হাতে রাখো হাত
শেষ পর্ব
ফায়জা_করিম
রিদি হাতের চায়ের কাপটা এতো জোরে ঠক করে টি টেবিলের উপর রাখলো যে, রেহান নিজের কাজ ভুলে হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
রেহানের তাকানোর ভঙ্গিতে এতেটাই বিস্ময় ঝরে পড়ছে যে ওর চোখের মনি দুটো বিস্ফোরিত হয়ে প্রায় ছোটখাট দুইটা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার জন্ম দিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। একভাবে তাকিয়ে থাকলে রিদি বোধহয় ওতে এতক্ষণে ম্যজিকের মতোই হারিয়ে যেতো।
রিদি আর এক সেকেন্ডও রেহানের দিকে তাকাল না, ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। রেহানের মনে হলো নির্ভেজাল শান্ত সকালটা রিদি নামের সাইক্লোনের তান্ডবে বিপর্যস্থ, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেই আনমনে মাথা নাড়তে লাগলো সে, নাহ.. রিদির চা টা চমৎকার হয়। চায়ের লিকারের ঘনত্ব আর চিনির মিষ্টতা বলে দিচ্ছে এই বিষয়ে মেয়েটা পারদর্শী হয়ে উঠেছে তবে সাথে চোখের কড়া চাহনিও কি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গোসল করে বের হয়ে নিজের ঘরের দরজায় বাবাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রীতিমতো অবাক হলো রেহান।
“বাবা, তুমি ওখানে দাড়িয়ে আছো কেন? ”
“ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদের অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢোকা ঠিক না। আমি তোমাকে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি বোধহয় গোসল করছিলে,” আফসার সাহেব ধীরস্থির ভাবে কথাটা বললেন। কিন্তু তার গলার স্বরে কেমন যেন মন খারাপের ছোঁয়া ছিল, রেহান মুহূর্তেই সতর্ক হলো। ওর বাবা খুব নরম মনের মানুষ।
“কি হয়েছে বাবা? তোমার গলার স্বর এমন লাগছে কেন? ”
আফসার আহমেদ কেমন বিষন্ন ভঙ্গিতে হাসলেন।
“রেহান আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না,আমি জানি রিদি বয়সে তোমার অনেক ছোট তাছাড়া একরকম জোর করেই তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়েটা হয়েছে… আমি মানছি। কিন্তু বাবা এখন বিয়েটা যখন হয়ে গিয়েছে তখন সেটাকে অস্বীকার করা তো ঠিক না।”
রেহান, বাবার কথায় ঠিক কেমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করবে বুঝে উঠতে পারলনা। বিয়ে অস্বীকার করেছে মানে! এতো ব্যাস্ততার মাঝেও রিদিকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খাইয়ে নিয়ে আসলো ও তারপরও যতো দোষ নন্দ ঘোষ। আর বাবা ওকে তুই না বলে তুমি বলছে তার মানে এটা একটা সিরিয়াস ম্যাটার।
আফসার সাহেব ছেলের দ্বিধান্বিত চেহারাটা পড়তে পারছিলেন। তিনি আর অযথা প্যাঁচালেন না।
“তুই একটু আমাদের ঘরে আয়।”
আহ শান্তি… মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রেহান। বাবা তুই বলছে মানে বিপদ হলেও সেটা ছোটখাট বিপদ।
