হাই সোসাইটির ললিতা-১
প্রণয়ের উত্তাল ঢেউ বধির করলেও এখানে সেটা অস্পষ্ট, অদৃশ্য, অজ্ঞাত। করিডোরে চাপা রুদ্ধ ও ভারী শ্বাসের ওঠা-নামার শব্দ। চুম্বনের আবেশে উত্তাল হাওয়ার বেগবান স্রোতে হারানো কাম স্পর্শে কাতরে বেসামাল নর-নারী অবয়বে আমরা দু’জন বেশ মত্ত।
____
মনটা আমার ছিল বেজায় খারাপ, বিষণ্ণ। কারণ সাংসারিক জীবনের ব্যস্ততায় বিরক্ত, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে লাইফস্টাইল। তাছাড়া সেখানে যোগদান করেছে রুক্ষতা, উগ্রতা কারণ মানসিক অবসাদ কাজ করছে বিধায়। স্বাভাবিক আমি নিজের জীবনকে খোলামেলা উড়ন্ত বিহঙ্গের মতো মনে করি সবসময়। সেখানে বাঁধাধরা নিয়মের সংসার আমায় সেসবে বাঁধা প্রদান করে, জীবনটাকে আমূল পরিবর্তন করায় মেতে উঠেছে। স্বাধীনচেত্তা আমি লেখাপড়া শেষে চাকরি করার ইচ্ছা পোষণ করি। উপরন্তু ভার্সিটিতে থাকাকালীন অন্যের প্রেমের পারদ মাপতে মাপতে একসময় নিজেও প্রেম নামক কলার খোসায় পিছলে পড়ি। স্কুল-কলেজেও প্রেম করেছি তবে সেগুলো ছিল গুণায় ধরার মতোন নয়। ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়ে প্রেমে পড়েছিলাম। সেই সময়ের প্রেম ছিল ক্ষীরের মতো, জমানো জমানো টাইপ। দিনকাল ভালোই কাটছিল। বিদায় বেলায় বলেও ছিল প্রেমিক পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে চাকরি হয়ে এলে। এতদিন নিজ লেখাপড়াও শেষ করে আমাকেও চাকরিতে নাম লেখাতে বলেছিল। সে জানত, আমার ইচ্ছার বিষয়বস্তু সবকিছুই। গতানুগতিক ধারার প্রেম বিয়ে পর্যন্ত আর গড়ায়নি। মাঝেই সেটা আর সম্ভব হয়নি, বাবা-মা’র আমার বিপক্ষীয় হয়ে দাঁড়ানোতে। দিয়ে দিলেন বিয়ে তাঁদের পছন্দানুযায়ী পাত্রের সাথে। কারণ আর সকল টিপিক্যাল বাবা-মা’য়ের মতোই। ছেলে বড়োলোক, আছে বাড়ি-গাড়ি, বেজায় খুশি ও সুখী হওয়ার মত সম্পত্তি। স্ট্যাটাসও সমানে সমান। আর কী চাই? জীবন সুন্দর। প্রেমিকের সাথে হাত ধরলে বাবা-মা’র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। সাথে ক’দিনও বা প্রেমিকের অল্প আয়ের ডালচাল ঠুসবে গলায়। মোটা চালের ভাত গলায় যাবে? এতকিছুর বিবৃতি শোনে বিয়ে করতে শেষে রাজিই হয়ে গেলাম। অতঃপর শান্তনু মজুমদারের বিয়ে করা বউ হলাম। মজুমদার পরিবারের যৌথ পরিবার হলে কী হবে, ইয়া বড়ো বাড়িতে মানুষ কেবল শ্বাশুড়ি, আমি ও আমার স্বামী। ও হ্যাঁ, সাথে আমার তিন বছর বয়সের মেয়ে সায়ন্তিকা। যৌথ পরিবার বলার কারণ বিয়েতে এসেছিলেন বরপক্ষ গোষ্ঠীসহ, হাজার ছাড়িয়ে ছিল সংখ্যায় তাঁদের। তাই ভেবে নিয়েছিলাম, মনে হয় কোন বড়ো হাঁড়িতে না জানি পড়েছি। তবে বিয়ের পরের দিনগুলোতে মানুষ আস্তে-ধীরে কমতে দেখায় ভয়ও খানিক কমে এসেছিল। সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্বামী শান্তনুর সাথে। মানুষটা দেখতে খারাপ না অতটা। গতানুগতিক ছেলেদের উচ্চতানুযায়ী সে। গোলগাল, উজ্জ্বল শ্যামলা, পুরু ঠোঁট চারচক্ষুওয়ালা। প্রথম প্রথম মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। সে অবশ্য সময় দিয়েছিল। আমি-ও একসময় ভাবলাম, যত্নশীল স্বামী, শান্তশিষ্ট শ্বাশুড়ি অযথা পিছনের অতীত নিয়ে পড়ে থেকে লাভ কী? বড়োলোক বাড়ির বউ খাও-দাও, আরাম করো। সেই ক্ষণেই হয় বিস্ফোরণ। শ্বাশুড়ি পড়েছে জাঁদরেল টাইপ। আগে-ভাগে ধরা পড়েনি সেটা। বোধহয় মহিলা আমায় ছাড় দিয়েছিলেন তো তাই। রান্নার ‘র’-ও জানতাম না। সুন্দরী হিসেবে মার্ক দিলে, এ প্লাসে গ্লোডেন পাওয়ার যোগ্যতা রাখি বিধায়, শ্বাশুড়ি আমার ছেলের বউ করার জন্য দেরি করেননি। লেখাপড়াও ভালো টাইপ অবস্থায় ছিল। আহারে