#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৮ (বোনাস),০৯
#Eshika_Khanom
পর্ব_০৮ (বোনাস)
নুহাশ এটা বলে আর কিছুর অপেক্ষা না করে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে মেঝেতেই বসে পড়ল। নিজের মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল নুহাশ। মোটেও সে নিজেকে কাপুরুষের পরিচয় দিতে চায় না। অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে তার দুই চোখ থেকে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করা শুরু করেছে সে ইতিমধ্যে। ইচ্ছে করছে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে, কিন্তু প্রিয় বন্ধুর শেষ সময়টুকুতে সে যে তার পাশে থাকতে চায়। তবে এখানে থাকলেই নিজের অব্যক্ত ভালোবাসাও তার নজরবন্দী হবে৷ নিজেকে দিশেহারা লাগছে তার। এমন একজনকেই ভালোবাসলো সে যাকে সে কখনোও পাবে না সে। প্রথমবার আয়াতকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে সে। তবে এমন এক তরফা ভালোবাসা যে কখনোই পূর্ণতা পাওয়ার নয়। নিজের সুখের জন্যে কারো দুঃখের কারণ হতে পারবে না সে। আদ্রাফ হয়তো দুনিয়াতে থাকবে না, তাই বলে তার স্ত্রীকে নিজের করতে পারবে না সে। আয়াতকে কষ্ট দিতে পারবে না নুহাশ, একদমই পারবে না সে। আয়াতের চোখে ইতিমধ্যেই আদ্রাফের জন্যে ভালোবাসা দেখে ফেলেছে সে। আজ নুহাশের নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা সে আদ্রাফ আর আয়াতকে একসাথে। দুইজনের মধ্যকার নীরব ভালোবাসা সেও অনুভব করছে, তবে তা মেনে নিতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে পড়লো নুহাশ। সোজা চলে গেল তার ওয়াশরুমে। শাওয়ারটা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বসন্তের আগমনের পূর্বে বিরাজমান শীতও আজ তাকে কাবু করতে পারলো না। নিজের অশ্রুধারাকে বিলিয়ে দিল কনকনে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে। কষ্টগুলোকে সহ্য করা যে এখন বেশিই কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে কি কাপুরুষেই পরিণত হবে সে?
.
.
.
“আচ্ছা শুনুন আমার না আপনার রুমটাতেও একবার ঢুকার খুব ইচ্ছে। আমি যদি একবার ঢুকি তাহলেও কি খুব সমস্যা হবে?” আদ্রাফকে প্রশ্ন করল আয়াত।
আদ্রাফ নাক মুখ কুচকে বলে, “আয়াত তুমি জানো তো আমার রোগ সম্পর্কে। আমার ব্যবহার্য কিছুই তোমার এখন স্পর্শ করা উচিত নয়। তোমাকে সাবধান থাকতে হবে।”
আয়াত বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ” উফচ আপনি বেশি ভয় পান। আমি শুধু দেখেই চলে আসবো।”
“কি দরকার আয়াত?”
“একটু প্লিজ, দুই মিনিট থাকব আপনার রুমে।”
আদ্রাফ ফোন চালাতে চালাতে বলল, “জেদ করো না তো!”
আয়াত জোর গলায় বলল, “আপনি না নিয়ে গেলে আমি জেদই করব। আমার অধিকার আছে আপনার রুমে যাওয়ার।”
আদ্রাফ আয়াতের কাছে একটু ঘেঁষে বসে ধীর কন্ঠে বলল,
“আমারও তো অনেককিছুর অধিকার আছে আয়াত।”
আয়াত পুনরায় কেঁপে উঠল। মানুষটা এই শীতের মধ্যেও আরও কাঁপিয়ে দেয় তাকে। বুঝেনা কি সে যে আয়াত তখন কি অনুভব করে? আয়াত কিছুটা চেপে আরও দূরে গিয়ে বসলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আদ্রাফ৷ আয়াতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“চলো আয়াত।”
আয়াত প্রশ্ন করল, “কোথায়?”