মায়ের ঘরে পা দিয়েই বোকা বনে গেল রেহান। বাবার খুব পালঙ্ক পছন্দ বলে এই আমলেও ওদের বাসার দুটো ঘরে সাবেকি আমলের কারুকাজ করা দুটো পালঙ্ক আছে। তার একটা দাদুর ঘরে আছে আর একটা এই ঘরে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মায়ের পালঙ্কের এক পাশের খুটি ধরে দাড়িয়ে রিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রিদির কান্না দেখে যে কারও মনে হবে যে ওর সাথে বড় ধরনের কোন অন্যায় করা হয়েছে, আর সেই সন্দেহের তীরটা যে কার দিকে সেটা সহজই অনুমেয়।
মায়ের মুখে রিদির কান্নার কারন শুনে রেহান হাসবে না কাঁদবে বুঝলনা। রিদি বাবা- মাকে নালিশ দিয়েছে যে, রেহানের নাকি ওকে পছন্দ না, ওর নাকি অন্য একটা মেয়ের সাথে প্রেম চলছে।
“দেখ রেহান, আমাদের রিদিটা হয়তো লাক্স সুন্দরী না, তা বলে একদম ফেলে দেবার মতোও কিন্তু না। তাছাড়া বিয়ে করা বউ ফেলে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখা তো হারাম, তুই বাবা ওই মেয়েকে ভুলে যা,” মিনা বললেন।
“সেই মেয়েটার নাম কি মা? ” রেহান তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। প্রেম করে ও!… বউ রেখে এমন প্রেম করার অভ্যাস থাকলে তো ওর আইবুড়ো নামটাই জুটতো না।
“আম্মা ওই মেয়ের নাম মুনিয়া। তোমার ছেলে ওর সাথে কথা বলার সময় দুই পাটির সবগুলো দাঁত বের করে হাসে আর সেই সময় তোমার ছেলের চোখগুলো যদি তুমি একবার দেখো তাহলে বুঝে ফেলবা আমার একটা কথাও মিথ্যা না,” রিদি নিজের উড়নার কোনটা দিয়ে নাকটা চেপে ধরে মুছলো।
রেহান জায়গায় দাড়িয়ে আছাড় খেল। মুনিয়া! কটমট করে রিদির দিকে তাকাতেই গা গুলিয়ে উঠলো ওর… ছি নিজের কাপড় দিয়ে নাকের শর্দি মোছে কে? জঘন্য একটা অভ্যাস।
“মা মুনিয়া, আমার কলিগ সাথে বেস্ট ফ্রেন্ড রাবাবের স্ত্রী। তুমি তো জান রাবাব আমেরিকায় এম এস এর কোর্সে আছে। মুনিয়া আর ওদের একমাত্র মেয়ে তানির ভিসার জন্য ইম্পর্টেন্ট কিছু ডকুমেন্টস দরকার ছিলো, যেগুলো শফিক নামের একজনের কাছে দিতে হবে। মুনিয়া আমাকে সেই নাম্বারটা দিচ্ছিলো। তাছাড়া রিদি নিজে ওই সময় আমার সাথে ছিলো ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ,” নিজের চরিত্রের স্বচ্ছতার জন্য এটুকু যথেষ্ট মনে হলো রেহানের।
“আম্মা সে আজকেও মুনিয়া নামের মেয়েটার সাথে গল্প করছিলো ফোনে আর হাসছিলো, এরকম হাসি একমাসের মধ্যে একদিনও আমি শুনেছি বলে মনে হয়না।” রিদির কথায় রেহানের বেহুঁশ হতে ইচ্ছে হচ্ছিল। এতো ঘরের শত্রু বিভীষণ… অথচ এই রিদির জন্যই নিজের এতোদিনের আইবুড়ো নামটা ঘোচাতে বাধ্য হলো রেহান।
কিন্তু এখন রেহান কি বলে বাবা- মাকে সত্যিটা বুঝিয়ে বলবে বুঝতে পারলনা। রেহান, শফিক সাহেবের হাতে কাগজগুলো দেবার পর মুনিয়াদের ভিসার কাগজ জমা দেয়ার জন্য রেডি হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য নিজেই, মুনিয়াকে ফোন দিয়েছিলো। কথার পিঠে তানিয়ার প্রসঙ্গ চলে এসেছিলো। মুনিয়া তখন ওকে বলছিলো বাচ্চা হলে বুঝবেন ভাইয়া জ্বালা কাকে বলে। মুনিয়ার এই কথা শুনে রেহান নিজেও হেসে ফেলেছিলো, এই হলো তার দুই দাঁতের পাটি বের করার অপরাধ।
