হরিপুর যাত্রা পর্ব-৫(মহারাজের আদেশ)

0
98

হরিপুর যাত্রা
পর্ব-৫(মহারাজের আদেশ)

(বি:দ্র:-খাবার খাওয়ার সময় ভুল করেও এই পর্ব পড়বেন না। অরুচিকর কিছু বিষয় রয়েছে গল্পে।)

অরুপের চড় খেয়ে বিভীষণ কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে বসে র‌ইল মাটিতে। ওদিকে যে গাছের পিছনে লুকিয়ে বিষ্ণু ও চন্দন তাদের কার্যকলাপ দেখছিলো সে গাছের নিচেই ছিল এক দাঁড়াশ সাপের বাসা।সাপ মশাই ভীষণ চটলেন তার বাসার সামনে অনাকাঙ্খিত অতিথি দেখে।রেগে শেষমেশ বিষ্ণুর পায়ে কামড়ে দিলেন দাঁড়াশ মশাই।বিষ্ণু নিচে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাপে কামড়ে ধরে আছে। তার এক চিৎকারে পুরো হরিপুর নড়ে উঠলো। বিভীষণ নিজের চড়ের কথা ভুলে তাকিয়ে আছে বিষ্ণুর দিকে। অরুপ বুঝতে পারছে না কি ঘটছে এখানে। অরুপ দৌড়ে গেল বিষ্ণু চন্দনের কাছে।

“ও মা…ম‌ইরে গেলাম গো। আমি শেষ রে চন্দন।আমাক ধর বাবা”,বিষ্ণু চেঁচিয়ে উঠলো।

“এ মা…এ তুমি কি ক‌ইরলে। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বাবা।তাকে তুমি কাইড়ে নিচ্ছো।কত বড় সর্পে দংশিছে রে।আমার বাবু আর কি ক‌ইরে বাঁচবি।”,চন্দন বলল।

“এ চন্দন…বাবা আমার… শিগগির পা থেকে বিষ চুইষে বের ক‌ইরে দে।তাহলি হয়তো বাইচে যাব।”,বিষ্ণু বলল।

“বাবু এ তুমি কি কচ্ছু। আমি যদি মুখ দিয়ে চুইষে বিষ বের করি,আমি নিজেই ম‌ইরে যাব। তা আবার পা চুইষতে হবি… অন্য কোনো জায়গায় হলিও ভাইবে দেখতাম।আমি তোমার পায়ে মুখ লাগাতি পাইরবো না। এমনিতেই তোমার পা অনেক নোংরা বরং তুমি মা কালীক স্মরণ করো।মা কালী তোমাক সুস্থ ক‌ইরে দিবে।, চন্দন বলল।

“এই দিন দেখার জন্যি তোক জন্ম দিয়েছিলেম রে শুয়োর।এক কাজ কর, দংশনের জাইগা ছুরি দিয়ে কাইটে রক্ত বের কর।বিষটা বের হোক।”,বিষ্ণু বলল।

“তার কোনো দরকার নেই।এটা দাঁড়াশ সাপ।এটা নির্বিষ।ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসেন অ্যান্টিসেপটিক সলিউশ্যন দিয়ে মুছে দেই। কোনো জীবাণু থাকলে মরে যাবে।”, অরুপ বলল।

“শুনুন দাদা,আমাগের সব ব্যাপারে আপনার নাক না গলানোই উত্তম ব‌ইলে মনে করি।আমার বাবু কুড়ি বছর যাবত এ গিরামের সবার দোষজ্ঞ ক‌ইরে আইসছে। আপনার থেইকে খুব ভালো বুঝেন তিনি। আপনার আন্টিপিসটিক আপনার চোতোরে মাখেন যায়ে।”,চন্দন বলল।