আদ্রাফ বলল, “যেখানে যেতে চেয়েছিলে।”
আয়াতের ঠোঁটে সুক্ষ এক হাঁসি ফুটে উঠলো। আদ্রাফের সাথে সেও চললো আদ্রাফের রুমে।
তবে রুমে গিয়ে অবাকের শেষ সীমানায় পৌছে গেল আয়াত। খুব সুন্দর করে মোহনীয়ভাবে সজ্জিত ঘরটির দেয়ালের বেশ কিছু অংশে আয়াতের ছবি টাঙানো। আয়াতের জীবনের পরিসরের ছোট ছোট কিছু মূহুর্তকে বিশেষভাবে সাজিয়ে তুলেছে আদ্রাফ। একবার আয়াত তার এক বান্ধবীর পোষা বিড়ালকে কোলে তুলেছিল। তার বান্ধবী তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল বিড়ালটি। সেই বিড়ালটিকে আদর করার মুহূর্তটি আদ্রাফ ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছে। আয়াত বিমোহিত হয়ে আদ্রাফের রুমে হেঁটে যাচ্ছে। আরেকটা ছবিতে সেই মূহুর্তকে অবলোকন করা যাচ্ছে যেখানে সে একটা বাবলগাল খেয়ে খুব বড় করে ফোলানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা ফেটে গিয়ে আয়াতের নাকে লেপ্টে রয়েছে। বাবলটি বড় করে ফোলাতে না পারার কষ্টে আয়াত দুঃখভরা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক সেই মূহুর্তেই ছবিটি তোলা হয়েছে। আনমনেই হেসে উঠলো আয়াত। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলো আদ্রাফ। আয়াত আরও এগিয়ে গিয়ে একটা ছবি স্পর্শ করতে নিলে আদ্রাফ বাঁধা দিয়ে বলল,
“ছুয়ো না এগুলো আয়াত, এগুলো মরণ পর্যন্ত আমার সম্পদ। তোমায় তো ছুয়ে দিতে পারব না আমার ভালোবাসা দিয়ে, তাই এই ছবিগুলোতেই নিজের ভালোবাসা কিছুটা উজাড় করব।”
.
.
.
মাত্র গোসল শেষে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো আয়াত। ঘন কেশ চুয়ে চুয়ে এখনো পানি পড়ছে।সেই সাথে ভিজে যাচ্ছে তার পিঠ। এই শীতের মধ্যেও দ্বিতীয়বার গোসল করতে হলো তাকে একমাত্র আদ্রাফের কারণে। আয়াত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একাই বলতে লাগলো,
“লোকটা ভীষণ খারাপ, আমায় গোসল করতে বাধ্য করল।”
আবার আনমনেই হেসে উঠলো আয়াত। মাথাটা কোনোরকম মুছে নিচে নেমে এলো। সোজা গেল দাদীর রুমটিতে। সদ্য গোসল করায় যথেষ্ট আবেদনময়ী লাগছে তাকে একজন পুরুষের। তবে তাকে দূর থেকেই দেখলো সে। আবার নিজেকে সংযত করে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। আয়াত দাদীর রুমে গিয়ে পিছন থেকে দাদীর দুই চোখ চেপে ধরল। ভয় পেয়ে গেলেন দাদী। নিজের চোখ ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দেখতে পেল যেন এক সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলকে। হাসি ফুটে উঠলো দিলারা জাহানের মুখে। আয়াতের ভেজা চুলগুলো দেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলেন,
“এই অবেলায় গোসল? কারণটা কি রে সতীন?
