হরিপুর যাত্রা পর্ব-৭(যাত্রা শেষে) শেষ পর্ব

0
205

হরিপুর যাত্রা
পর্ব-৭(যাত্রা শেষে)
শেষ পর্ব

যে দলবল সে আগুন্তক ছেলে মেয়েকে মারতে আসলো তাদের মধ্য থেকে একজন লোক অরুপ কে জিজ্ঞেস করলো,”দাদা একটা ছেইলে আরেকটা মাইয়ে এখানে দৌড়ে আইসলো।কোন দিক পালায়সে দেখিছেন নাকি?”

অরুপ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।তারা তাহলে ঐ ছেলে মেয়েকে তার দোকানে ঢুকতে দেখেনি। অরুপ কিছু ভেবে বলার আগেই আরেক জন অরুপের হাতে থাকা কেচি দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলো,”কি‌ ভিষক মশাই এত রাত্রিরে হাতে কাচি নিয়ে ঘুইরে বেরাচ্ছেন কেনো, কাউকে খুন করতি যাচ্ছেন নিকি?”

“আরে দাদা কি যে বলবো,এই মশার যন্ত্রনায় টেকা যাচ্ছে না। এদের কামড়ানিতে ত্যক্ত হয়ে হাতে কেচি নিয়ে নিয়েছি।”, অরুপ উত্তর দিল।

“মশা মারতি কাচি নিয়ে ঘুইরছেন।মাথা কি ঠিক আছে ভিষক মশাই”, সবাই হেসে উঠল।

“আরে কেচি নেওয়াই তো নিয়ম।বিলেতে বিজ্ঞানী রা প্রমান করেছেন হাতে কেচি নিলে মশা সামনে আসে না”

“তাই নাকি।তাহলি আমাগের ও তো এই উপায়ে কাজ করতি হবে।মশার যে কামড়, রাত্রিরে ঘুমানো যায় না।যাক গে ঐ ছেইলে মাইয়ে দুটো ক‌ই গেছে?”

“তারা তো জঙ্গলের দিকে গেল। আচ্ছা তারা কি করেছে?”

“ঐ মাইয়ে আমাগের তারানাথের স্ত্রী।ঐ মুসলমান ছেইলের সাথে পালায়ছে।ঐ দুই বদমাইশ কে ধরতি পারলি এবারের কালী পূজোয় বলি দেব ওদের।সবার আগে দিব মাইয়ে টারে,সনাতন ধর্মের হ‌ইয়ে কি করি ঐ মুসলমান ছেইলের সাথে পালায়ছে। ওরে নরকেও জায়গা দিলি নরকের অপমান হবি।এ তোরা সবাই চল ঘাট পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা ক‌ইরতে থাকি।গিরাম থিকে পালালে নদী তো পাড় হ‌ওয়াই লাগবি নে।ঐ খানেই দুটোকে মাইরে ভাসায় দেবানে”

“দাদা আমার তো মনে হচ্ছে আপনারা ভুল করছেন।”

“কি ভুল?”

“ওরা তো জানে আপনারা ঘাট পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা করবেন।তাই তারা জঙ্গল দিয়ে পালাচ্ছে।”

“কিন্তু ভিষক বাবু, জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ারের বাস,আবার যে গহিন জঙ্গল।ওখান দিয়ে পার হয়া যাবি নে।”

“এইখানেই তো ভুল করছেন।ঐ ছেলে পালানোর আগে নিশ্চয়ই জঙ্গল দিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।আর আমি স্পষ্ট দেখেছি জঙ্গলের দিকে যেতে। আপনারা সবাই জঙ্গলে গিয়ে খোঁজ করুন পেয়ে যাবেন ওদের।দেরি করে তাদের হাত ছাড়া করবেন না।”

“ভিষক মশাই দেখছি প্রত্যু্ৎপন্নমতি।এই সবাই চল জঙ্গলে যাব আমরা।আসি ভিষক মশাই।”

লোকজন চলে গেলে অরুপ ঘরের মধ্যে ঢুকলো।দেখলো মেয়ের হাতে শাঁখা মাথায় সিঁদুর। মেয়েটি ছেলেটিকে মাহমুদ বলে ডেকেছিল।তাহলে ছেলে মুসলমান।এর মানে ঐ লোকদের কথা সত্য। অরুপ মেয়েটাকে বলল,”তুমি যে তোমার স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে বিধর্মী এক ছেলের সাথে পালাচ্ছো তা কি ঠিক?”