চন্দন কোথায় গিয়ে যেনো একখানা ছুরি নিয়ে আসলো।যেই তার বাবার কাছে যাবে, অরুপ তার হাত ধরে ফেলল। অরুপ বলল,”শুধু শুধু একটা সুস্থ মানুষের পা কাটার কোনো দরকার নেই চন্দন। আমার কথা বিশ্বাস করো।এই সাপ নির্বিষ। বাচ্চা ছেলেরা এ সাপ দিয়ে খেলা করে। সাপের মুখ থেকে যদিও কোনো জীবাণু লাগতে পারে,আমি একটু ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি আর কোনো ভয় নেই।”
চন্দন অরুপের কথা কিছুতেই শুনলো না। অরুপের হাত সরিয়ে বসে পড়লো তার বাবা বিষ্ণুর পা কাটতে। অরুপ নিজের চোখে একটা সুস্থ মানুষের পা কাটা দেখতে পারবে না।চন্দনকে ধাক্কা মেরে ফেলে তার ছুরি খানা পকেটে নিয়ে বিষ্ণুকে কোলে করে তার দোকানের ভিতর ঢুকে গেল অরুপ।চন্দন ও বিভীষণ প্রতিবাদ করতে আসলে অরুপ হাতে ছুরিটি নিল।তারা আর দোকানে প্রবেশের সাহস করতে পারলো না। অরুপ বিষ্ণুর পায়ের ক্ষত অ্যান্টিসেপটিক সলিউশ্যন দিয়ে মুছে একটি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল।বিষ্ণু,চন্দন আর বিভীষণ এই অপমান মেনে নিতে পারলো না।তারা অরুপকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ছুটে গেল রাজা মশাইয়ের কাছে।
ভর দুপুর বেলা। খাবার খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রাজা রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।এই সময় একজন চাকর তাকে ডেকে দিলেন। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গার কারণে রাজা মশাই ভীষণ চটলেন।চাকর তাকে বলল,”আজ্ঞে মহারাজ ভিষক বিষ্ণু আইসে পুরো বাড়ি মাথায় তুইলেছেন।তিনি আপনার সাথে জরুরী কথা না বলে কিছুতেই প্রস্থান ক‌ইরবেন না। তাই রানী মা আপনাক ডাইকে দিতে ব‌ইল্ল।”

“কোথায় বিষ্ণু?”,রাজা মশাই বললেন।

“নিচে রাজ দরবারে লোকজন নিয়ে ব‌ইসে আছেন।”,চাকর বলল।

“চলো দেখি কি সমস্যা তার”, রাজা মশাই বললেন।

বিষ্ণু,চন্দন ও বিভীষণ গ্রামের কিছু বেকার ছোকরা দের নিয়ে রাজা মশাইয়ের অপেক্ষা করছেন। এদের আনা হয়েছে স্বাক্ষী দেবার জন্য। আজকে যে করে হোক অরুপকে শায়েস্তা করবেন বিষ্ণু।রাজা রাজেন্দ্রনাথ আসলেন। প্রথমেই বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করলেন,”কি ব্যাপার বিষ্ণু,এই ভরদুপুরে আইসে চিল্লেফাল্লা করিচ্ছো। সমস্যা কী?”

“মহারাজ আর কি ব‌ইলবো আপনাক।যে নুতন লোক আইনেছেন গিরামে,ভরা বাজারে ধ‌ইরে ধ‌ইরে অপমান ক‌ইরে দিচ্ছে লোক জনেক।”,বিষ্ণু বলল।

“কিডা অপমান করিছে?”,রাজা মশাই বললেন।

“আর কিডা…আপনাগের নুতন ভিষক মশাই।হে ভগবান এরম গুন্ডো যে কি ক‌ইরে ভিষক হলো কিডা জানে। এই বিভীষণ ছেইলেটা মশকরা ক‌ইরে তাকে যাইয়ে ব‌ইল্ল মুখে স্বাদ নেই।ওমনি ছেইলে টাকে ধ‌ইরে তেতো কাড়া গিলোয় দিলো। আবার কয় পাঁচ সিকি দিতে।যখন ছেইলে টা প্রতিবাদ ক‌ইরলো তাক ধ‌ইরে কি মাইর খানাই না দিল।”,বিষ্ণু বলল।

“তো ঠিক ই আছে মুখে স্বাদ নেই ব‌ইল্লে ত তেতো কাড়া দেবেই।আর কাড়া যেদিকে দিয়েছে কাড়ার পয়সা চাইতে দোষ কোথায়।আমি তো দেখছি এই বিভুর ই দোষ।এই ছেইলে মানসে কাহিনীর জন্যি তুমি আমার এতো সুন্দর ঘুম খানা নষ্ট ক‌ইরলে?”,রাজা মশাই বললেন।

