হাতে রাখো হাত পর্ব-১

0
3306

হাতে রাখো হাত
পর্ব-১
ফায়জা_করিম

“বাবা তুমি এটা কি বলছো! রিদি আমার চেয়ে কমছে কম চৌদ্দ বছরের ছোট, এটা অসম্ভব।”
রেহান চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো। ঘটনার আকস্মিকতায় ওর ঠোঁটজোড়া কাঁপছে… মাথায় বোমা পড়লেও বোধহয় রেহান এতোটা অবাক হতো না যতোটা বাবা আফসার আহমেদের কথায় হয়েছে।

“রেহান… বাবা তুই আমার কথাটা একবার মনযোগ দিয়ে শোন, রিদির এই মুহুর্তে একজন সত্যিকারের অভিভাবক দরকার,” আফসার সাহেব এক সেকেন্ডের জন্য কিছু ভাবলেন। ” আপাতত তোর চেয়ে ভালো কোন অভিভাবক রিদির জন্য আমার নজরে আসছেনা।”

“বাবা ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড রিদি আমাকে ভাই বলে, তুমি… তুমি বরং ফুপিকে বলো আরমানের বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কাউকে পায় কিনা রিদির জন্য। আরমানের অনেক বড় ফ্রেন্ড সার্কেল, ওর ফ্রেন্ডগুলো বেশির ভাগই বিদেশে বিভিন্ন কোর্সে আছে আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা রিদির সাথে বয়সের দিক দিয়ে মানানসই।”

“রেহান তোর মতো করে ওরা রিদিটাকে বুঝবেনা। তোর হাতে আমি চোখ বন্ধ করে মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমি জানি রিদি তোর সাথে সুখে থাকবে।”

“বাবা তুমি ব্যাপারটা বুঝতে চাইছো না, আমি আর রিদি বয়সের দিক দিয়ে একেবারেই বেমানান। তাছাড়া ওকে আমি কখনো সেই চোখে দেখিনি। এটা ইম্পসিবল বাবা, নিজের স্ত্রীর জায়গায় রিদিকে বসানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়… প্লিজ,” রেহান অস্থির হয়ে বললো। এমন জানলে ও এক সপ্তাহ বাড়িই ফিরতো না, দরকার হয় সারাদিন লাইব্রেরিতে যেয়ে পড়ে থাকতো, রাতে ইমার্জেন্সী ডিউটি করতো কিন্তু বাড়ি আসতো না।

“আমি তোকে জোর করছি না রেহান, একজন অসহায় বাবা হিসেবে অনুরোধ করছি। আমি জানি রিদিটা তোর কতো আদরের কিন্তু এই মুহুর্তে ওর শুধু আদর বা স্নেহ নয় একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রায় দরকার, যে বিপদে ওর সামনে ঢাল হয়ে দাড়াবে। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম এই কটা দিন, কিন্তু রিদির মামারা আমাদের উপর ভাবির মৃত্যুর দায়টা চাপাতে চাচ্ছিলো প্রথম থেকেই যেটা কোনভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। আল্লাহর অশেষ কৃপায় সেটা আমরা ভুল প্রমান করতে পেরেছি কিন্তু এখন রিদির বড় মামা মোজাম্মেল ওকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে যেতে চাইছে। আমি কোনদিন ভাবিনি আমার মেয়েকে নিজের বাড়ি থাকতে নিরাপত্তার জন্য অন্য বাড়ি গিয়ে আশ্রয় চাইতে হবে। কিন্তু কি আর করা শেষ পর্যন্ত মনে হয় ওদের ইচ্ছাটাই জয়ী হতে যাচ্ছে…. একমাত্র আল্লাহ তায়লা ই ভালো জানেন।”

আফসার আহমেদ ব্যাথিত মনে নিজের ঘরের দিকে চললেন। তার একমাত্র ছোট ভাই রায়হান আহমেদ পাঁচ বছর আগে ক্যান্সারে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। রায়হানের একমাত্র মেয়ে রিদি। রায়হান মারা যাবার পরে রায়হানের স্ত্রী মিতা আর রিদির সমস্ত দায়িত্ব আফসার আহমেদ নিজের কাধে তুলে নিয়েছিলেন।

