হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {২} #সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

0
1311

#হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {২}
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে রূপের মন খারাপ হয়ে গেল।তার তো শ্বশুরবাড়ি এখন আর তার নেই। তার স্বামীও এখন তার নেই।ভাবনার মাঝেই কুঞ্জের কথায় তার ধ্যান ভাঙে।
কুঞ্জ চামচ দিয়ে খাবার মুখে দিতে দিতে বললো,

—কেমন বর যে বউ একদিন একরাত বাড়িতে নেই তাও তার খোঁজ নেয় না?যেমন তুমি তেমন তোমার পছন্দ! হাহ্!

রূপের রাগ হলো কুঞ্জের কথায়।অনিলকে নিয়ে কথা বললে সে এমনিতেও সহ্য করতে পারেনা।তারউপর তার পছন্দ নিয়েও কথা বলছে কুঞ্জ। তাই সে রাগি গলায় বললো,
—অনিলকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবেন না।আপনি যাকে চিনেননা তাকে নিয়ে এভাবে বলতে পারেন না।

কুঞ্জ মুখ বাঁকিয়ে তাকালো রূপের দিকে। তারপর বিদ্রুপ করে বললো,
—এহ্ ভালোবাসা!এতো ভালোবাসা স্বামীর জন্য তাহলে তোমার স্বামী তোমার খোঁজ নিল না কেন এখনও?

রূপ চুপ করে থাকলো।কুঞ্জও আর বেশি ঘাটলো না। টেবিল থেকে উঠতে উঠতে তনয়কে উদ্দেশ্য করে বললো,
—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ওর স্বামীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

তনয় মাথা নাড়লো। এদিকে রূপ কুঞ্জের কথায় ঘামতে শুরু করেছে।তাও কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—আমার কোনো শ্বশুরবাড়ি নেই।

কুঞ্জ দাঁড়িয়ে গেল।পিছন ফিরে রূপের দিকে তাকালো।হালকা গোলাপি রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা।সোজা রেশমি চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে।ফর্সা গায়ে গোলাপি রঙে স্নিগ্ধ গোলাপের মতো লাগছে কুঞ্জের কাছে।কপাল ও ঠোঁটের উপরের ঘামগুলো যেন মনে হচ্ছে সদ্য ফোঁটা গোলাপের উপর শিশির বিন্দু।কয়েকা শুঁকনো ঢোক গিললো কুঞ্জ।নিজেকে সামলে নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
—মানে?

রূপ কুঞ্জের এমন গভীর চাহনিতে একটু বিব্রত হলো।নড়ে-চড়ে নিচু স্বরে বললো,
—আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।

কুঞ্জ অবাক হলো।তারপর কিছু একটা ভেসে বাঁকা হাসলো।ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,
—জানতাম!তনয় তাহলে তুমি ওকে সুন্দর করে ওর বাবার বাড়িতে ডেলিভারি করে দিয়ে এসো ঠিক আছে?

শেষের কথাগুলো কুঞ্জ বিদ্রুপ করে বললো।রূপের একটু খারাপ লাগলো।পরমুহূর্তে সে ভাবলো তার বাড়ির কেউ তাকে রাখবে না।তখন কি হবে?রূপ বসে বসে এসব সাত পাঁচ ভাবছে তখনই তনয় বললো,
—ভাবি আপনি কি ব্রাজিল নাকি আর্জেনটিনা?জানেন তো এখন বিশ্বকাপ চলছে?

তনয়ের কোনো কথা রূপের কানে ঢুকছেনা। সে নিজের জল্পনা কল্পনা নিয়ে ব্যস্ত।রূপের কোনো সাড়া না পেয়ে তনয় রূপের হাত ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে দিলো।আচমকা এমন হওয়ায় রূপ বেশ ঘাবড়ে গেল আঁতকে উঠে বললো,
—এই কে?

তনয় আবার টান দিয়ে রূপকে বসিয়ে দিল।রূপ তনয়কে এমন করতে দেখে একটু রেগে বললো,
—কি হয়েছে?

তনয় অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
—আরেব্বাস এ তো দেখি রাগও দেখাতে জানে।তো ভাবি কি তার প্রাক্তন স্বামীর কথা ভাবছিলেন?

রূপ বিরক্ত হয়ে বললো,
—বাজে কথা বাদ দাও।আর একটু আগে কি বলছিলে সেটা বলো।

তনয় আবার বিশ্বকাপের কথা জিজ্ঞেস করলো,
—তা ভাবি কি ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা?ভাই কিন্তু আর্জেনটিনা।আমি আবার ব্রাজিল।

রূপ বিরক্তি নিয়ে বললো,
—আমি খেলা বুঝি না।

ডাইনিং-এ বসে এসব খেজুরে আলাপ করছিল দুজন।তখন সেখানে আবার উপস্থিত হয় কুঞ্জ। এবার সে একদম কমপ্লিট সুটে এসেছে।সাদা শার্ট কালো কোট ও কালো পাজামা।হাতে টাইটানের দামি ঘড়ি।চোখে গোল গোল দুইটা চশমাও লাগিয়েছে সে।তনয় আর রূপকে এমন খোশগল্প করতে দেখে কুঞ্জর বেশ রাগ হলো।রাগি কন্ঠে বললো,
—তনয় তোমার কি কোনো কাজ নেই?মেয়ে মানুষের সাথে এতো কিসের কথা তোমার?

