হরিপুর যাত্রা পর্ব-৪(উত্তম দোষজ্ঞ)

0
109

হরিপুর যাত্রা
পর্ব-৪(উত্তম দোষজ্ঞ)

“বিষ্ণু কাকা…ও বিষ্ণু কাকা….দার খুলো গো কাকা।আমার স্বোয়ামী ম‌ইরে গেল।ও চন্দন…”, বিষ্ণুর ঘরের দরজার কড়া নাড়ছে তালেবের স্ত্রী।

“কি গো…এই রাত্রির বেলা এসে দ্বার ভাইঙ্গতেছো কেনো?”, দরজা খুলে চন্দন বলল।

“ওরে চন্দন আমার স্বোয়ামী যে পায়ের ব্যাথায় ম‌ইরে যাচ্ছে।বিষ্ণু কাকাক একটু আইসে দেখতি বল না।”, তালেবের স্ত্রী বলল।

“বাবুর শরীরটা খারাপ।বুড়ো মানুষ…বয়স তো আর কম হয় নি।এখন উঠোনো যাবে না।তুই ঐ লেপটা তালেবদার পায়ে ঘ‌ইষে দে।বাবু সকালে আসবেনে।”

“আরে ভাই বুঝিস না কেন…ও তো ব্যাথায় দাপরাদাপরি করতিছে।হয়তো পায়ে বেশি সমেস্যা হয়েছে।কাকাক একটু ডাইকে দে রে ভাই”

“এ ছেমরি, তুই বাংলা ভাষা বুঝিস নে?এখন বাবুক কোনো ভাবেই ডাকা যাবেনা। তোর স্বোয়ামী কিরোম পুরুষ মানুষ এটুকু ব্যাথায় প্রাণ ত্যাগ হ‌ইচ্ছে।যায়ে ওরে শুইয়ে থাকতি ক। সকালে দেখবি ভালো হয়ে যাবে নে।”

তালেবের স্ত্রীর হাজার মিনতিতেও লাভ হলো না। মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল চন্দন।ব্যর্থ হয়ে অসুস্থ স্বামীর কাছে ফিরে গেল সে। বাড়ির কাছে এসে দেখে,তার ঘরের সামনে মানুষের ভিড়।তালেব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। তালেবের স্ত্রীকে দেখতেই এক বৃদ্ধ মহিলা বলল,”ঐ মাগি,স্বোয়ামী মরার মত চিল্লোচ্ছে আর তুই বাইরে কোথায় ঘুরছিস? আমাদের কি ঘুম নিদ্রে নাই?কি শুরু করছিস তোরা?”

“ও খালা, আমার স্বোয়ামীর পায়ে ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে।তাই বিষ্ণু কাকাক ডাইকে আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আসবি না। কি যে করি।”

“তোর স্বোয়ামীর ঠ্যাঙ খানা পাইকে হলুদ হয়ে আছে দেখিস নে।সারাদিন কি করেছু?

“বিষ্ণু কাকা লেপ দিয়েছিল তা ঘ‌ইষেছি।কাজ হচ্ছে না। এখন সে আইসতেও চাচ্ছে না।কি করিবো বলো।”

“শম্ভুর দোকানে নুতন বৈদ্য আইসেছে না।তাকে ডাইকে নিয়ে আয়।”

“আমার স্বোয়ামী তো ক‌ইলো সে বিটা ভন্ড”

“আরে মাগি স্বোয়ামী ম‌ইরে যাচ্ছে তোর।এতো কিছু চিন্তে না ক‌ইরে শিগগির ডাকেক তাকে।”

