললেন মিস্টার রহমান।তিনি অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আমরা ভয় পেয়েছিলাম,সবটা জানলে হয়তো তুমি বিয়েতে রাজি হবে না।এ জন্যই জানাইনি তোমাকে কিছু। রায়ার জন্মদিনের দিন যখন অনাথ আশ্রমে গেলাম আমরা তখন সেখানকার বাচ্চাদের সাথে তোমার অবাধ মেলামেশা,তাদের সাথে খেলা,তাদের যত্ন নেয়া সবটা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম আমরা।খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তুমিও ঐ আশ্রমেই মানুষ। বাবা মা কেউই নেই।মনে হল তুমি নিজেও জানো বাবা মা না থাকার যন্ত্রণা টা ঠিক কি?তাই আমাদের রায়া দিদিভাই এর কষ্টটাও তুমি খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারবে ওকে বুঝতে পারবে।আমরা মনে প্রাণে চাইছিলাম রায়া তোমার মধ্যে দিয়ে ওর মায়ের স্নেহ পাক,মমতা পাক।সেজন্যই একপ্রকার মনের ভয় থেকেই জানানো হয়নি তোমাকে।তবে আমি স্বিকার করছি কাজটা ঠিক হয়নি।জানানো উচিত ছিল।এখন যদি তুমি এ বিয়েটা সবটা জেনে না টিকিয়ে রাখতে চাও তবে আমরা বাঁধা দেবনা।তোমার যা সিদ্ধান্ত তা মেনে নেব।নিজের নাতনির জন্য স্বার্থপরের মতো তোমার জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার আমাদের নেই।”

ঐশী শান্ত দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মিস্টার আর মিসেস রহমানের দিকে।তার চোখের ভাষা ঠিক কি বলছে তা যথার্থ ঠাওর করতে পারলেন না ওনারা।
কিছুক্ষণ শান্ত গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি করে প্রশস্ত হাসলো ঐশী। তার প্রসারিত ঠোঁট যুগলের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্ত স্থির হলেন মিস্টার ও মিসেস রহমান।

ঐশী এবারে সপ্রতিভ কন্ঠে বলে উঠল,
“শোন,তোমরা যখন একবার আমাকে এ বাড়ির বউ করে এনেছ,তখন জীবন থাকতে আমি আর তোমাদের ঘাড় থেকে নামছি না।আমি কাঁঠালের আঠার চেয়েও বেশি চিটকু।তাই আমার হাত থেকে তোমাদের আর এত সহজে মুক্তি নেই বুঝলে?তাই আমার এ বাড়ি থেকে যাবার কথা ভুলে যাও। আর আমার রায়া আমার মেয়ে।ও যখন আমার মেয়ে তখন ওর ভালো-মন্দ সবটা দেখা আমার দায়িত্ব। ওর চিন্তাও আর করোনা।ছোট থেকে না পাওয়া সবকিছু ও এবার ফেরত পাবে।আমি পাইয়ে দেব।
আর তোমাদের ঐ তারছেড়া ছেলেকেও একেবারে সিধে করে দেব আমি কথা দিলাম।
তোমরা অযথা টেনশন নিয়ে আর মাথার চুল পাকিও না তো।
ফিকার নট,ম্যায় হু না!”

ঐশীর বলা প্রতিটা কথা খুশির তরঙ্গ সৃষ্টি করলো যেন।সেই তরঙ্গই রহমান দম্পতির মুখাবয়বে বাঁধা পেয়ে হাসি হয়ে ঝড়ে পড়লো।

