#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১০,১১
#Eshika_Khanom
পর্ব_১০
আদ্রাফ এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে আয়াতের পানে দৃষ্টি মেলে বলল,
“হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস। ”
কথাটা বলা শেষ হলেই আয়াত ঝাপিয়ে পড়ল তার প্রাণপ্রিয়ের বুকে। অশ্রুধারার বর্ষণ পরিবেশটাকে আরও বেশি ভারী করে ফেলছে। একটি ভালোবাসার গল্পে শোভা পাচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয় ও বেদনা। এই শীতের মধ্যেও শুরু হলো বর্ষণ। হয়তো প্রকৃতিও আজ তাদের হৃদয়ের ব্যথায় ব্যথিত। প্রকৃতিও নিজের অশ্রুকে আটকে রাখতে পারেনি দুইটি ভালোবাসার মানুষের না পাওয়া ভালোবাসাকে দেখে। তাই তো এই শীতের মধ্যেও পড়ছে বৃষ্টি। অশ্রুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে আছে প্রকৃতি, খোদা তায়ালা আর দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মানব। নীরবে অশ্রু ফেলছে সে। আদ্রাফ এবং আয়াত পরস্পরের ভালোবাসা বিনিময় করছে কান্নার মাধ্যমে। কিন্তু সেই মানব, নুহাশের বুকে জমছে হাহাকার, বেদনা। নুহাশ কাঁদছে প্রচুর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর কাঁদছে। আদ্রাফ ও আয়াতের কষ্টের সাক্ষী সবাই হলেও নুহাশের কষ্টের সাক্ষী সে নিজে, প্রকৃতি এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই হবেনা। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় বন্ধুকে হারাবে বলে। কাঁদছে নুহাশ দুইটি ভালোবাসার মানুষের আর্তনাদে। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় মানুষটি কখনোই তার আপন হবেনা তাই।
“অক্ষিতে অশ্রুর সঞ্চার ঘটে রোজ,
হিয়া বোঝে না প্রিয়- কোথা পাই খোঁজ?
নয়নে নয়নে বাধা সে প্রনয় বাধন-
আনন্দ বদলে আজ হয়েছে রোদন!”
থাকতে পারছেনা নুহাশ আর, সরে আসলো সে বারন্দা থেকে। অপরদিকে কান্নার মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলো দুইটি ভালোবাসার পাখি। নুহাশ বিছানায় বসে পড়ল, অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আশেপাশে থেকে যেন কেউ বলে চলেছে,
“বেইমান হবি তুই নুহাশ, তোর সুযোগ এসে পড়েছে, অতি সন্নিকটেই সেই মূহূর্ত, কাজে লাগা নুহাশ কাজে লাগা।”
অপরদিকে হয়তো অন্য কেউ তাকে বলছে,
“নুহাশ তোর ইমান নষ্ট করিস না, দুইটি ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করিস না। ব্যথিত হৃদয়ের ব্যথা মাঝে মাঝে প্রকাশ না করাই উত্তম।”
জোরে জোরে কেঁদে উঠলো নুহাশ। জানেনা সে কি করবে, বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত তার। বড্ড অবুঝ লাগে তার নিজেকে। জানা নেই নুহাশ কার কথা শুনবে। বেছে নিবে সে কার পথ? বেইমানির পথ নাকি যে পথে রয়েছে শুদ্ধতা, পবিত্রতা?
.
.
.