দাদীর মুখে ফুটে উঠেছে দুষ্টুমি ভরা হাসি। নয়নেও খেলা করছে দুষ্টুমি। আয়াত দাদীর প্রশ্ন ও চোখের ভাষা বুঝতে পারলো। মূহুর্তেই লজ্জার লালিমা ছেয়ে গেল তার কপোলদ্বয়ে। লজ্জাভরা হাসি নিয়ে বলল,
” ধুর দাদী তেমন কিছুই না।”
দাদী প্রশ্ন করলেন, “তাহলে বল এই অবেলায় কেন গোসল করলি?”
আয়াত বলল, “দাদী আদ্রাফ…”
আর কথা শেষ করতে পারলো না আয়াত। দিলারা জাহান আয়াতের কথা থামিয়ে মাঝপথে বললেন,
“হুম জানি তো কারণটা আদ্রাফ। পোলাটা দিনে দিনে বেশরম হয়ে উঠছে।”
আয়াত এবার বলল, “ধ্যাত দাদী আপনি যা বলছেন তেমন কিছুই না।”
দাদী বললেন, “হয়েছে হয়েছে এই সময়টা আমিও পার করে এসেছি বুঝলি সতীন। এই সময়ে তোর গোসলের কারণ জানি আমি।”
আয়াত মুখ ভার করে বলল, “হুম বেশি জানেন।”
দাদী ভাব নিয়ে বললেন, “হুম তা তো জানবই।”
আয়াত দাদীর হাত ধরে আহ্লাদের সুরে বলল,
“ও দাদী আজ রাতের রান্নাটা আমি করি?”
দাদী অবাক হয়ে বললেন, “তুই করবি?”
আয়াত বলল, “হুম আমিই করব। আপনার কি মনে হয় আমি রান্না পারিনা? প্লিজ দাদী না করবেব না প্লিজ।”
দাদী বললেন, “হুম না করব না, তবে শর্ত আছে।”
আয়াত জিজ্ঞেস করল, “কি শর্ত?”
দাদী কিছুটা আবদারের সুরে বললেন, “এইযে তুই আমায় আপনি করে ডাকিস না আমার নিজেকে খুব পর পর লাগে। তোর এখন থেকে তাহলে আমায় তুমি করে ডাকতে হবে।”
আয়াত ফিক করে হেসে দিল। তারপর বলল,
“ওহ আচ্ছা। ওকে সোনা দাদী, আমি এখন থেকে তোমাকে তুমি করেই ডাকবো। এখন অনুমতি দাও না?”
দাদী আয়াতের গালে আলতো করে এক চড় দিয়ে বললেন,
“যাহ বানিয়ে ফেল আজকের রাতের খাবার। আর কোনো সমস্যা হলে আমাদের সার্ভেন্টদের সাহায্য নিবি।”
আয়াত খুব খুশি হয়ে গেল অনুমতি পেয়ে। খুশি হয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আই লাভ ইউ দাদী।”
দাদী আয়াতকে ধরে বললেন,
“এটা আদ্রাফকে বল, কাজে দিবে।”
আয়াত বলল, “তুমি তো উত্তর দাও!”
দাদী বললেন, “হুম আই লাভ ইউ টু সতীন।”
এবার দুইজনেই শব্দ করে হেসে দিল।
.
.
.
রাতের খাবার বানানোর জন্যে পূর্ণ উদ্যমে রান্নাঘরে কাজ করছে আয়াত। পাক্কা গৃহিণীর মতো কাজ করছে। নিজের সম্পূর্ণ মনযোগ রান্নার মধ্যেই দিয়েছে সে। হঠাৎ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো নুহাশ। ধীর পায়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে নিল সে। তাদের মধ্যে আর কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব হবে। নুহাশ আয়াতকে তখনই বলল….
#চলবে
#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৯
#Eshika_Khanom
রাতের খাবার বানানোর জন্যে পূর্ণ উদ্যমে রান্নাঘরে কাজ করছে আয়াত। পাক্কা গৃহিণীর মতো কাজ করছে। নিজের সম্পূর্ণ মনযোগ রান্নার মধ্যেই দিয়েছে সে। হঠাৎ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো নুহাশ। ধীর পায়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে নিল সে। তাদের মধ্যে আর কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব হবে। নুহাশ আয়াতকে তখনই বলল,
“আয়াত?”
