হারানো সুর,২য়-পর্ব,৩
শাহরিয়ার
পার্ট-২
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিতেই বাহির থেকে শাশুড়ি আম্মা ডাক দিলো। আমি সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে দরজা খুলে দিতেই আম্মা ঘরের ভিতর ঢুকলো।
আম্মা, মারে সারাদিনতো কিছু খাইলি না। আয় কিছু খেয়ে নে।
আমার ক্ষুদা নেই মা আপনি খেয়ে নেন ওদের সঙ্গে নিয়ে।
আম্মা, আমি ওদের সাথে খাবো এইটা তুমি কি করে ভাবতে পারলে? আমি যদি খাই তবে তোমার সাথে আর আমার নানতীর সাথে খাবো। নয়তো না খেয়েই কাটিয়ে দিবো জীবনের বাকি দিনগুলো।
আম্মা প্লীজ পাগলামি করবেন না। আপনি অসুস্থ মানুষ যেয়ে খেয়ে নিন।
কথা শেষ হতে না হতেই শাশুড়ি হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। কান্না করতে করতে সে বার বার বলতে থাকলো শাকিল এতো বড় পাপ এতো বড় অন্যায় আমার মৃত্যুর পর করতো। আমি বেঁচে থাকতে কেন করতে হবে?
শাশুড়ির কান্না দেখে আমারও প্রচণ্ড খারাপ লাগছিলো। এদিকে শাশুড়ির কান্নার সাথে সুর মেলাতে শুরু করলো কোলে শুয়ে থাকা সাবা। শাশুড়ি আম্মা আমার একটা হাত টেনে রান্না ঘরে নিয়ে আসলেন। সে এতো সময় বসে রান্না করেছে। আমাকে সঙ্গে নিয়েই খেতে বসলেন। কিন্তু কেন জানি খাবার আমার মুখের ভিতর নিতে পারছিলাম না শত চেষ্টা করেও। আম্মা বার বার বলে চলেছে অল্প হলেও খেতে হবে নিজের জন্য না হলেও সাবার জন্য। আমি অনেকটা সময় খাবার হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে একটা সময় কয়েক নলা খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর হাত মুখ ধুয়ে পানি খেয়ে সেখান থেকে উঠে দ্রুত নিজের রুমের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলাম।
ঘরের দরজার সামনে আসতেই পাশের ঘর থেকে ফিসফিসানির শব্দ কানে ভেঁসে আসতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রনায় যেন বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসছিলো। কোন রকমে বুকটাকে শক্ত করে চেঁপে ধরে রুমের ভিতর ঢুকে আসলাম।
মেয়েটাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশেই মাথা লাগিয়ে কান্না করছি আর আল্লাহর কাছে জানতে চাচ্ছি বার বার কি এমন ভুল আমার ছিলো যার জন্য এমন শাস্তী পেতে হচ্ছে আমাকে?