চেম্বারে বসে হা করে ঘুমুচ্ছে অরুপ। দোকানের সামনের দরজা খানা ও লাগানো নেই।ভাগ্যিস কোনো চোরের নজরে পরেনি।ন‌ইলে অরুপ সাহেব ঘুমটা ভাঙলে দেখতেন পুরো দোকান খালি।তালেবের স্ত্রী এসে দেখলেন ডাক্তার সাহেব হা করে ঘুমুচ্ছে। অরুপ কে দূর থেকে কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এবার সামনে এসে কয়েক বার তার শরীর নাড়া দিলেন। অরুপ তারপর ও ঘুমুচ্ছে। এদিকে তালেবের স্ত্রী অরুপকে ঝাকাচ্ছেন,ওদিকে অরুপ মশাই স্বপ্নে দেখছেন সে একজন রাজা।রাজাদের পোষাক পড়ে হাতির পিঠে করে কোথায় যেনো যাচ্ছেন। তালেবের স্ত্রী অরুপকে যত ঝাকাচ্ছে অরুপ তত হাতির পিঠে বসে দুলছে। তালেবের স্ত্রী তাকে চিৎকার করে ডাকছেন, ওদিকে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে অরুপের প্রজারা তাকে সংবর্ধনা দিচ্ছেন। অরুপের পিছে বসে আছে সুন্দরী এক রমনী।রমনী এক শাহী বাক্স খুলে চকচকে রসগোল্লা বের করলেন।রসে টইটম্বুর সেই বাক্সে থেকে একটি রসগোল্লা দুই আঙ্গুল দিয়ে তুললেন।সাদা ঝকঝকে রসগোল্লা দেখে অরুপ বিশাল বড় এক হা করলো।রমনী নিজ হাতে রসগোল্লা অরুপকে খাইয়ে দিবে।এমন সময় রমনী রসগোল্লা অরুপের মুখে না দিয়ে তার চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। রসগোল্লার রসে অরুপের চোখ ঘোলা হয়ে গেল।স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। রসগোল্লার রস নয় চোখে পানি মেরেছে তালেবের স্ত্রী।

“দাদা, আপনাকে অনেক সুময় ধরে ডাইকতেছি। কোনো ভাবেই আপনি উঠছেন না।তাই পানি মাইরলাম,গোস্সা করবেন না দাদা”

অরুপকে তার স্বামীর সব কথা খুলে বললেন তালেবের স্ত্রী। অরুপ প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দেয় তার বাসায়। তালেবের পা কেটে সব পুঁজ বের করলেন অরুপ।এটিএস ইনজেকশন দিয়ে। তালেবের ক্ষত ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।তালেবকে দেওয়া হলো ঘুমের ঔষধ।তালেব ঘুমিয়ে পড়ল। অরুপকে সবাই ধন্যবাদ জানালো।বাড়ির সবার সাথে কথা বলার সময় অরুপের নজর গিয়ে পড়ল রুপালির দিকে।এতো সুন্দর নারী অরুপ কখনো দেখেনি।তার দুধের ন্যায় সাদা সর্বগত্র,প্রতিমার ন্যায় টানা টানা‌ চোখ, নবজাতকের ন্যায় মলিন তার চেহারা, কোকিলের ন্যায় মধুর তার কন্ঠ।পড়নে নীল রঙের শাড়ি,হাতে নীল চুড়ি আর… আর তারপর যে জিনিসটা খেয়াল করলো অরুপ,মন খারাপ হয়ে গেল। চুড়ির সাথে হাতে রয়েছে শাঁখা।পরে কপালে খেয়াল করলো খুব সূক্ষ্ম সিঁদুর ও রয়েছে। বাসায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে সারা রাত মেয়েটির কথা ভাবতে থাকলো অরুপ। মনে মনে ভাবছে,”হায় ভগবান, একটা মেয়ে ভালো লাগলো আর সেও বিবাহিতা।এ জীবনে আর কত দুঃখ সহ্য করতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো অরুপ। সে রাতে স্বপ্নেও রুপালিকে দেখলো সে।

