হরিপুর যাত্রা
পর্ব-৬(সর্প যজ্ঞ)
“আজ্ঞে ধর্মগুরু,আমার মাই্যয়ে তো এখন সন্তান প্রত্যাশী। তবুও সে মুক্ত হবি না কেনো?”, মহারাজ বললেন।
“ক্ষমা করিবেন মহারাজ,বেদ তো তাই বলে। ভূমিষ্ঠ সন্তান ব্যতিত সক্কল নারীকে চিতা আরোহন করিতে হইছে।”, ধর্মগুরু বললেন।
“গরুজী,আর কি কোনো উপায় নেই আমার মাই্যয়ে টাক বাচাবার,ওর গর্ভে তো আরেকখান প্রাণ রয়েছে।”,মহারাজ বললেন।
“একটি উপায় অবশ্যই আছে।তা বেশ জটিল। আপনার অনুমতি থাকিলে বলবো।”, ধর্মগুরু বললেন।
“সেটা কি বলেন গুরুজী।”, মহারাজ বললেন।
“অজগর সর্পের সহিত কনেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিতে হইবে। তাদের এক বদ্ধ ঘরে এক নিশী থাকিতে হইবে।প্রত্যুষকাল অব্দি অজগর সর্প তাকে ক্ষতি না করিলে অর্থাৎ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করিয়া লইলে আপনার মেয়ে মুক্ত হইবে।তবে অজগর সর্প নিশ্চয়ই প্রাপ্তবয়স্ক হইতে হবে।”, ধর্মগুরু বললেন।
আশেপাশের সব গ্রামে অজগর খোঁজ শুরু হলো। অবশেষে মেহেরগঞ্জ থেকে এক বিশাল অজগর ধরে আনা হলো রাজার মেয়ের সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য।বাক্সে বন্দী অজগর সাপের সাথে রাজকন্যার বিবাহ সম্পন্ন হলো। রাজকন্যার ঘর ফুল দিয়ে সাজানো হলো সাপের সাথে ফুলসজ্জার জন্য। রাজার ভাই অমরনাথ নিজ ছেলের অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাড়িতে শোকের মাতম চলছে,এর মধ্যে বিবাহ। হরিপুর নামক এই গ্রামে এইসব অদ্ভুত ঘটনা যুগযুগ ধরে ঘটছে।সারা ভারতবর্ষে যেখানে নগরায়ন চলছে, লোকজন উন্নত হওয়ার জন্য বিলেত যাচ্ছেন লেখাপড়া করার জন্য। সেখানে হরিপুরে সতিদাহ্ হচ্ছে। সাপের সাথে মানুষের বিয়ে হচ্ছে। যে গ্রামে লেখাপড়া নিষিদ্ধ সেখানে এসব হওয়াই স্বাভাবিক।
সাপটিকে ফুলসজ্জা ঘরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এবার রাজকন্যাকে ঘরে নিয়ে যেতে দাসীরা দাঁড়িয়ে আছে। রাজকন্যা কান্না কাটি করছেন,তার বাবার পা ধরে কাঁদছেন আর বলছেন,”বাবা আমাক ছাইড়ে দেন আমি গ্রাম থেইকে পালায়ে যাই, তবুও এই সর্পের সাথে এক ঘরে আমাক বন্ধী কইরবেন না। নিজের মাই্যয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেইলে দিবেন না বাবা।ও বাবা কিছু বলেন না বাবা….এভাবি চুপ কইরে থাইকবেন না বাবা। আমি আপনার একমাত্র সন্তান।আমার সাথে এরম কইরবেন নে বাবা।”
“মা রে…এই নিয়মের ব্যতিক্রম করার সাথ্য আমারো নেই যে।আমাগের পূর্ব পুরুষেরা এর মাইন্য কইরেছেন।আমাগের ও কইত্তে হইবে। তুই দেখ মা মনসার আশীর্বাদে সর্প তোক কিছু কইরবে না।তিনি তো জানেন তোর গর্ভে নিষ্পাপ প্রাণ রইয়াছে। তুই শক্ত থাক মা।”,মহারাজ বললেন।