“দাদা,কে স্বোয়ামি?ওই তারানাথ হচ্ছে সাক্ষাত যম।(মেয়েটি তার হাতে গলায় বিভিন্ন দাগ দেখিয়ে বলল)এ অসুর প্রেত্যেকদিন আমাকে মাইরধর করতি থাকে। নিসা ক‌ইরে আইসে কত যে নির্যাতন করতিছে তা আমি আপনাক বুঝোয়ে বলতি পারবো না।আমার বাবা মা ও কিচ্ছু বলে না তারে এইসব বলার পরেও।আমাক তো বাঁইচতে হবি।আর মাহমুদ আমাক খুব ভালো বাসে।আমি বাঁচলি ওর সাথেই বাঁইচবো আর মরলি ওর সাথে ম‌ইরবো।তাতে আমাক যে যা বলার বলুক।”,মেয়েটি উত্তর দিল।

“আচ্ছা চিন্তার কোনো বিষয় নেই।আমি তাদের জঙ্গলের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি তারা খোঁজা খুঁজি করে না পেয়ে বাসায় চলে যাবে।ভোরে তোমরা নদী পার হয়ে স্টেশন চলে যেতে পারবে। তারপর সেখান থেকে যেদিকে যেতে চাও।ভোর পর্যন্ত এখানে থেকে যাও।আমার ঘর সব চেয়ে নিরাপদ।সারা জীবন থাকলেও কেউ টের পাবে না।এখন তোমরা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়।ভোরে র‌ওনা দিতে হবে।”

মাহমুদ ও রাধা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। বাহিরে নিজের চেম্বারের চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে গেল অরুপ। মধ্যরাতে হঠাৎ অরুপের দোকানের দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ। অরুপের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অরুপ ভীষণ আতংকে পড়ে গেল।এত রাতে কে এসেছে ভাবছে সে।আরো দুই টোকা দেওয়ার পর অরুপ জিজ্ঞেস করলো,”কে এসেছে?”

“আমি চন্দন দাদা। বাবুর শরীরটা তাপে পুইড়ে যাচ্ছে। কোনো বড়ি দিতি পারবেন?”

অরুপ শান্তির নিশ্বাস ছাড়ল।দুটি জ্বরের ট্যাবলেট বের করে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই দশ বারো জন রাজার সৈনিক ঘরের মধ্যে ঢুকে তিনজনকেই আটক করলো।পাশে দাঁড়িয়ে চন্দন আর বিষ্ণু হাসছে। অরুপ বুঝতে পারলো এই ঘটনার সাথে এই বাপ বেটাই জড়িত। অরুপ,রাধা ও মাহমুদ কে নিয়ে যাওয়া হলো রাজার বাড়িতে।ভোর হলে বিচার বসলো।রাজা রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুর কন্যাবিয়োগের পর থেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ।বিচার করবেন স্বয়ং ধর্মগুরু।বিচারে বিষ্ণু ও চন্দন ও উপস্থিত ছিল। প্রথমেই চন্দন ধর্মগুরুর কাছে নালিশ দেয়া শুরু করলো,”গুরুজী,এই লোক ফন্দি ক‌ইরেই আইসছে আমাগের গিরামকে ধ্বংস করার জন্যে।এই ছেইলে মাইয়ে অপরাধী,তাগেরে নিজ ঘরে লুকোয়ছে এই ভন্ড বৈদ্য। বৈদ্য শাস্ত্রের জ্ঞান তো মোটেও নেই আইসেছে আমার বাবুক গিরামে বদনাম করতি। লোকজন যখন এই অপরাধীগের খোঁজ করলো তার কাছে,সে বলে তারা নাকি জঙ্গলের দিকে গিয়েছে।ভাগ্যিস তার কাছে গিয়েছিলেম কালী পূজোর চাঁদা তুলতি।দেখি ভন্ড দোকানে নেই। ভিতরে ঢুকে যখন ঘরের মধ্যে উঁকি দিলাম দেখি এই ছেইলে আর মাইয়েকে পালানোর বুদ্ধি শিখোয়ে দিচ্ছে।আমি জলদি রাজপ্রাসাদে সেন বাবুকে জানাই তারপর সেন বাবু আর আরো কিছু লোক যাইয়ে তাগের হাতে নাতে ধ‌ইরেছি।এগের উচিৎ শিক্ষা দিবেন,যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই সাহস না করতি পারে।”

ধর্মগুরু অরুপকে জিজ্ঞেস করলেন,”ভিষক মশাই,চন্দন কি সত্যি বলছে?