কাজের বিঘ্ন ঘটে আয়াতের এক পুরুষালী কণ্ঠে। বুঝতে পারে কারো উত্তপ্ত কণ্ঠের আহবান। মস্তিষ্ক বলতে থাকে তাকে পিছনে ঘুরতে। মস্তিষ্কের ডাকে সাড়া দেয় আয়াত, সাথে সাথে সাড়া দেয় সেই ব্যক্তিরও। তবে সাড়া দেওয়ার আগে নিজের শরীরকে ভালোভাবে ওড়না দিয়ে আবৃত করে নেয়। আয়াতের কাণ্ড দেখে কিছুটা লজ্জিত হয় নুহাশ। নিজেকে জানাতে থাকে, নুহাশ তুই একবার নক করেও ঢুকতে পারতি। কিভাবে এ ভুল করলি? নুহাশের ধ্যানে বাগড়া দেয় আয়াত। জিজ্ঞেস করে,
“কিছু কি বলবেন নুহাশ ভাইয়া?”
ঝটপট তাকায় নুহাশ আয়াতের দিকে। দৃষ্ট মিলে যায় দুইজনের। নুহাশ চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর ধীরপায়ে একটা গ্লাস হাতে করে নিয়ে বলে,
“নাহ কিছু না।”
বলতে দেরি কিন্তু রান্নাঘর হতে বের হতে দেরি হলো না নুহাশের। আয়াত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নুহাশের প্রস্থানের পথে। হঠাৎ করে তেল ছিটে হাতে এসে লাগায় “আউ” করে একটা ছোট শব্দ মুখ থেকে বের করল। পূর্ণ ধ্যান দিল আবার রান্নার কাজে।
অপরদিকে রান্নাঘর থেকে নুহাশকে বেরিয়ে যেতে দেখে আদ্রাফ বেশ অবাক হলো। কারণ নুহাশ তো সহজে রান্নাঘরের সামনেই আসতে চায় না। পানি লাগলেও না। আর ও রান্নাঘর থেকে বেরোচ্ছে? সত্যিই অবাক করার বিষয়। তবে এই নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা করল না আদ্রাফ। বেরিয়ে গেল নিজের কাজে।
রাতে খাওয়ার সময় যখন আদ্রাফ জানতে পারলো যে আয়াত আজ রান্না করেছে তখন আয়াতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো সে। তখন মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের কাহিনী। আয়াত যখন রান্না করছিল তখনই তো তাহলে বোধহয় নুহাশ রান্নাঘরে ঢুকেছিল নিজের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে। একটা খটকা মনে নাড়া দিল। কতক্ষণ চুপ থেকে আবার সবার মতো আড্ডায় যোগ দিল।
খাওয়ার সময় দাদী নুহাশকে প্রশ্ন করলেন,
‘কিরে নুহাশ? আজ আমি তোকে একটা দায়িত্ব দেওয়ার সাথে সাথে তুই হারিয়ে গিয়েছিলি কেন?’
ভ্রুযুগল নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন আদ্রাফের দাদী। আয়াত দাদীর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে দেল। নুহাশ হালকা ভিরমি খেল। আদ্রাফ তখন আবার নিশ্চুপ। নুহাশ মনে মনে দাদীর কথার উত্তর সাজালো। উত্তর প্রস্তুত করেই যখন নুহাশ সেটা বলার জন্যে উদ্যত হলো ঠিক তখনই আদ্রাফ বলল,
‘দাদী তুমি ছোট থেকেই জানো ও কামচোর।’
খাবার খেতে খেতে অন্যদিকে না তাকিয়েই আদ্রাফ বলল কথাটা। আয়াত আদ্রাফের কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দিল। আয়াতের হাসির শব্দ শুনে আদ্রাফ এবং নুহাশ দুইজনেই একসাথে আয়াতের দিকে তাকালো। চুপসে গেল আয়াত তাদের চাহুনী দেখে। আয়াতের চুপসে যাওয়া দেখে সবাই আবার হেসে দিল। এই হাসির মাঝে দাদী বলে উঠলেন,
“কিরে কেউ তো আমায় পাত্তা দে!”
