হাই সোসাইটির ললিতা-৪,৫

0
469

হাই সোসাইটির ললিতা-৪,৫
লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম
০৪

মাথা ভারে ফেটে যাওয়ার অবস্থা। বুঝলাম, ড্রিংকস গতকাল আরদিনের তুলনায় বেশি নেওয়া হয়েছিল যার ফলস্বরূপ এই মাথা ভার ভার লাগা। রোদের প্রখরতা জানলা ভেদ করে মুখের চামড়া ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। এসি কি বন্ধ না কি? ভ্রু কুঁচকে এলো ভাবতেই।

“এটা খেয়ে নেও। হ্যাডেক কিছুটা কমবে।”

ঋষিকে দেখে অবাক হলাম না। গভীর রাতের অন্তরঙ্গতার মাঝের সৌন্দর্যে নেশার চেয়ে ছেলেটার পৌরুষের উষ্ণতা উপভোগে তাকে বুঝতে পেরেছিলাম। নিজেকে চাদরে মাঝে গুটিয়ে ওঠে বসলাম। হাতে লেমন জুস নেওয়ার সময় ঋষির দিকে তাকালাম না।

“সম্মতিতে হয়েছে কিন্তু। মুড অফ করে থাকলে আমার খারাপ লাগবে।”

পাশে বসা ঋষির কথা শ্রবণ হতেই পাশ ফিরে তাকালাম। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে গ্লাস বেড কর্ণারের টেবিলে রেখে বললাম,

“উহুম, মুড অফ না। চিন্তা করছি।”

“কীসের চিন্তা?”

ঋষির অবাকান্বিত হওয়ার ধারা অব্যাহত রেখে বললাম,

“তোমার গার্লফ্রেন্ড বিষয়টা কেমন নিবে।”

“আশ্চর্য তো! আমার গার্লফ্রেন্ড কিছুই মনে করবে না।”

“বলা সহজ। হ্যান্ডেল করা কঠিন যদি জানতে পারে।”

“সেটাই। যদি জানতে পারে।”

“না জানার কথা না কি?”

“থাকলে সে না জানবে।”

ঋষির ভ্রু নাচিয়ে বলা কথায় অবাক হওয়ার হার এবার আমার বৃদ্ধি পেল।

“রসিকতা করছ?”

“না, একদমই না।”

“হাহ্! গুড লুকিং হ্যান্ডসাম গাই, অথচ গার্লফ্রেন্ড নেই। আদৌও সত্য?”

উদাসীন, বিষণ্ণ মাখা নিভন্ত গলায় ঋষি বলল,

“আসলে ছিল। তার সাথে ব্রেকআপ হওয়ার দু’বছর চলছে।”

বসা থেকে ওঠে গিয়ে সিগাটের ধরিয়ে আমার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“তোমার কোন সমস্যা হবে?”

প্রথমে বুঝতে পারিনি। হয়তো তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছে বুঝেছিলাম। পরে হাতের সিগারেট উঁচিয়ে দেখালো, অর্থাৎ আমার সামনে সিগারেট খাওয়ায় আমার সমস্যা হবে কি না জিজ্ঞেস করছে। আমি না বোধক সম্মতি জানাই।

“সমস্যা নেই। আমি-ও মাঝেসাঝে খাই।”

কথাটায় অবাক হতে দেখলাম না। কেমন নির্জীব, নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে দেখলাম ঋষিকে। হয়তো বর্তমান সমাজে আর সবার মতো এসব খাওয়া মেয়েদের ঋষি নরমালি নিয়েছে। মেয়েদেরও তো মন আছে, আছে দুঃখ-কষ্ট, গহীনে থাকা অব্যক্ত কিছু কথা; যা এই ধোঁয়ার মাধ্যমে বাষ্পে ভেসে যায়।

“তোমার হাসবেন্ড জানলে কী হবে ভেবে দেখেছ?”

ঋষির প্রশ্নে খানিক্ষন চুপ থেকে পরক্ষণেই জবাব দিলাম,

“তার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। তার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর থাকতে হয়েছিল দু’বছর যাবৎ।”

“এজন্যই তোমার খোঁজ পাইনি।”

হাসতে হাসতে বলল ঋষি। হতভম্ব, মূক হয়ে খানিক বসে ভাবলাম, আমাকে খোঁজ করেছিল ঋষি? কিন্তু কেন? প্রশ্নের উত্তর শুধু তার কাছেই। ঋষির দিকে তাকালাম সে কী নির্বাক, শান্তভাবপূর্ণ অবয়ব চিত্তে দাঁড়িয়ে। চাদর আঁকড়ে ওঠে তার পিছনে গিয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম। আমার অস্তিত্বের আভাস পাওয়ায় হাত থেকে সিগারেট জানলা গলিয়ে ফেলে দিলো। অতঃপর জানলার ওপরে হাত রেখে বলতে শুরু করল,