পরদিন সকালে হৈচৈ এ ঘুম ভাঙলো অরুপের। দোকান থেকে কিছুদূর সামনে একটি বাড়ি আছে সেখান থেকেই শব্দটি আসছে। অরুপ উঠে দৌড়ে সেই বাড়িতে গেল। বাড়িতে গিয়ে দেখে কিছু মানুষ কাঁদছেন আর বাড়ির উঠানে এক মহিলার চুল কেটে ফেলা হচ্ছে।মহিলাটি পাথরের মতো নিথর হয়ে আছেন।তার চোখে পানি টলটল করছে। কিন্তু তার চেহারা একেবারে স্থির যেনো বিশাল কোনো ধাক্কা খেয়ে জীবিত থেকেও এখন তিনি মৃত। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, মহিলার স্বামী মারা গেছেন।আর যেহেতু তার সন্তান রয়েছে তাকে চিতা আরোহন করতে হয়নি। শুধু চুল ফেলে দিয়ে নিস্তার দেওয়া হবে তাকে।এ কেমন আজব নিয়ম। নারীর অমূল্য অলংকার হলো তার কেশ,আর সেটাই কেটে ফেলা হচ্ছে। সন্তানহীন স্ত্রীদের স্বামী মারা গেলে স্বামীর সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।আর সন্তান থাকলে মাথা টেকো করে দেওয়া হয়।এতো নিয়ম শুধু মেয়েদের জন্যেই কেনো। কোনো স্ত্রী মারা গেলে তো স্বামীদের পোড়ানো হয় না।তারা তো কি সুন্দর আরেকখানা বিয়ে করে ফেলে। ভাবতে ভাবতেই সেখান থেকে চলে আসলো অরুপ।রাতে তালেব আলীর সাথে ঘটা কাহিনী সব খানে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই তালেবের পা সুস্থ হয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারলো অরুপের চিকিৎসা সত্যিই ভালো,ভন্ড হচ্ছেন বিষ্ণু।দিনে দিনে রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো অরুপের আর বিষ্ণুর কাছে কোনো রোগী ই আসলো না। রাগান্বিত হয়ে বিষ্ণু আর চন্দন নতুন ফাঁদ পাতলো অরুপকে বদনাম করবার। এবার তারা ব্যবহার করবে চন্দনের বন্ধু বিভীষণ কে।দুই বাপ বেটা মিলে ফন্দি শিখিয়ে দিচ্ছেন বিভীষণকে।

“শোন বিভু, কাজটা ক‌রতি পারলি ভারি পুরষ্কার দেব তোকে। কিন্তু যদি কিছু উল্টো পাল্টা ক‌ইরেছিস,তোক আমি জুতোপিটা ক‌ইরবো।”,বিষ্ণু বলল।

“না কাকু,কোনো ভুল হবিনে। আপনি দুশ্চিন্তা ক‌ইরবেন নে।”

“ওরে শুয়োর,তুই ই তো আমার দুশ্চিন্তার কারণ।বেটার সামনি গিয়ে কিছু উল্টো পাল্টো কাজ ক‌ইরলেই সে বুঝে যাবে সব। তারপর আমরা তিনজন ই ফাসবো।মা কালী দিব্বি বলি, আমি তোক বধ ক‌ইরবো যদি আমার উপর কোনো বিপদ আইসছে।”,বিষ্ণু বলল।

“দেখ বিভু,তোক আমি আবার বুঝোয়ে দি। তুই ওই ভন্ডের কাছে গিয়ে বলবি তোর মুখে একবারে স্বাদ নেই।কোনটা মিঠে,কোনটা লংকা বুঝতি পারিস নে।যা বড়ি দিবে তা নিয়ে আসবি,পরে আবার যাইয়ে বলবি মুখে স্বাদ আইসছে না বড়ি খাইয়ে। তারপর বাবু আইসে তোক এক গিলাস রস খাইয়ে দিবে সবার সামনি। তুই খাইয়ে বলবি তুই স্বাদ অনুভব ক‌ইরতে পারছিস। তারপর সালাকে সবার কাছে ভন্ড পেমান ক‌ইরে দিব।বুঝলি?”, চন্দন বলল।

“আরে তুই দূর থেইকে দাঁড়ায়ে দেখ শুধু কি অভিনয়খানা করি।”, বিভীষণ বলল।

“অভিনয় করিস, কিন্তু বাড়তি কিছু করিস নে বাপু।এই প্ররোচনা যদি ভাগারে যায় তোক নেংটো ক‌ইরে গিরামে ভাগাবো আমি।”,বিষ্ণু বলল।

“এ দেখ চন্দন,এ বিষ্ণু কাকা কি ব‌লতিছে।আমাক নাকি নেংটো ক‌ইরে গিরামে ভাগাবে।আমি ক‌ইরতে পারবো তোগের কাম।এই ছেইলে বয়সে বধ হবার ইচ্ছে নেই আমার। তোর বাপ ঠিকই আমাক মাইরে ফেলবে একটু ভুল হলি।”, বিভীষণ বলল।

“এই বাবু, তুমি ছাওয়াল টাকে এতো ভয় দেখাচ্ছো কেনো?ওকে সাহস না দিয়ে এইসব বললে ছেইলে টা আতংকিত হয়ে যাচ্ছে দেখিচ্ছো না”,চন্দন বলল।

“হ্যা…হ্যা….ও বাদে এই কাজের জন্যি বলদ কোথায় আবার খুঁইজবো।এ বাপু তোক বধ ক‌ইরবো না তুই সাহস নিয়ে যা”,বিষ্ণু বলল।

