হলুদ_বসন্ত #পর্ব_০২,০৩

0
1005

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০২,০৩
#Eshika_Khanom
পর্ব_০২

আয়াত ভেবে পেল না কি বলবে। শেষে আদ্রাফকে প্রশ্ন করল,
“আপনার এই রোগটি হলো কিভাবে?”

আদ্রাফ শান্তস্বরে বলল, “প্লিজ এই প্রশ্নটা বাদে অন্য কিছু বলো।”

আয়াত আর কিছু বলল না। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বাগানের ফুল গাছগুলোর দিকে চলে গেল। সদ্য ফোঁটা বেলীফুল গুলো তীব্র আকর্ষণ করছে তাকে। একই সময়ে আদ্রাফের চোখে বন্দী হয়ে গেল এক স্নিগ্ধ যুবতী। সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের চেয়েও আবেদনময়ী লাগছে তাকে। বেলীফুলের গাছগুলো যেমন আয়াতকে আকর্ষণ করছে ঠিক তেমনই আদ্রাফকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছে আয়াত তার অজান্তেই। চোখ সরিয়ে নিল আদ্রাফ আয়াতের থেকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। তোমার যখন মন চায় নিজের রুমে চলে যেও। আর বাড়ি থেকে এক কদমও পা রাখবেনা বলে দিলাম।”

আদ্রাফের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আয়াত। আয়াতের কোনো উত্তর না শুনেই প্রস্থান করল সে। পিছনে ঘুরে আয়াত কিছু বলতে যাবে তখন দেখলো আদ্রাফ সেখানে নেই, চলে গিয়েছে। আবার একটু পরই শুনতে পেল একজন সার্ভেন্টের ডাক।

“ম্যাম আপনার আর স্যারের জন্যে কফি।”

আয়াত তার দিকে তাকিয়ে বলল, “উনি তো চলে গিয়েছে।”

সার্ভেন্টটি বলল, “তাহলে আমি স্যারের কফিটা নিয়ে যাই। এইযে আপনারটা রেখে গেলাম ম্যাম।”

“হুম।”

আয়াতকে কফি দিয়ে আদ্রাফের কফিটি নিয়ে সে চলে গেল। আয়াত আরও কিছুক্ষন মোহমুগ্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশে বসে রইল।
.
.
.

আদ্রাফের ফোনের রিংটোন অনেকক্ষণ ধরে বেজেই চলেছে। যে কল দিয়েছে ফোনের ওপার থেকে যেন খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আদ্রাফের সাথে কথা বলার জন্যে। তবে আদ্রাফের তো ফোনটা ধরার নামই নেই। হঠাৎ ফোনে কল আসা বন্ধ হয়ে গেল। ৫-৭ মিনিট অতিবাহিত হল। এরপর পুনরায় শুরু হলো রিংটোনের যুদ্ধ। অনেক সময় পরে যেন খোদা তায়ালা ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির অপেক্ষা প্রহর শেষ করল। আদ্রাফ এতোক্ষন ওয়াশরুমে থাকায় ফোনের কলটা রিসিভ করতে পারেনি। ফোনটা রিসিভ করার পরই ওপর পাশ থেকে একজন বলল,

“কার সাথে রোম্যান্স করছিলি? এতো সময় লাগে ফোন রিসিভ করতে?

আদ্রাফ হালকা হাসল। অতঃপর আফসোসের সহিত বলল,
” যাকে ভালোবাসি তাকে তো একবারও ছুয়ে দেখা হলো না। রোম্যান্স কিভাবে করব?”

ওপাশে থেকে উত্তর দিল, “আচ্ছা এতো দেরি হলো কেন?”

“আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।”

“ওহ তাই বল।”

“হুম নুহাশ।”

ফোনের অপর পাশে থেকে আদ্রাফের বন্ধু নুহাশ বলল,
“আমি বাংলাদেশে আছি। চাইলে দেখা করতে পারে আদ্রাফ ইসলাম আমার সাথে।”

আদ্রাফ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“দেশে ফিরেছিস আমায় জানালি না কেন?”