একই বাসার উপরতলা আর নিচ তলায় বাস করতেন দুই ভাই আফসার আহমেদ আর রায়হান আহমেদ। তারা দুজনেই নিজেদের পৌত্রিক ব্যাবসা দেখাশুনা করতেন। রায়হান আহমেদ মারা যাবার পর আফসার আহমেদ প্রতি মাসের শুরুতেই রায়হানের স্ত্রী মিতার হাতে তাদের প্রাপ্য টাকার অংশ বুঝিয়ে দিতেন। মিতাও মিতব্যায়ী ছিলেন, প্রায় পুরো টাকাটাই তাই ব্যাংকে রিদির নামে জমেছে। কিন্তু গত মাসে মিতা তার বাবার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় আসার পথে রোড অ্যাকসিডেন্ট করেন। সেই অবস্থায় মিতাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ইমার্জেন্সী অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অপারেশন চলাকালীনই মিতা মারা যায়। সেই থেকে রিদির মামা মোজাম্মলে হক, আফসার আহমেদের কাছে একভাবে রিদির সম্পত্তির সব হিসেব চাচ্ছেন।

কিন্তু যেখানে আফসার আহমেদ, রিদির সম্পত্তির হিসাব মোজাম্মেল সাহেবকে কাগজে কলমে দেয়া দূরে থাক মুখে বলাটাও সমিচীন মনে করছেন না সেখানে নতুন উপদ্রপের মতো মোজাম্মেল হক এখন তার দূর সম্পর্কের কোন শালার ছেলের সাথে রিদির বিয়ে দেবার চিন্তা করছেন। আফসার সাহেবের স্ত্রী মিনা তাকে এই গোপন খবরটা জানিয়েছেন।

তখন থেকে আফসার আহমেদের মাথায় কেবল এই চিন্তাটা ঘুরছে যে রেহানের সাথে রিদির বিয়েটা হলে সবচেয়ে ভালো হয়, যদিও ওদের বয়সের পার্থক্যটা অনেক বেশি। কিন্তু যেদেশে বিপত্নীক লোকেরা হরহামেশা দুই বাচ্চার বাবা হয়ে সোজা আঠারো বছরের মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে রেহান এখনও পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ছুতোয় বিয়ের চেহারা পর্যন্ত দেখেনি। চুয়াডাঙ্গা গেলে রিদিকে হয়তো তাদের পাকাপোক্তভাবে হারাতে হবে… এই কষ্টটা তিনি কাকে বোঝাবেন আফসার সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

রিদি নিজের বাইশ বছর বয়সে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি কোনদিন। আম্মু ছাড়া জীবন ওর কল্পনার বাইরে। সেই আম্মু ম্যাজিকের মতো নাই হয়ে গেছে ওর জীবন থেকে… রিদির পুরো দুনিয়া এখন একরকম স্থবির। শুধুমাত্র বড় চাচিআম্মা আর রেহান ভাইয়ার কথায় কখনো কখনো খাবার মুখে তুলতে বাধ্য হয় ও।

এখন আবার মামা ওকে চুয়াডাঙ্গা সাথে করে নিয়ে যেতে চাইছেন। রিদিমার মামার সাথে যেতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু মামা ওকে স্থায়ীভাবে সেখানে নিয়ে যেতে চান। আম্মু মারা যাবার পিছনে নাকি ওর চাচার হাত আছে। চাচা আর রেহান ভাইয়া নাকি রিদির সম্পত্তিটুকু আত্মসাৎ করার চক্রান্ত করছে। কিন্তু এটা যে একেবারেই অমূলক একটা সন্দেহ মামাকে এটা কোনভাবেই বোঝাতে পারছেনা রিদি।

ওর চাচা আফসার আহমেদ অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। চাচা নিজে প্রতিমাসে ওর আম্মুর কাছে ওদের ব্যাবসার লাভের অংশ বুঝিয়ে দিতেন, কোথায় কি করতে হবে সেটাও আম্মুকে বলে দিতেন। আব্বু মারা যাবার পর থেকে ওর কলেজে আনা নেয়াও চাচা অথবা রেহান ভাইয়া করে। এমন মানুষ সম্পর্কে খারাপ কথাগুলো শুনতে রিদির খুব কষ্ট হচ্ছিল।

রেহান থমথমে মুখে বাইরে থেকে ফিরতেই রিদি এসে ওর ঘরে ঢুকলো, “ভাইয়া আমাকে বাঁচাও, আমি চুয়াডাঙ্গা যাবোনা প্লিজ।”

“চুয়াডাঙ্গা যাবিনা মানে?”