“জ্বি।আমি তাদের সাহায্য করেছি।আমার মনে হয় না তারা কোনো অপরাধ করেছে।”, অরুপ বলল।

“আপনাদের বিলেতি রীতি এই গ্রামে চলিবে না। এখানকার কিছু সংস্কৃতি র‌ইয়াছে, কিছু অনুশাসন র‌ইয়াছে।তা সবাই মান্য করিতে বাধ্য।এই মেয়ে স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করিয়া ভিন্নধর্মী পুরুষের সহিত পালাবার চেষ্টা করিয়াছে। নিঃসন্দেহে তারা দোষী।আর তাদের সাহায্য করিয়া আপনিও দোষ করিয়াছেন।”, ধর্মগুরু বললেন।

“আমি সকল দোষ নিজের ঘাড়ে নিলেম। মাহমুদকে আমিই উস্কে দিয়েছি,ভিষক মশাইকে ও আমি ই ফাসায়েছি।যা শাস্তি হ‌ওয়ার আমার হোক।”রাধা ধর্মগুরু কে বলল।

“যাই হোক আমরা ও মেনে নিলেম তা। শাস্তি তোমাকেই বেশি দেয়া হ‌ইবে।তোমাকে আমৃত্যু কংকর নিক্ষিপ্ত করা হ‌ইবে।এই মুসলমান ছোকড়া কে তেরো বসন্ত রাজ কারাগারে বন্ধ করে রাখা হ‌ইবে।আর ভিষক মশাইকে আগামী দিবস সূর্যাস্তের পূর্বেই গ্রামত্যাগ দিতে হ‌ইবে।আর কোনো কালে তিনি হরিপুরে আসতে পারবেন না।এই রায়‌ ই কার্যকর হোক।”