“কোথায় জানায়নি? এইযে জানালাম।”

“এটা তো মাত্র বললি।”

“আগে বললেও তুই এ কথাই আমায় শুনাতি।”

“হয়তো।”

“দেখা করবি কবে? চল আজই কোথাও দেখা করি।”

আদ্রাফ বলল, “হুম এক শর্তে দেখা হবে আমাদের।”

“ছোটবেলার বন্ধুর সাথে দেখা করবি আবার কিসের শর্তে? আচ্ছা যা তাও বল।”

“আমাকে তুই ছুতে পারবি না। আমার থেকে কিছুটা দূরে থাকবি।”

“কেন?”

“দেখা হলেই বলব।”

“আচ্ছা যা ঠিক আছে।”

“হুম।”

আদ্রাফ ফোন কেটে দিল। দরজার অপর পাশ থেকে কেউ নক করায় পিছনে ঘুরে তাকালো। দেখলো তার দাদী এসেছে। আদ্রাফ দূর থেকেই তার দাদীকে বলল,
“দাদী আমার রুমের সামনে কেন আসলে? তোমার যদি কোনো সমস্যা হলে তখন কি করবে তুমি? কাউকে দিয়ে আমায় ডেকে নিতে তাহলেই তো হতো।”

আদ্রাফের দাদী বাহিরে দাঁড়িয়েই বলল
“ওই রোগটা হওয়াতে কি এমন হয়েছে যে নিজেকে গৃহবন্দী বানিয়ে ফেলেছিস তুই?”

আদ্রাফ মুচকি হেসে বলল,
“আরে দাদী তেমন কিছুনা। শুধু আর কিছু ভালো লাগেনা। তুমি তোমার রুমে যাও, আমি আসছি।”

আদ্রাফের দাদী বাহিরে থেকেই আদ্রাফের রুমে হালকা উঁকি মেরে নিল। তারপর হতাশ হয়ে বলল,

“তা আমার সতীন কই রে?”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল আদ্রাফ তার দাদীর কথা শুনে। প্রশ্নটা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তার। দাদীর কথা শেষে বুঝতে পেরে হালকা সংকোচ নিয়ে বলল,
“দাদী তুমি কি আয়াতের কথা বলছ?”

আদ্রাফের দাদী মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ রে! কই আমার আয়াত সতীন?”

আদ্রাফ উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। আদ্রাফের দাদী এইডস রোগ এবং এর ঘাতকতা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নয়। আদ্রাফ তার দাদীকে জানাতে চায়নি যে সে এইডস রোগে আক্রান্ত। গোপন খবর তো বাতাসে উড়তে উড়তে ছড়ায়। সে সাথে আদ্রাফের এইডস হয়েছে এই খবরটাও কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কানে পৌছে গেল। আর তা থেকে খবরটা গেল দাদীর কানে। আদ্রাফ তার দাদীকে সামলাতে তখন তাকে বলেছিল যে এটা তেমন কোনো রোগ নয়। সেরে যাবে জলদিই। আদ্রাফের দাদী তার নাতি আদ্রাফকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। আর রোগ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিশ্বাসটা জলদিই করে ফেলে সে। এবার আব্দারই করে ফেলে নাতিবউ পাওয়ার। দাদীর কথা রাখতে বাধ্য হয়ে তাই নিজের ভালোবাসাকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় সে।

আদ্রাফের দাদী আদ্রাফকে আবার ডাক দিয়ে প্রশ্ন করল,
“কিরে কই হারায় গেলি?”

আদ্রাফ বলল, “তুমি তোমার ঘরে যাও, আরামে বস একটু, শান্ত হও, আমি আয়াতকে পাঠাচ্ছি।”

“কই ও?”

আদ্রাফ মিথ্যে বলল। বলল, “ওয়াশরুমে।”

দাদী বলল, “আচ্ছা।”
.
.
.

আয়াত সার্ভেন্টের দেখানো অনুযায়ী একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা খানিকটা ভেজানো। ভিতরে রকিংচেয়ারে একটা ছাইরঙা পোশাক পড়া মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। আয়াত বুঝে নিল ইনিই আদ্রাফের দাদী। কিছুক্ষণ আগে আদ্রাফ একজন সার্ভেন্টকে পাঠায় তার রুমে। সে তাকে জানায় আদ্রাফ তাকে তার দাদীর সাথে দেখা করতে বলেছে। দাদী নাকি তার সাথে দেখা করতে চায়। আয়াতও বাধ্য মেয়ে হয়ে সার্ভেন্টের পিছু পিছু দাদীর ঘরের দিকে যায়। পথিমধ্যে সার্ভেন্টকে প্রশ্ন করে,

“আপনারা সবাই এমন রোবটের মতো কেন?”