“মামা আমাকে জোর করে নিজের সাথে চুয়াডাঙ্গা নিয়ে যেতে চাইছ পার্মানেন্টলি। আমি ওখানে গিয়ে থাকতে পারবনা ভাইয়া,” ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো রিদি।

রিদির কান্না দেখে রেহানের মেজাজ অসম্ভব খারাপ হলো। কি শুরু করেছে রিদির মামা। চাচিআম্মা মারা যাওয়ার পর থেকেই উনি একটার একটা উদ্ভট দাবী করেই যাচ্ছেন ওদের নামে আর এখন আবার রিদিকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন। এতেদিন রেহান মুরুব্বি মানুষ মনে করে চুপ ছিলো কিন্তু আজ এর একটা হেস্তনেস্ত ওকে করতেই হবে।

“তুই তোর ঘরে যা রিদি,মোজাম্মেল মামাকে আমি দেখছি…. ”

রেহান হন্তদন্ত হয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছিলো কিন্তু রেহানের মা ওকে থামালো।

“রেহান তুই এখন যাস না ওরমধ্যে, তোর আব্বু কথা বলছে মোজাম্মেল ভাইয়ের সাথে।”

“আম্মু এখানে কথা বলার কি আছে? রিদি এই বাড়ির মেয়ে ও ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা কেন যাবে .. আর রিদির মামা বলেই যদি মোজাম্মেল মামার রিদিকে নিয়ে যাবার অধিকার থাকে তাহলে রিদির চাচা হিসেবে বাবা রিদিকে এখানে কেন রাখতে পারবেনা?”

ছেলের এমণ প্রশ্নে নাস্তানাবুদ মিনা। কিন্তু রেহানকে এখন না আটকালে সামনে বিপদ হতে পারে, মোজাম্মেল ভাই খুব সুবিধার লোক নন।

“রেহান, মোজাম্মেল ভাই তোর চাচীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে… তোর বাবাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা শুনিয়েছে। তোর বাবা নাকি ইচ্ছেকরে তোর চাচীর ভালো ট্রিটমেন্ট করায়নি। সেখানে এখন রিদির কিছু হলে আমাদের তো মুখ দেখানোর অবস্থা থাকবে না বাবা।”

“মোজাম্মেল মামার ট্রিটমেন্ট দরকার তাই না.. মা.. দাড়াও আমি করছি ওনার ট্রিটমেন্ট।”

খপ করে রেহানের হাতটা চেপে ধরলেন মিনা আহমেদ,” আমি বলছি তুই বড়দের মধ্যে কথা বলতে যাস না।”

“কিন্তু কিছু না বললে তো ওরা রিদিকে নিয়ে যাবে মা। ”

“গেলে যাবে, রিদির মামা হয় সে।”

“কিন্তু মা রিদি তো যেতে চাচ্ছে না। ”

“আমরাও তো সেটা চাচ্ছি না। ”

“তাহলে চলো উপরে যেয়ে ব্যাপারটা আটকাই ”

“কোন জোরে? কি বলে আটকাবি তুই? ”

“আশ্চর্য আমি ওর ভাই হই।”

“হ্যাঁ, কিন্তু চাচাতো ভাই, মায়ের পেটের ভাই না। রিদিটা বেঁচে না থাকলে ওর সব সম্পত্তি তুই পাবি আর সেই সম্পত্তির লোভে আমরা যে রিদিকে মেরে ফেলবো না তার কি গ্যারান্টি।”

“কি বলছো তুমি এসব… আমরা রিদিকে মেরে ফেলবো?”

“কথাটা আমি বলছি না, রিদির মামা বলছে। এখন তুই রিদিকে বিয়ে করলে অবশ্য সেটা ভিন্ন কথা হতো… তখন আমাদের জোরটা অনেক বেশি থাকতো,” মিনা আফসোসের সুরে জানালেন। রিদিটাও বলতে গেলে তার হাতেই মানুষ। ছোট জা চাকরি করতো বলে একটা সময় স্কুলের পরে রিদি মিনার কাছেই বেশি থাকতো, রিদির জন্য টানটাও তাই মিনার একটু বেশী। নিজের ছেলের বউ হিসেবে রিদিকে মেনে নিতে তাই তার কোন আপত্তি নেই।

মায়ের কথায় সিড়িতে কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে দাড়িয়ে রইলো রেহান। শেষ পর্যন্ত মাও ওই দলের!