কত ভালোবাসতো মানুষটা আমাকে সব কিছু মিথ্যা প্রমাণ করে দিলো। মানুষ যে বলে সময় বদলে যায়, প্রতিশ্রুতি বদলে যায় বদলে যায় ভালোবাসার মানুষটাও। তাদের কথা গুলোই কি তবে সত্যি? কিন্তু আমিতো বদলে যায়নি, দিনের পর দিন এই মানুষটাকে ভালোবেসেছি। আজও ভালোবেসে চলেছি এই মানুষটাকে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দু’চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাএকা হয়ে গেলো। তবুও যেনো দু’চোখের পানি শেষ হচ্ছে না। দূর মসজিদ থেকে দিনের সর্বশেষ আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে দু’চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ছোট বেলা থেকে আর যাই হোক না কেন নামায, রোযা, সঠিক নিয়মে দান ক্ষয়রাত কখনো আমি বন্ধ করিনি।
তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে রুম থেকে বের হয়ে আসতেই চোখে পড়লো শাকিল আর তার নতুন বউয়ের হাসাহাসি আর মাতামাতির শব্দ। খাবার খাওয়ার জন্য তারা ঘর ছেড়ে কিচেনের সাথে লাগোয়া ডাইনিং এ এসেছে। বুকটা ছেদ করে উঠলো। এই শাকিল আমি এক বেলা না খেয়ে থাকলে আমাকে খাওয়ানোর জন্য কতই কি না করতো। অথচ আজ আমি একা একটা ঘরে পরে রয়েছি। খেয়েছি কি না খেয়েই পরে রয়েছে সে একটি বারের জন্যও এসে জিজ্ঞাসা করলো না।
কথা গুলো ভাবতেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এতোদিন কাকে আমি ভালোবেসে এসেছিলাম? যে মানুষটাকে এতো এতো পরিমাণ ভালোবাসলাম সেই মানুষটা মুহুর্তের ভিতর আমাকে ভুলে গেলো। ভালোবাসা নিয়ে মানুষ অভিনয় করতেই পারে তাই বলে নিজের স্ত্রী সন্তানদের ভালোবাসা নিয়ে অভিনয়? আমার ভালো মন্দ না জানতে চাইতেই পারে কিন্তু সাবা? ওতো ওরই রক্ত তবে কি করে ওকে উপেক্ষা করে সে চলতে পারছে? না আর ভাবতে পারছি না, হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো আমার। কোন রকমে ওদের কথা এড়িয়ে ওয়াশ রুমে এসে ওযু করে নিয়ে, সোজা নিজের রুমের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
জায়নামায বিছিয়ে নামাযে লুটিয়ে পড়লাম। যার কেউ নেই তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট্য। নামায শেষ হতেই সাবার কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। আমি উঠে যেয়ে মেয়েকে বুকের সাথে লাগিয়ে নিলাম। আমি কষ্ট করে বেঁচে থাকতে পারলেও আমার মেয়েটা কি করে এতো কষ্ট সহ্য করবে?
আর চাচা চাচী, চাচাত ভাইটা যদি জানতে পারে? তবে তারা কিভাবে রিয়াক্ট করবে? কথা গুলো ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে উঠছিলো। এ বাড়ি ছেড়ে গেলে শুধু মাত্র ঐ একটাই জায়গা রয়েছে আমার যাওয়ার মত। কিন্তু তারাও যদি আমাকে আর আশ্রয় না দেয়। নানান রকম কথা ভাবতে ভাবতে রাত গভীর হয়ে আসছে। সেই সাথে পাশের রুমের ফিঁসফিঁস শব্দে যেন আমার দম আরও বন্ধ হয়ে আসছে।
দুই দিন আগেও কত কথা বলতাম দু’জন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে আর আজ শাকিল অন্য কারো সাথে জেগে রাত কাটাচ্ছে। সেও তার বিবাহিত স্ত্রী। আমি তার স্ত্রী ছিলাম। কত রকম গল্প বলতাম দু’জন জ্যোৎস্নার আলো নাকি আমার সমস্ত শরীরে মাখিয়ে দিবে। আমি কখনো ঢাকা শহরে যাইনি এবার বৈশাখি মেলায় আমায় ঢাকায় নিয়ে যেয়ে। ঢাকাই শাড়ি রেশমী চুড়ি কিনে দিতে চেয়েছিলো মানুষটা, সবটাই ছিলো শুধুই তার অভিনয়। এতো ভালোবাসার পরও মানুষটা আমার হইলো না। এই দুঃখে না পারবো আমি বেঁচে থাকতে না পারবো আমি মরে যেতে।
নানান রকম চিন্তায় এক সময় ক্লান্ত দু’চোখ ঠিকই বন্ধ হয়ে এলো। ফজরের আযানে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে এসে নামাযে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নামায শেষে মোনাযাতে আল্লাহর নিটক প্রার্থনায় লুটিয়ে পরলাম যেন যা হয় ভালো কিছু হয়।
“আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতাগুলো আল্লাহ্’র সমীপেই নিবেদন করছি!” [সূরা ইউসুফ: ৮৬]
মোনাজাত শেষ করতেই বাহির থেকে চাচাত ভাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। যে জিনিসের ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো। আমি চাইনি চাচার বাড়ি পর্যন্ত এ খবর পৌঁছে যাক কিন্তু এ গ্রাম আর ঐ গ্রাম মুহুর্তে মানুষের কান থেকে কান অব্দি পৌঁছে যায়। চাচাত একমাত্র ছোট ভাই এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে রক্ত গরম। সব চেয়ে বড় কথা চাচা চাচীর চেয়ে সে আমাকে অনেক বেশী ভালোবাসে। আপন বড় বোনের চেয়ে কোন অংশে কম ভালোবাসে না। আমি ছোট বেলা থেকেই তাকে ছোট ভাইয়ের মত করেই আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছি। রুমানের আওয়াজে এবার আমি দ্রুত রুমের ভিতর থেকে বের হয়ে আসলাম। না জানি আর কার কার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আমাকে দেখে রুমান একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রুমান।
এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ভাই?
