হারানো সুর-১০ম পর্ব,১১তম পর্ব
শাহরিয়ার
১০ম পর্ব
ভয়ে ভয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সাবা ঘুমিয়ে পরলো। আমার চোখেও প্রচন্ড ঘুম এসে জমা হয়েছে। দু’চোখের পাতা এক করে ফেলেছি, এমন সময় মা এসে ডাক দিলো। আমি দরজা খুলে দিতেই মা বললো না খেয়ে কেন চলে আসলি।
আমার ক্ষুধা লাগেনি মা, আপনারা খেয়েছেন?
মা: আমরা খেয়েছি আয় এখন তুই ও খাবি। সত্যিই আজ তোর হাতের রান্না অনেক মজা হয়েছে। নিজে কেমন রান্না করলি তা নিজে খেয়ে দেখবি না তা কি করে হয়?
আমি আচ্ছা ঠিক আছে আমি আসছি।
মা: আসছি না এখুনি আমার সাথে চল।
আর কোন কথা না বলে মায়ের সাথে ডাইনিং এ চলে আসলাম। মা নিজের হাতে খাবার বেড়ে দিলো। সত্যিই খাবার ভীষণ ভালো হয়েছে। আমার খেতে খেতে শাকিলদের বাড়িতে প্রথম দিনের কথা মনে পরে গেলো।
তিন চার রকমের রান্না করেছি আমি, শাকিল শাশুড়ি আম্মা আরও দুই তিনজন খাবার টেবিলে বসে আছে, আমি সব রকম রান্না নিয়ে তাদের সামনে রাখলাম। আম্মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। সকলে খাচ্ছে আর একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আমার ভীষণ ভয় ভয় লাগছিলো। হঠাৎ একজন বলে উঠলো বাহ বউ মায়ের হাতেতো যাদু আছে। আজ কত বছর পর এতো ভালো রান্না খেলাম তার কোন হিসেব নেই।
সাথে সাথে সকলেই বলে উঠলো সত্যিই রান্নার প্রশংসা না করে পারছি না। খুবি দারুণ রান্না হয়েছে। শাকিল তখনো চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিলো। আমি খুব ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখছি তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমার ভয় আরও বেড়ে যাচ্ছে তবে কি শাকিলের আমার রান্না পছন্দ হয়নি?
হঠাৎ করেই শাকিল বলে উঠলো, দেখতে হবে না রান্না কে করছে? শাকিলের এমন কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। শাশুড়ি আম্মা বলে উঠলো, এই ছেলে বউ পাগলা হবে। লজ্জায় শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে আমি সেখান থেকে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসি।
কিরে মা আর একটু দিবো নাকি?
মায়ের কথায় আমি কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আছি, উনার দিকে তাকিয়ে না মা আর লাগবে না। বলে খাবার শেষ করে টেবিল থেকে উঠে চলে আসি নিজের রুমে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি কেমন আছে আম্মা। মানুষটা আমাকে ভীষণ ভালো বাসতো।
মা বাবা হারা এতিম মেয়ে ছিলাম, উনিই আমাকে বুঝিয়ে ছিলেন মা কেমন হয়। তার আদর ভালোবাসা কেমন হয়। আজ সেই মানুষটা কেমন আছে আমি জানি না। মানুষটা যে ভাবেই থাকুক না কেন ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক এটাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি।
যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে শাকিলের সামনা সামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবো আমার কি অপরাধ ছিলো শাকিল? কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে? কি ভুল ছিলো আমার যার জন্য আমার সুখের সংসারটা তুমি ভেঙে চূরমার করে দিলে? এতো ভালোবাসার বিনিময়ে তুমি আমার সাথে কি করে পারলে এতো বড় প্রতারণা করতে? যদি কখনো আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দেয় তবে