রেহানের এক মুহূর্তের জন্য প্রচন্ড রাগ হলো রিদির উপর। আশ্চর্য, এতো ছোট মনের মানুষও হয়, অকৃতজ্ঞ নয় একেবারে কৃতঘ্ন যাকে বলে তাই হচ্ছে রিদি। আশ্চর্য কোন অপরাধ ছাড়াই রেহানকে প্রতারক বানিয়ে ফেলেছে সে। অথচ অপরাধী রিদি নিজেই। হ্যাঁ, হয়তো এখন ছেলেটার সাথে কোন যোগাযোগ রাখছে না রিদি কিন্তু তাতে কি? একসময় সেই ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক তো ছিলো। রিদি যেন মনে কষ্ট না পায়, সেজন্য রেহান তো দূরে দূরে থাকছে। রেহান তো জানে ওদের মধ্যে বয়সের দূরত্বটা এতোই বেশি যে ঐ জিশান নামের ছেলেটার জায়গা দখল করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। একবছর, দুইবছর নয় চৌদ্দটা বছর ওদের মধ্যে গ্যাপ আর সেটা পূরন করা অসম্ভব।
রেহান তো নিজেকে সে জন্য মনে মনে প্রস্তুতো করেই রেখেছে… যে, যখনই রিদি ওকে ছেড়ে দেবার কথা বলবে ও যেন ভেঙ্গে না পড়ে। টুডে অর টুমোরো রিদি যে ওকে ছেড়ে জিশানের কাছে চলে যাবে রেহান সেটা মেনে নিয়েছে মনে মনে।
“মিথ্যা কথা বলছে আম্মা, আসলে আমাকে একদম পছন্দ নয় তোমাদের ছেলের। আমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে, সেই জন্য প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
“হোয়াট? রিদি আমি চুপ আছি মানে এই না যে আমি দুর্বল। আমি চুপ ছিলাম কারন আমি জানি এলাকায় আমাদের একটা আলাদা সম্মান আছে। কিন্তু মানুষ তার কর্মের ফলে ভোগে, সেটাই হয়তো আসলে নিয়তি। আমি তোর আর জিশানের সম্পর্কটা জেনেও এতোদিন চুপ করে ছিলাম কারন আমি আগে সেটা জানতাম না। বিয়ের আগে হলে এই বিয়ে আমি হতেই দিতাম না, কিন্তু ছেলেটা আমাকে ফোনই করেছে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। এখন আমি মুনিয়ার সাথে শুধু কথা বলাতেই যদি খারাপ লোক হয়ে যাই তাহলে তুই কি একবার ভাব।”
রেহানের কথায় আফসার আর মিনা আহমেদ দুজনেই একজন, অপরজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। কিন্তু দুজনেই এর বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানেন না তাই চুপ করে ছেলেমেয়েদের কথা কাটাকাটি করতে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারলেন না।
“জিশান… জিশানটা আবার কে! এই নামে তো আমি কাউকে চিনি না,” ভ্রু জোড়া কপালে তুলে জানতে চাইলো রিদি। রেহানের ওই হাসি হাসি মুখে ফোনে কথা বলার দৃশ্য তখনও দাবানলের মতো ওর হৃদয়কে পোড়াচ্ছে। ওদিকে বলে বুড়ো দাদু কিন্তু প্রেমিকার জন্য চুলে রঙ দিয়ে জোয়ান সাজছে।