আজ অনেকদিন পর সাজতে বসেছে আয়াত। শেষ সেজেছিল নিজের বিয়েতে তবে স্বেচ্ছায় নয়। তবে নিজের ইচ্ছে থেকে এর আগে কবে প্রসাধনী ছুয়েছিল সেটা মনে পড়েনা তার। মাঝে মাঝে নিজের সৎমাকে ধন্যবাদ জানায় সে মনে মনে। কারণ সে এই পদক্ষেপ নিয়ে আয়াতকে একটা ভালো পরিবার উপহার করেছে। আবার আয়াত নিজেকে প্রশ্নও করে,”আদ্রাফ যখন থাকবে না তখন সে কি করে বাঁঁচবে?” এই কয়েকদিনে যে সে আদ্রাফকে খুব আগের চেয়েও খুব বেশি ভালোবাসে ফেলেছে। আদ্রাফের প্রতি ভালোবাসা তার মনে জেগেছিল নীরবে, আদ্রাফের কাণ্ডকারখানায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল সে। প্রথম প্রথম প্রেম তো এভাবেই জাগে।নিয়তি তাকে এবং আদ্রাফকে অলৌকিকভাবেই মিলিয়ে দিয়েছে। আবার মিলিয়েও মিলায়নি। আসলে সবকিছু সবসময়ই পূর্ণতা পায় না। মাঝে মাঝে কিছুটা অপূর্ণতাও রয়ে যায়। আদ্রাফবিহীন নিজেকে ভাবলেই শিউরে উঠে সে। চোখ ভরে আসে নীরে। যদি তাকে সবাই আবার বিয়ে দিয়ে দিতে চায়? না করবেই না সে। কিছুতেই আর রাজী হবেনা। দাদীর খেয়াল রেখে এবং আদ্রাফের স্মৃতিগুলোকেই আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিবে বাকিজীবন। পরপারেই মিলিত হবে ভালোবাসার সাথে। হয়তো জান্নাতের কোনো হলুদ বসন্তের মাঝে মিলন ঘটবে তার সাথে তার প্রাণপ্রিয়ের।
বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছে আদ্রাফ আয়াতের জন্যে। আজ মেয়েটার সাথে বাহিরে যাবে, কিছু কেনাকাটা করে দিবে সাজেকে যাবে বলে। সেই উদ্দেশ্যেই আজ এতো প্রস্তুতি। চোখ দুইটি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আয়াতের জন্যে। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, আগমন ঘটলো আয়াতের। নিজে একটু সেজে নিলেও আবৃত করে রেখেছে নিজেকে খিমারের মাধ্যমে। পরিপূর্ণ পর্দাশীল নারীতে পরিণত সে। আদ্রাফ এই রুপ একদমই আশা করেনি। শুধু কাজলরাঙ্গা দুইটি নয়ন দেখা যাচ্ছে তার, যা আদ্রাফকে বিমোহিত করার জন্যে যথেষ্ট। আদ্রাফ এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আয়াতের দিকে। বিপরীতে আয়াত পর্দার আড়ালে মুচকি হাসলো আদ্রাফের অভিব্যক্তিতে। পরবর্তীতে আদ্রাফ আয়াতকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে নিজেও বসলো। ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করল, দুইজন্যে রওয়ানা দিলো তাদের আজকের গন্তব্যে।
গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছে আয়াত এবং আদ্রাফ। দুইজনেই নিশ্চুপ, আটকে পড়েছে জ্যামে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সড়কের ট্রাফিক অবস্থা বেশিরভাগ সময়ই অপরিবর্তনীয়। চোখ খুললেই যেন ট্রাফিকের দেখা পাওয়া যায়। হঠাৎ করে যেন আদ্রাফের মধ্যে এক কবি প্রতিভা প্রকাশিত হলো। আচ্ছা ভালোবাসলেই কি কবি প্রতিভা বেড়ে যায়? জানা নেই। আদ্রাফ বলতে শুরু করল,
“পড়েছি প্রেমে আমি গভীর ঐ দৃষ্টিতে
এমন মোহময়ী আর নেই সৃষ্টিতে।”
আয়াত অবাক হয়ে তাকালো আদ্রাফের দিকে তার মুগ্ধ মোহনীয় দৃষ্টি নিয়ে। আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের চাহুনীতে। আদ্রাফ আবার বলতে লাগলো,
“সঞ্চারিনী ভেবে করো নাকো ভুল
এ প্রেম পেতে ঠিক হবে ব্যাকুল,
স্বর্গের অপ্সরাও মেনে যাবে হার
ও চোখের প্রেমেতে পড়বো বারংবার।”
থেমে গেল আদ্রাফ, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আয়াতের পানে। আয়াত বরাবরের মতোই মুগ্ধ হলো আদ্রাফের আবৃত্তিতে। আয়াত কিছু বলতে যাবে তখনই আদ্রাফ আবার বলল,
‘শোনো হে শোনো কামিনী-
ও মায়বী চোখের অধিকারীনি-
জেনে নিও ডুবতে চাই আমি ঐ চোখে
দুঃসাহস কার মোরে রুখে?”