রুমান, বুবু তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে এক রাতে?
আমি মুখে মিথ্যে হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে কই আমারতো কিছু হয়নি।
রুমান, বুবু তুই মিথ্যা হাসি দিয়ে তোর সুন্দর চোখের নিচের কালো দাগ লুকাতে পারবি না। পারবি না লোকাতে তোর মুখের ক্লান্তির চিহ্ন। আমিতো আমার বুবুকে চিনি। তুই সব কিছু ব্যাগে ভরে নে আমার সাথে এখুনি চল। এখান থেকে সোজা তুই আমাদের বাড়ি যাবি। তারপর বিকেলে থানায় যেয়ে মামলা করবো।
তুই কি পাগল হইছিস ভাই? কার বিরুদ্ধে মামলা করবি? উনি তোর দুলাভাই, আর আমি এ বাড়ি ছেড়ে আপাতত যাচ্ছি না। তুই বস আমি তোর জন্য চা নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি।
রুমান, দুলাভাই ঐ লোকটা আমার কিছু হয়না। যে আমার বোনের কোমল হৃদয়টি ভাঙতে বিন্দু পরিমাণ কার্পন্ন করেনি সে কোন দিনও আমার দুলাভাই হতে পারে না। আমিতো উনাকে জেলের ভাত খায়িয়েই ছাড়বো। তুমি তাড়াতাড়ি সাবাকে নিয়ে আমার সাথে চলো।
ভাই তুই পাগলামি করিস না মাথা ঠাণ্ডা কর, এটা আমার স্বামীর বাড়ি, আর মেয়েরা স্বামীর বাড়ি আসে লাল শাড়ি পরে, আর বের হয় সাদা কাফনের কাপড় পরে। আমিও যেদিন মরবো সেদিন না হয় সাদা কাপড় পরিয়ে নিয়ে যাস।
রুমান, তুমি যাই বলো আপু আমি ঐ লোককে কোনদিন ও ছাড়বো না। আজ হোক কাল হোক তাকে আমি শাস্তি দিবোই।
কথা গুলো বলে রাগে গজ গজ করতে করতে রুমান বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে গেলো অনেক ডেকেও ওকে আর থামাতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে রইলাম। কি করবো না করবো কোন কিছুই যেনো বুঝতে পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে নিজের স্বামী সংসার সব অন্য এক মহিলার হয়ে যাচ্ছিলো অথচ আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। কিছুই করতে পারছিলাম না। চাইলেই রুমানের সাথে বের হয়ে যেয়ে শাকিলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতাম। কিন্তু সত্যিই কি মানুষ আমাকে ভালো চোখে দেখতো? আর যে মানুষটাকে এতো ভালোবেসেছি সেই মানুষটার বিরুদ্ধেই কি করে আমি মামলা করতাম। প্রচণ্ড রকম মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে আমি শুধু মা বলে একবার চিৎকার করে উঠলাম। তারপর সব কিছু শুধুই অন্ধকার।
চলবে…
হারানো সুর-৩য় পর্ব
শাহরিয়ার
যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিজের রুমে। শাকিল আমার পাশেই বসে রয়েছে। কিন্তু সাবা আমার সাবা কোথায় আমি লাফিয়ে উঠলাম।
আম্মা, সাবা আছে মা আমার রুমেই ঘুমাচ্ছে।
আম্মার কথায় কিছুটা সস্থি ফিরে আসলো মনের ভিতর।
শাকিল, কেমন লাগছে এখন তোমার?