সার্ভেন্ট বলল, “স্যারের অসুস্থতার পর এই বাড়িতে যতটুকু প্রাণবন্ততা ছিল সেটাও হারিয়ে গিয়েছে।”

আয়াত চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে আবার প্রশ্ন করল,
“ওনার বাবা মা কোথায়?”

উত্তর দেয়নি সে। দাদীর ঘরের সামনেই এসে পড়ে তারা। সে সার্ভেন্ট আয়াতকে বলে,
“ভিতরে বড় ম্যাডাম বসে আছেন। আপনি যান, গিয়ে দেখা করুন।”

এই বলে সে চলে যায়। আয়াত রুমের দরজার সামনে যায়। বাকিটুকু সবার জানা। আয়াত কেন যেন ভয় পাচ্ছে আদ্রাফের দাদীর সাথে দেখা করতে। ঘরের ভিতর থেকে আয়নার মধ্যে একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় আদ্রাফের দাদী মিসেস দিলারা জাহান। তিনি বলেন,
“বাহিরে কেন দাঁড়িয়ে আছিস সতীন? ভিতরে আসো।

টাসকি খেয়ে গেল আয়াত। কি বললেন উনি এটা? ধীর পায়ে মাথা নিচু করে ঘরটিতে প্রবেশ করে আয়াত। পুরোনো আমলের বিভিন্ন আসবাবপত্র দ্বারা সুসজ্জিত এই ঘরটি। বেশিরভাগই জমিদারদের ব্যবহার করা আসবাবপত্রের অনুরূপ। ঘরটির ভিতরে কিছুটা প্রবেশ করে আবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। দিলারা জাহান আবার বললেন,
” কিরে আমার সামনে আসবি না?”

আয়াত এই কথা শুনে সামনে আসে আদ্রাফের দাদীর। দেখতে পায় পাকা পাকা চুল ও দুধে আলতা গায়ের রঙ নিয়ে একটা বই হাতে রেখে বসে আছেন সে। বুড়ো বয়সেও এতো রুপ! ভাবতেই বারবার অবাক হচ্ছে আয়াত। দিলারা জাহান আয়াতকে একটা সোফা দেখিয়ে আবার বললেন,
“এদিকে বস তো! আমি একটু দেখি তোকে।”

চুপ করে আয়াত আদ্রাফের দাদীর সামনে এসে মাথা নিচু করে বসে। কেমন যেন একটা আজব অঅনূভুতি হচ্ছে তার। কিছুটা লজ্জা গ্রাস করছে তাকে। আদ্রাফের দাদী আয়াতের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে নেন। সাথে সাথেই বলে উঠেন,
“মাশাল্লাহ!”

এরপর আর কিছু না ভেবেই নিজের গলা থেকে একটা মোটা স্বর্ণের চেইন আয়াতকে পড়িয়ে দিল। আদ্রাফের দাদীর এহেন কাজে আয়াত স্তব্ধ। হা করে তাকিয়ে রইল আয়াত। আদ্রাফের দাদী আয়াতের গালে হাত দিয়ে বলল,
“এখন এটাই দিলাম সতীন। একটু পরে তোকে আরও গয়না দিব। আসলে এখন হাতের কাছে এটা ছিল তাই আরকি।”

আয়াত দাদীর আচরণে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। দিলারা জামান মুচকি হেসে বললেন,
“কিরে আমি তোকে সতীন বলায় রাগ করলি? নাকি শুধু একটা চেইন দিলাম দেখে মন খারাপ করলি?”

এবার আয়াত যেন কিছু না বললেই নয়! আয়াত বলল,
“বলেন কি দাদী? আপনি যা দিয়েছেন তাই তো অনেক বেশি। আমি কখনোই এসবের আশা করিনি দাদী। আর রইলো সতীনের কথা, আমি একটুও রাগ করিনি বা মন খারাপ করিনি।”

দাদী বললেন, “তাই নাকি? খুব ভালো। তা আদ্রাফ কি করে? তোকে পাঠাতে বললাম বলে কি সে আসতে পারবে না?”

