হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {শেষ পর্ব} #সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

1
1513

#হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {শেষ পর্ব}
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

একটা চেয়ারে বাঁধা রিফা।ঘরটা একদম অন্ধকার না হলেও আধারের রাজত্ব বেশি।পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাবে ঘরটা কেমন ভেজা ভেজা। রিফা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে দেখছে।কুঞ্জ ভিতরে ঢুকে রিফার সামনে বসলো।রিফা কান্না করতে করতে চোখ মুখ ভিজিয়ে ফেলেছে।কুঞ্জকে দেখে ভয়ে কাঁপছে সে। কুঞ্জ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,
—তনয় কোথায়?

রিফা ভয় পেয়ে বললো,
—তনয় কে?আমি কোনো তনয়কে চিনিনা।আমাকে প্লিজ যেতে দিন আমার মেয়ে বাসায় একা।

কুঞ্জ ধমকে বললো,
—একদম নাটক করবে না।বলো তনয় কোথায়?

রিফার সেই একই কথা,
—আমি তনয়কে চিনিনা।

কুঞ্জ এবার রিফাকে ভয় দেখাতে বললো,
—তোমার মেয়ে না বাসায় একা?তোমার মেয়ের বয়স কত?ওয়েট গেস করি আট বছর?

রিফা কেঁদে দিল।কুঞ্জ কন্ঠটা একটু নরম করে বললো,
—দেখো।বলে দাও তনয় কোথায়?তনয়কে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে সিসি ক্যামেরায় তা দেখা গিয়েছে।এমনিতেও আগেরদিন তনয় যখন তোমার সাথে কথা বলছিল তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল তোমার মধ্যে কোনো গন্ডগোল আছে।

রিফা হাত বাঁধা থাকায় চোখের পানি কাঁধের কাপড় দিয়ে মুছে নিলো। তারপর বললো,
—বলছি।রাতে আমি যখন ওকে ওষুধ খাওয়াতে যায় তখন ও ঘুমাচ্ছিল।আমি ওর ওঠার জন্য অপেক্ষা করি।ও উঠে আমাকে দেখে খুশি হয়ে বলেছিল,”আরে ডা. আপনি?আমার তো আজকের রাতটা তাহলে খুব ভালো কাটবে।”
আমি গম্ভীর কন্ঠে বলি,”আমি ডা. না নার্স।”
সে হাসে।হেসে বলে,”আমার জন্য আপনি ডা. আমার হার্টের ডা.।”
আমি বুঝতে পারি আমার জন্য তার মনে কিছু অনুভূতির জন্ম হচ্ছে। কিন্তু আমার জন্য তার অনুভূতি জন্মালে সে ঠোকে যাবে।তাই আমি তার সাথে আর কোনো কথা বলিনি।তাকে এড়িয়ে চলে এসেছি।কথাটা বলে কুঞ্জের দিকে তাকালো রিফা।

কুঞ্জ রেগে গিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে বললো,
—গল্প বানানো বন্ধ করো।সত্যিটা বলবে নাকি তোমার মেয়েকে নিয়ে আসবো?

রিফা ভয়ে কাঁপতে থাকে।সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—আমার স্বামী নেই।আমার মেয়েকে আমি অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি।আমার দুঃসময়ে আমাকে ডা. সাদমান আমাকে সাহায্য করে।

কুঞ্জ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—ডা. সাদমান কে?

রিফা বললো,
—আমাদের হাসপাতালেই চাকরি করতো সে।কিন্তু কিছু বছর আগে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়।

কুঞ্জ রিপার সামনে টুল নিয়ে বসলো।ভ্রু কুঁচকে বললো,
—কেন?

রিফা একটা ঢোক গিলে বললো,
—কারণ সে কিছু পেশেন্টের উপর এক্সপেরিমেন্ট করে যার কারণে তারা মারা যায়।যাতে আমাদের হাসপাতালের অনেক দূর্নাম হয়।তাই তার লাইসেন্স বাতিল করা হয়।

কুঞ্জ চোখ বড় বড় করে ফেলে।ঘামতে শুরু করেছে সে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
—তনয়ের উপর এক্সপেরিমেন্ট করোনি তো তোমরা?

ভীত চোখে তাকিয়ে আছে রিফা।মুহুর্তেই তার চোখের পানিতে পুরো মুখ গলা ভিজে যায়।হেঁচকি তুলতে তুলতে সে বললো,
—আমি ওনার সাথে এমন কিছু করতে চাইনি।ওনাকে আমারও অনেক পছন্দ ছিল।অনেক ভোলা আর সাদাসিধা ছিলেন উনি।অনেক ভালো মানুষ ছিলেন উনি।আমার একবার বলায় উনি আমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে যেতে রাজি হয়।তারপর ডা.সাদমানের গাড়ি এসে ওনাকে নিয়ে যায়।উনি আমার কাছে সাহায্যও চায়তে পারেনি কারণ উনি অজ্ঞান ছিল। আমি কিছু করতে পারিনি।

কুঞ্জের চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
—ইউ বাস্টার্ড! আর কোনো মানুষ পেলি না এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য?কি এক্সপেরিমেন্ট করেছিস তোরা?কোথায় নিয়ে গিয়েছিস ওকে?ওকে কি মেরে ফেলেছিস তোরা?