জ্বি, ভালো তবে আপনার নতুন বউ ফেলে এখানে আসা ঠিক হয়নি। কথাটা বলেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে আম্মাকে বললাম সাবাকে নিয়ে আসার জন্য। আম্মা সাবাকে নিয়ে আসতে ঘর থেকে বের হতেই শাকিল হাত চেপে ধরে রত্না আমাকে ক্ষমা করে দিও।
ক্ষমা কিসের ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি? বিয়ে করেছেন সে জন্য ক্ষমা? আমার ভালোবাসা বিশ্বাস সব কিছু মিথ্যা প্রমাণ করেছেন তার জন্য ক্ষমা? নাকি এতোদিন পর্যন্ত আপনার সাথে থেকেও আপনার মত একজন বেইমান প্রতারককে আমি চিনতে পারিনি তার জন্য ক্ষমা করবো বলতে পারেন? আপনি ক্ষমা পাবার যোগ্যনন আপনি যে পাপ করেছেন তার শাস্তি অবশ্যই পাবেন এবং খুব শিগ্রই পাবেন।
কথা গুলো বলতে বলতেই মা চলে আসলো। সাবাকে কোলে নিয়ে মাকে বললাম আমি একটু রেস্ট নিবো। মা আর শাকিল রুম থেকে বের হয়ে গেলো। এদিকে দুপুর হয়ে এসেছে আজান দিয়েছে আমি ওযু করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামায শেষে মোনাজাতে যেতেই বার বার আমার কানে বাজতে লাগলো।
“জেনে রেখো, আল্লাহ্’র সাহায্য নিকটে!”
[ সূরা বাক্বারা: ২১৪ ]
আমি মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম, জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে সাবা বুকের সাথে লাগালাম। এই মৃহুর্তে আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি জানি না আমার আগামিতে কি হবে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎই বা কি হবে। শুধু জানি নিশ্চই আমার আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবে এবং সঠিক পথ দেখাবে।
আমি সাবার আর আমার কিছু জামা কাপড় ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। এরপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালাম। আম্মা আমাকে দেখে দৌঁড়ে চলে আসলো। কান্না শুরু করে দিলো। উনার কান্না দেখে নিজের ও চোখ দিয়ে টলমল করে পানি পরছে। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম দু’চোখের পানি মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলাম আম্মা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আমি আপনার সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি। পারিনি আপনার দেয়া দায়িত্ব রক্ষা করতে। আমাকে ক্ষমা করবেন মা। আমি আমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আপনার সন্তানকে চির জীবনের জন্য মুক্তি দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন বলেই মাথাটা নিচু করে তার হাতের কাছে নিয়ে গেলাম।
আম্মা, কান্না করতে করতে আমার ভাগ্য এতো খারাপ তোর মত মেয়েকে পেয়েও আমি ধরে রাখতে পারলাম না। দোয়া করি মা এই নরপশুর কাছ থেকে দূরে যেয়ে অনেক অনেক ভালো থাক। জীবনে অনেক অনেক সুখি হও মা। আমার কলিজার টুকরা নাতনীটারে বুকের মাঝে আগলে রেখো।
শাকিল, ততক্ষণে দরজা খুলে এসে বাহিরে দাঁড়িয়েছে। আমার আর আম্মার কথা শুনেই হয়তো সে এসেছে। আমি শাকিলের সাথে কোন রকম কথা না বলেই হাঁটতে শুরু করলাম। ওর মত বেইমানের সাথে আমার বিন্দু পরিমাণ কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। শাকিল পেছন থেকে ঢাকতে ঢাকতে সামনে এসে দাঁড়ালো।
শাকিল, কোথায় যাচ্ছো তুমি?
তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই,
শাকিল, পাগলামি করো না, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ।
আমি শাকিলকে থামিয়ে দিলাম, তোমার মেয়ে না শাকিল ও শুধুই আমার মেয়ে, আর আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের কোন রকম খারাপ কিছু হবে না। শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমি আমার মেয়ের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করবো। ভয় নেই মেয়ে কখনো তোমার কাছে তার অধিকার চাইতে আসবে না। আসলে মেয়েকে আমি কখনো জানতেই দিবো না তুমি তার বাবা লাগো। কারণ আমি চাইনা আমার মেয়ে কখনো জানুক তার বাবা কতটা খারাপ চরিত্রের মানুষ ছিলো। কতটা নারী লোভী ছিলো, আমি হয়তো সব সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু আমার মেয়ে সহ্য নাও করতে পারে। কারণ সেও একজন নারী। তাই আমি কখনোই আমার মেয়ের সামনে আপনার পরিচয় জানাবো না। আর আমিও খুব শিগ্রই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো আপনাকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে থাকুন, আমাদের পথ আটকাতে আসবেন না।
কথা গুলো বলার পর শাকিল স্টিল হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলো। কোন রকম কথা আর ওর মুখ থেকে বের হলো না। আমি সাবাকে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। শাকিল এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আমার তাতে বিন্দু পরিমান কষ্ট লাগছিলো না। শাকিলের মত বেইমানকে আমি চিনতে পারিনি এটা আমার ভুল। আমার কষ্ট লাগছিলো এতোদিন ধরে তিলে তিলে ঘরে তুলা আমার যত্নের সংসারটার জন্য। বাড়ির উঠোন, চারিপাশে লাগানো হরেক রকম ফুল গাছ সব আমাকে জেনো বার বার পেছন থেকে ডেকে চলছিলো। বলছিলো যাসনে রত্না এসব কিছু তোর নিজের হাতে যত্ন নিয়ে গড়ে তুলা। তুই চলে গেলে কে নিবে এর যত্ন? আমি নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সব কিছু পেছনে ফেলে হেঁটে চলছি মনকে বুঝাচ্ছি সব কিছু শুধুই মায়া। সব চেয়ে বেশী খারাপ লাগছিলো শাশুড়ি আম্মার জন্য। জানিনা ঐ মহিলা উনার ঠিক মত যত্ন নিবেন কিনা। উনার মত মানুষ হয়না। আমি উনাকে পেয়ে মা হারানোর দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। সেই মানুষটাকে আজ আমি একা ফেলে চলে যাচ্ছি। তাই বুকের ভিতরটা বার বার মোচড় দিয়ে উঠছিলো।
তবুও সব কিছু পেছনে ঠেঁলে এক সময় সে বাড়ির সীমানা ছেড়ে বহুদূর চলে আসলাম। শাশুড়ির কান্নার আওয়াজ ও এখন আর কান অব্দি আসছে না। আমি হাত থেকে ব্যাগটা নামিয়ে একবার সে বাড়ির দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। না দেখা যাচ্ছে না এতোটাই দূরে চলে এসেছি যে শাকিলদের বাড়ি তার বাড়ির সাথে মিশে থাকা সব স্মৃতি, সব কিছুই অনেক দূরে পরে রয়েছে।
একটা ভ্যান গাড়ি আসতেই আমি তাতে উঠে বসলাম। মেয়েকে বুকের সাথে লাগিয়ে বসে রইলাম। পাঁচ বছরে এই প্রথম আমি একা কোথাও বের হলাম। নয়তো কোথাও বের হলে সব সময় শাকিল পাশে থাকতো শক্ত করে হাত ধরে রাখতো।