অবশেষে যে এই অতীব চমৎকার হাস্যোজ্জল মেয়েটির হাত ধরে তাদের জীবনে সুখপাখিদের আগমন ঘটতে যাচ্ছে তা ভেবেই পরম শান্তিতে স্বস্তির শ্বাসবায়ু ত্যাগ করলেন তারা।আর মুখের মাঝে বহাল রাখলেন দুর্দমনীয় হাসি।
ঐশীর ছড়িয়ে দেয়া হাসি।।
.
চোরের মতো সদরদরজার পাল্লা দুটো একটু ফাঁক করে বাড়ির ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নিল সায়াহ্ন। এখন মধ্য রাত।ঘড়ির কাঁটা এক কি দুইয়ের ঘরে নড়চড় করছে হয়তো।সারাদিন রাগ দেখিয়ে বাড়ির বাইরে কাটানোর পর রাত দশটার দিকে তার মনে হয়েছে সে মারাত্মক ছেলেমানুষী করে ফেলেছে। রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি।বাবা মার একমাত্র ছেলে সে।তাদের ছাড়া কখনোই একা কোথাও থাকেনি সায়াহ্ন। যতই রাগ হোক দিন শেষে সুরসুর করে সে বাড়িতেই চলে আসতো।কিন্তু ঐশীর কথায় রাগের মাথায় এত রাত অবধি বাইরে থেকে যাওয়াটা তার ঠিক হয়নি। তাই চুপচাপ আবার বাড়ির পথেই পা বাড়িয়েছে সে।
পায়ে হেটে বাড়ি পৌঁছতেই এত রাত হয়ে গেছে।
কিন্তু বাড়ির সদরদরজা এত রাতেও খোলা পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছে সে তবে সারাদিন রাগের মাথায় জেদ দেখিয়ে কিছু দাঁতেও কাটেনি সে।তাই আপাতত খিদেয় পেটে ইঁদুর ছুটছে।তাই নিজের মাথা আর এই দরজা খোলা রাখার ঘটনায় খাটানোর এনার্জি পায়নি সে।তাই আপাতত মাথা থেকে দরজা রহস্য সরিয়ে ফেলে অন্ধকারে গুটিগুটি পায়ে কিচেনে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যায় সে।ফ্রিজ খুলতেই রাতের বেছে যাওয়া সাদা ভাত আর মুরগীর মাংস দেখতে পায় সে।খিদের জ্বালায় সেটাই বের করে প্লেটে বেড়ে নেয়।ভয়ানক ঠান্ডা খাবারগুলোর মাঝে হাতের আঙুল খেলিয়ে সেগুলো মেখে নিয়ে প্রথম গ্রাস মুখে পুড়তেই কোথা থেকে চিকন কন্ঠে ভেসে আসে ,
“ঠান্ডা খাবারই খাবেন?আমি কি গরম করে দেব?”

কন্ঠস্বরের উৎপত্তি কোথা থেকে তা দেখতে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় তার ঠিক অপর পাশ বরাবর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঐশী।মুখে বরাবরের মতোই হাসি।

মুখে পোড়া খাবারটা চিবোনোর চেষ্টা করতেই সায়াহ্ন বুঝতে পারলো খাবারগুলো ভীষণ ঠান্ডা। দাঁত লাগাতেই দাঁত শিরশিরিয়ে উঠলো তার।তাই কিছুটা ভেবে,খানিক ইতস্তত করে সে ঐশীর দিকে চাইলো।নামানো কন্ঠে বলে উঠল,
“একটু গরম করে দিলে ভালোই হত।”

ঐশী আবার হাসে।হেসে এগিয়ে যায় সায়াহ্নর দিকে খাবারে প্লেটটা হাতে নিতে গিয়ে আবার হাত সরিয়ে নেয় সে।বারকয়েক চোখ পিটপিটিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে মুখে অদ্ভুত চুকচুক শব্দ করে বলে ওঠে,
“আরেহ্! আমি এ ঘরে কি করছি?তাও আবার আপনার সামনে?আমার তো আপনার কোন কাজ করা, আপনার ভাষ্যমতে সো কল্ড সেবা করা বারণ তাইনা? কি জানি কখন আপনি বলেন আমি এখানে এসে এটাই প্রুভ করতে চাইছি যে আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ!আর আমাদের মাঝে সম্পর্ক খুব ভালো!আমি ভীষণ দায়িত্বশীল স্ত্রী!কিন্তু এসব করে কি লাভ বলুন?এতেও তো আপনার মনে জায়গা করে নিতে পারবনা আমি!তারচেয়ে আমার এসব নাটক মা-বাবার সামনে গিয়েই দেখাবো নাহয়।আপনাকে দেখাতে এসে তো লাভ নেই।।এসব নাটকে আপনি,দি গ্রেট ঝগড়ুটে, রাগী,বদমেজাজী, অসামাজিক প্রাণী সায়াহ্ন রহমান তো ভুলবেনা!তাইনা?? অ্যাম আই রাইট?”

