হরিপুর যাত্রা পর্ব-১(বারি অন্বেষণ)

0
366

হরিপুর যাত্রা
পর্ব-১(বারি অন্বেষণ)

দুপুর বেলা কলেজ থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত অরুপ।এক গ্লাস পানির জন্য পাঁচ মিনিট ধরে ডাকছে মা কে, কিন্তু তার মায়ের কোনো খোঁজ খবর নেই। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে নিজেই রান্না ঘরে গেলেন পানি আনতে। মাটির কলসির পানি ঠান্ডা থাকে। মাটির কলসির হাজার খোঁজ করেও পাওয়া যাচ্ছে না।পাত্র হাতে নিয়ে উঠানে গেলেন টিউবওয়েল থেকে পানি নেওয়ার জন্যে। সেখানে আগে থেকেই মহাভারতের পূর্নাবৃত্তি চলছে।রাধা মাসির চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে আছেন বিনা দি।আর বিনা দির চুল পর্যন্ত হাত পৌঁছাতে না পারায় তার বুকের ব্লাউজ ধরে আছেন রাধা মাসি। সেখানে দাঁড়িয়ে দম নেওয়ার আগেই আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাগন যারা এতোক্ষণ তাদের যুদ্ধ উপভোগ করছেন চটে গেলেন অরুপের উপর। সেই রণক্ষেত্রে উপস্থিত অরুপের পিসি নিজেই চেঁচিয়ে বললেন,”শিগগিরই ঘরে যা বাপু!এখানে দাঁড়াস নে।এই মাগীরা যে কোনো সময় একে অপরের বস্ত্র হরণ করবে। তুই ঘরের মধ্যে ঢুইকে বসে থাকগে।”
অরুপ ব্যর্থ মন ও তৃষ্ণার্ত হলক নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। মনে মনে ভাবছেন,”এতগুলো মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে তামাশা না দেখে যদি দু’জনকে ছাড়িয়ে দেয় তাহলেই তো এই মহাভারতের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বিনে টিকিটে বস্ত্রহরণ অনুষ্ঠানে কেউ বিঘ্ন ঘটাতে চাইছে না।”
তৃষ্ণায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন অরুপ। চিন্তা করলেন ঘটিতে থাকা গরম পানি পান করে প্রাণ রক্ষা করতে হবে। রান্নাঘরের তাপে ঘটিতে থাকা পানি প্রায় ফুটন্ত।ঘটির গায়ে হাত দিয়েই তৎক্ষণাৎ সরিয়ে ফেললো হাত।মনে মনে ভাবছে এই গরমে ঘটিতে থাকা এ পানি পান করলে স্বরযন্ত্র নির্ঘাত পুড়বে। হঠাৎ অরুপ ভাবলো পাশের বাসার তটিনীদের বাসায় গিয়েই তো এক গ্লাস পানি পান করা যায়। অরুপ ছুটে গেল তটিনীদের ঘরে। ঘরের মেঝেতে শুয়ে আনমনে চিত্রাংকন করায় বিভোর তটিনী।তটিনীদের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অরুপ।তটিনী একবার মাথা তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে আবার চিত্র অঙ্কনে মনযোগ দিয়ে বলল,”কিরে অরুপ দাদা!দুয়োরে ছেওড়াদের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভিতরে আয়।”
অরুপ ভিতরে ঢুকে তটিনীর পাশে বসে বলল,”আমার সোনা ময়না তটিনী কি করছে?”
বিরক্তিকর চোখে অরুপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,”মতলব কি মশাই? সরাসরি বললে ভালো হয়।ওসব ময়না টিয়ে বলে আমাদের উঠোনের আমড়া,পেয়ারা খাওয়ার দিন শেষ।”
