#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৪,১৫
#Eshika_Khanom
পর্ব_১৪
“নুহাশ আমি চাই আমার মৃত্যুর পর তুই আয়াতকে বিয়ে করবি। করবি তো?” আদ্রাফকে করুণ স্বরে প্রশ্ন করল নুহাশ। ঝটপট কিছুটা দূরে সরে গেল নুহাশ আদ্রাফের থেকে। বলল,
“এটা তুই কি করে বলছিস আদ্রাফ? শোকে কি তোর মাথা পুরোই নষ্ট হয়ে গিয়েছে?”
অপরাধী স্বরে আদ্রাফ বলল,
“আমি জানিনা আমি কি বলছি। আমি আয়াতের ভালোর জন্যই এটা চিন্তা করেছি। আর তাই তোকে জানালাম। বলতে পারিস প্রস্তাব দিলাম। বলনা আমায়, করবি আয়াতকে বিয়ে?”
নুহাশ বলল, “সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত আদ্রাফ। তুই বুঝতে পারছিস তুই কি বলছিস?”
আদ্রাফ বলল, “কেন তুই কিসের ভয় পাচ্ছিস নুহাশ? তোর কি এটায় সম্মানে আঘাত লাগছে যে তুই একজন বিবাহিতা নারীকে আবার বিয়ে করছিস? মেয়েটা বিবাহিতা হলেও কি হয়েছে, ও খুব ছোট। আর এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে সে জীবনে। আমি মারা যাবার পর যদি ওর দিকে কেউ কুদৃষ্টি নিয়ে তাকায়? তার চেয়ে ভালো না আমি মরবার আগে ওর একটা ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাক। ও নিজের জন্যে একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী পেয়ে যাক। আমি সবার ভালোর জন্যেই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তারপর নুহাশ কিছু বলার আগেই আদ্রাফ নুহাশকে বলল,
“এই দাঁড়া, নুহাশ তুই কি মনে করছিস আমি তোকে ওর বডিগার্ড টাইপ কিছু হতে বলছি? উহু, তোকে ওর সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিতে চাইছি। যে অধিকার আমার ছিল, কিন্তু আমি কখনো প্রয়োগ করিনি।”
নুহাশ নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,
“ভাই তুই একটু ঠান্ডা হো। তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস। আরে ভাই আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না।”
“কেন পারবি না নুহাশ? তুই ওকে বিয়ে করলে আমি কতটা নিশ্চিন্তে মরতে পারবো তুই আসলে বুঝতে পারছিস না। আর নুহাশ, তুই তো আয়াতকে ভালোবাসতি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো তোর চোখে আয়াতের প্রতি ভালোবাসা দেখেছি। তাহলে কেন আমার প্রস্তাবকে নাকোচ করছিস তুই?”
নুহাশ স্তব্ধ হয়ে গেল আদ্রাফের কথায়। চিন্তা করতে লাগলো যে ও কিভাবে বুঝতে পারলো যে সে আয়াতকে ভালোবাসে। আদ্রাফ নুহাশের চিন্তিত মুখ দেখে মৃদু হেসে বলল,
“একজন মানুষ যে ভালোবাসতে জানে সে অপরজনের ভালোবাসাটাও বুঝতে পারে। তাই এটা নিয়ে এতো ভাবতে হবেনা তোর।”
নুহাশ তখন আদ্রাফকে বলল,
“আমি পারবো না রে তবুও আয়াতকে বিয়ে করতে।”
আদ্রাফ নুহাশের উত্তর শুনের নিজের চোখটা বন্ধ করে নিল। তারপর চোখ আবার খুলে হুট করেই নুহাশের কলার চেপে জিজ্ঞেস করল,
“এই এই তুই কি আবার ওকে সেকেন্ড হ্যান্ড টাইপ কিছু মনে করছিস না তো? সাধারণত এটাই তোর অসম্মতির কারণ হতে পারে। তুই এসব নীচ চিন্তা কিভাবে করতে পারলি নুহাশ। ওর প্রতি তো তোর কোনো ভয়ও থাকবার কথা না। আয়াতের দ্বারা তো তোর কোনো ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা আমি দেখছি না।”