…………………………………….

ঢাকার আজিমপুর নিবাসী আফসার আহমেদের একমাত্র পুত্র রেহান আহমেদের সাথে একই এলাকার রায়হান আহমেদের একমাত্র কন্যা আনিয়া আতিফা রিদির বিবাহের জন্য তিন লক্ষ্য এক টাকা দেনমোহরানা ধার্য করা হইয়াছে। আপনি কি এই এই বিবাহে রাজি আছেন….. রাজি থাকলে কবুল বলুন।

কাজী সাহেবের কথাগুলো কানে যেতেই রিদি ফ্যালফ্যাল করে চাচিমার দিকে তাকাল। রিদির পাশে ওর একমাত্র ফুপি সালেহা বসে আছেন। তিনি পাশ থেকে বললেন, “রিদি আম্মু কবুলটা বলে ফেলো , নাহলে কাজী সাহেব মনে করবেন আমরা তোমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছি।”

চাচিমার চোখেও অনুরোধ ঝরে পড়ছে, কাঁদতে কাঁদতে তিনবার কবুল বললো রিদি। চোখের সামনে আব্বু- আম্মুর চেহারাটা আজ খুব করে মনে পড়ছে রিদির। আজ ওর জীবনের কতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন অথচ তারা ওর বিয়েতে অনুপস্থিত, রিদি তাদেরকে জড়িয়ে ধরতেও পারছে না। চোখের জল বরফ গলা নদীর মতো রিদির দুই গাল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো।

“আলহামদুলিল্লাহ,” কাজী সাহেব সাক্ষী সবুদ নিয়ে পুনরায় পাত্রের কাছে চললেন। আফসার আহমেদ তখন আনন্দে বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন।

………………………….

রেহান ড্রইং রুমের সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু বাইরে থেকে তাকে যতো শান্ত আর পরিশ্রান্ত লাগছে ভিতরে ভিতরে
সে ততটাই অস্থির। মাথার ভিতর দুর্দান্ত গতিতে ভয়নক এক ঝড় বয়ে চলেছে। ঝোঁকের মাথায় বিয়েতে রাজি হয়ে রিদির জীবনটা নষ্ট করে দিলো না তো রেহান, নিজেই সে নিজের সঙ্গে যুঝছে।

“কিরে আর কতক্ষন এখানে বসে থাকবি, এবার নিজের ঘরে যা রেহান, ” সালেহা এসে রেহানকে ঠেলতে লাগলেন।” মেয়েটাকে কষ্ট দিস না বাবা। ”

“যাই….. ফুপি একটা কথা বলতাম।”

“বল আমি শুনছি।”

“রিদি কিছু খেয়েছে? সারাদিনই তো কান্নাকাটি করছিলো শুনলাম।”

সালেহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রেহানের প্রশ্ন শুনে। যাক ছেলেটার ভিতরের আগুন বোধহয় নিভেছে তাহলে।

“খেয়েছে তবে খুব অল্প। আমি তোদের দুজনের জন্যই ঘরে খাবার দিয়ে এসেছি। তুই পারলে জোর করে আর একটু খেতে বলিস।”

“হমম, ” থেকে থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে রেহানের। ভিতরে ভিতরে কি ভীষন অস্বস্তি, রিদির মুখোমুখি হওয়া এতো কঠিন কখনো ভাবেনি। চোখের সামনে দিন দিন বেড়ে ওঠা মেয়েটার সাথে কি করে এরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো ও… কাজটা ঠিক হলো কি ভুল, এটা নিয়েই ওর সংশয় কাটছে না। আসলে চরম একটা ভুলই মনে হয় করেছে ওরা সবাই মিলে, রিদিকে দেশের বাইরে কোথাও পড়তে পাঠিয়ে দিলেই হতো। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো তাতেও বিশেষ লাভ হতো না। বাইরে যেতে হলেও রিদিকে বিয়ে করেই যেতে হতো, সাথে উল্টো ওর স্বামীকেও সঙ্গে যেতে হতো কারন বিয়ে ছাড়া রিদিকে বাবা পাঠাতো না একা কখনোই।