রাজকন্যা মহারাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। দাসীরা তাকে টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে।যাবার বেলা ও বাবার কাছে প্রাণরক্ষার অজস্র আকুতি করলো। কিন্তু বিধি বিধান ও বংশ পরম্পরার কাছে হেরে গেল পিতৃত্ব। রানী সাহেবাকে আগেই তার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি ও চিৎকার করছেন আর মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন।রাজা রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির ছাদে গিয়ে চৌকিতে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে মেয়ের ছোটবেলার স্মৃতি গুলো কল্পনা করছেন। এদিকে রাজার বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের দোকানের দিকে যাচ্ছে অরুপ।তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে খুব। ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না।মাথায় আটকে আছে হরিপুরের প্রাণহরণকৃত কুসংস্কার। কিভাবে পারে এরা নিজ মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে। আসলেই কি ধর্ম মানুষের অমঙ্গলের জন্যে।দেব দেবতা রা কি মানুষের অমঙ্গল কামনা করতে পারেন?এসব ভাবতে ভাবতে অরুপ এসে পরেছে বাঁশের সাঁকোর সামনে।সে দেখলো অনেক মানুষজন পার হয়ে যাচ্ছে সাঁকোর উপর দিয়ে।একটি বৃদ্ধ লোক হাতে একটি বাটি নিয়ে বসে আছে সাঁকোর সামনে।তার পা দুটোর একটি ও নেই।যে ই সাঁকো তে উঠছে সবাইকে বলছে তাকে যেনো একটু পার করিয়ে দেয়।কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে না।যে যার মতো পার হয়ে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ লোকটি শুধু ব্যর্থ মিনতি করছেন। অরুপের খুব মায়া হলো লোকটার জন্য। অরুপ তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি দাদু এখানে বসে আছেন কেন?”
“বাবা আমাক তুইলে একটু হাক্কাটা পার করায়ে দিতে পারবি?”, বৃদ্ধ লোকটি বলল।
“জি অবশ্যই। কিন্তু আপনি এতো রাতে এই অবস্থায় যাবেন কোথায় দাদু?”, অরুপ বলল।
“আমার ছাওয়ালের কাছে যাবো।সে বিটা অপরাহ্নে বাড়ি ফিরে নি হয়তো মেলা ব্যস্ত আছে। খাবার না খেয়ে থাকবিনে এতো বেলা। তাই ভাবলেম এই পাত্রে কইরে একটু খাবার দিয়ে আসিগে। কিন্তু হাক্কা টা তো আমি পার হতি পাইরবো না।তাই একটু তুইলে হাক্কা টা পার কইরে দিলি আমি নিজেই চইলে যাতি পারবো।”, বৃদ্ধ লোকটি বলল।
অরুপ বৃদ্ধ লোককে তুলবে এমন সময় চন্দন এসে অরুপের হাত সরিয়ে দিল। অরুপ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“ভিষক মশাই এ করিচ্ছেনটা কি।এ বুড়ো সারা গিরামের ময়লা আর গোবর ঘইষে ঘইষে চলাফেরা করে।তার হাত আর কোমরের নিচে দেখেন এখনো গু লাইগে আছে কিসের যেনো। দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না,উনার শরীরে এরম বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ আপনি ভুলেও উনাকে তুইলবেন না।সাতবার চান কইরলেও এ গন্ধ যাবিনে।”চন্দন বলল।
“হ্যা বাবা থাক লাইগবে না।আমার শরীরে সত্যিই গু লাইগে আছে। তুমি আমাক তুইল্লে তোমার গতরেও ভইরবে।বরং আমি ই অইন্য ব্যবস্থা করছি।”, বৃদ্ধ লোকটি অরুপকে বলল।
অরুপ চন্দনের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে। বৃদ্ধ লোকটিকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা পার হয়ে গেল সাঁকো।চন্দন এ কান্ড দেখে নাক ধরে অরুপকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সাঁকো পার হওয়ার পর অরুপ বৃদ্ধকে বলল,”দাদু এবার কোন দিক যেতে হবে?”