ভোর হলো।সূর্য সবে মাত্র উদয় হয়েছে। মাহমুদকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো রাজ কারাগারের অন্ধকার কক্ষে। রাজপ্রাসাদের বাইরের ময়দানের মধ্যে একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়েছে রাঁধা কে।গ্রামের অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সামনে।৫/৬ জন সৈনিক বস্তায় বস্তায় পাথর এনে ময়দানের লোকদের সামনে ফেলছেন।রাঁধা ক্লান্ত হয়ে গেছে এ জীবন নিয়ে। ছোটবেলা বুঝ হবার পর পরই এক জল্লাদের কাছে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো।এত বছর সে জল্লাদের অত্যাচার সহ্য করতে করতে সে আধমরা এখন। মাহমুদ নামক একটি‌ লোক‌ই এই পৃথিবীতে তাকে ভালোবেসেছিল। নিজের কারনে সেই ছেলেটি ও এখন কারাগারে বন্দী। আসলেই রাঁধা খুব ক্লান্ত।এই সমাজ তৈরি করা হয়েছিল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। কিন্তু এই সমাজ কখনো রাঁধাকে বিন্দুমাত্র সুখ দিতে পারেনি।বরং সে এতো বছর পর একটি সুখের প্রদীপ জ্বালালো,তা ও নিভিয়ে দিল এই সমাজ। এখন মরন‌ই তার কাছে শেষ প্রশান্তি। ধর্মগুরু ও অন্যান্য রাজ প্রাসাদের লোকেরা এসে বাহিরের বারান্দায় দাঁড়ালেন। একজন লোক হাতে বিশাল লোহার দন্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ধর্মগুরু ইশারা করলেই ঘন্টায় বারি দিবেন।সব লোকজন হাতে বিশাল বিশাল আকারের পাথর নিয়ে প্রস্তুত। রাঁধা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রথ আসছে নাকি। ধর্মগুরু সেই লোককে ইশারা করলেন। ঘন্টা বেজে উঠল।সাথে সাথে ময়দানে উপস্থিত সকল লোক সজোরে পাথর ছুঁড়তে লাগলেন রাঁধার গায়ে।এক মিনিটের মধ্যেই রাঁধার আশপাশের মাটি রক্তে ভিজে গেল। অরুপ রাজপ্রাসাদ থেকে দোকানের দিকে চলে যাচ্ছে।এই দৃশ্য সে সচোক্ষে দেখতে পারবে না। কিন্তু লোকজনের হৈচৈ এর মধ্যেও রাঁধার চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে।চোখ দুটো বারবার মুচ্ছে অরুপ তবুও অশ্রুধারা যেনো আজ থামতে চাইছে না।এরকম নির্মম ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি অরুপ আর দেখতেও চায় না। এরকম ঘটনা খুব সুন্দর করে আপনার মানবতার উপর থেকে বিশ্বাস কেড়ে নিবে।তাতে জীবিত থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠে।অনবরত পাঁচ মিনিট পাথর ছুঁড়ার কার্যক্রমের পর হঠাৎ আবার ঘন্টা বাজলো।সবাই পাথর ছুঁড়া বন্ধ করলেন। রাজপ্রাসাদের উপরে বারান্দা থেকে একটি লোক ধপাস করে মাটিতে পড়লেন।সবাই বারান্দার দিকে তাকিয়ে আতংকিত হয়ে গেলেন।রাজা রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক হাতে ধর্মগুরুর মাথা আরেক হাতে তরবারি। ধর্মগুরুর দেহটা নিচে পরে আছে। চিৎকার করে হাসতে লাগলো রাজা রাজেন্দ্রনাথ।তাতে রাঁধার কোনো লাভ হলো না। রাঁধা খুব শান্ত ভাবে খুঁটির সঙ্গে ঝুলে আছে, কোনো নড়াচড়া নেই এই রক্তাক্ত দেহে। হয়তো তার আত্মার শান্তি প্রাপ্তি হয়েছে।
অরুপ ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে এমন সময় চোখে পড়লো নদীর পাড় কার যেনো অন্তেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে।লাল শাড়ি পরে সামনে আছে এক রমনী। দুইজন লোক তার হাত ধরে আছে।আর মেয়েটি অনবরত অশ্রু বিসর্জন করে জীবন ভিক্ষা চাইছে।হয়তো মেয়েটি নববধূ, সতীদাহ হবে এখন। আরেকটু সামনে গিয়ে অরুপ খেয়াল করলো মেয়েটি আর কেউ নয় তার স্বপ্নে আসা সেই রুপালি। অরুপ দৌড়ে সেই সমারোহে ঢুকলো। একজন লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো বিয়ের পর স্বামীর সাথে সংসার করার সৌভাগ্য হয়নি মেয়েটির।বিয়ে শেষ করেই চাকরির জন্যে কলকাতা গিয়েছিল তার স্বামী।আর আজ ফিরলো বাক্সে বন্দী লাশ হয়ে। অরুপের ভীষণ রাগ হচ্ছে। আবার একটি নিষ্পাপ মেয়েকে প্রাণ দিতে হবে। অরুপ এবার আর ভীরুর মতো চেয়ে তামশা দেখবে না। অরুপ রুপালির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।তাকে যে দুই জন ধরে রেখেছিল তাদের উদ্দেশ্য করে বলল,”আহা দাদা কি করছেন ওকে এভাবে জোর জবরদস্তি করলে কি হবে নাকি।পরে দেখা যাবে চিতায় উঠে সব উপরে দৌড়োবে।বরং ওকে পৌরাণিক শব্দে বুঝিয়ে বলেন যে চিতা আরোহনে ওর কত ফায়দা।”

দু’জনের মধ্যে একজন বলল,”দাদা এই পাগল মাই্যয়ে কিছুতেই বুঝিচ্ছে না তো। দেখেন না কিরম ছুটোছুটি করিচ্ছে।”