“দাঁড়ান মহারাজ নালিশ আসলটা বাকি আছে “,বিষ্ণু বলল।

“সিটা আবার কোনটা?”, রাজা মশাই বললেন।

“আমার ঠ্যাঙে সর্পে দংশিছে ঐ ভন্ডের দোকানের সামনে।আমার ছেইলে কে ক‌ইলুম ঠ্যাঙ টা কাইটে বিষের রক্ত খানা বাইর কইরে দে।সে দৌড়ে এসে আমার ছেইলে কে মাইর ধর ক‌ইরে আমাক কুলে তু‌ইলে দোকানে নিয়ে কিছু ভুয়ো লেপ মাইখে এই পট্টি মাইরে দিল। আমার জীবনের কি তার কাছে কোনো মূল্য নেই।এইটাকি ন্যায় মহারাজ?”,বিষ্ণু বলল।

“তোমাক সর্পে দংশিছে কোন সুময়ে”,

“সকাল বেলা”,

“বিষাক্ত সর্পে দংশিলে তুমি এতক্ষণে হরিধ্বনি শুনতে পাইতে। এভাবে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়ে থাকতি পারতে না। তো তার দোষজ্ঞ ভুয়ো না তা নিশ্চয়ই বুইঝেছো। এবার যাও আমি ঘুমে চোক্ষে কিচ্ছু দেখছি না।আমাক ঘুমতে দাও।”

“আর বিভীষণ কে আর চন্দনকে যে তার দোকানের সামনে মাইর ধর ক‌ইরলো তার বিচার কি? নিজের দোকানে এই সব মানুষের সামনে এদের হত্যা করার চেষ্টা ক‌ইরলো তার বিচার? এদের যে মান সম্মান ধুলিসাৎ হয়ে গেল তার বিচার?”

“বাপু এত বিচার ক‌ইরতে পাইরবো না। তুমি এদের সবাইকে নিয়ে যায়ে ওর দোকানে হাইগে দাও গে।যাও এখান থেকে এখন।”

ঘুমের ঘোরে রাগের মাথায় মহারাজের কথাকে বিষ্ণু অস্ত্রের মতো ব্যবহার করলো। সবাইকে বুঝিয়ে দিল মহারাজের আদেশ অরুপের দোকানে মলত্যাগ করতে হবে।রাস্তা দিয়ে অরুপের দোকানে যাবার পর্যন্ত গ্রামের সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো অরুপের শাস্তির ব্যাপারে।বিষ্ণু সবাইকে তার গাছের আম খাওয়ালো যাতে মলত্যাগ করতে সুবিধা হয়। সবাইকে জোর করে অনেক পানি পান করানো হলো যাতে পেটের খাবার জলদি হজম হয়।বিষ্ণু ও তার সৈন্য এসে হাজির অরুপের দোকানের সামনে। ইতিমধ্যেই অরুপ খবর পেয়ে গেছে এ ঘটনার‌। হরিপুরে কোনো খবর ছড়িয়ে পড়তে আলোর গতির চেয়ে কম সময় লাগে। অরুপ দোকানের সামনে বসে দা দিয়ে বাঁশের মাথা কেটে সূচালো করছে।সবাই ভয় পেয়ে গেলেন সূচালো বাঁশ দেখে।বিষ্ণু সবাইকে আবার বুঝিয়ে দিল যে মহারাজের আদেশ পালন করতে এসেছে তারা,তাদের কোনো ভয় নেই।চন্দন অরুপের সামনে গিয়ে বলল,”কি ভিষক মশাই, মহারাজের আদেশ শুইনেছেন?”