নুহাশ আদ্রাফের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“নিজের চিন্তা নিজের কাছে রাখ। আমি আয়াতকে ভালোবাসলেও তাকে নিজের বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে বেশি শ্রদ্ধা করেছি। আর যাইহোক আমি আয়াতকে বিয়ে করতে পারবো না। আর মনে রাখিস আয়াতও তোর এসবে রাজী হবেনা। আমি তোর অন্যান্য কাজের ব্যবস্থা করছি। এসব উটকো চিন্তা মাথা থেকে বের কর।”
নুহাশ বাগান থেকে প্রস্থান করল। আদ্রাফ চিন্তায় পড়ে গেল, ওর মাথা একটুও কাজ করছে না। বাগানে হাঁটু মুড়ে বসে কাদঁতে লাগলো আদ্রাফ। হৃদয় ভেঙে যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। একদিকে মৃত্যুর ভয়, আরেকদিকে প্রিয় মানুষদের হারানোর যাতনা। তার মৃত্যুর পরই বা আয়াতের কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা। ভেবে পায় না আদ্রাফ যে সে কি বলছে, কি করছে এবং আসলেই তার কি করা উচিত। কারো নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে আদ্রাফের বুঝতে বাকি রইল না সে কে। তবে মনে ভয় লাগলো, এতোক্ষণ তার এবং নুহাশের মধ্যকার কথোপকথন কি সে শুনতে পেরেছে? সেগুলো শোনার পর অভিব্যক্তি কি আয়াতের? কিছু প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিবে সে? পারবেনা, তাই পিছনে ফিরে তাকালো না আদ্রাফ। অগ্যতা আয়াত আদ্রাফের সামনে এসে নিজেও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। আদ্রাফের চোখে ও কপোলে অশ্রুকণার আভাস পেয়ে নিজের ডান হাত দিয়ে মুছিয়ে দিল সেগুলো। আদ্রাফ চোখ বন্ধ করে রেখেছে, সে কিছুতেই আয়াতের সম্মুখীন হতে পারবে না। আয়াত নিজের চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“কি হলো? চোখ বন্ধ করে এভাবে বসে রয়েছেন কেন? আমায় দেখতে ইচ্ছে করেনা বুঝি আপনার?”
নয়নযুগল তবুও খুললো না আদ্রাফ। কাঁপা কন্ঠস্বরে বলল, “এখানে থেকে যাও আয়াত।”
আয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, তবে মনে রাখবেন আমি মরে গেলেও আপনার ওমন বাচ্চামো সিদ্ধান্তে রাজী হব না। শুধু নুহাশ ভাইয়া নয়, আপনি বিহীন কোনো পুরুষ আমার জীবনে নেই এবং আমি ইনশাআল্লাহ আসতেও দিব না। ইনশাআল্লাহ আমি ইহকালেও আপনার এবং পরকালেও।”
কথাটা শেষ হতেই আয়াত আদ্রাফের মুখের একটু কাছে চলে গেল। নিজের অধর দিয়ে আদ্রাফের অধরপান হালকা ছুয়েই বাগান থেকে প্রস্থান করল আয়াত। চোখ খুলে তব্দা মেরে বসে রইল আদ্রাফ। আয়াতের কাণ্ডে আদ্রাফ যেন নির্বাক এবং শক্তিহীন।
মুচকি হাসলো আদ্রাফের। আমরণ এই মিষ্টি মূহুর্তকে আগলে রাখার নিজের হৃদয়ে সিদ্ধান্ত নিল।
.
.
.
“আদ্রাফের এই রোগের কোনোই চিকিৎসা কি আর নেই?” ডক্টরকে জিজ্ঞেস করল আয়াত। ডক্টর নিশ্চুপ। আসলে মাঝে মাঝে সময় এতোটাই কঠিন হয়ে যায় যে কাউকে একটু ভরসার হাতও বাড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডক্টরেরও ঠিক একই অবস্থা। আয়াত আবার বলল,
“ডক্টর আমারও স্বপ্ন ছিল ডক্টর হওয়ার, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক বিষয়ের উপর ধারণা রাখতাম আমি। এইডস এর প্রতিষেধকও তো বের হওয়ার কথা ছিল। সেটা তৈরির প্রচেষ্টা চলছিল তাইনা?”
ডক্টর নিজের ডানহাতে থাকা কলমটি টেবিলে রেখে বললেন,
“মিসেস আদ্রাফ আপনি কি আপনার হাজবেন্ডের মেডিকেল রিপোর্টটি দেখেছেন? তার শারীরিক অবস্থা দেখে বুঝতে পারছেন যে তার কাছে আর কতটুকু সময় আছে?”
আয়াত বলল, “আমি দেখেছি। তবে কি শেষ একটা চেষ্টা করা যায়না?”
