#হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {৩}
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
বসার ঘরে সোফায় বসে খুব মনযোগ সহকারে খবরের কাগজ পড়ছে রেজা খান।তার পাশে বসেই তার ছোট ছেলে মিলন টিভিতে ”চিকু অর বান্টি”দেখছে আর হেসে হেসে বার বার সোফায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।রেজা সাহেব বার বার বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে।মিলন এবার ক্লাস নাইন পাশ করে টেনে উঠেছে।মিলনের মা ইমামা রান্না ঘরে তার স্বামীর জন্য চা বানাচ্ছে।মিলনের হাসিতে রেজা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
—এই তোমার পড়া নেই?সারাদিন এসব কি দেখো?
মিলন কিছু বলবে তার আগেই বাড়ির সদর দরজার কলিং বেলটা বেজে ওঠে।ইমামা বেগম রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
—এই মিলন যা তো দরজাটা খুলে দে।
মিলন গিয়ে দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় রূপ ও তনয়।মিলন এতো দিন পর নিজের বোনকে দেখে অবাক হয়ে যায়।পরক্ষণেই নিজের বোনকে জরিয়ে ধরে খুশিতে কেঁদে দেয়।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—আপু এতোদিন তুমি আসোনি কেন?কত মিস করেছি তোমাকে জানো?
রূপ নিজের ভাইকে এতোদিন পর পেয়ে সেও জরিয়ে ধরে।ভাইকে শান্তনা দিতে বলে,
—কাঁদছিস কেন পাগল ছেলে?কেমন আছিস বল তো?
এদিকে মিলনের আপু বলা শুনে রেজা সাহেব নিজের জায়গা থেকে উঠে আসে।এতোদিন পর নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।পরক্ষণেই রূপের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা মনে আসতেই হুংকার দিয়ে বলেন,
—তুমি এখানে আসার সাহস পেলে কোথায়?
রূপের কষ্টে কান্না চলে এলো।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।ও চোখের পানি মুছে ওর বাবাকে বললো,
—আব্বু কেমন আছো?
রেজা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
—নাটক কম করো। বের হও আমার বাড়ি থেকে।আমার মান সম্মান সব তুমি নষ্ট করে দিয়েছো।নিজে তো স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই আছো।এদিকে আমাদের যত হেনস্তা হতে হচ্ছে।
রেজা সাহেবের কথা শেষ হতেই রূপের পিছন থেকে মাথা বের করে তনয়।দাত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলে,
—কেমন আছেন আংকেল?
রেজা সাহেব অবাক হয়ে বলে,
—আরে তনয়?তুমি?
তনয় মাথা চুলকে রূপের পিছন থেকে বের হয়ে আসে।রূপ বিস্মিত হয়ে ওর বাবা আর তনয়কে দেখছে।ভাবছে তার বাবা তনয়কে কিভাবে চিনলো?তনয় রেজা সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—আংকেল আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।কুঞ্জ ভাই আমাকে পাঠিয়েছে।
এদিকে নিজের স্বামীর চিৎকারে রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসে।এসে রূপকে এতোদিন পর দেখে কেঁদে দেয়।দৌড়ে এসে রূপকে জরিয়ে ধরে বলে,
—রূপ কেমন আছিস মা?
তনয় রূপকে বলতে না দিয়ে বলে,
—আন্টি ভাবী ভালো আছে।আপনি ওনাকে ওনার রুমে নিয়ে যান।আমার আংকেলের সাথে কথা আছে।
রূপকে ঘরে নেওয়ার কথা শুনে রেগে যায় রেজা সাহেব।দ্বিমত পোষণ করে বলেন,
—না ও আমার বাড়িতে থাকবে না।
তনয় রেজা সাহেবকে বললো,
—আংকেল শান্ত হন।কুঞ্জ ভাই বলেছে ওনাকে এখানে থাকতে।আন্টি ভাবীকে নিয়ে ঘরে যান।
ইমামা ও মিলন রূপকে নিয়ে রূপের ঘরে চলে যায়।এতোদিন পর রুমটা দেখে কান্না করে দেয় রূপ।সে তার এতো সুন্দর রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এতো ভালোবাসা ছেড়ে একটা বিষাক্ত মানুষের কাছে গিয়েছিল নিজের সুখ খুঁজতে।মুখে অনিলকে বিষাক্ত বললেও মন থেকে ঘৃণা করতে পারছে না সে।কত ভালো বাসতো সে অনিলকে। অনিলও তো তাকে পাগলের মতো ভালো বাসতো।তার সাথে একটু কথা বলার জন্য অনিল কেমন ছটফট করতো।আর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বললে তো মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো।কিন্তু এখন অনিল নিজেই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।তাও মাঝ পথে!রূপকে এমন ভাবুক হতে দেখে ইমামা বেগম রূপকে ধাক্কা দিলো।জিজ্ঞেস করলো,
—কেমন আছিস মা?