জোরপূর্বক হেসে অরুপ উত্তর দিলেন,”ধুর বোকা ওসব কিছু না।বড় তৃষ্ণা পেয়েছে রে। তোদের মাটির কলস থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে আয় না।”
তটিনী চিত্রে রঙতুলি ঘষাঘষি করতে করতে বলল,”একটু বসে জিরো।আমি সূর্যের কিরণটায় রং ঘষে যাচ্ছি।”
অরুপ উত্তেজিত হয়ে বলল,”আরে ভাই যাস না একটু। তৃষ্ণায় প্রাণ বেরিয়ে গেল যে।”
তটিনী ঠান্ডা মাথায় বলল,”এতো ক্রোধিত স্বরে আমার সাথে কথা বললে কলিজাটা আজীবন শুকিয়েই থাকবে।আর আমাকে দিয়ে জল আনয়নের জন্যে খরচা দিতে হবে।”
অরুপ ভ্রু কুঁচকে বলল,”কি খরচা দিতে হবে তবে?”
তটিনী বলল,”দুই সিকি দিলেই চলবে”
অরুপ তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলল,”যা নিয়ে আয়, দুই সিকি ই দিব।”
তটিনী অট্টহাসি হেসে বলল,”আমাকে কি গবেট মনে হয়? আমি সিকি না নিয়ে জল আনবো তারপর তুই জল গিলে সিকি আর দিবি নে।আগে সিকি পরে জল।”
অরুপ বলল,”কি জ্বালারে ভগবান।এই নে দুই সিকি যা জল নিয়ে আয়।আর বড় পাত্রে নিয়ে আয় নাইলে হবে না।”
তটিনী রান্না ঘরে গিয়ে তামার গ্লাসে পানি নিয়ে এলো।তরিঘরি করে পানির গ্লাস হাতে নিয়েই চুমুক দিয়ে এক ধাক্কা খেল অরুপ। মুখের পানিটুকু ফেলে দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,”এই বাঁদর ছানা তোকে না বলেছি ঠান্ডা জল আনতে।এ দেখি ফুটন্ত গরম জল।”
তটিনী মুচকি হেসে বললো,”মাটির কলসটা গতকাল ভেঙ্গে গেল রে দাদা।এখন মা ঘটিতে জল রাখেন। তোর তো ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।এই জলটাই গিলে নে।”
অরুপ উঠানে তামার গ্লাসটি ফেলে দিয়ে রাগে গজগজ করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। প্রচন্ড রোদে মাথা ঘুরছে অরুপের,এর মধ্যে পানিশূন্যতা।এতো জায়গায় পানি খুঁজে ব্যর্থ হয়ে তার মাথার তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার বাসুদেব কাকুর সাথে রাস্তায় দেখা। বাসুদেব কাকু জিজ্ঞেস করলেন,”কি গো ভিষক মশাই, চেহারার বাড়োটা বেজে আছে কেন?”
অরুপ পরম দুঃখিত কন্ঠে সব খুলে বললেন বাসুদেব চ্যাটার্জিকে। অরুপের ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে বাসুদেব বললেন,”আরে ছোকরা আমার ঘরেই তো বিশাল মাটির মটকা আছে।কি ঠান্ডা ও সুস্বাদু জল তার।আয় আমার ঘর থেকে জল খাবি।”
অরুপের কাকার জন্যে শ্রদ্ধা আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়ে গেল।তার ডাক্তারি পড়ার সময় এক টাকা দিয়ে ও সাহায্য করে নি এই লোকটি। অনেক ধন সম্পদের মালিক আর তার আপন কাকা হয়েও তার বিপদের সময় কোনো কাজে আসেনি সে। কিন্তু তাতে কি!আজ উনি ই তো দেবতা হয়ে তার জীবন রক্ষা করবেন এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাইয়ে। বাসুদেব অরুপকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলেন।অরুপকে সামনের ঘরেই বসিয়ে তিনি ভিতরে গিয়ে মটকা থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলেন। ঠান্ডা পানির গ্লাসের বাহিরে জমে থাকা বাষ্প দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল অরুপের।কাকার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ঠান্ডা পানির গ্লাসটি হাতে নিল অরুপ। পিতলের গ্লাসটি ধরে অরুপের গরমে ঘামন্ত হাতটি শীতল হয়ে গেল। অরুপ ভাবছে এই টা পানি নয়, সাক্ষাৎ অমৃত। অরুপ গ্লাসটি এনে মুখে ঠেকাবে ওমনিতে তার কাকিমা এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় গ্লাসটি। অরুপ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে তার কাকিমার দিকে। বাসুদেব তার স্ত্রীকে বললেন,”একি করলে মালতী,ছেলেটাকে জল পান করতে দিলে না কেনো?এ কেমন ব্যবহার তোমার।”
অরুপের কাকিমা মালতী ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন,”কি করছি দেখলেন না?জলের গ্লাস ফেলে দিয়েছি।তো আপনি কি চান আমি আপনার ভাইপো কে প্রসাব খেতে দেখেও বাঁধা দিব না?”
বাসুদেব বললেন,”মানে?”
মালতী নাক ফুলিয়ে বললেন,”আপনার ছোট ছোকরা কিছুক্ষণ আগে মটকার উপর উঠে তার মধ্যে পেচ্ছাব করিছে।আর আপনি ভাইপো কে সেই জল খাওয়াচ্ছিলেন।”
এ কথা শুনে অরুপের মন ভেঙ্গে গেল।কাকা ও কাকিমা প্রস্রাব নিয়ে ঝগড়া হ‌ওয়ার সময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অরুপ। অরুপ মনে মনে ভাবছেন সৃষ্টিকর্তার হয়তো ইচ্ছা সে আজ পানি পান করতে পারবে না।শরীরে শক্তি যেনো কমে এসেছে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।মনে পড়ছে অবাক জলপান নামক গল্পের কথা। বাড়িতে চলে গেলেন অরুপ। বাড়িতে গিয়ে দেখেন তার মা এসে পড়েছে। আধমরার মতো ঘরে ঢুকেই মা কে জিজ্ঞেস করলেন,”কোথায় গিয়েছিলে তুমি?আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি সর্বত্র”
অরুপের মা ইন্দ্রানী চ্যাটার্জী খাটের নিচে থেকে মাটির কলসি থেকে গ্লাসে পানি ঢালছেন আর বলছেন,”একটু দাঁড়া বাপু গলাটা ভিজিয়ে নেই।কি যে গরম পড়েছে ভগবান।”
যেই ইন্দ্রানী পানি পান করবেন অরুপ তার মায়ের হাতের থেকে খপ করে গ্লাস কেড়ে নিয়ে এক ঢকে সব গুলো পানি গিলে মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছে।ইন্দ্রানী মনে মনে ভাবছেন ছেলেটার মাথা ঠিক আছে তো।
ঘরে প্রবেশ করলেন অরুপের বাবা,অরিজিৎ চ্যাটার্জী।ঢুকেই অরুপ ও তার মাকে নিয়ে বসেছেন জরুরী কথা বলবেন।
“শোনো তোমরা দুজনে।এক মহা আনন্দের সংবাদ আছে।”, অরিজিৎ চ্যাটার্জী বললেন।
“সোনার দাম বেড়েছে বললে লাভ নেই।আমার আছেই ঐ একটা নাকের নথ আর এক জোড়া কানের দুল।দাম বাড়ুক গে, আমি সোনা বিক্রি করবো না। তোমার লোভ সামলাতে হবে। ছেলের বৌকে কি দিবে হ্যা?”,ইন্দ্রানী বললেন।