ডক্টর বললেন, “আদ্রাফের কি অবস্থা?”
আয়াত বলল, “আদ্রাফের খুব জ্বর। আমাদের কাউকেই তো নিজের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়না। ২জন নার্স রেখে নিয়েছে তাই আপনার কথামতো নিজের জন্যে। নাহলে তো সেটাও করতো না। মেন্টালি ডিপ্রেসড আদ্রাফ।”
ডক্টর প্রশ্ন করলেন, “দেহের কোন কোন অংশে ব্যথা হয় এখন?”
আয়াত উত্তরে বলল, “সে তো আমাদের কিছুই জানায় না। তবে আমি নার্সের থেকে জানতে পেরেছি তার ঘাড়ে এবং বগলে একটু বেশিই ব্যথা অনুভব হয়।”
“এইডসের লাস্ট স্টেজে এমনই হবে।”
আয়াত আগ্রহ নিয়ে বলল, “ডক্টর আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছিল এইডসের ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এর ট্রায়ালও সফল হয়েছে।”
“জ্বি আপনার কথা সত্য।”
“তবে কি আমরা সেই ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আনাতে পারিনা? যত টাকা লাগুক, আদ্রাফকে বাঁচানোর কি শেষ চেষ্টা করতে পারিনা আমরা?”
ডক্টর গম্ভীর দৃষ্ট নিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আয়াত উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করল,
“ডক্টর সেই সফল প্রতিষেধক দিয়ে কি আর একটা চেষ্টা করা যায়না?”
#চলবে
#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৫
#Eshika_Khanom
“তোমায় ভালোবাসি এটা না জানিয়ে মারা গেল আমার একটা আফসোস থেকে যেতো, কষ্ট হতো খুব। কাকতালীয়ভাবে তোমায় পেয়ে গেলাম। কিন্তু ভাগ্য কেমন তাইনা? তোমায় পেয়েও হারিয়ে ফেলব আমি। পেয়েও পাওয়া হলো না আমার তোমায়।”
দেওয়ালে টাঙালো আয়াতের একটি ছবি ছুয়ে আদ্রাফ কথাটি বলল। একটা ডায়েরী খুলে নিল সে। মাঝ দিয়ে একটি পৃষ্ঠায় লিখতে শুরু করল।
“হয়তো আমার মৃত্যুর পর তুমি এই ডায়েরীটি পড়বে। তখন কি আমার জন্যে তোমার চোখ থেকে মুক্তদানাগুলো গড়িয়ে পড়বে? জানিনা। হয়তো নিজের সুন্দর এক সাজানো সংসার গড়িয়ে নিবে তুমি। তোমার জন্যেই তো সব রেখে গেলাম। যাওয়ার আগের দিন তোমায় একটা কথা বলে যাব। কি বলব তা হয়তো তোমার এই ডায়েরী দেখে মনে পড়বে। মনে পড়বে সেই গল্প যখন তোমার হাত ধরে আমি বলেছিলাম নিজের এবং আমার দাদীর খেয়াল রেখ। এই কাঁদবে না কিন্তু তুমি। নিজে ভালো থেকো। জানিনা কোনো হলুদ বসন্তে কি তোমায় আমার আবার ফিরে পাওয়া হবে কি না? তবে আমি মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে বললে জান্নাতের হলুদ বসন্তে তোমায় চাইবো।”
.
.
.
নিস্তেজ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে আয়াত। চোখের জলের ছাপ বসে গিয়েছে তার কপোলদ্বয়ে। ফ্রেশ না হয়েই সে সোজা চলে গেল দিলারা জাহানের ঘরে। আচমকাই জড়িয়ে ধরল তাকে। আয়াতের এমন কাণ্ডে ভয় পেয়ে গেলেন দিলারা জাহান। আয়াত তখন তার বুকে মুখ গুজে রেখেছে। দাদী জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে? কি হয়েছে সতীন?”
কোনো সাড়া দিল না আয়াত। আগের মতোই রয়ে গেল দাদীর বুকে। দাদী আয়াতের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। কিছু সময় এভাবেই স্নেহ মমতা বিনিময়ের মাধ্যমে পার হলো। আয়াত মাথা তুলে চাইলো দাদী দিকে। তাকিয়েই একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল। দাদীও হেসে দিলেন এই বাচ্চা হাসি দেখে। আয়াতের দাদীকে প্রশ্ন করলেন,
“কি অবস্থা এখন শরীরের?”
দাদী উত্তরে বললেন, “তা আমার শরীরের অবস্থা জানতে বুঝি এসেছিস?”