স্তব্ধ আয়াত, পুনরায় নিশ্চুপ আদ্রাফ। গাড়িতে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। সাহস নিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে ড্রাইভার বললেন,
“সত্যিই স্যারের মতো সাহসী আর কেউ নাই। কার আর দুঃসাহস থাকবে যে তাকে বাধা দিবে?”
এটা বলেই মুখে তালা লাগালেন যেন ড্রাইভার। আদ্রাফ বলল,
“দুঃসাহস আমার এই রোগ দেখিয়েছে, রুখে দিয়েছে আমায়।”
আয়াত বিনিময়ে কিছু বলল না। মুখ থেকে বের করলো না কোনো শব্দ। নীরবে মাথা এলিয়ে দিল আদ্রাফের কাঁধে।
.
.
.
কিছু কেনাকাটা শেষে বাড়িতে ফেরার বদলে আদ্রাফ আয়াতকে অন্য এক স্থানে নিয়ে এলো। আয়াত বারবার জিজ্ঞেস করার পরও আদ্রাফ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলেনি। তাই মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে আয়াত। আদ্রাফের অভিব্যক্তিও এতে খুব সামান্য। গাড়ি নামলো একটা নিরিবিলি জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমে গেল আদ্রাফ এবং আয়াত। আয়াত দেখতে পেলো একটা খ্রিস্টান কবরস্থানের সামনে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। বুক ধক করে উঠলো আয়াতের। আদ্রাফ তখনো চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কিছু না বলেই আয়াতের এক হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো আদ্রাফ। কবরস্থানের গেট পার করে ভিতরে ঢুকতে পেল তারা। নীরব এক জায়গা সেখানে, পরিবেশটা কেমন যেন ছমছমে। শীতল হাওয়া বইছে সেখানে। শীতও সেখানে অন্যান্য স্থানের তুলনায় তীব্র যেন। কিছুটা ভয় লাগছে আয়াতের। এক হাত দিয়ে আদ্রাফের হাত খামচি মেরে ধরে রইল সে ভয়ে, আর অপর হাত দিয়ে আদ্রাফের জ্যাকেট শক্ত করে ধরে রইল। আদ্রাফের কোনো রিয়েকশন নাই। সেভাবেই আরও সামনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো তারা। অনেক মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন এখানে। শত শত কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। সময়ের সাথে সাথে তারাও এগিয়ে যাচ্ছে। কাকের কা কা ডাক যেন সেই সাথেই আরও বেড়ে যাচ্ছে। আয়াত দূর থেকে কবরস্থানের অপর পাশে দেখলো নতুন কাউকে কবর দিচ্ছে তার স্বজনেরা। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তার এতোই ভয় লাগছে যেন সে পারলে আদ্রাফের সাথে মিশে যায়, কিন্তু আদ্রাফ এখনো স্থির। এভাবেই হেঁটে হেঁটে একটা কবরের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”
#চলবে
#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১১
#Eshika_Khanom
আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”
আয়াত না-বোধক উত্তর প্রকাশ করল। আদ্রাফ বলল,
“এটা আমার আরেক বন্ধুর কবর যাকেও আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
আয়াত কিছু বলল না আর। আদ্রাফের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অন্তরটা তার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবে আয়াতের কাছে আদ্রাফকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যে কোনো ভাষা নেই। সে তো আদ্রাফের সম্পর্কে ভালোমতো জানেই না। আদ্রাফ নিজে থেকেই বলতে থাকলো,
“নুহাশ তো পড়তে বিদেশে চলে যায়, দেশে থেকে যাই আমি আর জীম। জীমের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না দেখে আমি আর নুহাশ ওকে নানাভাবে সাহায্যে করতাম। ওর স্বপ্ন ছিল সবকিছুতে প্রথম থাকার। কিন্তু ভার্সিটির টপে সবসময়কার স্থানটা ছিল আমার, আর তার পরের স্থান ছিল ফরহাদের। খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু কখনোই বুঝতে পারিনি ও আমার বন্ধু নয়, এক বিষধর সাপ ছিল। জীমের টপার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে ও আমার উপর প্রতিশোধ নেয় আয়াত।”
আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি করেছিলেন তিনি?”