“আমার বাবা-মা নেই। পিসিমা’র কাছে মানুষ হওয়া আমি। তিনি নিসন্তান ছিলেন। আমাকে পেলেপুষে বড়ো করেছেন। বছর চারেক হলো লেখাপড়া ছেড়েছি বি.এ. শুধু কমপ্লিট করে। চাকরি-বাকরি আমার দ্বারা হবে না জানিয়ে দিলাম। অতি আদরে, আহ্লাদিতে বড়ো হওয়ায় পিসিমা-ও গো করলেন না। কিন্তু সমস্যা গিয়ে বাঁধালো গার্লফ্রেন্ড সোমা। তার সাথে মাত্র দুই বছরের রিলেশন ভার্সিটিতে থাকাকালীন। ভার্সিটি ছাড়লাম, আর তাতেই আমার ওপর তার যতো চোটপাট। চাকরি করো, টাকা কামাও তারপর আমায় ঘরে তুলো, এই বাক্য শুনতে শুনতে কান ঝলাপালা হওয়ার মতোন অবস্থা। লাগল ঝগড়া ধুমসে। অতঃপর ব্রেকআপ। সেদিন অত রাগান্বিত হতে দেখে আমার বন্ধু টেনে নিয়ে গেল তোমাদের পার্টিতে।”

“ওহ্, তা-ই সেদিন ওমন মুখ কালো করে উদাসীন হয়েছিল। যার কারণে পাশে থাকা অতিশয় ড্রিংকস নেওয়া সুন্দরীর দিকে পর্যন্ত ফিরে তাকাওনি।”

বলতে বলতে ঋষির পিঠে মাথা ঠেকিয়ে তার ওপর ভর ছেড়ে দিলাম। হাসির দমকে ঋষির কেঁপে ওঠা শরীরের দুলুনি বুঝতে পারছিলাম।

“অতিশয় সুন্দরী ছিল কি না সেজন্য চোখ ঝলসে যেত, অত তাকালে। তাই নিজেকে অনলে পুড়াতে বাঁধা দিচ্ছিলাম মন’কে।”

“সেই তো পুড়লে।”

এবার ঋষি আমার দিকে ঘুরে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দু-হাতের মুঠোয় জড়িয়ে রাখা চাদরে তার হাত রেখে বলল,

“এমন অনলে হাজারবার পুড়তে রাজি।”

খানিক চুপ থেকে ফের আমার কানে তার নেশাক্ত মিশানো উষ্ণ, আর্দ্র কণ্ঠে বলে উঠল,

“কেউ একজন মনকাড়া লুক নিয়ে, মিষ্টি হাসি টেস্ট করার আহ্বান দিয়েছিল। আমি সুযোগে পুরো মিষ্টিটা গিলে নিলাম।”

এই আহ্বান আবার এলো তবে আমার কাছে। সাদরে গ্রহণ করলাম। ফের ডুব দিলাম গভীর সমুদ্রে দু’জন। যদি-ও তলিয়ে যাওয়ার ভয় জড়িয়ে। কিন্তু ফিরতে চাই না যে। যা হওয়ার হোক না তাতে।

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

হাই সোসাইটির ললিতা |৫|

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। অফিসেও বসিনি আজ। সারাদিন ঋষির উষ্ণ ছোঁয়া, ঘুরে-ফিরে বাইরে হ্যাংআউট করে সময় কাটিয়ে নিজেকে প্রাণবন্ত বোধ হচ্ছিল। আসলে মেয়েবাজ ছেলেটা’ই মাতিয়ে রেখেছিল এতটা যে, বাড়ির খবর রাখার জো-ই ছিল না। তবুও ফোনের কাঁপা অবস্থা টের পেয়েছিলাম সাইলেন্ট থাকা বিধায়। বাড়ি এলেই নিজেকে কেমন যেন নিস্তব্ধে ঘেরা বিদীর্ণ রূপে পাই। কীসের হাহাকার, নিঃসঙ্গতা আমাকে চেপে ধরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়? নিজেরও বোধগম্য হয় না। মাঝেমধ্যে হয়। হয়তো আমি অন্যের বন্দিত্ব কিংবা সাংসারিক জীবন পছন্দ করি না সেজন্য। তাছাড়া আমি তো স্বাধীন, স্বাভাবিক জীবন পছন্দ করি। এসবকিছুই আমাকে বাড়ির টানে বাধাপ্রাপ্ত করে।

“কী করছ?”

“এই তো বসে বই পড়ছিলাম। এসো।”

শান্তনু আর আমার রুম আলাদা। সেটা শান্তনুর অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই।

“সায়ন্তিকা কি ঘুমিয়ে?”