এইতো গত বছর ঈদের দিন রুমানদের বাড়িতে আসবো, রিক্সা ঠিক করে দিলো। হঠাৎ রিক্সা অল্প একটু চলার পর পেছন থেকে ডাক দিয়ে থামিয়ে দৌঁড়ে এসে পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো। শাশুড়ি এমন অবস্থা দেখে সাথে সাথে হাসতে হাসতে বলে উঠলো বউ পাগলা ছেলে আমার। সত্যি বউ পাগলা তা নাহলে সে কি করে আমাকে রেখে আজ অন্য কাউকে বউ করে নিয়ে এলো। আমার সংসারে আমি নিজেই পর হয়ে গিয়েছি। তাইতো সব ছেড়ে আজ চলে যাচ্ছি অজানা গন্তব্যে।
ভ্যান এসে চাচার বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই আমি নেমে ভাড়া পরিশোধ করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম। চাচা আসরের নামায শেষ করে মাত্রই ঘর থেকে বের হয়েছে। হঠাৎ করে আমাকে বাড়ির উঠানে দেখে কিছুটা চমকে উঠেছে চাচা। আমি চাচাকে সালাম করে শরীর কেমন আছে জিজ্ঞাসা করলাম।
চাচা, আমিতো মা ভালো আছি কিন্তু তোর সাথে কি হতে কি হলো কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমার সাথে কিছুই হয়নি, ঐসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। চাচী কোথায় চাচীকে দেখতে পারছি না।
চাচা, তোর চাচী আছে ঘরের ভিতর তুই ফ্রেশ হয়ে রুমে যা। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে বিছানায় শুয়িয়ে দে। আর মনে হয় সারাদিন কিছুই খাসনি খেয়ে নে কিছু।
আমি আমার সেই পুরনো রুমে ঢুকলাম, রুমটা সেই আগের মতই আছে। বিছানার চাদরটাও নতুন বিছানো মনে হয় কাল রাত বা আজ সকালেই বিছানো হয়েছে এটা রুমানের কাজ আমি জানি। ও জানতো আমি আসবো। সাবাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে ওয়াশ রুমে চলে আসলাম। কল ছেড়ে পানিতে হাত দিতেই সমস্ত শরীর শীতল হয়ে আসতে শুরু করলো। ইচ্ছে করছিলো গোসল করতে কিন্তু করা হলো না। ওযু করে এসে নামাযের জন্য দাঁড়ালাম।
নামায শেষ হতেই বাহির হতে চাচীর গলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি রুম থেকে বের হয়ে চাচীকে সালাম জানালাম।
চাচী, মুখটা কালো করে মারে কি বলমু তোরে আশেপাশের মানুষজনতো নানান রকম কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। না আমি তাদের কথায় কান দেই না। কিন্তু মানুষের মুখতো আর বন্ধ করে রাখা যায় না। তাদের মুখে যা আসে তা বলে, যে এমন সুন্দরি মেয়ে হবার পরেও স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয় কি করে। নিশ্চই কোন সমস্যা আছে। আরও অনেক রকম কথা, তুইতো গ্রামের মানুষকে ভালো করেই জানিস।
হঠাৎ, দূর থেকে রুমান চিৎকার করে বলে উঠলো, আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করো। রত্না আপু যদি তোমার নিজের মেয়ে হতো তবে কি তুমি তার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারতে? তোমারে আল্লাহ মেয়ে দেয়নি তার বদলে রত্না আপুকে দিয়েছে আর তুমি তার সাথে এমন জগন্য ব্যবহার করছো। মানুষ কি বললো তাতে হৃদয়ে আঘাত লাগে না কিন্তু নিজের মানুষ আঘাত করলে তা হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দেয় এতোটুকু বুঝো না?
আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছি আমার সেই ছোট রুমন আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। কত কিছু বুঝে, অথচ ভাই তুই জানিস না এ সমাজ তোর বোনের দোষ এতো বেশী খুঁজবে যে তোর বোনটা খুব বেশী সময় তোর সাথে থাকতে পারবে না। এ শহর ছেড়ে বহুদূর চলে যেতে হবে আমাকে।
চলবে…