হাই সোসাইটির ললিতা-২,৩

0
488

হাই সোসাইটির ললিতা-২,৩
লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম
০২

মনকাড়া লুক নিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে সবার নজর কাড়লাম বোধহয় আমি। সকলের মুখে মুখে একটাই বুলি, ললিতাকে বোঝাই যায় না এক বাচ্চার মা। বিয়ের আগের চেয়ে বাচ্চা হওয়ার পর দেখি পুরো লুক’ই চেঞ্জ। মনে মনে খুশির ফোয়ারা ছুটছিল আমার। হাতে ড্রিংক নিয়ে স্লিভলেস, লং গাউনে সাদৃশ্য ধবধবে পায়ে সকল পুরুষের লোভাতুর দৃষ্টি দেখে বক্র হাসলাম খানেক। চশমা লাগিয়ে সায়ন্তিকাকে কোলে নিয়ে হিমশিম খাওয়া শান্তনু আমার কাছে এলো দ্রুত পদে।

“ললিতা, কী করছ গো? বাবুকে একটু রাখো না।”

হতবিহ্বল, বিস্মিত চিত্ত ধরে বললাম,

“মাথা খারাপ না কি তোমার?”

আমার কথায় যে শান্তনু অবাক হলো তার চেহারা দেখেই বুঝলাম।

“হোয়াট? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”

মুখের হতবিহ্বলতা বজায় রেখেই শান্তনু উত্তর দিলো,

“কী অবস্থা! বাবুকে রাখার কথায় মাথা খারাপের কী আছে?”

“তুমি কি আমাকে চোখে দেখছ না? এই ড্রেস পড়ে বাবুকে কোলে নেবো? লাইক সিরিয়াসলি? আমাকে কেমন দেখাবে? ন্যানিকে বলো, যাও।”

কথাখান বলেই অন্যদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তবে শান্তনুর মুখ নিসৃত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দ কর্ণগোচর হলো ঠিকই। সেদিকে অবশ্য পাত্তা দিলাম না বেশি একটা। কারণ অনুষ্ঠানের মধ্যমনি যেমন আমি, তেমনি আমাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য আরেকজনও ছিল। সে আমার বিপরীত লিঙ্গেরই অর্থাৎ পৌরুষেয় সৌন্দর্যে মণ্ডিত পুরুষ। যেখানে সকলের নজর আমার ওপর নিবদ্ধ, সেখানে এই পুরুষটির কাছে হেয় প্রতিপূর্ণ দৃষ্টি আমায় বারংবার হারিয়ে দিচ্ছিল। নিজের ওপর জেদ চাপল হেরে যাবার উসুলে সম্মুখে ইগনোর করা চমৎকার পুরুষটাকে নিজ পিছু ঘুরিয়ে ছাড়ব। অনুষ্ঠানে ড্রিংক করার জন্য বাড়ির কর্ণারে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানের চেয়ারগুলোতে বসে বসে ড্রিংকে মশগুল কিছু নারী-পুরুষ, সেখানেই বিদ্যমান আমার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ। নিজের গ্লাস একটানে ফাঁকা করে, এগিয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাক্ষাৎ নিতে গ্লাসে ড্রিংক নেওয়ার বাহানায়।

“ড্রিংক প্লিজ।”

কর্মরত মেয়েটা অভিজ্ঞ হাতে ড্রিংক তৈরি করে দিতে ব্যস্ত। সেখানে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে অন্যমনস্ক নিহিত কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির দিকে একনজর তাকিয়ে দেখলাম। সে বড়োই উদাসীন। পাশে যে পার্টির সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি দাঁড়িয়ে, সেটা তার নজরেই এলো না! হৃদয়বিদারক আমার কাছে ঠেকলেও তার কাছে তো কেবল তুচ্ছতম বিষয়। তবুও হারার মাঝে জিতের নেশায় মত্ত আমি আগেই হাত বাড়ালাম।

“হেই, আ’ম ললিতা।”

আগেপিছু কিছুই লাগালাম না, আসলে কেন জানি ইচ্ছেই করল না। হয়তো কোনকিছুর আকাঙ্ক্ষা পূরণের তৃষ্ণায় তৃষ্ণিত ছিলাম বিধায়। আমাকে অবাক করে দিয়ে সম্মুখের পুরুষটি বলে উঠল,

“আই নোও ইউ, মিসেস মজুমদার। আ’ম ঋষি রয়।”

নিজের পরিচয় গোপনের কোন বিষয় না। তা সত্ত্বেও সাধারণ বিষয়টা বর্তমানে কেন জানি আমার মন বিখণ্ডিত করে দিলো, বিরক্তিকর ঠেকল। তবুও ফিকে হওয়া মুখে হাসির রেখা টেনে ঋষির হাতে হাত মেলালাম। বিদ্যুৎ গতিতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পেল মাংসপিণ্ডের অভ্যন্তরীণে। হাত ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ঋষি দুষ্টুমির হাসি নিক্ষেপ করে বলল,

“ইসস! এত সফট ছিল!”