রিফা কুঞ্জের চিৎকারে কেঁপে ওঠে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
—আমি কিছু জানি না।আমার কাজ শুধু মানুষদের নিয়ে আসা।ঐ গাড়িটা.. ঐ গাড়িটা লোকদের কোথায় নিয়ে যায় আমি জানিনা।প্লিজ এবার আমাকে যেতে দিন।

কুঞ্জ দিক বেদিক হারিয়ে বের হয়ে আসে রুম থেকে। সারা শহরে লোক লাগিয়ে দেয় ডা. সাদমানকে খুঁজতে।নিজেও আবার হাসপাতালে চলে যায়।ডা. সাদমানের সম্পর্কে জানতে।ডা. মিরা আর কুঞ্জ বসে আছে সামনাসামনি। ডা. সাদমানের কথা শুনে ডা. মিরা অবাক হয়ে কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে বললো,
—ইনি তো সাইকো।

কুঞ্জ বললো,
—সাইকো কেন?

মিরা ডা. সাদমানের একটা ছবি দেখিয়ে বললো,
—ইনি ডা. সাদমান আমার সিনিয়র ছিলেন।যখন স্টুডেন্ট ছিলেন।তখন থেকেই উনি যেন কেমন ছিলেন মানে সবসময় নিজে কিছু একটা নিয়ে রিসার্চ করতেন।আমি একদিন তার কাছে জানতেও চাই কি নিয়ে সে রিসার্চ করছেন?তখন সে বলেন সে নাকি এমন কিছু ভাইরাস তৈরি করছে যেটা থেকে মানুষ অমর হবে।মানে কখনোই মরবে না।সেদিনই বুঝেছিলাম ওনার মাথায় সমস্যা।

কুঞ্জের ফোনে রূপ বার বার কল করছে কিন্তু কুঞ্জ বার বারই কেটে দিচ্ছে। রূপ রেগে আর ফোন করে না।কুঞ্জ ফোন সাইলেন্ট করে মিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
—এমন উদ্ভট রিসার্চ কেন করতো সে?

মিরা ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—সেটা তো জানি না। তবে মনে হয় সে আজীবন বেঁচে থাকতে চায়তো হয়তো মরতে চায় না সে।কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব না।

কুঞ্জ বললো,
—আচ্ছা ইনি এখন কোথায় আছেন জানেন?

মিরা বললো,
—না সেটা তো জানি না।

কুঞ্জ মিরাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো।বেরিয়ে রূপকে কল দিলো রূপ রিসিভ করেই বললো,
—হ্যালো।তনয়ের কোনো খোঁজ পেয়েছেন?

কুঞ্জ বললো,
—না পেলে জানাবো তোমাকে।আচ্ছা শোনো আমাকে কেউ কল দিচ্ছে। এখন রাখি।

কুঞ্জ ফোন কেটে দিয়ে সেই নম্বারে কল দিলো।যেটা কুঞ্জের গার্ডের নম্বার।কল রিসিভ করলে গার্ড বললো ডা. সাদমানের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে তারা।কুঞ্জ তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায় সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে।সেখানে গিয়ে কুঞ্জ দেখে একটা বেশ পুরোনো বাড়ি।দেখে মনে হচ্ছে বহুকাল আগে বানানো হয়েছে।কুঞ্জ বাড়ির কলিং বেলে চাপ দেয়।কিন্তু কলিং বেল বাজে না কারণ হয়তো বেলটা নষ্ট। কুঞ্জ এবার দরজায় জোরে জোরে থা’প্পড় দিতে থাকে।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ কিন্তু কেউ দরজা খোলে না।হঠাৎ কুঞ্জের গায়ে এক বালতি তরল পদার্থ পড়ে।যা দেখে কুঞ্জের সাথে থাকা গার্ডরা ভয় পেয়ে যায়।কিন্তু পুলিশের লোকেরা ভয় পায় না।কুঞ্জ গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তার গা ভর্তি র’ক্ত প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে সে উপরের দিকে তাকায়।উপরে ব্যালকোনিতে বালতি হাতে খিলখিল করে হাসছে ডা. সাদমান।কুঞ্জকে উপরে তাকাতে দেখে জিহ্বা বের করে ভেঙ্গালো। এতক্ষণে দরজা ভাঙা শুরু করে দিয়েছে।লোকটা দৌড়ে রুমের ভেতরে চলে গেল।কুঞ্জ ভেতরে ঢুকলো।ভেরতটা প্রচন্ড নোংরা।চারিদিকে ছিটে ফোঁটা রক্ত। ভেতরে যেতে চারিদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল।খুব সম্ভবত কোনো গ্যাস স্প্রে করেছে লোকটা।কিছুক্ষণের জন্য সবার শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হলো।চারদিক পরিষ্কার হতেই সবাই খোঁজা খুঁজি শুরু করলো।কিন্তু লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না।