আয়াত মাথা নিচু করে নিল। ফর্মালিটি অনুযায়ী প্রথমে সবকিছু করলেও শেষের কথাটা তার খারাপ লাগায় মন থেকেই দাদীকে উত্তর দিয়েছিল সে। তবে এবার কি বলবে তা ভেবে পেল না আয়াত। মাথা নিচু করে নিল সে। দাদী আবার বললেন,
“তোর কি বরকে সাথে নিয়ে আসার মুরদ নাই?”

#চলবে

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৩
#Eshika_Khanom

“তোর কি বরকে সাথে নিয়ে আসার মুরদ নাই?”

এটা বলেই দাদী হেসে দিলেন। প্রশ্নটা শুনে কিছু সময়ের জন্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিল আয়াত। দাদী হাসতে হাসতে আয়াতের গালে হাত রেখে বললেন,
“ভয় পাস নাকি আমার নাতিরে?”

প্রশ্নটা আয়াতের মনে খুব ভালোভাবে গেঁথে গেল। নিজেকে মনে মনে নিজেই প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা সত্যিই কি সে আদ্রাফকে ভয় পায়? পেলেও কতটুকু পায়?

আদ্রাফের দাদী দিলারা জাহান আয়াতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বুঝলেন আয়াত কিছু একটা চিন্তা করছে। দাদী আয়াতের কপালে একটা টোকা দিলেন। কেঁপে উঠলো আয়াত, ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল সে। দাদী প্রশ্ন করলেন,
“কি সতীন এখনই বরকে মিস করছিস?”

লজ্জা পেল আয়াত। কোথা থেকে লজ্জাটা তার মধ্যে ভর করল সে জানে না। দাদী হাসিমুখে বললেন,
“থাক থাক তোর লাল হয়ে যাওয়া গাল দেখে আমি আমার উত্তর পেয়ে গিয়েছি।”

আয়াত নিজের গালে হাত দিল। কি বলছেন এসব দাদী? আয়াতের মাথায় গোলমাল পাকিয়ে গেল। আদ্রাফের দাদী আয়াতের কাণ্ড দেখে খিলখিল করে আবার হেঁসে উঠলেন। বললেন,
“হয়েছে আর কিছু ভাবতে হবে না। বেশি চিন্তা করলে আমার মতো চুল পেকে যাবে। এজন্যই তো আমার নাতি আমায় ছেড়ে দিয়ে একটা সতীন এনেছ্র আমার জন্যে। আবার এই সতীন আমার সাথে কথাও বলে না।”

আয়াত হেসে দিল। বলল,
“দাদী আপনার চুল পাকা হলেও আপনি অনেক মিষ্টি। ”

“তাই নাকি?”

আয়াত বলল, “হুম তাই। এতো কিউট আপনি যে এখনো আপনাকে পাওয়ার জন্যে আপনার পিছনে ছেলেরা লাইন ধরে থাকবে।”

দাদী মুখ বাকিয়ে বললেন,
“তাহলে তোর বর তোকে বিয়ে করল কেন? আমার পিছন ছেড়ে দিল কেন?”

“কে বলেছে আমি তোমার পিছু ছেড়েছি?” দরজার বাহির থেকে প্রশ্ন করল আদ্রাফ।

আয়াত আর আদ্রাফের দাদী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রাফ এসেছে। আয়াত কেন যেন মুখ ঘুরিয়ে নিল। আদ্রাফ খেয়াল করল ব্যপারটা, তবে বিষয়টা স্বাভাবিকই নিল। বাঁধ সাধলেন আদ্রাফের দাদী। বললেন,
“সতীন দেখি আমার আদ্রাফের দিকে তাকিয়েও দেখে না। এই আদ্রাফ তুই এদিকে আয় তো।”

আদ্রাফের একটু সংকোচ হলো। পরে দাদী মন খারাপ করতে পারে এই চিন্তা করে দাদীর সামনে এলো। তখন দাদী বলল,
“এই আমার বালিশের নিচে যে আলমারির চাবি থাকেনা? ওইটা আমায় এনে দে।”

আদ্রাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দাদীর বিছানার সামনে গিয়ে বালিশে হাত দিল। হাত দিতেও তার কিছুটা সংকোচ হয়েছিল। তবুই বালিশটি সরিয়ে আলমারির চাবির ছড়াটা এনে দাদীর হাতে দেওয়ার জন্যে উদ্যত হলো। তখনই দিলারা জাহান বাধা দিয়ে বলল,
“এই আমায় দিতে হবেনা। এই পা ব্যথা নিয়ে বারবার উঠতে পারিনা রে। তুই আমার সিন্দুক থেকে নীল রঙা গয়নার বাক্সটা বের কর।

আয়াত সবকিছু চুপ করে শুনলেও দাদীর কথাটার মানে বুঝতে পেরে অবাক চোখে আবার দাদীর দিকে তাকালো। বলল,
” দাদী!”