অবশ্যই আমি এই প্রশ্ন গুলো ঠিকই করবো প্রেমিক নামক ঐ প্রতারক মানুষটাকে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ফজরের নামাযের পর, নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে নিজের রুমে এসে বই নিয়ে পড়তে বসেছি। এটা এখন আমার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছে। স্যার চলে যাবার পর মা আমাকে পড়া দেখিয়ে দিবে। মা বলেন আমি খুব ভালো ছাত্রী অল্প বুঝালেই আমি সব পড়া খুব সহজে মুখস্ত করে নিতে পারি।
ছোট বেলা থেকেই আমি লেখা পড়ায় ভালো ছিলাম। যার কারণে স্কুল পড়তে আমার কোন রকম টাকা লাগতো না। স্কুল থেকেই বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। সেই টাকা দিয়েই বেশ ভালো ভাবে আমার লেখাপড়া হয়েছিলো। কতই না সুন্দর ছিলো সেই সকল দিন গুলো।
হঠাৎ নবম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পর, রেজাল নেবার দিন পরিচয় হলো শাকিলের সাথে। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে ওর বাড়ি। আমাদের স্কুল থেকেই এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে নাকি পাস করেছিলো। তাই স্যার ম্যাডামদের সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি রেজাল্ট কার্ড নিয়ে আনন্দ করতে করতে বের হচ্ছিলাম। দরজার সামনে আসতেই শাকিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যাই।
শাকিল: সরি সরি আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি বলে হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।
আমি প্রথমে তার হাত ধরতে না চাইলেও যখন বুঝতে পারলাম একা উঠে দাঁড়াতে খুবি কষ্ট হচ্ছে তখন উপায় না পেয়ে তার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম।
শাকিল: আমার মনে হয় আপনার খুব বেশী ব্যথা লেগেছে, চলুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
আমি ফিঁক করে হেসে দিয়ে বললাম, না না ভাইয়া আমার তেমন লাগেনি আমি ঠিক আছি। আসলে ভুলটা আমারই আমি এভাবে দৌঁড়ে না বের হলেই পারতাম।
এরপর শাকিল নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলো। দু’জন গল্প করতে করতে স্কুল গেটের বাহিরে চলে আসলাম। দু’জন দু’জনের সম্পর্কে জানলাম। বেশ খানিকটা পথ এক সাথে হাঁটলাম। তারপর আমি শাকিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠে নিজের বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেলাম। প্রথম দেখাতে তার সাথে কথা বলেই আমি হয়তো তার প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। কে জানতো সেই মানুষটাই বদলে এক সময় অন্য নারীতে আসক্ত হবে। কথা গুলো ভাবতেই চোখের কোনে জল এসে জমা হয়েছে।
মা: দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রত্না কি করছিস পড়তে বসেছিসতো?
আমি দ্রুত চোখের কোন থেকে পানি মুছে জ্বি মা পড়তে বসেছি।
মা: আচ্ছা পড় আমি একটু পর আসছি জাহাঙ্গীর বের হবার পর।
জ্বি আচ্ছা, বলে আমি আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম আমাকে যে অনেক বড় হতে হবে। নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাকে যে শাকিলের মুখোমুখি হতে হবে।