“আপনারা ওকে ছাড়েন।আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি।দেখবেন নিজ ইচ্ছায় চিতায় উঠে বসবে।”, অরুপ বলল।

“নেন আপনি ই যা বলার ব‌ইলে দেন।দেখেন একটু শান্ত হয় কি না।”রুপালির হাত ছেড়ে দিয়ে লোকটি বলল।

অরুপ রুপালির বাহু সজোরে ধরে তার কানে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,”দেখ,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।প্রথম দেখায় ই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বিবাহিতা তাই নিজের অনুভূতি কখনো প্রকাশ করিনি। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে বিয়ে করবো। পেশাগত আমি একজন ডাক্তার।তোমাকে অনেক সুখী রাখবো।বলো রাজি আছো?”

রুপালি ছুটোছুটি বন্ধ করে হা করে তাকিয়ে আছে অরুপের দিকে। রুপালি বুঝতেই পারছে না এই লোক কি‌ পাগল না সুস্থ। রুপালির উত্তর না পেয়ে অরুপ আবার বলল,”সময় বেশি নেই জলদি বলো।”
রুপালি হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। অরুপ ওমনিতে রুপালির হাত ধরে লোকজন ধাক্কা মেরে প্রাণপনে ঘাটের দিকে দৌড়াতে লাগলো।অন্তেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত সবার পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগলো।পরে অরুপ রুপালির পিছু পিছু তারাও দৌড়াতে লাগলেন। ঘাটের কাছে চলে এসেছে অরুপ।নদীতে স্রোত প্রবল। সাঁতরে পার হ‌ওয়া সম্ভব নয়।ঘাটে একটি নৌকা ছিল। অরুপ ও রুপালি মাঝিকে যেয়ে পার করিয়ে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু গ্রামের অপরাধীদের পার করে দিয়ে নিজে দোষী হতে চায় না মাঝি। এদিকে লোকজন খুব কাছে চলে এসেছে।ধরতে পারলে দুজনের এক জনের ও নিস্তার নেই।এমন সময় পিছন থেকে একজন বলে উঠলো,”লক্ষন এগের পার ক‌ইরে দিয়ে আয় শিগগিরই বাবা।”

অরুপ পিছনে ঘুরে দেখলেন এ তো সেই পা হীন বৃদ্ধ লোক।তাহলে মাঝি ই তার সন্তান। বৃদ্ধ লোক আবার বললেন,”লক্ষন‌ ভাবছিস কি বাবা।এগের পার করতেই হবে তোর।ন‌ইলে আমার মরা মুখ দেখবি।এই ছেইলে দেবতুল্য।এর সাহায্যে তোর অনেক পূন্য হবে রে বাবা।”
মাঝি বাবার কথায় রাজি হয়ে গেল। লোকজন এসে পরেছে তাই অরুপ বৃদ্ধ কে জরিয়ে ধরে একবার ধন্যবাদ বলতে পারলো না। নৌকায় উঠে পড়লো আর মাঝিও প্রাণপনে বৈঠা মারতে লাগলো।একটুর জন্য লোকজন তাদের ধরতে পারলো না। অরুপ ও রুপালি সফল হলো। নৌকা নদীর মাঝে যাওয়ার পর তারা দুজন ই বসে পরলো। রুপালি অরুপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। অরুপ মুচকি হাসি দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

বিশ বছর পর…..
অরুপ এখন ঢাকার নামকরা মেডিকেলের ডাক্তার। তার বাবা,মা, রুপালি ও তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এখন ঢাকাতেই বেশ শান্তিতে বসবাস করছেন।মেয়ের নাম রেখেছেন রাঁধা।মেয়ে কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে উঠেছে।কাল তাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান।মেয়ে বাবাকে বলে রেখেছে লাল শাড়ি কিনে আনতে পরদিন নবীনবরণে পড়ে যাবে।মেডিকেল থেকে বের হয়ে মেয়ে রাঁধার জন্য শাড়ি কিনতে যাবেন এমন সময় তার পিছনে থেকে তার নাম ধরে একজন লোক ডাকলো। লোকটিকে দেখে ভদ্রলোক ই মনে হচ্ছে কিন্তু তাকে চিনতে পারলো না অরুপ। অরুপ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কি আমাকে চিনেন?”