ইন্দ্রানীর উপর রাগে ফুঁসতে লাগলেন অরুপের বাবা।যেনো এক্ষুনি ইন্দ্রানীকে বধ করবেন তিনি। অরুপ আবহাওয়া শীতল করবার উদ্দেশ্যে বলল,”মা! তুমি কি একটু চুপ করবে।বাবা এখানে জরুরী কথা বলছেন আর তুমি আছো তোমার অলংকার নিয়ে।বাবা তুমি এনার কথায় কান দিও না। তুমি বলো কি বলছিলে।”

অরিজিৎ চ্যাটার্জী আবার মুখে হাসি এনে বললেন,”ঐ যে শম্ভুনাথ আছে না?ঐ যে আমার হরিপুরের খদ্দের। উনার মেয়ের স্বামীর তো স্বর্গবাস হয়েছে। আগামীকাল ওর সতীদাহ।”

“সতীদাহ মানে? বিংশ শতাব্দীতে কিসের সতীদাহ।কি বলছো তুমি এসব।”, অরুপ বলল।

“আরে হরিপুরে এখনো লোকজন অত্যন্ত অজ্ঞ, এখনো তারা মনে করে যে নব-বধু স্বামীর শবদাহে বসে আত্মত্যাগ দিলে সে মা সতীর বরদান পায় আর স্বামীকে সাথে নিয়ে স্বর্গে চলে যায়। তাদের রাজাই এসব বিধি-বিধান এখনো অটুট রেখেছেন।”, অরুপের বাবা অরিজিৎ বললেন।

কান্নার মতো ডাক নিয়ে ইন্দ্রানী বলে উঠলেন,”অ্যারে অরুপ,এই লোকেক ধরে নিয়ে পাগলা খানায় ফেলে দিয়ে আয়। একজনের মৃত্যু ঘটছে এখানে আর উনার কাছে তা খুশির সংবাদ….ও…রে…ঠাকুর গো এই লোক এমনিতেই বলদা এর মধ্যে পুরো মাথা টা কাইড়ে নিলে।খ্যামা….খ্যামা”

অরিজিৎ চ্যাটার্জী চটে গিয়ে বললেন,”গিন্নী তুমি চুপ কর তো। ভগবানের আশীর্বাদে একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে।শম্ভুনাথের মেয়ে পরলোকগমন করলে তিনি দার্জিলিং চলে যাবেন।তার হরিপুর বাজারে বিশাল এক দোকান রয়েছে।তিনি মুক্তহস্তে সে দোকান অরুপ কে উপহার করতে চান।যাতে করে অরুপ হরিপুরে তার দোষজ্ঞ ব্যবসা শুরু করে অনেক মুনাফা করতে পারে।মজার বিষয় হলো সেখানে কোনো বৈদ্যখানাই নেই।”

“একটা চিকিৎসালয় দিতে যে অনেক খরচা লাগবে বাবা।ঔষধ,নানান আসাব পত্র, চেয়ার, টেবিল মিলে অনেক টাকার খরচ।প্রায় এক হাজার টাকা লাগবে।”, অরুপ বলল।

“শম্ভুনাথ তাদের রাজার সাথে কথা বলে তোকে ব্যবসার জন্য কিছু টাকা ধার করে দিবেন বলেছেন। চিন্তার কোনো বিষয় নেই।”, অরিজিৎ বললেন।

“কিন্তু শম্ভুনাথ কাকা এতো কিছু করবেন কেনো আমার জন্যে?এর মধ্যে হয়েছে কন্যাবিয়োগ।”, অরুপ বলল।

“আরে ওর কাছে আমি কিছু টেকা পাই। এখনতো এদেশ ছেড়ে চলে যাবে।তাই আরকি টাকার বিনিময়ে এই উপকার করে দিবে। তুই আজ‌ই হরিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দে।ভোরে গিয়ে অন্তেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হবি, শম্ভুনাথকে একটু সান্তনা দিবি।দেরি করিস না এখনো প্রস্তুতি নে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেলা দিবি।”, অরিজিৎ বললেন।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাবা মা কে প্রণাম করে হরিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো অরুপ।….

(পরের অংশ পর্ব-২ এ)

#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#বারি_অন্বেষণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here