তার ফ্লার্ট করার মাধ্যমেই বোঝা গেল ছেলেটা মেয়েবাজ টাইপ। আমি-ও সেই ভঙ্গিতে জবাব দিলাম,

“ছিল যে, এখন নেই?”

“ধরায় বুঝেছিলাম। এখন তো ছাড়া। অতীত হয়ে যাওয়ার হিসেবে ছিল-ই আসে।”

আফসোস ঝরে পড়ে ঋষির কণ্ঠে। খানিক হেসে দিলাম তার কথা শুনে। আমার হাসি দেখে আবার ফ্লার্টিং করে বুকের বাঁপাশে হাত রেখে নেশাতুর কণ্ঠে বলল,

“হায়! এত মিষ্টি হাসি!”

“ওহ্ তাই বুঝি? হাসি মিষ্টি হয় বুঝলে কীভাবে?”

বলেই খুব কাছে গেলাম। ঋষির নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়ছে আর আমার নিশ্বাস তার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। কানের কাছে গিয়ে ধিমে যাওয়া স্বরে ফিসফিসিয়ে ফের বললাম,

“তা টেস্ট করে দেখছ না কি দেখবে?”

বয়সে ছেলেটা আমার ছোটো হবে। তাই আপনি সম্মোধনের ধারেকাছেও গেলাম না। হতবিহ্বল, বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকা ঋষিকে ফেলে ড্রিংক নিয়ে চলে এলাম। বোধহয় আমার নরম ঠোঁটের আবরণ তার কানের চামড়ার আস্তরণ স্পর্শ করল। আগুনে ঘি ঢালার কাজ শেষ। এবার পোড়ার পালা।

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

হাই সোসাইটির ললিতা |৩|

ঋষি এসেছিল শান্তনুর বন্ধুর সাথে। তাতেই ছেলেটা আমার বায়োডাটা বের করে ফেলেছে, পুরোই চালু চিজ। প্রথম সাক্ষাৎটা বেশ ছিল। কিছু একটা ফিলিং তো আসার কথা ঋষির মাঝে। হয়তো এসেও ছিল। মেয়েবাজ ছেলেটা বুঝেও সেটাকে ছেড়ে দিলো। কথায় আছে না, “একেবারে খাওয়ার চেয়ে ধীরে ধীরে খাওয়ার মজা বেশি”। সেই চাল’টা দেওয়ার তাড়নায় আমার দেওয়া দান ফিরিয়ে দিলো। সেদিনের অতটুকুই কথা হলো। কিন্তু ঋষির চর্মচক্ষু যে বারবার আমার ওপরে নিবন্ধিত ছিল সেটা বেজায় উপভোগ করেছিলাম। সাথে নিজের রূপটাকেও একটু খুলে ধরেছিলাম।

মুম্বাই, ভারতের অভ্যন্তরীণ সিটি। আপাতত মুম্বাইয়ের এয়ারপোর্টের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি। দীর্ঘ দুইবছর পর সিঙ্গাপুর থেকে নিজ জন্মভূমিতে পা রাখলাম। আগের আমি আমূলে পরিবর্তন হয়েছি। আগের চেয়েও জীবনটাকে এখন রঙিন দেখি। নিজের অভিমতে অন্যের নির্দেশনা তোয়াক্কা করি না। শান্তনুর অ্যাক্সিডেন্টে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিল। পা ও কোমরের গুরুতর ইনজুরিতে বিদেশি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তায় এই দু’বছর সেখানে কাটিয়ে নিজ দেশে ফেরা। সিঙ্গাপুরের মেয়ে সায়ন্তিকাকে ন্যানির কাছে রেখে হসপিটালে শান্তনুর দেখাশোনা শেষে ক্লান্ত আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। উপরন্তু শান্তনুর যাবতীয় কাজকর্মের হাল আমার হাতেই ছিল। সেগুলো সিঙ্গাপুরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে সলভ করতাম। আদ্যোপান্তে আমি যে নিজের অস্তিত্ব ভুলার পথে চলা শুরু করেছিলাম, তার ধর্তব্য হয়নি। দিন শেষে এত ঝক্কি মাথা বিগড়ে দিচ্ছিল। শেষে নিজেকে খোঁজার জন্য আগের তীরে ভেড়লাম, তবে নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে। শান্তনুর অফিসে এখন প্রতিনিয়ত আমাকেই দেখা লাগে। শ্বাশুড়ি তো বিছানায় পড়ে, যখন ছেলের অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনেছিলেন। ছেলেরও একই হালে বেহাল দশা। বিছানায় পড়ে থাকা লাগে, চলাফেরা হয় হুইলচেয়ারে বসে। মাঝেমধ্যে আমাকে সাহায্য করে অফিসের বিষয়ে অনলাইন করে। বিষিয়ে যাওয়া জীবনে এক পশলা বৃষ্টির খোঁজে প্রতিনিয়ত ক্লাবে যাওয়া হয় আমার। আজও বান্ধবী শ্রেয়ার সঙ্গে বেরিয়ে পড়া নাইটক্লাবের উদ্দেশে। একমাত্র নাইটক্লাবের রঙিন দুনিয়ায় নিজের অগোছালো, জগাখিচুড়ি জীবনকে আলোর ছিটেফোঁটাতে দেখতে পাই আমি।
_______