“ওয়েট আমি দেখাচ্ছি। রেহান নিজের মোবাইল খুলে জিশান আর রিদির একটি ছবি দেখাল। সাথে ছেলেটা ওকে একটা মেসেজও লিখেছে। সেখানে সে উল্লেখ করেছে যে সে আর রিদি একজন আরেকজনকে প্রান দিয়ে ভালেবাসে। কিন্তু রেহানের হঠকারিতার জন্য ওদের এই পবিত্র প্রেমটা আজ অপূর্ণ রয়ে গেল। এর সম্পূর্ন দায় রেহানের। জোর করে এই বিয়ে দেবার ফলে রিদি যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে জিশান, রেহানকে ছাড়বে না। এরপর জিশানের ভালেবাসার গভীরতা নিয়ে রেহানের মনে আর কোন প্রশ্ন উঠেনি। কারন সে তো রিদিকে ফেরত চায়নি শুধু রিদি ভালো থাকুক এটুকুই চেয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য। রেহান এজন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে দুষছে, ওর ভুলে ছোট বোনটা সারাজীবন কষ্টে কাটাবে, না পারবে কাউকে বলতে আর না পারবে সইতে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে রিদিটা আস্ত একটা বেয়াদব।
“এই ছেলের নামতো জিশান না, ওর নামতো মিজান… দুই দুইবার ম্যাট্রিক ফেল। আর এই ছবিতো এখনকার নয়, দুই বছর আগে যখন নানুবাড়িতে ঈদ করতে গিয়েছিলাম তখন ওর সাথে পাঁচ -দশ মিনিট কথা বলেছিলাম। এরপর তো এই ছেলের সাথে আমার আর কোনদিন কথাই হয়নি। আর ছবিতে যে কমিজটা আছে সেটাও তো ছিড়ে গেছে বলে সেদিন আম্মাকে দিয়ে দিয়েছি মোছার কাজে ব্যবহার করার জন্য,” একদমে বলে রিদি থামলো।
রিদির কথায় মিনাও এগিয়ে এসে ছবিটা দেখলেন। তাইতো এই জামাটা তিনিই রিদিকে বছর দুই আগে কিনে দিয়েছিলেন ঈদে আর কামিজটা ছিড়ে গিয়েছে বলে রিদি ওটা বাতিলও করে দিয়েছে।
“এটাতো রিদির অনেক আগের ছবি, থ্রীপিসটা আমি কিনে দিয়েছিলাম ঈদের জন্য।”
মিনার কথায় রেহান দ্বিধায় পড়ে গেল। তাহলে কি ছেলেটা মিথ্যা বলেছে? কিন্তু মিথ্যা কথা বলে ছেলেটার লাভ কি? কিন্তু রিদির মুখে ঘাবড়ানোর কোন চিহ্ন নেই উল্টো আরো তেজের সাথে ছেলেটার দোষ ধরছে। মাও রিদির পক্ষেই সাফাই দিচ্ছে… অবশ্য সে এটা বরাবরই করে আসছে।
“আমার মনে হচ্ছে এটা সেই ছেলে যার সাথে মোজাম্মেল রিদির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তোর নাম বলার পর আর সামনে এগুনোর সাহস পায়নি। ছেলেটার বাবা মোজাম্মেলের কেমন যেন দূর সম্পর্কের শালা হয়। লোকটা সম্ভবত মোজাম্মেলের শ্বশুরবাড়ির এলাকার চেয়্যারম্যান। ছেলে রিদিকে দেখে হয়তো পছন্দ করেছিলো, তাই এটা ওটা করে বিয়ে ভাংতি দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, রিদি ওরকম কিছু করলে আমরা বাপ -চাচা, আমাদের কানে এর কিছু না কিছু আসতো। রিদিকে কলেজ থেকে আনা নেয়া তুই অথবা আমি করি। ওরকম কিছু থাকলে একদিনও কি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়তো না? ”
আফসার আহমেদের কথায় মিনা সায় দিলেন। রিদি তাদের অমন মেয়ে না।
রেহান তখন অন্য চিন্তায় ব্যাস্ত। রিদি যদি ওই ছেলেকে ভালো না বাসে তাহলে কাকে ভালোবাসে? না মানে ওই ছেলেকে তো চিনেই না বলছে। ব্যাপারটা তাহলে কি দাড়ায়…. রিদি ওকে ভালোবাসে? না হলে মুনিয়ার ফোন নিয়ে অতো রিঅ্যাক্ট করছে কেন?