সায়াহ্ন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।এই মেয়ে যে তার চেয়েও দু ধাপ ওপরের ঘাড়তেড়া তা বুঝে নিতে বেশি বেগ পেতে হলনা তার।মুখের ভাতটুকু কোনরকম গিলে নিয়ে মাখা ভাত ফেলে উঠতে যেতেই টের পেল তার পেট গুরগুর করছে ডাকছে।এমতাবস্থায় খাবার ছেড়ে ওঠাটা বোকামো।তাই ঐশীর গায়ে আগুর জ্বালানো কথা গুলো হজম করে নিয়েই সে বলে উঠল,
“দেবেনা যখন তখন আগ বাড়িয়ে দরদ দেখাতে এসেছো কেন?আমার সামনে অযথা ঘুরঘুর করবেনা একদম।যাও তো এখান থেকে। ”

ঐশী সায়াহ্নর পাশের চেয়ারটা টেনে ধুপ করে বসে পড়লো।গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে নিস্পৃহ স্বরে বলে উঠল,
“এটা আমারও বাড়ি।আপনার বিয়ে করা বউ হিসেবে এ বাড়িতে আপনার সমান অধিকার আমারো আছে। তাই যখন তখন যেখানে সেখানে আমি অবাধে ঘুরতে পারি।আমাকে বাঁধা দেবার কোন রাইট আপনার নেই।তাই আমি এখানেই থাকব।আপনার সমস্যা হলে আমি চলে যান?এমনিতেও সকালে না বলে গেলেন,এ বাড়িতে থাকবেন না আর!তো আবার ফিরলেন কেন তবে?তাও আবার চোরের মতো!”

সায়াহ্নর এবার নিজেকে পাগল পাগল মনে হতে লাগলো।এই মেয়ের সাথে মুখ লাগাতে গেলেই বিপদ।তাই চুপচাপ মেখে রাখা ভাতে মনোযোগ নিবদ্ধ করলো সে।খিদে পেটে গপাগপ না চাবিয়েই ঠান্ডা ভাতগুলো গো গ্রাসে গিলতে লাগলো সে।
বেশ কিছুক্ষণ পর যখন তার খাওয়া শেষ হল তখন ঐশী আরেকটি গা জ্বালানো কথা বলে উঠল,
“এই খাবারগুলোও তো বাবার টাকায় কেনা,মায়ের নিজের হাতে রাঁধা।”
সায়াহ্ন ভ্রু কুচকে বলে উঠল,
“হ্যাঁ!তো?”
ঐশী দুষ্টু হাসলো।মুখময় সে হাসির আভারছড়িয়ে দিয়ে বললো,
“তো, এসবেও তো রায়ার অধিকার আছে,ষোল আনা আছে। এমনকি আমারো আছে।তো এই খাবার গুলো আপনি খেলেন যে?এখন আপনার পাকযন্ত্রে আবার এলার্জি হবে না তো?”

সায়াহ্নর কথা বলার ভাষা হারিয়ে গেল।কথার জালে এই মেয়ে তাকে কিভাবে ফাসিয়ে দিচ্ছে তা ভেবেই অবাক হয়ে গেল।
উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই পেটে মোচর দিয়ে উঠল তার।দুহাতে পেট চেপে একপলক ঐশীর মুখপানে তাকিয়ে একছুটে চলে গেল বাথরুমে।

ঐশী কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিল।পেছন থেকে চেচিয়ে বলে উঠল,
“কি হল মিস্টার সায়াহ্ন রহমান?আমাদের অধিকারস্থ খাবার খেয়ে শেষমেশ পেটেও এলার্জি হল নাকি আপনার!!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here