এভাবেই দিন গুলো কেটে যেতে লাগলো। দেখতে দেখতে এ বাড়িতে চার মাস কেটে গেলো, কিভাবে কেটে গেলো টেরই পেলাম না। হেমন্তের শেষে শীত চলে এসেছে। আমার বা সাবা দু’জনের কারোরই তেমন ভারী কোন কাপড় নেই শীতের। মাকে বলবো কি বলবো না কথা গুলো ভাবছিলাম। এমন সময় স্যার তার ডিউটি শেষ করে বিকেলে বাড়িতে ফিরে, আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাবাকে ডাক দিলো। আমি সাবাকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বললাম স্যার ভিতরে আসেন।
জাহাঙ্গীর: না ভিতরে আসবো না তোমরা দু’জন একটু রেডি হয়ে বের হও। মার্কেটে যাবো। শীত পরেছে খুব, সকলের জন্য শীতের জামা কিনতে হবে। আমি মায়ের রুমে যাচ্ছি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হও।
কথাটা বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। মানুষটা বড্ড কঠিন হলেও সব দিকে খেয়াল আছে এটা একটা ভালো দিক। আমি সাবাকে রেডি করে নিজেও রেডি হয়ে রুমের বাহিরে এসে দেখি উনি সেখানে নেই। বুঝতে পারলাম মায়ের রুমে গেছে। যাবো কি যাবো না ভাবতে ভাবতে মায়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে উনিই নিচে নেমে আসলো।
মা: নিচে নেমে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমার শরীরটা ভালো না তোরাই যা। আর তাছাড়া আমার শীতের পোশাকের শেষ নেই।
কি হয়েছে আপনার মা? আমাকে জানাবেন না? আমি মার্কেটে যাবো না। আগে আপনি সুস্থ হোন তারপর শীতের জামা কাপড় কেনা যাবে।
জাহাঙ্গীর: আম্মুর তেমন কিছু হয়নি, তোমরা চলো বাসায় রেস্ট নিক ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চা মেয়েটা শীতে কষ্ট করছে।
আমি উনাকে খুব ভয় পাই, উনার কথার উপর আমি কথা বলতে পারি না। তাই মাথা নিচু করে উনার সাথে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম।
বাড়ির বাহিরে বের হতেই গাড়িতে যেয়ে বসলো স্যার, আমি কোথায় বসবো বুঝতে পারলাম না। পেছনে বসতে যাবো এমন সময় স্যার সামনের দরজা খুলে দিয়ে বললো সামনে বসো। পেছনে বসলে মানুষ মনে করবে আমি তোমাদের বাড়ির ড্রাইভার।
উনার কথায় আমি বেশ লজ্জা পেয়ে দ্রুত সামনে যেয়ে দরজা খুলে উঠে বসে পরলাম। গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধরে। বিশাল বড় একটা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো। আমি খুব ভয়ে ভয়ে শপিং মলের ভিতর ঢুকলাম। প্রতিটা দোকান খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম।
জাহাঙ্গীর: এমন বোকার মত হা করে তাকিয়ে থেকো না, মানুষ কি মনে করবে? ভাববে জীবনে কোন দিন এতো বড় শপিং মলে আসোনি।
তাদের ভাবনাটা তো ভুল না স্যার, আমি সত্যিই কখনো এতো এতো দোকান দেখিনি কখনো।
জাহাঙ্গীর: তার জন্য তা মানুষকে বুঝাতে হবে?
কথা বলতে বলতে একটা দোকানের ভিতর ঢুকে সেখান থেকে সাবার জন্য বেশ কয়েকটা জামা কিনে দিলো। তারপর আরেকটা দোকানে ঢুকে আমার জন্য আর মায়ের জন্য শাল আর শীতের জামা কিনে দিয়ে বললো পছন্দ হয়েছে?
আমি আস্তে করে বললাম হ্যাঁ হয়েছে কিন্তু এগুলো তো অনেক দামী। স্যার আপনার জন্য কিছু কিনলেন না?
জাহাঙ্গীর: মুচকি হেসে আমার অনেক রয়েছে, আপাতত প্রয়োজন নেই।
এরপর শপিং মলের আরেকটা ফ্লোরে নিয়ে আসলো আমাকে আর সাবাকে, যেখানে শুধুই খাবার দোকান। স্যার এখানে কি করবো আমরা?
জাহাঙ্গীর: চুপ সব সময় স্যার স্যার করবে না, মানুষ তাকিয়ে দেখে। এখানে খাবার খাওয়ার জন্য এসেছি।
তাহলে আমি কি বলে ডাকবো স্যার?