“হ্যা শুনেছি।”, অরুপ বলল।

“তাইলে সামনে থেইকে স‌ইড়ে যান।আমাগের শান্তিতে হাইগতে দিন।বুইঝলেন তো মহারাজের আদেশ, কোনো বাধা দিলে কি পরিণতি হ‌ইবে।”,চন্দন বলল।

“আমি মহারাজের আদেশ অমান্য করার ভুল কখনো করবো না। তোমরা দোকানে উঠো।শান্তিতে মলত্যাগ করো, আমি তোমাদের এই সুকর্মে সমর্থন করছি।”,অরুপ বলল।

সবাই লোটা আর পাত্রে পানি ভরে দোকানে উঠলেন মহারাজের আদেশ মানার জন্যে।প্রায় দশ বারো জন লোক একটি দোকানে মলত্যাগ করবেন তা দেখতে দর্শকের ভিড় জমে গেল। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় অরুপ বলল,”মহারাজ আদেশ করেছেন মলত্যাগ করার জন্যে, নির্দ্বিধায় মলত্যাগ করুন। কিন্তু আমার দোকানে যে এক বিন্দু মূ্ত্র ত্যাগ করবে তার পশ্চাৎদেশে এই সূচালো বাঁশ ঢুকবে।” অরুপের কথা শুনে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন।সবাই ভাবছেন এ কি করে সম্ভব,মলত্যাগের সময় মূত্রত্যাগ তো হবেই। কিন্তু মহারাজ যে মূত্রত্যাগের বিষয়ে কিছু বলেননি। ছেলেটা আসলেই প্রত্যুৎপন্নমতী। সূচালো বাঁশের আগা দেখে আর কারো সাহস হলো না কোনো কথা বলার।বিষ্ণু ও তার সৈন্য মহারাজের আদেশ খারিজ করে অরুপের দোকান থেকে চলে গেলেন।
সন্ধ্যায় অরুপের দোকানে দশ বারো জন সৈনিক আসলো।রাজা সাহেব এক্ষুনি তাকে বাড়িতে ডেকেছেন।তার মেয়ের স্বামীর অবস্থা খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে,বুকে ব্যাথা অনুভব করছেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি র‌ওনা হলেন অরুপ। গিয়ে দেখলেন রোগী অনবরত হাপাচ্ছেন আর বুকে হাত ঘষছেন। রোগী কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে গেছেন। ঔষধপত্র দিতে দিতে রোগী নিস্তেজ হয়ে গেলেন। রোগীর পাল্স পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ সিপিআর দেওয়ার পর রোগীকে মৃত ঘোষণা করলেন অরুপ। রাজকন্যা শোকে জ্ঞান হারালেন। রাজার মেয়ের স্বামী ছিল রাজার ই ভায়ের পুত্র। কিছুদিন আগেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখন রাজ্যের নিয়মানুসারে রাজকন্যার সতীদাহ হবে। রাজা মশাই চুপচাপ এক কোণে বসে অশ্রু ঝরাচ্ছেন মেয়েকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দিতে হবে ভেবে।অরুপ খুব‌ই দুঃখিত হল এ পরিস্থিতি দেখে। রাজকন্যার জ্ঞান ফিরলো। হঠাৎ অরুপের মাথায় এক বুদ্ধি আসলো। অরুপ সবাইকে বাইরে যেতে বলল। অরুপ রাজকন্যাকে তার পরিকল্পনার কথা বললেন, রাজকন্যা রাজি হলো। অরুপ দরজা খুললেন। সবার মাঝে রাজা মশাইয়ের সামনে গিয়ে বলল,”আপনার মেয়ে গর্ভবতী।সে সন্তান প্রত্যাশী।এখন আর তাকে চিতা আরোহন করতে হবে না।কারন এখন তার সন্তান আছে।রাজা মশাই অরুপকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। খুশিতে আটখানা হয়ে রাজা এখানে সেখানে ছুটছেন, সবাইকে খুশির সংবাদ শুনাচ্ছেন। এখানে যে কেউ মারা গেছে সবাই ভুলে গেলেন।রাজা মশাই হরিপুরের ধর্মগুরু কে এ সংবাদ জানালেন। ধর্মগুরু ধার্মিক দিক থেকে হরিপুরের আইন কেমন হবে তা নির্ধারণ করেন। রাজার বাড়িতেই থাকতেন।রাজাকে সব বিষয়ে পথপ্রদর্শন করতেন। ধর্মগুরু খুশির সংবাদ শুনে রাজা মশাইকে বললেন,”মহারাজ,খুশি হবেন না। আপনার মেয়ের সন্তান এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি।সে এখনো মুক্ত নয়…

(পরের অংশ পর্ব-৬ এ)

#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#মহারাজের_আদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here