আয়াত দাদীকে বিছানায় বসিয়ে বলল, “উহু শুধু এই বিষয়ের জন্যে নয়, তোমার সাথে গল্প করতেও এসেছি। দাদী আহ্লাদী স্বরে বলল, ” বাহ তাই নাকি?”
আয়াতও আহ্লাদী স্বরে উত্তর দিল,”হুম।”
দাদীর সাথে একসাথে বসে গল্পে মেতে উঠলো তারা দুইজন। মাঝ দিয়ে আবার দাদীর একটু কাশি শুরু হয়েছিল, আসলে বয়সের ভারে বর্তমানে যা একটু হয় সেটাই। তবুও আজও দিলারা জাহান অনেক শক্তিশালী বলা যায়। এখন সেটা মানসিকভাবে হোক অথবা শারীরিকভাবে। আয়াত কথার মাঝেই দাদীকে প্রশ্ন করে বসল,
“আচ্ছা দাদী কিছু মনে করবে না তো যদি আমি একটা প্রশ্ন করি?”
“কি প্রশ্ন?”
একটা প্রশ্ন বিয়ের প্রথম দিন থেকেই আয়াতের মনে বারবার উঁকি দিয়ে চলেছে। সেই প্রশ্নটাই আজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। দাদীকে নিশ্চয়তার জন্যে প্রশ্ন করল,
“তুমি সত্য এবং সঠিক উত্তর দিবে তো?”
দাদী জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি এমন প্রশ্ন করবি রে?”
আয়াত বলল, “আগে বলো বলবা আমায় আমি যেটা প্রশ্ন করব?”
দাদী আয়াতের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ আমি চেষ্টা করব।”
আয়াত খুশি হয়ে গেল দাদীর উত্তরে। মনে এক আশার রেশ জাগলো সে আজ তার প্রশ্নের উত্তর সে পাবে। দাদী তাড়া দিয়ে বললেন,
“কিরে বল তোর কি প্রশ্ন?”
আয়াত সোজাসাপ্টা এবার প্রশ্ন করল,
“আদ্রাফের বাবা মা কোথায় দাদী?”
দাদীর নিষ্পাপ মুখখানায় অতিশয় যেন কালো ছায়া দিয়ে ঢেকে গেল। ছলছল করে উঠল নয়নজোড়। তবে আয়াতের মাথায় বিলি কাটা বন্ধ হলো না। সেভাবেই সে বলতে লাগলো,
“আদ্রাফ যখন খুব ছোট তখন ওর বাবা ওর মাকে মানে আমার বউমাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন আমার বউমা জোর করে আদ্রাফকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আদ্রাফ তবে খুব ছোট ছিল রে, তাই সে বাবা মায়ের মধ্যকার বিরোধ বুঝতে পারেনি। রোজ আদ্রাফের বাবা বউমাকে মারধর করত, বাসা থেকে বের করে দিতে চাইতো। তবে বউমা আমার দাঁত কাঁমড়ে এই সংসারেই পড়ে থাকতো। আমাদের তো কম ছিল না রে, তবুও আমার ছেলেটার বউমার সম্পত্তির প্রতি লোভ ছিল। এই সম্পত্তিই সব বিরোধের সৃষ্টি করে। আদ্রাফ রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে ঘোরে বাড়ির সদর দরজার সামনে চলে যেতো। হয়তো বেচারা আমার নাতি স্বপ্নে দেখতো যে তার মা কে তার বাবা তাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর তো বললাম বউমা আদ্রাফকে নিয়ে চলে যায়। আমি বারবার আমার ছেলেকে বোঝাতাম যে দেখ আমার বউমা আর নাতিকে ফিরিয়ে আন। আমার বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগে রে। আমার ঘরের লক্ষীকে তুই কেন তাড়িয়ে দিলি? আমার ছেলের এক কথা ছিল, যদি তোমার বউমা ওর বাবার বাড়ির সম্পত্তি না নিয়ে এ বাড়িতে ফিরে আসে তবে ওর লাশ এই বাড়ির বাগানে পড়বে। সবার মঙ্গলের জন্যে তাই আমিও চুপ করে যেতাম। এভাবে সময় যেতে থাকে। আমার ছেলে অন্য একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে সময়ের প্রবাহে। মেয়েটা তাকে বিয়ের জন্যে চাপ দিতে থাকে। তাই আমার ছেলে আমার বউমাকে তালাক দিয়ে দেয় এবং আইনের সাহায্যে আদ্রাফকে জোড় করে নিজের দখলে নিয়ে আসে। বউমা নিজের ছেলেকে ছাড়া থাকতে চাইনি। আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল রে। সে বউমাকে হুমকি দেয় যে সে যদি আদ্রাফকে দেখতেও এখানে আসে তবে আদ্রাফের লাশ পড়বে বউমার সামনে। ”
বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন দিলারা জাহান। অশ্রুসিক্ত হচ্ছে আয়াতও। দাদী আবার আয়াতকে বলতে থাকেন,
“আমার বউমা তার পেটের চেলে আদ্রাফ বিহীন মূহুর্তগুলো সইতে পারেনি রে। একদিন ঘুমের মধ্যে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।”
স্তব্ধ হয়ে যায় আয়াত এটা শুনে। বিলি কাঁটা থামিয়ে নিজের চোখের জল মুছে নেন দিলারা জাহান। আয়াত চিন্তা করতে থাকে সমাজের এই হিংস্র পুরুষদের কথা। যাদের কারণে আজও মেয়েরা নিজে সম্মানের সহিত বাঁচতে পারেনি। ঘৃণা হয় আয়াতের সেই শাসক পুরুষদের প্রতি। যার মধ্যে আদ্রাফের বাবা একজন। আদ্রাফও তো তারই রক্ত, তারই অংশ। তবুও দুইজনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। ফুঁস করে এক শ্বাস ছাড়ে সে। দাদী কাতর স্বরে আয়াতকে প্রশ্ন করে,
“কিরে বাকিটুকু শুনবি না?”
“শুনব আমি।”
দাদী বলতে থাকেন, “নিজে নতুন একটা বিয়ে করে সেই মেয়েকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে বলে উদ্দেশ্য নেয়। আদ্রাফ সারারাত কাঁদতো জানিস যে আমার মা কই, আমার মা কই। আমি বলতাম, তোর মা একটু বেড়াতে গিয়েছে। ওকে সামলাতে যে কতোটা বেগ পেতে হতো তা আমি জানি। না খেয়ে থাকতো আদ্রাফ, রোজ বাড়ির সদর দরজার সামনেই বসে থাকতো। অপেক্ষা করত কখন ওর মা আসবে ওর সামনে। কখন ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলবে এইতো বাবা আর ভয় নেই, তোমার মা এসে গিয়েছে। এই অপেক্ষায় সবসময়ই থাকতো আদ্রাফ। তার থেকে যে তার মাকে আলাদা করে দিল তার বাবা চিরদিনের জন্যে। সত্যি বউমা এর মৃত্যুর জন্যে আমার ছেলেই দোষী। সময়ের গতির সাথে আদ্রাফেরও বুঝ হতে শুরু করে। আর আমার ছেলে, সে তার ছেলের দিকে তো ফিরেও তাকায় না। আদ্রাফের সব দায়িত্ব আমার ছিল, সে শুধু টাকা দিত। পরবর্তীতে নতুন বউকে নিয়ে যখন সে বিদেশে যাবে বলে ঠিক করে সেদিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় তারা দুইজনেই ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়।”
আয়াত কিছুটা তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলল,
“যে যার যার পাপকর্মের শাস্তি পেয়েছে।
তারপর আবার আফসোস নিয়ে বলল,
” মাঝ দিয়ে আদ্রাফ আর তোমার কষ্ট হয়েছে। আর কষ্ট ভোগ করেছেন আদ্রাফের মা।”
আদ্রাফের দাদী অশ্রুসিক্ত নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আর দেখ না আমি আর আদ্রাফ আমাদের প্রিয়জনদের হারালাম এর মাধ্যমে। ”
কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। পুরোনো কষ্টের স্মৃতি যেন বাধনছাড়া হয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। আয়াত জড়িয়ে ধরলেন দাদী দিলারা জাহানকে। মনে মনে ভাবতে লাগলো সে,
“হয়তো কষ্ট আমাদের পিছুই ছাড়েনি। একা আমিই কষ্টে কাটাইনি, আদ্রাফ আর দাদীও অনেক কষ্ট পেয়েছে। এমনকি এখনও আদ্রাফ কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে, নিজের জীবন দিয়ে। হতভাগা আমি শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না আমাদের জন্যে। আল্লাহর কাছে হয়তো আদ্রাফ এখন খুবই প্রিয় তাই আদ্রাফকে নিজের কাছেই নিয়ে নিবেন তিনি।”
#চলবে