আদ্রাফ বলে, “আমার জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে সেই প্রতিশোধ। একদিন আমায় ডেকে পাঠায় ফরহাদ নিজের বাড়িতে। আমিও ওর ডাকে ওর বাড়িতে যাই। প্রচুর মারামারি হয় আমাদের সেদিন। কিন্তু ওর প্রতিশোধের শক্তি এতোই বেশি ছিল যে আমি পরাজিত হয় মারামারিতে। একসময় নিজের সব শক্তি হারিয়ে পড়ে থাকি মেঝেতে। আর জীম আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে সেই সময়। জানো সেটা কিসের?”
আয়াত প্রশ্ন করল, “কিসের?”
আদ্রাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওইটায় ছিল এইচআইভি ভাইরাস। ”
তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে আদ্রাফ,
“আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে এই শয়তান। বন্ধু নামের কলঙ্ক ছিল ও। আজ আমি এইডস আক্রান্ত ওর জন্যে, প্রিয়জনদের হারাবো আমি ওর জন্যে। আমার জীবনটাকে অভিশাপে পরিণত করেছে জীম।”
অশ্রু ঝরছে আদ্রাফের চোখজোড়া থেকে। আয়াত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেই কবরের দিকে।মানুষ এতোটাই খারাপ হতে পারে? নিজের সৎমায়ের প্রতিও মনে কখনো এতো ঘৃণা জন্ম নেয়নি যতোটা ঘৃণা হচ্ছে এই মৃত মানুষটার প্রতি। ক্রোধ কতই না ভয়ানক হতে পারে যে বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়। শীতল হাওয়া বইছে চারিদিকে, নিস্তব্ধ পরিবেশে দুইটা প্রাণ এখনোও দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশ্বাসঘাতকের কবরের সামনে।
.
.
.
পুরো গাড়িতে আদ্রাফ এবং আয়াতের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। আয়াতের বিশ্বাস ছিল আদ্রাফ কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল না। তবে আদ্রাফের বর্তমানের অবস্থার জন্যে দায়ী এই মারাত্মক ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সে আগেই। আদ্রাফ প্রতিদিন মরছে আগাম মৃত্যুর হাঁকে। হয়তো ওর কষ্ট কেউই বুঝতে পারবে না। আসলে এটা অসম্ভব। ব্যস্ত রাস্তায় নিশ্চুপ দুই মানব পাশাপাশি বসে রয়েছে ও ফিরছে নিজেদের বাসস্থলে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি মানেই সে অনৈতিক কাজে জড়িত সেটা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে প্রতিশোধ এতোই ভয়ানক রুপ নেয় যে এটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে।
খেয়েদেয়ে যার যার ঘরে চলে গিয়েছে সবাই। অনেকে ইতিমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। তবুও একই বাড়িতে চোখে ঘুম নেই ছয় জোড়া নয়নের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃতু্র প্রহর গুনছে আদ্রাফ। জানেনা সে আর কতদিন বাঁচবে। এইডস রোগ হয়েছে এক বছর ছাড়িয়ে গেল। মেডিসিন নিতে নিতে জিহবা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার খুব জলদিই মরে যেতে। আবার নিজের ভালোবাসা এবং প্রিয়জনদের টানে থমকে যায় সে। আয়াতকে ছাড়া সে বাঁচতেই পারবেনা এই কথাটা চিন্তা করলেই নিজেকে বিদ্রুপ করতে থাকে আদ্রাফ। ও তো মরেই যাবে আবার আয়াতকে ছাড়া বাঁচবে না মানে কি? হাস্যকর লাগে নিজেকে। কেন সে টপার হয়েছিল? এতো ভালো রেজাল্ট তাকে কি এনে দিয়েছে? মৃত্যু! মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। প্রতিহিংসা জিনিস এমনই।
আয়াত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা। চোখ বন্ধ করলেই সেই কবরটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আচ্ছা জীম কি করে মারা গেল? জানা হয়নি তার। এতোকিছু যেহেতু আদ্রাফ নিজে থেকেই তাকে বলেছে তাহলে হয়তো জীমের মৃত্যু কিভাবে হলো তাও বলবে। যথা চিন্তা তথা কাজ। উঠে গেল আয়াত শোয়া থেকে। ফোনটা হাত নিয়ে আদ্রাফকে কল দিল। রিসিভ করল আদ্রাফ। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো এক উদগ্রীব কণ্ঠস্বর। আদ্রাফ বলল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে কি আয়াত? আমায় কল দিয়েছ যে?”