নিজের ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো রেহানের। জীবনে বহু চড়াই উৎরাই পার করেছে সে এতোদিন কিন্তু আজকের মতো বিরূপ বোধহয় কোনটাই ছিল না।

ঘরে ঢুকতেই আরেক দফা হকচকিয়ে গেল রেহান। খাটের উপর বৌয়ের মতো বসে থাকা রিদিকে দেখতে পেয়ে মন ভয়নক রকমের প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। এ হতেই পারে না, রিদি আর ও একই ছাদের নিচে… এটা অসম্ভব। রিদির জন্য ও ক্লান্তি ঝেড়ে মাঝরাতে আইসক্রিম আনতে ছুটতে পারে, রিদির পছন্দের জুতো কেনার জন্য সাতদিনের কষ্টের টাকাটা অনায়াসে ওকে দিয়ে দিতে পারে, বায়না ধরলে ক্যাফেতে নিয়ে ফাষ্টফুড খাওয়াতে পারে কিন্তু তাই বলে নিজের স্ত্রীর জায়গাটা রিদিকে কি করে দিবে?

রিদিকে, রেহান প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু সেটা নিজের ছোট বোন ভেবেই, সেখানে আজ রিদি স্ত্রীর দাবী নিয়ে হাজির হয়েছে। দুজনের সম্পর্কের এই হঠাৎ পরিবর্তন আর বয়সের ব্যবধান, রেহানের নিজেকে ভীষন অসহায় মনে হলো।

এই বিয়েতে ওরা দুজনের কেউ সুখী হতে পারবেনা। বাবা – মায়ের কথায় রাজি হয়ে এ কেমন ভুল করলো ওরা।

রিদি দুই হাটুতে থুতনি রেখে চুপ করে নানা কিছু ভাবছিলো। ফুপি, বড় চাচিআম্মা যতোই বলছিলো এই বিয়েতে ওরা নাকি সুখি হবে, রিদির কান্না পাচ্ছিল। রেহান ভাইয়া কি এখন ওকে আগের মতো ভালেবাসবে? ও শুনেছে রেহান একদমই রাজি ছিলোনা, শুধু চাচা – চাচির চাপের মুখে এই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। রিদিকে বাঁচানোটাই এই বিয়ের মুখ্য কারন। এক কথায় রেহান ওকে বাঁচানোর জন্য নিজে আত্মত্যাগ করেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে রিদির, রেহানের জন্য কি করা উচিত?

রেহান ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিতেই রিদি বেনারসির আঁচলটা মুঠিতে চেপে ধরলো উৎকন্ঠায় । এ বাড়িতে যে মানুষটার সাথে ওর সবচেয়ে সহজ সম্পর্ক ছিল, যার কাছে কোন সমস্যার কথা বলতে ও কোনদিন দ্বিধাবোধ করেনি আজ তার সামনেই কথা বলতে জিভ আটকে যাচ্ছে রিদির।

অন্য সাধারন পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ওদের পরিস্থিতি নয়, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত খাটের পাশে গিয়ে দাড়ালো রেহান।

রেহান পাশে দাড়াতেই রিদির শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। রেহান এখন কি করবে? নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলো রিদি কয়েক সেকেন্ড।

“সামনের সপ্তাহে ক্লাস টেস্ট আছে না? ”

বরাবরের মতই রেহানের ভারী স্বর রিদির বুকে সমুদ্রের মতোই আস্ফালন তুললো, তবে এতে ভিন্নতা প্রচন্ড। অন্য সময় রেহানের এমন কথা বলা মানেই সব কিছু রেখে এখনই পড়ার টেবিলে যা রিদি । কিন্তু বিয়ের রাতে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে এমন কথা বলা তাও আবার এটাই যদি হয় প্রথম বাক্যালাপ, তখন দুজনের মধ্যে যে পাহাড় সমান ব্যবাধান তৈরী হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই বাঁধাটা ওরা পার হবে কি করে এখন… কার কাছে আছে এর সমাধান।