হঠাৎ বুকের মধ্যে কেমন শো শো করে ঝড় উঠতে লাগলো রেহানের, হাতের তালু রীতিমতো ঘামছে। রিদির সামনে এই যুদ্ধে ঢাল তলোয়ার ছাড়া ও যাবে কি করে… এমনিতেই তো ও আধমরা হয়ে আছে বিয়ের দিন থেকে৷ কিন্তু এখন সেই জরাজীর্ণ হৃদয় ভালোবাসার ধাক্কা সইতে পারবে তো, রিদিটা যে অনেক ছোট… ওর সাথে তাল সামলে চলাটা যে ভীষন কঠিন।
রেহানের মাথায় আসছিলো না… এখন ওর কি করা উচিত? বয়সের পার্থক্যটাকে ঘুচিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে না রিদিকে আরও সময় দিবে? ওর সাথে চড়ুইভাতি সংসারটা যদি সত্যি করতে রাজি হয়ে যায় রিদি.. বার কয়েক ঢোক গিলে রেহান, বুকের ভিতর তখনও স্টেশনে দাড়ানো যাত্রীর মতোই উৎকন্ঠা।
কিন্তু যাকে নিয়ে এতো আলোচনা সেই রিদি ততক্ষণে নিজের ঘরে চলে গিয়েছে।
“ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই,
যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।
কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে
প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে॥”
“কি হচ্ছে? ” যতোটা সম্ভব নিজেকে গুরুগম্ভীর করে দেখানোর তৎপরতা চলছে তখনও রেহানের৷ যতো যাই হোক রিদির অনেক বড় সে এটা কিছুতেই ভোলা যাবে না।
“কিছু না, আমি নানুর বাড়ি চলে যাচ্ছি,” রিদির কান্নাভেজা কন্ঠটা যেন ছুঁয়ে গেল রেহানকে। ধুস.. মেয়েটা কাঁদছে সেই তখন থেকে। কিন্তু এমনি এমনি কি করে জড়িয়ে ধরে… আগে তো কখনও ধরেনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? এর অভ্যাস আছে ওর।
“কেন?”
“আমি না থাকলে তুমি শান্তিতে থাকবে। কেউ তোমার উপর রাগবেনা, চিল্লাবেনা।”
” ওহ.. আমি তো মনে করলাম সেই ছেলেটার কাছে যাবি বুঝি। ”
“মানে! ওই মিজান ”
“মানে কিছু না… তুই গোছান বাদ দে আমি বরং দূরে কোথাও পোস্টিং নিয়ে চলে যাবো, তোকে আর যন্ত্রনা দিব না।”
“একদম খুন করে ফেলব,তারপর নিজেও নিজের জানটা শেষ করে দিব… একবার যেয়ে দেখো।”
এক ধাক্কায় কাপড়ের ব্যাগটা মাটিতে ফেললো রিদি।
“আত্মহত্যা পাপ রিদি,” সাবধানে কাপড়ের ব্যাগটা দূরে সরিয়ে রাখলো রেহান। রিদিকে এই মুহুর্তে এতো সুন্দর লাগছে নাকি সবসময়ই এতে সুন্দর ছিলো কে জানে, কিন্তু রেহান দু’চোখ দিয়ে রিদিকে দেখছিলো।
“আর দূরে ঠেলে দেয়া বুঝি পাপ না? আমার কি অপরাধ বলতো, আমি… আমি কি দোষ করেছি? ওই মুনিয়ার কি আছে?”
“মুনিয়ার একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে, ” রিদির খুব কাছে এসে দাড়াল রেহান। রিদির চোখদুটো দেখতে জবা ফুলের মতো লাল হয়ে আছে , নাকের নাকফুলটা ভয়ংকর ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠে থেমে যাচ্ছে প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে। দুর্দান্ত ইচ্ছেগুলো হঠাত করেই মাথাচাড়া দিলো রেহানের বুকের মধ্যে। এতোকাল সে কি তাহলে আদতে কাউকে ভালোবাসেনি.. চলার পথে হঠাৎ হঠাৎ দু’ একটা মুখ, চোখের চাহনি ওকে বিচলিত করেনি? করেছে…. কিন্তু তারা কেউ আসলে ওর মনের দেয়ালে ফাটল ধরায়নি। এতোটা কাছে কাউকে পেতেই ওর ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু রিদি পেরেছে, কিভাবে সেটাই রেহানের কৌতূহলেকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
“মেয়ে.. পাঁচ বছর!”