জাহাঙ্গীর: আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ থাকবা রোবট দেখেছো কখনো? রোবটের মত থাকবে আমি নড়তে বললে নড়বা। বসে থাকতে বললে বসবা।
এরপর একটা টেবিলে বসে খাবারের অর্ডার করলো। আমি চুপচাপ বসে খেতে শুরু করলাম। খাওয়া শেষ হতেই আমরা শপিং মল থেকে বের হয়ে আসলাম। তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরে আসলাম। আমার আর সাবার ব্যাগ গুলো আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিলো আর মায়ের ব্যাগটা হাতে করে নিয়ে স্যার উপরের দিকে উঠে গেলো। আমি ব্যাগ গুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগ থেকে শালটা বের করে গাঁয়ে জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এতো সুন্দর লাগছিলো যেনো নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না। অবাক নয়নে তাকিয়ে শুধু নিজেকেই নিজে দেখে চলছি।
চলবে…
হারানো সুর-১১তম পর্ব
শাহরিয়ার
আজ এক নতুন আমিকে আবিষ্কার করলাম। আসলে সুন্দর পোষাকে বা দামী পোষাকে যে মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় তা এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। চাদরটা শরীর থেকে সরিয়ে রেখে সাবার পাশে বিছানায় শুয়ে পরলাম।
জীবন খুব জটিল, খুব কঠিন, তবুও আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। কঠিনতম জিনিসটাও সহজ মনে হবে যখন আপনি ভালো থাকবেন। আবার যখন দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন পার করবেন তখন সহজ অনেক কিছুও আপনার কাছে কঠিন মনে হবে। বেঁচে থাকার যে আনন্দ তা উপভোগ করতে হলে জীবনকে সহজ করে তুলতে হবে। “আলহামদুলিল্লাহ” এই মুহূর্তে আমার জীবনের হিসেব বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে।
মেয়েটাকে বুকের মাঝে নিয়ে থাকতে পারি, সারাদিন নিজের সংসারের মত কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে পড়ালেখা করছি। তিন বেলা ভালো খাবার পাচ্ছি, ভালো জামা কাপড় পাচ্ছি এর চেয়ে বেশী একটা মানুষের আর কি প্রয়োজন? হয়তো মানুষের এর চেয়ে বেশী কিছুর প্রয়োজন হয়না। কিন্তু আমার কাছে এসব কিছুই ক্ষণস্থায়ী মনে হয়। আমি লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হতে চাই। এরপর নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজে কিছু করতে চাই। যে আশায় আমি শাকিলের বাড়ি ছেড়েছি একদিন আমার সে স্বপ্ন পূরণ হবে “ইনশা আল্লাহ” এটা আমার বিশ্বাস।
মানুষের জীবনে সুখের মুহূর্ত গুলো হয়তো খুব দ্রুতই চলে যায়। আমার জীবন থেকেও হয়তো তেমনি হচ্ছিলো। আরও দু’টি মাস চলে গেলো। রমজান মাস চলে আসলো। বাড়িতে কাজের চাপ আরও কমে গেলো। স্যার বাহির থেকেই ইফতার নিয়ে আসে সকলের জন্য। শুধু সেহরি আর রাতের খাবার রান্না হয় বাড়িতে। তাও এক সাথেই রান্না হয় শুধু গরম করে নিতে হয়। হালকা শীত না হলে হয়তো গরম করার ও প্রয়োজন পরতো না।
বিগত পাঁচ বছরে এই প্রথম শাশুড়ি আম্মাকে ছাড়া রোজা রাখছি, ইফতার করছি সেহরি করছি। সব কিছুতেই তার কথা মনে পরে। জানিনা উনি কেমন আছেন খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে। মায়ের আদর ভালোবাসা সত্যিই কখনো ভুলে থাকা যায়না। আমিও শত সুখের মাঝেও আম্মাকে ভুলতে পারি না। মানুষটার কাছ থেকেই যে প্রথম বুঝেছি মায়ের ভালোবাসা কেমন হয়।
স্যার মানুষটা বাহিরে যতটা কঠিন, ভিতরে ঠিক ততটাই যে নরম তা আমি পুরোপুরি বুঝে ফেলেছি। আগের মত আর ভয় লাগে না মানুষটাকে। প্রতিদিন ইফতারের সময় সাবাকে কোলে নিয়ে বসে ইফতার করে। একটু একটু করে খাবার মুখে তুলে দেয়। দেখতে বেশ ভালোই লাগে। শাকিলের কাছে থাকলেও হয়তো শাকিল এভাবে মেয়ের মুখে একটু একটু করে খাবার তুলে দিতো।
দেখতে দেখতে রমজান মাস শেষ হয়ে আসছিলো। পঁচিশটা রমজান চলে গেলো। ছাব্বিশ রমজানের দিন স্যার সেহরির সময় সবাইকে বলে দিলো ইফতারের পর শপিং করার জন্য বের হবে। সবাই যেনো প্রস্তুতি নিয়ে থাকি।
আমি যাবো না শপিং করতে।
জাহাঙ্গীর: কেন যাবে না?