“হুম, সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“তাহলে দেও ও’কে রুমে দিয়ে আসি।”

আমার কথায় বাঁধ সেধে শান্তনু বলল,

“না, থাক আজা এখানে।”

“আরে না, তোমার অসুবিধা হবে। রাতে ও হাত-পা উঠিয়ে দেয়।”

মেয়ের রুমও আলাদাভাবে তৈরি করা। মেয়ে তিন বছরে পদার্পণ করেছে। শান্তনু অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই মেয়েটার জন্মদিন আর পালন করা হয়নি। এমনিতেও মেয়ের সাথে আমার সখ্যতা খুব বেশি একটা নেই। বাবা বলতেই পাগল আর চেনে নতুন ঠিক করে সখা ন্যানিকে। আমি অতটা মাথা ঘামাইনি না অবশ্য এতে। তাদের বাপ-মেয়ের টান’টা মনে কম থাকাই ভালো। যেখানে ভালোবাসা কাজ করে না সেখানে অযথা মায়া বাড়িয়ে আঁটকে থেকে লাভ দেখছি না আমি।

“তাহলে তুমি রাত জেগো না। ঘুমিয়ে পড়ো।”

ওঠে চলে আসার সুযোগের জন্য কথাটা বললাম। বই থেকে মুখ উঠিয়ে চশমা খুলে পাশে রেখে আমার হাত ধরে শান্তনু অতি শান্ত ও ঠান্ডা স্বরে বলল,

“আজ আমাদের সাথে ঘুমাও না।”

“না, না এমনিতেই সায়ন্তিকাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, তোমার অসুবিধা হবে বলে। আবার এখন আমি থাকলে তো আরো ঝামেলা হবে।”

আলগোছে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কথাগুলো বললাম। তবুও কাজ হলো না বোধহয়। উলটো গো ধরা আকুতিভরা কণ্ঠে শান্তনু বলল,

“মিথ্যে কথা বলো না প্লিজ। অসাড়ে শরীর আমার। অসুস্থতা কিংবা ব্যথা নেই।”

ফের কণ্ঠে আকুলতা সহিত আর্দ্রতা মিশিয়ে বলল,

“তোমাকে বছর হলো কাছে পাই না, ললিতা। তোমার শরীরের মাদকতা মেশানো উষ্ণতা নিশ্বাসে নিতে পারিনি। আগের তুমি যদি-ও অচেনা ছিলে আমার ভিড়ে। কিন্তু এখন তো বহুদূরে।”

আঁতকে উঠলাম আতংকে। কোনোভাবে কি শান্তনু টের পেয়ে গিয়েছে ঋষির কথা? ভাবনার অবকাশ দিলো না সম্মুখের গো বেচারা ছেলেটা। উফ! অসহ্য!

“কী ভাবছ? এই যে তুমি হারাওনি অফিস টু বাড়ি, বাড়ি টু অফিস করে? সারাক্ষণ বাইরে অফিসের কাজে খাটতে থাকো। কাছে এসে না খোঁজ করো আমার আর না মেয়ের।”

উফ! শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেলাম। হাঁদারাম তাহলে এটা ভাবছে! আর আমি কী না কী ভেবে নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছিলাম। ইস কথা শুধু পেঁচাচ্ছে! নাহ, এখন রাজি না হলে কথার ফুলঝুরি ছুটবে। সেই এখানেই বসিয়ে রাখবে। তারচেয়ে রাজি হয়ে যাওয়াই শ্রেয়। অবশ্য আপাততের জন্য। স্বগোতক্তি চিন্তাভাবনা রেখে বললাম,

“আচ্ছা, আচ্ছা। রাত হচ্ছে ঘুমাতে চলো। থাকছি আজ।”

মেয়েকে মাঝে রেখে শুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাহ, শান্তনু আমাকে মাঝে দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। হাহ্! আহ্লাদিপনা দেখে বাঁচি না।

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। গতরাতের অন্তরঙ্গতা মুহূর্তের মধ্যেই স্বপ্নে এসে হানা দিয়েছিল বলে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা পোষণ করা ব্যক্তি অপরদিক ফিরে ঘুমাচ্ছে।

“হুহ্! সে না কি জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। আজাইরা ঢং যত।”

ওঠে পড়লাম তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে। বিড়াল পায়ের শব্দে বেরিয়ে নিজের রুমে ফিরে গেলাম। মনমস্তিষ্কে কেবল ঋষিই ঘুরছে। কাছে পাওয়ার তীব্র নেশা শরীরে বিস্তর আঘাত হানছে। সেদিন রাতের ঋষির আদুরে স্পর্শ শরীর জুড়ে মনে হচ্ছে এখনো বহমান। তাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা চক্রহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইচ্ছে জাগল, ঋষির সাথে কথা বললে কেমন হয়? ঋষি কি জেগে? পরক্ষণেই ভাবনাগুলো অবাস্তবতায় পরিণত হলো। স্মরণে এলো, ঋষির সাথে এতো ঘুরে-ফিরে তার নাম্বার নেওয়ার কথা মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল। মন খারাপ হয়ে এলো। ঘুম তো হলোই না জাগ্রতচিত্তে অস্থিরতা ছাপিয়ে নির্ঘুম কাটালাম সারাটা রাতভর।
______

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here