“আর যাতি হবি নে বাবা। এবার তুমি আমাক নামায়ে দাও।আমি নিজেই যাতি পারবো।”, বৃদ্ধ বলল।
“আরে না দাদু আপনি কষ্ট করে যাবেন কেন?আমি ই আপনাকে আপনার ছেলের কাছে পৌঁছে দিব।”, অরুপ বলল।
“না বাপু।আমি নিজেই যাব।এতে আলেদা প্রশান্তি রয়েছে।নিজে কষ্ট করি ছেলেকে খাবার দিয়ে আইসপো তাহলি মনে আনন্দ থাইকবে অপাহিচ হওয়া স্বত্তেও ছাওয়ালের জন্যি কিছু করতি পারিছি।আর যদি তুমি আমাক দিয়ে আসো তাহলি সুখের বদলে আফসোস হবে যে নিজের ছেইলে কে খাবার দিতে যাইয়ে তোমাক কষ্ট দিয়ে ফেললাম।আমাক তুমি নামায়ে দাও বাপু।”, বৃদ্ধ হাসিমুখে বলল।
অরুপ বৃদ্ধকে নিচে নামিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ লোকটি তাকে অসংখ্য আশীর্বাদ করে এক হাতে পাত্রটি জরিয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে চলে যাচ্ছেন। অরুপ মনে মনে ভাবছে বাবারা কেন এমন হয়।এই লোক গুলো এতো স্বার্থছাড়া কেনো।কেনো সন্তানের মুখে একটু হাসি ফুটাতে নিজের সর্বসুখ ত্যাগ দেয়। কিন্তু কখনো এগুলো প্রকাশ করতে চায় না। আজব প্রাণী এরা। ভাবতে ভাবতে অরুপ চলে গেল।
দোকানের বাহিরে বসে অরুপ কাঁদছে।তার নিজেকে খুব নিচুজাত প্রাণী মনে হচ্ছে। চোখের সামনে একজন মানুষের অনর্থ দেখেও ফেরাতে পারলো না অরুপ। প্রভুর কাছে প্রার্থনা করছে অরুপ যাতে রাজকন্যা সুস্থ থাকে সকাল পর্যন্ত। রাজকন্যাকে ফুলসজ্জার ঘরে ঢুকিয়ে বাহিরে থেকে আটকে দেওয়া হলো। ধর্মগুরু সবাইকে রাজকন্যার ঘরের সামনে যেতে বারণ করে দিলেন।সারা রাত রাজকন্যার চিৎকারের শব্দ শোনা গেল।ভোরের দিকে চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল।ঘুম থেকে উঠে রাজকন্যার ঘরের দরজা খুলে দিলেন ধর্মগুরু। অজগর রাজকন্যাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলো না। রাজকন্যা শরীর পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে অজগর। রাজকন্যার মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে মেঝে ভিজে গেছে কিন্তু তার চোখ দুটি এখনো খোলা।অজগরের আলিঙ্গনের চাপ সহ্য করতে পারলেন না রাজকন্যা।যজ্ঞ পূর্ণ হলো না। সকালেই রাজকন্যার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলো।তখন থেকে রাজা মশাইয়ের মুখ বন্ধ।কারো সাথে কোনো কথা বলছেন না তিনি।কন্যার চিতা পোড়ানোর পর বাড়িতে গিয়ে বিছানায় পড়লেন তিনি। খাবার দাবার সব বন্ধ করে দিলেন।তার চোখে শুধু মেয়ের শেষের মিনতি গুলো ভাসছে।তার চিকিৎসার জন্য অরুপ তাদের বাড়িতে গেল।রাজাকে খানিকটা সান্তনা দিয়ে বলল রাজকন্যা গর্ভবতী ছিল না। রাজকন্যা মরতে চায় নি তাই এ মিথ্যা কথার সহায়তা নিতে হয়েছে।রাজা মশাই কিছু বললেন না। শুধু চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন আর চোখ হতে অশ্রুঝরছে। একজন বাবা হয়ে সন্তানের চিতায় আগুন দেয়ার কষ্ট কতটা তীব্র হতে পারে তা উনাকে দেখলেই বোঝা যায়।রানীমা সারাক্ষণ পূজো ঘরে বসে মেয়ের জন্য অশ্রু বিসর্জন করছেন আর প্রার্থনা করছেন। রাজপ্রাসাদে কোনো টুক শব্দ নেই এখন।রাজা মশাই অসুস্থ হওয়ায় রাজ্যের সকল ভার এখন ধর্মগুরু নিলেন।