আয়াত বিনিময়ে বলল, “আপনি কষ্ট করে কি একটু বাগানে আসবেন?”
আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”
আয়াত বলল, “প্লিজ আসুন।”
কল কেটে দিল আয়াত। আদ্রাফ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল আয়াতের এভাবে ডাকার কারণ। খুজে পেল না উত্তর। চলে গেল সে বাগানে।
আদ্রাফ বাগানে গিয়ে দেখলো সেখানে দোলনায় বসে রয়েছে আয়াত। চোখে মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে অপেক্ষা করছে কারো জন্যে। আদ্রাফকে দেখে সে এক মুঠো হাসি তাকে উপহার দিল। ইশারা করে আদ্রাফকে তার পাশে বসতে বল। চুপটি করে আদ্রাফ তার পাশে বসলো। আয়াত নিজের হাত বাড়িয়ে দিল আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ এক হাত রাখলো আয়াতের হাতের উপর। আয়াত প্রশ্ন করল,
“আমি একটা প্রশ্ন করলে কি আপনি তার সঠিক উত্তর দিবেন?”
আদ্রাফ জিজ্ঞেস করল, “কি প্রশ্ন?”
আয়াত আদুরে স্বরে বলল, “আগে বলুন উত্তর দিবেন।”
আদ্রাফ হালকা হেসে বলল, “চেষ্টা করব।”
আয়াত নিজের হাসির পরিধি আরেকটু বাড়িয়ে বলল, “তাহলেই চলবে।”
“আচ্ছা।”
“জীম কিভাবে মারা গিয়েছেন?”
আদ্রাফের কপাল সংকুচিত হল। জিজ্ঞেস করল,
“তুমি জেনে কি করবে?”
আয়াতের দায়সারা উত্তর, “আমি জানতে চাই।”
আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”
আয়াত বলল, “আমার অধিকার আছে।”
আদ্রাফ বলল, “তুমি সবসময়ই এটা বলো।”
আয়াত চোখ রাঙিয়ে বলল, “আমি জানতে চেয়েছি।”
আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের কান্ডে। তারপর বলল,
“তবে শুনো, আমার দেহে জীম এইচআইভি ভাইরাসে ঢুকানোর পর কতক্ষণ আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি ওর বাড়িতে। আমায় একা ফেলে রেখে জীম বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। হয়তো জেদের বসে কাজটা করে ভয় পেয়েছিল। পালিয়ে যায় সে নিজের বাড়ি থেকে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তখন সে কার এক্সিডেন্ট করে। জীমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং আমি যতটুকু জানি সে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকে জীমের। এবং শেষে ও মারা যায়।”
“ওহ”
“আচ্ছা তুমি ঘুমোতে যাও, অনেক রাত হয়েছে। কাল আমার কাজ আছে আমি ঘুমোতে গেলাম। শুভ রাত্রি।”
আয়াতের তরফ থেকে কোনো উত্তর না নিয়েই আদ্রাফ চলে গেল বাড়ির ভিতরে। আয়াত দোলনায় একা একা বসে রইল। জীমের জন্যে তার মোটেও আফসোস হচ্ছে না। নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছে সে। এবং আরও পাবে। কারণ সে দুর্বিষহ করে তুলেছে আদ্রাফের জীবন। অভিশাপে পরিণত করেছে তার জীবনকে। যে অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ মৃত্যু।
#চলবে