“হমম..”
রিদির এবার একটু খটকা লাগলো। রেহান ওকে ছেড়ে অন্যমেয়ের সাথে প্রেম করলেও করতে পারে কিন্তু তাই বলে কোন বাচ্চার মাকে… মনে হচ্ছে ওরও একটু ভুল হয়েছে। কিন্তু ভুল হলে হয়েছে.. বেশ করেছে সব্বাইকে বলে দিয়েছে। ওকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ে মানুষের সাথে কিসের অত মাখামাখি…
“রিদি ”
“উমম”
“আমি খুব খারাপ জানিস তো… মনে করেছি বুড়ো জামাই নিয়ে এমনি তোর দুঃখের শেষ নেই তার উপর আবার কাটা ঘায়ে নুনেরছিটে দিয়ে কি দরকার। তাই ওই ছেলেটার মেসেজ আর ছবিটা তোকে দেখাইনি,” রিদির চোখের পানিগুলো আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলো রেহান। এগুলো সব ওর সম্পত্তি এখন থেকে.. অনেক দামী।
“তোমাকে বিয়ে করে আমি খুব দুঃখে আছি এই মনে হলো তোমার। সেই জন্যই তোমার সাথে ঘুরতে যাবো বলে অত সেজেগুজে গেলাম? অবশ্য তোমার পক্ষে সেটা মনে করাই স্বাভাবিক, তুমি তো সব কিছুই অনেক বেশি বোঝ আমার চেয়ে , কোন কিছুই তাই আলোচনার প্রয়োজন মনে করনি।”
রেহানের বুঝতে পারলো ভুল তো ওর হয়েছিলো। বিয়ের রাতে রিদিকে অযাচিত ভাবে প্রশ্ন না করাটা যেমন ওর সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো তেমনি পরে সুযোগ পেয়ে সেটা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সুধরে নিতে পারতো, অযথাই বাবা-মাকে এর মধ্যে আনার কোন মানে ছিল না। খামাখোই একটা নাটক হলো।
“আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে রিদি,” কালক্ষেপণ না করে রিদিকে নিজের বুকের সাথে আকড়ে ধরলো রেহান। সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে।
“ভুল কিনা জানিনা তবে তুমি বললে আমি এই সত্যিটা অনেক আগেই তোমাকে জানাতে পারতাম। কিন্তু তুমি তো আর আমাকে ভালোবাসোনা, আমার কাছে তোমার তাই কিছু জানারও ছিলোনা,” রেহানের বুকের মধ্যে পড়ে থেকেই অভিমানে ঠোঁট উল্টালো রিদি। একদম একটা অমানুষ… এত্তোগুলো কষ্ট দিয়েছে রিদিকে।
“রিদি…”
“উমম..”
“আমি মুনিয়ার সাথে কথা বললে তোর রাগ হয়… ”
রিদি চোখ বুজলো, “হুমম ”
“আমারো হয়, আর কখনো অন্য কোন ছেলের সাথে ছবি তুলতে যেন না দেখি।”
“দেখলে? ”
“একদম খুন করবো। ”
” ওমা… কাকে?”