সবাই দাদীর দিকে তাকালেন। দাদী আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ সোজা কথা বল, কবে যাবি হানিমুনে?”
আদ্রাফ বলল, “কি দাদী? কি নিয়ে পড়লা? তুমি তো দেখি এখন আমায় জোর করে হানিমুনে পাঠাবে।”
দাদী বললেন, “হ্যাঁ দরকার পড়লে জোর করব। আমার সতীনের সাথে অন্যায় করতে দিব না।”
নুহাশ মাথা নিচু করে সব কথা শুনছে। এখন চাইলেও সে উঠে যেতে পারবে না। বারবার ওকে ডাকার পরও সে চলে গেলে এটা সাক্ষাৎ বেয়াদবি হবে। মাথা নিচু করে নিশ্চুপভাবে সে নিজের খাবার শেষ করতে লাগলো। আদ্রাফ বলল,
“আমি এখন হানিমুনের ঝামেলায় যেতে পারবো না দাদী।”
দাদী বললেন, “তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে।”
আদ্রাফ কান্না কান্না স্বরে বলল, “দাদী এটা কিন্তু ঠিক না! আমি মানি না।”
দাদী বললেন, “তুই মানবে সাথে নুহাশও মানবে।”
এটা শুনে নুহাশের গলায় খাবার ঠেকে গেল। কাশতে লাগলো সে। আয়াত জলদি উঠে পানি এগিয়ে দিল নুহাশকে। আদ্রাফ একবার নুহাশের দিকে তাকালো আবার তাকালো আয়াতের দিকে। নুহাশ পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,
“ও দাদী তুমি কি বল?”
দাদী বললেন, “আরে আমি তো এমনি কথার কথা বলেছি। আর এমনি তুই যাবি মানে তুই ওদের হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এটা আমার আদেশ।”
নুহাশ করুন স্বরে বলল,
“বলে দাও তোমরা, কোথায় যাবা?”
আদ্রাফ ভাবলেশবিহীন হয়ে বলল, “আমি জানিনা।”
নুহাশ এবার আয়াতকে জিজ্ঞেস কর,
“আয়াত অন্তত তুমিই বলো।”
নুহাশের কথার প্রতিউত্তরে আয়াত লাজুকভাবে প্রশ্ন করল, ” আমি বলব?”
দাদী বললেন, “হ্যাঁ আয়াত ওই ফাজিলের কাছে প্রশ্ন করে লাভ নাই। শুধু শুধু সময় নষ্ট করেছি। তুইই বল।”
আদ্রাফ বিড়বিড় করে বলল, “হ্যাঁ জীবনের শেষ সময়ে আমাকে না ভালোবেসে সবাই আয়াতকেই ভালোবাসে।”
দাদী হাঁক দিয়ে বললেন,
“এই কি বললি?”
আদ্রাফ বলল, ” না না কিছুনা দাদী।”
আবার খাবারে মনোযোগ দিল আদ্রাফ। আয়াত খানিক সময় ভেবে বলল, “সাজেকে যাই? আমার এখানে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে।”
আদ্রাফ এবং নুহাশ একসাথে অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কখনো যাও নাই সাজেকে?”