রিদি ওর স্বচ্ছে লালচে উড়নার ভিতর থেকেই রেহানকে দেখতে পাচ্ছিল। মেরুন রঙের শেরওয়ানী পরা রেহানকে দেখতে কেমন অপরিচিত লাগছে ওর, এমনকি রেহানের চাহনি, কথা বলার ভঙ্গী সব। অথচ ছোটবেলা থেকে এই ঘরে রিদির অবাধ বিচরন। এমনকি ঘরের পর্দাগুলোও বোধহয় রিদির হাতের ছোঁয়া পেতে অভ্যস্ত। তবু রেহানকে দেখে রিদির বুকে দামামা বাজছে, মনে হচ্ছে হৃদযন্ত্র আজ প্রলয় নৃত্যে মত্ত। প্রচন্ড বজ্র হুংকার দিয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা শুরু হচ্ছে। রিদির মনে হলো এই শব্দের জের ধরেই আজ ওকে শুলে চড়াবে রেহান।

“উহহহ….” রিদির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়েমৃদু কাশল রেহান। রিদি ঠিক আছে তো?

“ক্লাস টেস্ট এক সপ্তাহ পিছিয়েছে,” নিচু স্বরে জবাব এলো রিদির।

“এক সপ্তাহ! কেন? এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিলেই কি স্টুডেন্টরা সব ভাল রেজাল্ট করবে? ”

রেহানের কথায় রিদি মুখ টিপে হাসলো। এখন বুঝি কেউ এগুলো জিজ্ঞেস করে নতুন বউকে?

“যাই হোক এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়া উচিত,” রেহান আড়চোখে একবার বিছানাটা দেখেই মুখ গম্ভীর করে ফেললো। ওদের বাড়ির মুরুব্বীদের কি আক্কেল, বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়েছে, ছোট বোনের সামনে ওর মান সম্মান কিছুই রাখলনা এরা।

রিদি ঘাড় কাত করে সায় দিলো। আসলে কথা বলতে কেমন জিভ অসার হয়ে আসছে ওর, মনে হচ্ছে একটা কুয়ার ভিতরে আটকে গেছে ও… কবে মুক্তি পাবে কে জানে।

কাপড় পাল্টাতে গিয়ে রেহানের আলমারি খুলতে হলো রিদিকে। ফুপি ওর অল্প কিছু কাপড় রেহানের আলমারির এক পাশে রেখে গিয়েছে। সেখান থেকে লাল রঙের একটা সুতির সালেয়ার কামিজ নিলো রিদি। ফুপি বলেছিলো কাল সকালে গোসল করে এটা পরতে। কিন্তু রেহান তো ওর বিয়ের বেনারসিই ছুঁয়ে দেখলো না, সকালের লাল রক্তিম পলাশেই বা ওর কি আসে যাবে।

রিদি কাপড় পাল্টে বের হয়ে দেখে বিছানায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়িসহ চাদরটা গোল করে মুড়িয়ে পড়ার টেবিলের চেয়ারের উপর রাখা হয়েছে.… রেহান ওদের শোয়ার বন্দোবস্তো করছে মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে।

গরম লাগছিলো বলে গোসলের পরে ফ্যানের নিচে দাড়িয়েই মাথায় প্যাচানো গামছাটি খুলে ফেললো সে, খোপা করা চুলগুলো ঝপ করে কোমর ছাড়িয়ে আরো নিচে গিয়ে পড়লো দুর্দান্ত গতিতে।

“রাত দুপুরে নতুন কাপড় পরে ঘুমানোর কি দরকার… গরমে হালকা পাতলা কাপড় পরলে ঘুমটা বরং ভালো হয়,” গম্ভীরমুখে মশারী গুঁজতে লাগলো রেহান। ওর কথায় মনে হচ্ছিলো নতুন কাপড় পরাটা এই মুহুর্তে রাজদ্রোহিতার মতোই অন্যায়।

“কাপড়টা কি পাল্টাবো?” চোখটা পানিতে ভরে আসছিলো রিদির। রেহানের আচরন বলছে সে এই মুহুর্তে খুব রাগ করে আছে।

“সেটাই মনে হয় উচিত ” ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেহান, ওর কেবলই মনে হচ্ছে এগুলো কোনটাই সত্য নয়। কাল ঘুম থেকে উঠতেই দেখবে সব আবার আগের মতো হয়ে গেছে… তখন রিদিকে দেখলে হয়তো আজকের এই দুঃস্বপ্নের কথা মনে করে ভীষন হাসবে ও।

রিদি আর কথা বাড়ালো না। আলমারি খুলে গাঢ় নীল রঙের একটা সালেয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। রিদি বাথরুমে যেতেই কোলবালিশটা মাঝখানে রেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো রেহান।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here