“জি চিনবো না কেন। আপনাকে না চিনলে কাকে চিনবো, এমনিতে গোঁফ দাড়িতে আপনাকে বেশ ভালোই লাগছে দাদা।”

“আপনি আমাকে গোঁফ দাড়ি ছাড়া দেখেছেন কখনো? মানে গত আঠারো উনিশ বছর আগে থেকেই গোঁফ দাড়ি রাখছি। আপনি কি আমাকে তার আগে থেকে চেনেন?”

“আমার নাম মাহমুদ।আমার বাড়ি হরিপুরে।মাহমুদ নামে কারো কথা কি আপনার মনে পড়ে?”

“মাহমুদ তুমি?… তোমাকে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? তোমার চেহারা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেমন আছো তুমি? হরিপুরে সবাই‌ কেমন আছে?”

“হরিপুর তো নেই অরুপদা… রাজকন্যার মৃত্যুতে মহারাজ রাজেন্দ্রনাথ পাগল হয়ে বসলেন। আপনি যেদিন চলে গেলেন সেদিন ই ধর্মগুরুকে মহারাজ হত্যা করলেন।মহারাজ ও দুদিন পর মারা গেলেন।গ্রামে কলেরা মহামারী ছড়িয়ে পড়ল।হরিপুরের বেশিরভাগ লোক সে মহামারীতে মারা গেছে। অনেকে বলেন রাঁধার অভিশাপ লেগেছে গ্রামে।কেউ কেউ গ্রাম ত্যাগ করলেন। ব্রিটিশ সরকার কয়েদিদের ঢাকার কারাগারে নিয়ে আসলেন।আমার তেরো বছর এভাবেই কারাগারে বন্দী হয়ে কেটে গেছে। বের হয়ে দেখি ব্রিটিশরা চলে গেছে এখন আমরা পাকিস্তানী। হরিপুর গেলাম সেখানে ও সব বদলে গেছে। স্কুল হয়েছে, হাসপাতাল হয়েছে। ওখানকার মানুষজন এখন আর অজ্ঞ নয়। কিন্তু সেখানকার নাম বদলে গেছে। এখন ঐ জায়গাকে সবাই রাজেন্দ্রপুর হিসেবে চিনে।ঢাকা ফিরে আসলাম আপনার খোঁজে,দেখি আপনি খুব বড় মানের ডাক্তার হয়েছেন। আপনার সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। দূর থেকেই আপনার পরিবারের খোঁজ নিয়েছি, দোয়া করেছি। এখন একটি চায়ের দোকান দিয়েছি। খুবই ভালো আছি।”

“আছ হঠাৎ আমার সামনে আসলে যে… কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই?”

“জি অবশ্যই। শুনেছি আপনার মেয়ের নাম নাকি রাঁধা রেখেছেন। খুবই মিষ্টি মেয়ে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে আমার দোকানে চা খেতে আসে।যখন ওর চায়ের পয়সা না নেই তখন অনেক জিজ্ঞেস করে কেনো শুধু ওর থেকে চায়ের পয়সা নেই না। আমি তো তাকে বলতে পারি না যে ওর বাবার কাছে কত বড় ঋণী আমি। সেদিন বন্ধুদের সাথে বলছিল আপনাকে বলবে একটি লাল শাড়ি লাগবে ওর।এই যে একটি লাল শাড়ি এনেছি। শাড়িটা আমার রাঁধার, আপনার রাঁধা কে পড়লেও মানাবে। ভেবেছিলাম বিয়েতে ওকে শাড়িটা দিব। কিন্তু তা আর হলো না। আপনি আপনার মেয়েকে এটা দিয়ে দেন। রাঁধার জন্য কেনা শাড়ি রাঁধা পড়ুক। আমি যদি ওকে সরাসরি দেই ও হাজারটা প্রশ্ন করবে। আপনি কি ওকে আপনার পক্ষ থেকে এই শাড়িটা দিবেন?”

“অবশ্যই।”(অরুপ শাড়িটা হাতে নিল। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে। আকাশে বাতাসে শান্তির গীত শুনতে পাচ্ছে তারা)

(সমাপ্ত)

#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#যাত্রা_শেষে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here