আয়াত নিচু স্বরে বলল, “না আমি যাইনি সাজেকে। সমস্যা হলে যাব না।”
আদ্রাফ হেসে দিল। তারপর বলল,
“আরে সমস্যা নাই। তুমি যেতে চেয়েছ তবে চল। আর দাদী নুহাশকে লাগবে না, আমিই সব ঠিক করে নিচ্ছি। ”
নুহাশ মাথা নেড়ে সায় দিল। দাদীও আদ্রাফের কথায় সায় দিলেন। সবাই চুপচাপ নিজেদের খাওয়া শেষ করলেন।
খাওয়া শেষে সবাই যার যার রুমে চলে যায়। আদ্রাফ এবং আয়াত বাগানে যাবে ঠিক করে। শীতের রাতের পরিবেশে বাগানের সৌন্দর্য অন্যরকম। গাছে থোকা থোকা ফুল, কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়া বাগান এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। দুইটি ভালোবাসার মনে তৈরি হয় হাহাকার। পাখিরা তাদের দোর বন্ধ করে আগলে রেখেছে নিজেকে ও নিজের প্রজাতিকে। কনকনে ঠাণ্ডায় কিছু ফুল আবার নুয়েও পড়েছে। সেই সাথে ঠান্ডায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে আয়াত।হাতের কবজি প্রচুর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। মনে খেলা করছে কিছু শীতল অনুভূতি। আদ্রাফের মনে খেলা করছে নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যা কখনোই সম্ভব নয়। জ্যাকেটের ভাজে নিজের সুপ্ত অনুভূতি সমূহ সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান তাদের মাঝে। কুয়াশাও যেন তাদের মিলন না হবার দুঃখে আরও ঘন হয়ে যাচ্ছে। সকলের হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি সমূহকে আরও মিলিয়ে নিচ্ছে এই কুয়াশা। এই দলে সাক্ষী বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিও। যে দূর থেকে আয়াত এবং আদ্রাফের নিস্তব্ধ প্রেম দেখে যাচ্ছে। নিজেকে নিজের ভালোবাসার জন্য্ব কঠিন বানিয়ে ফেলছে। নীরবতা ভেঙ্গে আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“আয়াত শুনছো কি?”
আয়াত যেন লুকোচুরি খেলার এক উত্তর দিল,
“হুম আছি।”
আদ্রাফ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আজ তুমি রান্না করছিলে যখন তখন কি নুহাশ এসেছিল?”
আয়াত বলল, “জ্বি।”
আদ্রাফ বলল, “কি করতে এসেছিল?”।
আয়াত বলল, ” আমায় পিছন থেকে ডাকলো। আমি কি জিজ্ঞেস করতেই কিছু না বলে ঝটপট বেরিয়ে গেল সেখানে থেকে।”
আদ্রাফ পুনরায় এক নিঃশ্বাস ফেলল আয়াতের উত্তরে। এরপর জিজ্ঞেস করল,
“নুহাশকে তোমার কেমন লাগে?”
আদ্রাফের প্রশ্ন শুনে পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আয়াত। তারপর বলল,
“আমার কাছে তিনি আপনার প্রিয় বন্ধু আর কিছুই নয়। তাই তাকে বিচার করা আমার কাজ নয়।”
পুনরায় নিস্তব্ধ পরিবেশে নিস্তব্ধ এই দুই প্রাণ। আবার আদ্রাফ বলতে শুরু করল,
“জানো আয়াত আমার মন কি বলে?”
আয়াত প্রশ্ন করল,
“কি বলে আপনার মন?”
আদ্রাফ বলে, “এক সময় আমার কবরে ছেয়ে যাবে হলুদ বসন্ত। যদি আল্লাহ রহম করে, কোনো এক হলুদ বসন্তেই আমার প্রিয়তমার সাথে মিলন ঘটবে আমার। আমি সেই সময়েরই অপেক্ষা করব।”
আয়াত চুপ করে গেল। কোনো প্রতিউত্তর দিল না আর। চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা চিকচিক করল। ভারী হয়ে গেল পরিবেশ।
আদ্রাফ এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে আয়াতের পানে দৃষ্টি মেলে বলল,
“হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস। ”
#চলবে