রূপ নিজের আবেগ অনুভূতি ধরে রাখতে পারলো না।সে শব্দ করে কেঁদে দিলো।কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—মা আমি ভালো নেই মা!
ইমামা বেগমও কেঁদে দিলেন।মিলনকে পাঠিয়েছেন লেবুর শরবত আনতে। যা গরম পড়েছে!লেবুর শরবত খেলে একটু ভালো লাগবে।ইমামা বেগম আহত স্বরে বললেন,
—কি হয়েছে মা?কোনো সমস্যা?আমাকে বল!
রূপ ওর মাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মাকে বললো,
—মা অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।মা ক্ষমা করে দাও আমাকে।
ইমামা বেগম কি বলে নিজের মেয়েকে শান্তনা দিবেন তা সে ভেবে পায় না।সত্যি তো এটাই যে রূপ যেটা করেছে সেটা ভুল।রূপ কিছুক্ষণ থেমে আবার কেঁদে দিলো তার মাকে বললো,
—মা অনিলের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
ইমামা বেগম অবাক হন।মেয়েকে কোল থেকে উঠিয়ে বলে,
—কি বলছিস এসব?কেন?
রূপ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,
—কারণ আমি ওর বংশের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবো না।
ইমামা বেগম কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন।নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তব্দা খেয়ে। সে বিশ্বাসই করতে পারছেন না। কিভাবে সম্ভব তার মেয়ের তো কোনো সমস্যা নেই তাহলে কেন তার মেয়ে মা হতে পারবে না?হঠাৎ ইমামা বেগম নিজের মেয়েকে শক্ত করে জরিয়ে ধরেন।
তনয় আর রেজা সাহেব মুখোমুখি বসে আছে।রেজা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
—কুঞ্জ এখনো কেন রূপের জন্য এতো কিছু করছে বলবে আমাকে একটু?
তনয় হাসে কপাল চুলকে বলে,
—তা আবার নতুন করে বলা লাগবে আপনি তো সব জানেনই।কুঞ্জ ভাই বলছে উনি ভাবিকে নিয়ে যাবে।আর যতদিন না নিয়ে যায় ততোদিন ভাবি এখানে থাকবে।
রেজা সাহেব বললেন,
—তুমি রূপকে কোথায় পেয়েছো?আমরা এতো দিন খোঁজ খবর নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো খবর পাইনি।
তনয় একটা লম্বা একটা শ্বাস নিলো।তারপর বলতে শুরু করলো,
—আসলে আমি গিয়ে ছিলাম ভাইয়ের নেক্সট পেইন্টিং-এর লোকেশন ঠিকঠাক করতে।তো আমি সব ঠিকঠাক করে আসার পথে দেখি ভাবি রাস্তায় পড়ে আছে।আমি প্রথমে গাড়িতে বসে চিনতে পারিনি।গাড়ি থেকে নেমে কাছে যেতেই দেখি ভাবি।ভয়ে তো আমার আত্মা কেঁপে উঠেছিল।ভাবতে থাকি কি করবো?তারপর ভাবিকে নিয়ে কোনো উপায় না পেয়ে ভাইয়ের কাছে যায়।এতো বছর পর ভাই ভাবিকে দেখবে আসা করেনি।আর এভাবে দেখবে তাও আসা করেনি।সব ঘটনা শুনে ভাই ভাবীর ট্রিটমেন্ট শুরু করাই।ভাবি জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি ভাবির অনিলের সাথে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।তাই ভাই বললো আপনার কাছে দিয়ে যেতে।
রেজা অবাক হয়ে বললেন,
—ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে মানে?কেন ডিভোর্স হলো?
তনয় বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,
—জানি না সেটা ভাবি বলেনি।ভাই হয়তো আপনার সাথে একবার দেখা করতে আসতে পারে।আচ্ছা আমি আজকে আসছি ভাই কল করছে।
বলতে বলতে তনয় বের হয়ে গেল ফ্লাট থেকে।ফ্লাট থেকে বের হয়ে কুঞ্জর কল রিসিভ করে।কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে রাগি গলায় কুঞ্জ বলে উঠলো,
—এই তুমি এতো সময় ঐখানে কি করো হ্যাঁ?জামাই আদর খাও নাকি?
তনয় কুঞ্জকে খেপাতে দাঁত কেলিয়ে বলে,
—ঐ আরকি ভাবি আর আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি করলাম আরকি বুঝছেন ভাই?
কুঞ্জ এবার আরও জোরে ধমক দিয়ে বললো,
—তোমার সাহস বেশি হয়ে গিয়েছে।দাড়াও তোমার ব্যবস্থা নিতে হবে।এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে আমি যে ব্রান্ডের জল রং ব্যবহার করি ঐ ব্রান্ডের আরেকটা জল রং নিয়ে আসো আগেরটা শেষ।গার্লস কলেজের সামনে গিয়ে আবার দাড়িয়ে থেকো না তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।
চলবে..?