বেচারি! ছেলে বউ যে রাঁধতে জানে না আর না কখনো ছেলের বউয়ের হাতে রান্না খেতে পারবেন। সেই দুঃখে না কখন আবার মর্তলোক গমন করেন। যাইহোক বাঁধা দেন বাড়িতে সন্ধ্যার পরেই কিটিপার্টি অনুষ্ঠান করতে। আগেই বলেছিলাম, স্বাধীনচেতা বলে ভালো লাগার মধ্যে আমার পার্টি-টার্টি, ঘোরাঘুরি, শপিং করা এসব। উপরন্তু ঘাড়ত্যাড়ামি তো ছিলই। সেটা অবশ্য পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে। অতিরিক্ত বাঁধা পেলে সেই কাজ আবার করতে কালক্ষেপণ দেরি করি না। এখন এসে পড়েছি শ্বশুর বাড়ি। বাবা বাড়িতে ছিলাম বিধায় ইচ্ছানুযায়ী চলতে-ফিরতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন অন্যের বাড়িতে একটু ইতস্তত বোধ কাজ করে। প্রথম দিকে শ্বাশুড়ি পার্টি করাতে নিষেধ জানালে, পরে বন্ধু-বান্ধবদের না জানিয়ে দেই বাড়ি মুখো হতে। কিন্তু বুড়ো শ্বাশুড়ির সাথে তো আর কথা জমে না। নিজের রুমে একা একাই থাকি বেশিরভাগ সময়। শান্তনু থাকে অফিসে ব্যবসা নিয়ে। একমাত্র উত্তরাধিকার পরিবারের সে, বাবাহীন সম্পত্তির দেখাশোনা তাকেই করতে হয় কি না। সময়-টময় কাটে না ভেবে, একদিন না জানিয়েই বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি নাইট ক্লাবে। রাত বেশ একটা নয়, নয়-দশটা বাজতেই ফোন আসে শান্তনুর নম্বর থেকে। গম্ভীরস্বরে বাড়ি যাও, মা একা বলেই ফোন কেটে দেয়। মুড অফ হয়ে ফেরত যাই বাড়ি। শ্বাশুড়ির হাজার খানেক কৈফিয়ত দিয়ে রুমে যেতে হয়েছিল। আবার ফের শান্তনুর প্রশ্ন বাণে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয় আমাকে। দিনকে দিন সম্পর্কের উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি হচ্ছিল। সেটা বোধহয় বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণশীল শান্তনুরও চোখে পড়ল। তাই একা সময় কাটানো কিংবা সম্পর্কে উন্নতি যাই হোক, সেসবের জন্য বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করল। বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমার। ফিগার সচেতনতায় কঠোর ছিলাম। কিন্তু কী আর করা! যেখানে জীবনের স্বাধীনতা হরণ হলো অন্যের সাথে জড়িয়ে, সেখানে অন্যের সিধান্তই চাপল মাথায়। মা’কে বলেও বুঝাতে পারলাম না। তাঁর একই কথা, বাচ্চা নে, সব ঠিক হয়ে যাবে। শেষমেশ সায়ন্তিকা এলো কোল জুড়ে বিয়ের দু’বছর পরে। প্রথম প্রথম সবকিছুই মধুর লাগে, সেটা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। তিক্ততা আসে বছর গড়ালেই। আমাদের সম্পর্কেও এসেছিল। সন্তান কোনো সমাধান নিয়ে তো আসেইনি, জটিলতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। শরীরের প্রতি যত্নশীল আমি মুটিয়ে যাওয়ায় বেশ কুণ্ঠাবোধ করতাম। সৌন্দর্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থা আমাকে ডিপ্রেশন ফেলে দিচ্ছিল। উপরন্তু আগেই প্রেগ্ন্যাসির সময় তো মানসিক বিষণ্ণতায় ছিলাম, এখন সেটার প্রকোপতা আরো বৃদ্ধি পেল। মেয়েকে ফিডিংও ঠিকমতো করাতাম না। একপ্রকার নিজেকে পরিবর্তনের ভূত চাপল মাথায়। জিম করে নিজের রূপটাকে ফিরে আনার সিধান্তে উপনীত হলাম। শান্তনু বাঁধা দিলো না, তবে বলে নিলো, বেবিকে সময় আগে দিয়ে নিতে। আমি-ও সুযোগ পেয়ে আবারো বাঁধনহারা হলাম। তবে মেয়েটাকে সময় দিয়েই। এবারের সময়টাতে ধৈর্যটাকে সঙ্গে রাখলাম, অধৈর্য হলাম না। মেয়ের বয়স গড়িয়ে বছর হলো। অনুষ্ঠান করলাম, বড়সড় করেই। মজুমদার পরিবারের বড়ো ও প্রথম সন্তান কি না। আবার যৌথ পরিবারের পুরো গোষ্ঠীর দেখা হলো। সেখানেই পতনের শুরু হলো।
চলবে…
লেখা: Mannat Mim – মান্নাত মিম