সন্ধ্যা বেলা রোগী দেখা শেষ করে চেয়ারে বসে বসে অরুপ ভাবছেন,”এ গ্রামে আর থাকা যাচ্ছে না।এই আধুনিক যুগে এদের কুসংস্কার এবং উদ্ভট রীতিনীতিতে এখন আর টিকতে পারছি না। চোখের সামনে নির্দোষ মানুষদের মৃত্যু ঘটছে, সাধারণ মানুষ জ্ঞানহীন মূর্খের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে। কাউকে শিক্ষা অর্জন করতে দেওয়া হচ্ছে না।বরং তাদের উদ্ধত করা হচ্ছে যাতে এসব অপকর্ম ভবিষ্যতে ও জারি থাকে। রাজার থেকে ব্রিটিশরা ট্যাক্স নিচ্ছেন কিন্তু এসব নিয়ে কিছু করছেন না। সতীদাহ প্রথা নিয়ে এতো আইন কিন্তু খাজনা নিয়েই নিজের চরকায় তেল দিচ্ছে তারা।তারাই বা কি করবে যেখানে আমরা নিজেরাই মূল্যবোধহীন।আমি এইসব দেখতে দেখতে এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যাব।তখন চোখের সামনে এসব অপরাধ ঘটলেও আমার আর খারাপ লাগবে না। মানুষ উন্নত জীব,যে কোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিবে এটাই স্বাভাবিক।এখান থেকে চলে না গেলে আমিও মনুষ্যত্ব হারাবো। আমিও এদের মতো এক পশুতে পরিনত হবো।না… আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো উপায় ও যে নেই।আমি একা কতদূর কি করবো? পুরো গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত এরা সবাই এক।আমি আওয়াজ তুললে আমারও মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে। খুব শীঘ্রই চলে যেতে হবে।”
হঠাৎ তার দোকানে একটি ছেলে ও মেয়ে ঢুকে পড়লো।তারা ভীষণ আতংকিত ছিল।ঘেমে একাকার হয়ে আছে দু’জনে। হয়তো দৌড়ে এসেছে। ছেলেটা অরুপের পায়ে পরে বলল,”দাদা,আমাগের আপনার ঘরে একটু আশ্রয় দিন।আমাগের হত্যা করার জন্যে লোকজন আইসতেছে। তাগের হাতে পরলেই মাইরে ফেলবে। দাদা দয়া করুন আপনার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাইকবো।”
মেয়েটি ভয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,”ঐ যে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে।তারা এইসে পইরেছে।এখন কি হবি মাহমুদ।”
“আপনারা চিন্তা করবেন না। কিছু হবে না। তাদেরকে আমি দেখছি আপনারা আমার ঘরে ঢুকে বসে থাকেন।”, অরুপ বলল।
অরুপের দোকানের ভিতর দিয়ে আরেকটি কামরা আছে।ঐখানেই অরুপ ঘুমায়,ঐটাই তার ঘর।সেখানে তাদের ঢুকিয়ে বাহিরে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে অরুপ।দশ-বারো জন লোক হাতে লাঠি বাঁশ এসব নিয়ে হন হন করে তার দোকানের দিকেই আসছে। অরুপ বুঝতে পারলো তারা হয়তো দূর থেকে ঐ ছেলে মেয়েকে তার দোকানে ঢুকতে দেখে ফেলেছে। টেবিলের ড্রয়ের খুলে একটি কেচি হাতে নিয়ে দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো অরুপ। অরুপ মনে মনে ভাবছে সে একা দশ বারো জনের সাথে মারামারি করবে। কখনোই সম্ভব নয় কিন্তু এই ছেলে মেয়েকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। লোকগুলো তার সামনে এসে পরেছে। হাতের কেচিটি শক্ত করে ধরে আছে অরুপ….
(পরের অংশ পর্ব-৭ এ)
#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#সর্প_যজ্ঞ