আদ্রাফের দাদী এক ভ্রু কুচকে আয়াতের দিকে তাকালো। তারপর আদ্রাফকে বলল,
“কেমন সতীন আনলি রে আদ্রাফ? মাঝে মাঝে কথাই বলে না, আবার যখন কথা বলে তখন বেশিই বলে ফেলে।”

আয়াতের অপরাধবোধ হলো। আদ্রাফ আয়াতকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“দাদী যেটা বলছে সেটা শুনো। এতো চিন্তা করো না তুমি।”

আদ্রাফ আলমারির সিন্দুক খুলে একটি বড় নীল রঙের গয়নার বাক্স বের করল। তারপর সেটি দাদীর হাতে দিয়ে বলল,
“নাও ড্রামাকুইন”

আদ্রাফের দাদী বাক্সটা খুলে আয়াতের সামনে ধরলো। আয়াত দেখতে পেল অনেক ভারী ভারী পুরনো ডিজাইনের গয়না। আদ্রাফের দাদী আয়াতের এক হাত ধরে বলল,
“সতীন তোর হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে এই গয়নাগুলো। একটু পুরোনা তো। চিন্তা নাই তোকে আদ্রাফ নতুন গয়নাও গড়িয়ে দিবে। কিন্তু এটা তুই রাখ।”

আয়াতের অজান্তেই তার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আদ্রাফের দাদী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“কীরে মেয়ে কাঁদিস কেন?”

আয়াত বলল, “এতোকিছুর ভার কিভাবে বইবো দাদী?”

আদ্রাফের দাদী আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েরা হলো তরলের মতো। যে পাত্রে রাখবে সেই আকারই ধারণ করবে। তুইও সব পারবি, চিন্তা করিস না। আছি তো আমি যে কয়দিন আছি। আর এরপর তো আদ্রাফ আছেই তোর সঙ্গে, তাইনা আদ্রাফ?”

আদ্রাফের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। আয়াতের মনে প্রশ্ন জাগলো,
সত্যিই কি সে আছে আমার সঙ্গে?” পরক্ষণেই আবার ভাবলো, “সে থাকলেও কি? না থাকলেও কি? এমনিতেই তার যে রোগ, মরণ তার সন্নিকটে। পাশে থাকবেই বা কি করে?”

আদ্রাফের দাদী দুইজনের দিকেই একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,
“আমি ভুল তো কিছু বলিনি আমার মনে হয়। কি আদ্রাফ, কিরে সতীন কিছু হয়েছে?”

আদ্রাফ বললো,” কি আর হবে? পা দুটো খুব ব্যথা করছে এই আরকি।”

“তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কয়েকদিন ধরে দেখি তুই আমার ধারেকাছেই থাকিস না?”

” সে অনেক কথা, পরে বলি।”

“আচ্ছা তাহলে আমার সতীনকে এই গয়নাগুলো পড়িয়ে দেখা তো! আমি মনপ্রাণ জুড়িয়ে তোদের দেখি।”

আয়াত আরও অস্বস্তিতে পরে গেল। আদ্রাফ রেহাই পেতে বললো,
“দাদী তুমি জানো এই গয়নার মারপ্যাঁচ আমি কিছুই বুঝিনা। তার চেয়ে বরং তুমিই পড়িয়ে দাও ওকে৷ আমি দেখি।”