” আবার কাকে? তোকে। এক নাম্বার আসামী তুই আমার কারাগারের, জেল জরিমানা যা হবে এখন থেকে সব তুই ভোগ করবি।”
“কেন…. আমি আসামী কেন হবো? ”
“তুই আমার বউ সেজন্য। জানিস না একই পাপ দুজনে করলে দুজনেরই শাস্তি পেতে হয়। আজ থেকে আমার পাপের শাস্তিগুলোও বোনাস হিসেবে তুই ভোগ করবি,” রেহান মুখ টিপে হাসলো।
“তোমার বউ হয়েছি তো কি হয়েছে, তোমার পাপের শাস্তি আমি কেন ভোগ করবো, তুমিতো আর আমাকে ভালোবাসোনা,” গাল ফুলিয়ে বললো রিদি। শখে বাঁচেনা, পাপ করবে উনি আর ভোগ করবে রিদি.. জন্মেও না।
” তাতে কি… তুইও তো বাসিস না ”
” মিথ্যে একটা বললেই হলো না? … ভালো না বাসলে বুঝি বড় আব্বু আর আম্মার কাছে যেয়ে এমনি এমনি অভিযোগ করলাম। আমার সংসারে আগুন লাগাতে আসছিলো শয়তান মহিলা একটা। আমার বর কি কুরিয়ার সার্ভিস যে কাগজ দিয়ে দিয়ে বেড়াবে, নিজের দরকারের কাগজ নিজে গিয়ে দিতে পারেনা? ”
পরমুহূর্তেই রিদির পায়ের নিচ থেকে মাটি হাওয়া হয়ে গেলো।
“বুড়ি… তোকে না পেলে ঠিক মরে যাবো ”
রিদিকে সোজা কোলে তুলে নিয়েছে ততক্ষণে রেহান।
রিদি তখন তাল সামলাতে রেহানের গলা জাপটে ধরেছে।
“ইহহ… আমি মোটেই বুড়ি না ”
“আমি বুড়ো…. আমার সাথে থাকতে হলে তোকে বুড়ি হতেই হবে।”
“উল্টো হবে।”
“মানে? ”
“মানে আমার মতো খুকির সাথে থাকতে থাকতে…. তুমি বুড়ো থেকে খোকা হয়ে যাবে।”
“হমম… মন্দ না, তবে তোর আরো আগে জন্মানো উচিত ছিল জানিস রিদি। তাহলে বোধহয় আমি এতো কমপ্লেক্সে ভুগতাম না,” রিদির কপালে গাঢ় করে একটা চুমু দিলো রেহান।
রিদির চোখটা তখন জলে টস টস করছে অথচ কালও ওরা এক বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়েছে… কত দূরে চলে গিয়েছিলো ওরা দুজন সম্পর্ক তৈরী হবার আগেই।
রেহান যখন ঘরের দরজাটা দিলো রিদি তখনও কাঁদছে।
“রিদি… আমরা কি সামনে এগুবো?” ফ্যাসফাসে গলায় করে জানতে চাইলো রেহান। এখন দুজনের মধ্যের দেয়ালটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে রেহানকে, এটাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে এক হওয়ার নেশাটা তীব্র হচ্ছে প্রতি সেকেন্ড। ভালেবাসার আকাঙ্খা বড় আজব,মানুষকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে।
রিদির মনে হলো প্রশ্নটা এই মুহুর্তে অবাঞ্ছিত হলেও সুন্দর…. অনেক সুন্দর। অধিকারের জিনিসে অধিকার খাটানোর আগে তাকে ভালোবাসা আর সম্মান জানানোটা জরুরি। রেহানকে ও কখনভালোবেসেছে রিদির জানা নেই, হয়তো বিয়ের মুহূর্ত থেকেই, কিন্তু সেটা নিজের বুঝতে ওর সময় লেগেছে। আর আজ যেভাবেই হোক ওদের দূরত্ব কমার একটা সু্যোগ এসেছে, অহংকার ধরে রেখে সেটা দূরে ঠেলার কোন মানে হয়না, তাতে সম্পর্ক জোরা না লেগে আরো ভেঙ্গে যাবে।
রিদি বুভুক্ষের মতো রেহানের গলা জড়িয়ে ধরলো। ছুটির দিনের আকাশে বাতাসে বৃষ্টিটা তখন আসি আসি করছে।
দরজার বাইরে একবার দুইবার মায়ের ডাক শুনতে পেল ওরা … কিন্তু তখন ওরা মত্ত, দিশেহারা, নিজেদের ভালোবাসা কে খুড়তে ব্যাস্ত.. কারন ওরা জানে ভালোবাসাটা ততক্ষণে হয়েই গিয়েছে।
সমাপ্ত।