“এই চন্দন,কাকা কি ব‌ইল্লো?এই কাজের জন্যি আমাক বলদ পাইছে।আমি ক‌ইরবো না তোগের কাজ।আমাক ছাইড়ে দে চন্দন।আমাক এতো অপমান আমার স্ত্রী আর শ্বাশুড়ি ব্যতিত কেউ করে নাই।আমি আকাম্মো না। আমার খুব জরুরী কাজে বান্দরের খেলা দেইখতে যাতি হ‌বি।মোক ছাড়।”, বিভীষণ বলল।

“আরে বিভু তুই চটছিস কেনো রে বাপু।বাবু কি তোক বলদ ক‌ইছে নিকি?উনি তোক বলৎ ক‌ইছে।ব…ল…খন্ড ত।বলৎ”,চন্দন বলল।

“আমাক বুকা পাইয়েছিস তাই নে?বলৎ নামে কোনো শব্দ আছে নিকি?”, বিভীষণ বলল।

“আরে চ্যাংরা,আছে…আছে…।এটা পৌরাণিক শব্দ।বলৎ শব্দের অর্থ হচ্ছে যে….যে….(উপর দিকে চেয়ে একটু ভেবে বলল)যে অইত্যেন্ত বলবান।আর বাবু আর আমি জানি যে তোর মতো বলবান আর সাহসী এই হরিপুরে নেই।”, চন্দন বলল।

মিথ্যে ব্যাখ্যায় গলে গেল বিভীষণ। মুখে বিশাল এক হাসি আটকে গেল।
“তাই নিকি। তাইলে কাকা আমাক খ্যামা ক‌ইরে দেন।আমি আপনাক ভুল বুইঝেছি।আমি বলৎ বিভীষণ এখন দেখেন কিভাবে এই ভন্ড বৈদ্য কে বুকা বানাই।”, বিভীষণ বলল।
দূর থেকে গাছের পিছনে লুকিয়ে বিষ্ণু আর চন্দন বিভীষণের দিকে তাকিয়ে আছে। বিভীষণ হন হন করে গিয়ে অরুপের সামনে বসলো।অরুপ জিজ্ঞেস করলো,”কি সমস্যা আপনার?”

বিভীষণ উত্তর দিল,”বৈদ্য মশাই,আইজ সকাল থেইকে কিছুরই স্বাদ পাচ্ছি নে।মিঠে খাচ্ছি,লংকা খাচ্ছি,টক খাচ্ছি কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছি নে।জলদি আমাক বড়ি দিয়ে সুস্থ করুন।”

“জিভে কোনো আঘাত পেয়েছিলেন?”

“না। হঠাৎ কি যেনো হলো।”

“পান খেয়েছিলেন নাকি?”

“ওসব কিচ্ছুই খাইনি।আপনি বরং বড়ি দিয়ে দেন কয় বেলা খাইতে হবে ব‌ইলে দেন।আমি খাইয়ে নিব।”

অরুপের সন্দেহ হলো তাকে।তার রোগ সত্য নাকি মিথ্যা তা ধরার জন্য সুন্দর উপায় ভাবলেন। টেবিলের নিচ থেকে একটা বোতল আরেকটি চামচ বের করে দিয়ে বলল,”বাসায় গিয়ে কোনো বড়ি খেতে হবে না।এই শিশি থেকে এখুনি দুই চামচ সিরাপ খেয়ে নাও”

শিশি খুলে এক চামচ সিরাপ মুখে দিয়েই থু… করে সব সিরাপ ফেলে দিল বিভীষণ।তিতা ঔষধের ধকে মুখ ভেংচিয়ে আসছে তার। বিভীষণ বলল,”সালা এতো তেতো কাড়া মানুষ মানুষকে খাওয়ায় নিকি?”

একগাল হেসে অরুপ বলল,”এইতো তোমার স্বাদ ফিরে এসেছে।সিরাপ যে তেতো তা ধরতে পেরেছো এবার দাও আমার ৫ আনা”

বিভীষণ রেগে গিয়ে বলল,”তোক ফুটো পাই দিব না সালা।কি করবি রে তুই আমার? সালা ভন্ড।”

অরুপ সাথে সাথে উঠে ঠাস করে এক চড় দিয়ে দিল বিভীষণের গালে।চড়ের ওজন স‌ইতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় বিভীষণ….(পরের অংশ পর্ব-৫ এ)

#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#উত্তম_দোষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here