“আদ্রাফ আর একটা কথাও না। যেটা বলেছি সেটা কর।” আদেশের সুরে বললেন দাদী।

আদ্রাফ করুণ চোখে আয়াতের দিকে তাকালো। আদ্রাফ কারো বেশি কাছেই যেতে চাইছে না। ওর ভয় হয় যদি ওর থেকে কারও এই রোগ আবার হয়ে যায়? নিজে যেভাবে এবার জীবন দিয়ে ভুগছে, অন্য কেউ সে কষ্টের সম্মুখীন হোক তা সে চায়না। আয়াতের বোধগম্য হলো আদাফের চাহুনী। বুঝতে পারলো আদ্রাফের কেন এতো সংকোচ। নিজে বসা থেকে উঠে গেল আয়াত। আদ্রাফের সামনে এসে দাঁড়ালো আয়াত। আদ্রাফের হাত গয়নার বাক্স দিয়ে বলল,
“এখানে থেকে গয়না গুলো নিয়ে আমায় পড়িয়ে দিন।”

অবাক হলো আদ্রাফ। তার নয়নযুগলে সৃষ্টি হলো হাজারো প্রশ্ন। তবে আয়াত বুঝতে পেরে দুইটি বাক্যেই সমাধান দিয়ে দিল। আয়াত আদ্রাফের কানের সামনে একটু এগিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“ভয় নেই, রোগটা তো ছোয়াচে নয় যে আমারও হয়ে যাবে। আপনি শুধু শুধু বেশিই ভয় পেয়ে আছেন, চিন্তা নেই।”

আদ্রাফ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি আদ্রাফকে উপহার দিল। ইশারা করে বলল, পড়িয়ে দিন নাহলে দাদী কষ্ট পাবে। হালকা মাথা নাড়িয়ে আয়াতের ইশারায় সম্মতি দিল আদ্রাফ। একে একে অনেকগুলো গয়না আয়াতকে পড়িয়ে দিল। হাঁপিয়ে উঠল দুজনেই। একজন গয়না গায়ে দিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর একজন পড়িয়ে। দুজনেই একসাথে বলল,
“আর না দাদী।”

দুইজনকে চোখ ভরে দেখলো দিলারা জাহান।
.
.
.

“শীতের এই শেষ মূহুর্তের আবহাওয়াটা দারুন তাইনা আয়াত?” বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আয়াতকে প্রশ্ন করল আদ্রাফ। তবে বিনিময়ে উত্তর পেল, “হুম।”

আদ্রাফ বললো, “আমার দাদী মতো এবার আমারও বলতে ইচ্ছে করছে যে তুমি কথা বলতে পারেননা।”

আয়াত ভ্রু কুচকে আদ্রাফের দিকে তাকালো। আদ্রাফ তখন দুই হাতের শাহাদাত আঙুল দুইটি উঠিয়ে বলল,
“এইযে খালি একেক রকম এক্সপ্রেশন দিবে, কিন্তু কোনো কথা বলবেই না।”

আয়াত রেগে বলল, “তো আমি কি এখন মাইক নিয়ে গান বকবক শুরু করব?”

আদ্রাফ বললো, “করতেই পারেন, জীবনের শেষ মূহুর্ত আমার বন্ধুর বকবক শুনেই নাহয় কাটাই।”

আয়াত চুপ করে গেল। কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। আদ্রাফ বলতে লাগলো,
“আচ্ছা আয়াত, সত্যিই তো এইডদ রোগ এমনি সবাত একটু সান্নিধ্যে থাকলে ছড়াবে না তাইনা?”

আয়াত উত্তর দিল না। আদ্রাফ জোরে ডাক দিয়ে বলল,
“এই আয়াত, শুনতে পেলে না?”

আয়াত চমকিয়ে উঠল। তারপর বললো, “শুনেছি তো৷ মাথায় রাখুন এইডস রোগ ছোয়াচে নয়। তাই সবার থেকে দূরে থাকতে হবেনা। কাছে থাকলেও কিছু হবেনা। চিন্তা নেই।”

আদ্রাফ বললো, “জানো আয়াত, জীবনের শেষ অংশটুকু সবার সাথেই হাসিখুশি হয়ে কাঁটাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু সে বলল, তুই যার কাছেই যাবি যার কাছাকাছি থাকবি সেই তোর রোগ পেয়ে যাবে। তাই সবার থেকে দূরে থাকা। কিন্তু তোমার কথায় বিশ্বাস করলাম। তোমার চোখে মিথ্যা দেখতে পাইনি। তুমি যেহেতু বলেছ, তাহলে এখন থেকে যে কয়দিন বাঁচি সবার কাছাকাছিই থাকব। ইনজয় করবো।”

আয়াত তখনই আদ্রাফের কথার মাঝে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
“আমি বাবার সাথে দেখা করবো!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here