তনয় দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিল।টেবিল থেকে উঠে কুঞ্জের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—ভাই কি জেলাস নাকি?

কুঞ্জ তনয়ের কথা শোনার জন্য কান এগিয়ে নিয়েছিল।তনয়ের কথা শুনে চোখ গরম করে তাকালো সে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—অবান্তর কথাবার্তা বন্ধ করে চলো আমার সাথে।আর একটা কথা মেয়ে মানুষের থেকে যত দূরে থাকবে জীবনে ততোই সুখে থাকবে বুঝেছো?

রূপ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল।তবে কি বিষয়ে এরা কথা বলছে তা রূপ বুঝতে পারিনি।কুঞ্জ চলে যাওয়ার কথা বলতেই রূপ তড়িঘড়ি বলে,
—কোথায় যাবেন?

পরক্ষণেই বুঝতে পারে ভুল জায়গায় ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। যেহেতু এতো সেজে গুঁজে যাচ্ছে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কাজে যাচ্ছে। রূপ দাঁত দিয়ে জিভ কাটে।রূপের কথায় কুঞ্জ বিরক্তকর চাহনি দেয়।রাগি গলায় বলে,
—আমার খাচ্ছো আবার আমার কাছেই কৈফিয়ত চাচ্ছো?এ তনয় ওকে বলো কোথায় যাচ্ছি আমরা?

তনয় তার দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো।দাঁত বের করেই বললো,
—আপনার জামাই পেটাতে যাচ্ছি। যাবেন নাকি?

কুঞ্জ রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তনয়ের দিকে।রূপ ভয় পেয়ে যায়।ভয়ে বলে,
—আস্তাগফিরুল্লাহ্! দয়া করে এমন কিছু করবেননা।অনিলের কিছু হলে আমি…

আর কিছু বলতে পারে না রূপ।কুঞ্জ রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিয়ে।মনে হচ্ছে এখনই খেয়ে ফেলবে।কুঞ্জ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
—হাহ্! ভালোবাসা!এনিওয়ে তুমি রেডি হয়ে থেকো।আমরা ফিরে আসার পর তনয় তোমাকে তোমার বাড়ি দিয়ে আসবে।

কুঞ্জ আর তনয় বেরিয়ে গেল।রূপ এই ফাঁকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে লাগলো।বাড়িটা বেশ সুন্দর। আর ঐ গোমড়া মুখ লোকটাও যে বেশ সৌখিন তাও বোঝা যাচ্ছে বাড়ির সাজসজ্জা দেখে।বাড়ির এমন কোনো দেয়াল নেই যেখানে পেইন্টিং নেই। সবগুলো পেইন্টিং খুব নিখুঁত হাতে আঁকা হয়েছে।এতো দক্ষ হাতে আঁকা যে পেইন্টিং গুলো দেখে মনে হচ্ছে এগুলো সত্যি চোখের সামনে আছে।রূপ অবাক হয়ে দেখছে চারপাশ।হ্যাঁ সে জানতো বড়লোকরা অনেক বিলাসী জীবনযাপন করে।কিন্তু কোনো মানুষ এতো বেশি বিলাসী হয় সে এই প্রথম দেখছে।ঘুরতে ঘুরতে সে একটা রুমে চলে যায়।বিশাল রুমের চারিদিকে ছবি আঁকার সরঞ্জাম। বেডের টিক মাথার কাছের দয়ালে এক বিশাল পেইন্টিং। এটা তাকে যে রুমে রাখা হয়েছিল সেই রুমের পেইন্টিংটাই।সেই চোখ জোড়া।তবে এটা আরও বিশালাকৃতির। রূপ এগিয়ে গেল সেদিকে।এই চোখজোড়া সে আগেও দেখেছে।রূপ কোমল হাতে ছুঁয়ে দিলো পেইন্টিংটা।পেইন্টিংটার একদম শেষ প্রান্তে ডান সাইডে খুব সুন্দর অক্ষরে “কুঞ্জ দেওয়ান” লেখা। ঐ রাগি লোকটা এতো সুন্দর ছবি আঁকে?কই লোকটাকে তো দেখে বোঝা যায় না।আচ্ছা লোকটার কি কেউ নেই?বাবা কিংবা মা কেউকেই তো দেখি না।এতো বড় বাড়িতে লোকটা একা থাকে?
এসব ভাবতে ভাবতে রূপ চলে গেল তাকে যে রুমে রাখা হয়েছিল সেখানে।তারপর ভাবতে লাগলো তার বাবার কথা।সে কখনো তাকে বাড়িতে থাকতে দিবে না।তখন কোথায় যাবে রূপ?
পরিবার তাকে আর অনিলকে মেনে না নেওয়ায় তারা পালিয়ে বিয়ে করে।অনিলের জন্য সে তার জন্মদাতা মা-বাবাকে ছেড়েছে।আর এখন তার ভালোবাসা তার অনিলই তাকে ছেড়ে দিল।আসলেই বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে সুখী হওয়া যায় না।এখন রূপ এটা খুব ভালো ভাবে বুঝছে।

দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।বিকেল পেড়িয়ে রাত হয়ে গেল।কিন্তু তা কুঞ্জ এলো না তনয় এলো!রাত আটটার দিকে তনয় এলো রূপের ঘরে।রূপ তনয়কে দেখে বললো,
—এখন আসলে?তাহলে বাসায় যাবো কখন?

তনয় দাঁত দিয়ে জিভ কেটে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
—আসলে ভাবি আজ তো আর সময় নেই। তাই আমরা কাল যাবো সকালে।

রূপ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—হুম।

তনয় এগিয়ে এসে বসলো রূপের পাশে।জিজ্ঞেস করলো,
—ভাবী রাতের খাবার খেয়েছেন?

রূপ না বোধক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—না।আপনি?

তনয় এবার দাঁত বের করে হাসলো।চুলগুলো পিচনে ঠেলে বললো,
—কি যে বলেন ভাবী আপনাকে ছাড়া কি আমি একা একা খেতে পারি?

রূপ তনয়ের কথা না বুঝে বললো,
—মানে?

কুঞ্জ রূপের ঘরেই আসছিল। এসে তনয়কে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। তনয়ের কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেল।কর্কশ গলায় বললো,
—তনয়?তুমি এখানে কি করো?তোমাকে না বলছি মেয়ে মানুষের সাথে কথাবার্তা একটু কম বলবে?

কুঞ্জকে দেখে রূপ দাঁড়িয়ে গেল।নিজের কামিজের ওড়না ঠিকঠাক করতে লাগলো।যদিও সেগুলো আগে থেকেই ঠিক ছিল। তাও একবার ঠিক করলো।তনয় থমমত খেয়ে বললো,
—আরে ভাই?আপনি?

কুঞ্জ আগের মতোই কর্কশ গলায় বললো,
—কেন ডিস্টার্ব করলাম নাকি?তোমাকে আমি কি বলছিলাম?

তনয় মনে করার ভান করতে করতে বললো,
—কি বলছিলেন যেন?

কুঞ্জ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—চুপ থাকো গ’র্ধব!যাও নিজের কাজে।এসেই ওমনি এই রুমে কি?একা একটা মেয়ের রুমে আসতে লজ্জা করে না?

তনয় নিষ্পাপ কণ্ঠে বললো,
—আপনিও তো আসছেন তাহলে?

কথাটা বলে কুঞ্জের দিকে তাকাতেই শুঁকনো ঢোক গিললো তনয়।রূপ ঠোঁট টিপে হাসলো।কুঞ্জ চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তনয়ের দিকে।তা দেখে তনয় ভীত স্বরে বললো,
—এমন করেন কেন?আমি কি ভাবিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?যাচ্ছি তো।

তনয়ের কথা শুনে রূপ অবাক হয়ে বললো,
—কিহ্?

তনয় তড়িঘড়ি বললো,
—কিছু না। যাচ্ছি আমি।

কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিল তনয়।কুঞ্জ রক্ত চক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
—স্বপ্নেও ভেবো না এই কথা।একবার হারিয়েছি।এখন যখন ফিরে পেয়েছি আর হারাতে দেবো না।

তনয় মুচকি হাসলো।তনয় যেতেই কুঞ্জ কয়েকটা ব্যাগ ছুড়ে মারলো রূপের দিকে।এবার রূপ এগুলো ঠিক ধরে নিল।ব্যাগগুলো ছুড়ে গিয়েই কুঞ্জ রুম থেকে চলে গেল।রূপ ঠোঁট উল্টায়। ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আবার কুঞ্জের যাওয়ার দিকে তাকায়।মন খারাপ করে নিজে নিজেই বলে,
—আজব! লোকটা এমন কেন?হুহ্!

রূপ ব্যাগগুলো নিয়ে বিছানায় বসে।ব্যাগগুলো এক এক করে খুলে দেখে তার ভিতর কিছু সেলোয়ার-কামিজ। আর একটা সুন্দর হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখে তার উপর ছোট একটা কাগজে “রূপ” লেখা।রূপ হাসে।সে জানে না সে কেন হাসছে? তবু সে চওড়া হাসি দেয়।

চলবে..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here