“রাত আয়ি হে রাত আনে দো,
নেশা হতা হে নেশা হনে দো,
দিল জালতা হে দিল জালনে দো,
ইয়াদ আয়ি হে মুঝে পিনে দো…

রাত আয়ি হে রাত আনে দো,
নেশা হতা হে নেশা হনে দো,
দিল জালতা হে, দিল জালনে দো,
ইয়াদ আয়ি হে মুঝে পিনে দো…”

গানটি আমার বেশ পছন্দের, গানটির গায়কও। গানের কথাগুলোর সাথে আমার জীবনের বেশকিছুটা তুল্যতা রয়েছে। তাই তো গানটি গাওয়ার সময় নিজের ভেতরকার কষ্ট ছাপিয়ে গেছে বিধায় সকলের করতালিমুখর পরিবেশ। অথচ যাকে নিয়ে গাওয়া সেই হারিয়েছে বেশ। স্যাড গানের পর পরিবেশকে হালকা করতে রোমান্টিক ডুয়েট গান ছাড়া হলো বিধায় সকলে নিজেদের পার্টনারের সঙ্গে মেতে উঠল ডান্স করতে। আমি-ও তাদের মাঝে ড্রিংকের গ্লাস নিয়ে হেলতেদুলতে থাকলাম। তখনও জানতাম না, সম্মুখীন কারো নজরবন্দি হচ্ছিলাম, যার জন্যই কি না দিল জ্বলা গান। নেশায় পেয়েছিল যে সেদিন, সেটা কি মনের গহীনে জমিয়ে থাকা দুঃখের না কি ভালোবাসার সুখের? নিজের পক্ষে বোঝায় দায় হয়ে পড়েছিল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোন ব্যক্তির সাথে ডান্সে মশগুল খেয়ালে এলো না। শুধু তার স্পর্শে, জেন্টস পারফিউমে মাতোয়ারা হতে আমার বেশি সময় নিলো না। এমনিতেই নেশায় চড়ে বুদ হয়ে আছি। উপরন্তু সামনের বলিষ্ঠ পুরুষের স্পর্শে দু’বছরের বন্য কাতরা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। শান্তনুর হসপিটালাইজ হওয়ার পর থেকে শরীরী মিলনের ব্যাঘাত ঘটাতে ভেতরকার ঘুমিয়ে থাকা বুনো হিংস্রতা জেগে উঠল আচমকা। ডান্স ফ্লোর পেরিয়ে করিডোরে রুমের উদ্দেশে পা বাড়ালাম সম্মুখে ব্যক্তিকে নিয়ে। আবছা আলোয় কাঙ্ক্ষিত পুরুষের মুখাবয়ব দেখতে পেলাম ঝাপসা চোখে। নেশার ঘোরে টলটলে পা থমকে দাঁড়ালাম। তবুও টলতে থাকা ভাব সরছে না দেখে পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। আগন্তুকের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

“ইজ’ন্ট ইউ ঋষি?”

উত্তরে মুখ বন্ধ পেলাম। দুর্বিষহ লাগল শ্বাস নিতে। দমবন্ধ হওয়া অনুভূতিতেও একরাশ আনন্দতার আক্ষেপ ছুঁয়ে দিলো এক পশলা বৃষ্টির ন্যায়। না পাওয়ার সন্ধিক্ষণে বাঁধ ভাঙল পাওয়ার আনন্দতাকে ঘিরে। চারিদিকের হৈ-হুল্লোড় তখন তুচ্ছতম মনে হলো। বোধ হলো, হয়তো সুদূর থেকে ভেসে আসছে মোহনীয় সুর।

করিডোর জুড়ে চুম্বনের আবেশে প্রণয়ের উত্তালতা বিরাজমান। শ্বাস নেওয়ার বেগবান শব্দ বিস্তার। প্রতিযোগিতা নেমেছে আমাদের দু’জনের মধ্যে, দীর্ঘায়িত চুম্বনের। রাত বাড়ার সাথে একে-অপরের উষ্ণতায় মিলেমিশে একাকারে ব্যস্ত।

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here