চারদিক খোঁজা খুঁজি করতে করতে একটা চটের বস্তা দেখলো কুঞ্জ। কুঞ্জ বুক কেঁপে উঠলো অজানা আশংকায়। সে চিৎকার দিয়ে ডাকলো পুলিশ অফিসারকে,
—স্যার স্যার তাড়াতাড়ি এদিকে আসুন।এটা একটু খুলে দেখুন না।

অফিসারও ভীত চোখে তাকালো কুঞ্জের দিকে ওনার সাথে থাকা দুইজন কনস্টেবলকে বললো,
—এটা খুলো।

তারা সেটা খুলার কাজে লেগে গেল।কুঞ্জ শুঁকনো ঢোক গিলছে।বস্তার মুখ খুলতেই দৃশ্যমান হলো তনয়ে বেগুনি মুখ।কুঞ্জ কেঁপে উঠলো।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার কয়েক কদম পিছিয়ে গেল সে।আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বের করতেই দেখা গেল তনয়ের সারা শরীর। শরীর শিরাগুলো সব জেগে গিয়েছে।কোথাও কোনো কাটা ছেঁড়ার দাগ নেয়।ঠোঁটটা বেগুনি রং হয়ে আছে।কুঞ্জ দৌড়ে তনয়ের কাছে গেল।কিন্তু তনয়কে ধরার আগে অফিসার কুঞ্জকে আটকে দিয়ে বললো,
—দেখুন মি. কুঞ্জ দয়া করে ডে’ড বডির গায়ে হাত দিবেন না।

কুঞ্জ কাঁদছে।সে তনয়কে কখনো এমন অবস্থায় দেখবে স্বপ্নও ভাবেনি।কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক দিলো তনয়কে,
—তনয় ভাই আমার।দেখ আমি তোর ভাই এসেছি।ওঠ দেখ রূপ আমাকে মেনে নিয়েছে।তুই না ওর সাথে মিলে আমাকে জ্বালাতে চেয়েছিলি?জ্বালাবি না?ভাই?

অফিসার তনয়ের বডি নিয়ে যেতে বললেন।আর কুঞ্জকে বললেন,
—মি. কুঞ্জ আপনি বাসায় যান।আমরা ডা. সাদমানকে ধরার জন্য অলরেডি ফোর্স লাগিয়ে দিয়েছি।বডি পোসমর্টাম করে লাশ পাঠিয়ে দিবো।

কুঞ্জ ভীত চোখে অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললো,
—স্যার পোসমর্টাম না করলে হয় না?এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার ভাইটা।

অফিসার অসহায় কন্ঠে বললেন,
—দেখুন মি. কুঞ্জ এটি তো পুলিশ কেস।না হলে আমি অবশ্যই আপনার কথা রাখতাম।

কবর স্থানে দাঁড়িয়ে কবর যিয়ারত করছে কুঞ্জ আর রূপ।বাড়ির বাকি সবাইও আছে শুধুমাত্র লেউসি দেওয়ান ছাড়া।সে এমার্জেন্সি টিকিট পায়নি।তাই আসতে পারিনি। রূপ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর কুঞ্জ নিঃশব্দে। মাত্রই তনয়ের দা’ফন কার্য শেষ হলো।কুঞ্জের মাথায় টুপি গায়ে কালো পাঞ্জাবি। রূপের গায়ে কালো রঙের শাড়ি।রিফাকে পুলিশ এরেস্ট করেছে।ডা. সাদমানকেও পুলিশ ধরে এনেছে।জানা গেছে তার বাবা মা সে অনেক ছোট থাকতে মারা যায়।তার আপন চাচা তার বাবা মাকে মারে।যা সে মেনে নিতে পারিনি। সে পালিয়ে বাঁচলেও মানষিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।সে মৃত্যুকে খুব ভয় পায় মৃত্যু থেকে বাঁচতেই তার এতো কাণ্ড। তনয়ের বাবা মা নেই তাই কুঞ্জই ছিল তার সবকিছু।রূপকে শান্তনা দিতে কুঞ্জ রূপের কাঁধে হাত দিলো।রূপ আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।কুঞ্জ নিজের চোখ মুছে বললো,
—দোয়া কর কেঁদো না।কারও আসাতে জীবন পূর্ণতা পায় আবার কারও আসাতে জীবনের সমাপ্তি ঘটে।যেমন তুমি আসাতে আমার জীবন পূর্ণ হলো আর রিফার আসাতে তনয়ের জীবনে সমাপ্তি ঘটলো।

সমাপ্ত

(আসসালামু আলাইকুম। সবাই আসা করি ভালো আছেন।গল্পটা শেষ করলাম। জানি গল্পটা নিয়ে অনেক তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি।শেষের দিকে হয়তো বরিংও বানিয়ে ফেলেছি।আসলে আমি গল্পটা বেশি বড় করতে চাইনি।দশ পর্ব করতে চেয়েছিলাম।তবে আপনাদের ভালো রেসপন্স পাওয়ায় পাঁচ পর্ব বেশি করে ফেলছি। সব শেষে সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য।আজকেও আবার নেক্সট লিখেন না যেন।🙄)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here