আমার ভয় লাগে এতো বড় শপিং সেন্টারে যেতে। আমার এতো বড় জায়গা এতো মানুষের ভিড়ে থাকতে কেমন জানি লাগে। আমি ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না।
জাহাঙ্গীর: জীবনে বড় হতে হলে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়। বড় বড় জায়গা বড় বড় মানুষের সাথে চলতে হয়। তুমি যেখানে থাকবে সেই জায়গার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। যে শহরে থাকবে সে শহরের মানুষের মত চলাফেরা করা শিখতে হবে। তবেই তুমি সফল হতে পারবে।
তবুও স্যার আমি যাবো না, আমার সত্যিই কেমন জানি লাগে।
মা: একটা থাপ্পর খাবি মেয়ে, চুপচাপ খেয়ে নে।
আমি আর কোন কথা না বলে সেহরি খেয়ে নিলাম। তারপর নামায পড়ে ঘুমিয়ে পরলাম। সারাদিন বাসার টুকটাক কাজ করতে করতে কেটে গেলো। আসরের নামাযের পর স্যার বাসায় আসলো। এসেই আরেক বার বললো তাড়াতাড়ি সব কাজ কর্ম শেষ করে নিতে। ইফতারের পর পরই শপিং করতে বের হয়ে যাবে মার্কেট গুলোয় প্রচন্ড ভিড় এখন।
ইফতার শেষেই সকলে রেডি হয়ে বের হয়ে পরলাম ঈদের শপিং করার জন্য। শপিং করতে করতে সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেলো। দোকান গুলোতে প্রচন্ড রকম ভিড় রমজান শেষের দিকে ঈদ চলে এসেছে তাই হয়তো এতো ভিড় লেগে আছে দোকান গুলোতে। শপিং শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো।
জীবনে প্রথম এতো দামী দামী জামা কাপড় দেখলাম। এতো দামী কাপড় কিনলাম। এতো সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। কোনটা রেখে কোনটা কিনবো বুঝে উঠতে ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। সকলের পছন্দ মত জামা কাপড় কেনা হয়েছে। সাবার জন্য কেনা হয়েছে সবচেয়ে বেশী ড্রেস। স্যারের চোখে যেটাই পছন্দ হয়েছে সেটাই কিনে দিয়েছে মানুষটা। আমি অনেকবার মানা করেছি স্যার এতো কিনে দিতে হবে না। কে শোনে কার কথা উল্টো ঠোঁটে আঙ্গুল লাগিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করে।
আমার জন্যও দুইটা জামার সেট আর দু’টো শাড়ি কিনে দিয়েছে। সব গুলো ড্রেস আর শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
সব কিছু গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুতে রাত বারোটার উপরে বেজে গেলো। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় অল্পতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হামলে পরে। আর দু’চোখ খুব দ্রুতই বন্ধ হয়ে আসে, আমি হারিয়েই যাই ঘুমের রাজ্যে।
কত দ্রুত যে দিন চলে যাচ্ছিলো বলে বুঝাতে পারবো না। দেখতে দেখতে চাঁদ রাত চলে আসলো। আমি স্যারকে বললাম মেহেদী পাতা কিনে এনে দিতে। সকলে হাতে মেহেদী নিবো।
জাহাঙ্গীর: মেহেদীর পাতা কোথায় পাবো? টিউব কিনে এনে দিতে পারি।
ঐসব কি হাতে দেয়া যাবে?
জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ যাবে কিছু কোম্পানি হালাল উপায়ে ঐসব মেহেদী বানাচ্ছে সো চিন্তা নেই।
বেশ তাহলে নিয়ে আইছেন। আমি কখনো ঐসব ব্যবহার করিনি। স্যার বাসা থেকে বের হয়ে গেলো মা আরও কি কি যেন কিনে নিয়ে আসার কথা বললো। স্যার চলে যাবার পর আমি মা আর সাবা গল্প করতে বসে পরলাম। মাকে বলতে শুরু করলাম চাঁদ রাতে গ্রামে আমরা কত মজা করতাম। সকলে এক সাথে মেহেদী ভাটতে বসতাম। তারপর সারা রাত বসে একজন আরেক জনের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতাম। কতই না আনন্দ হতো দিন গুলোতে।
মা: মাথায় হাত দিয়ে সে সকল দিনের কথা ভেবে খারাপ লাগছে তাই না? মন খারাপ করিস না মা। দেখবি এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি মাকে বললাম হ্যাঁ দিন গুলো সত্যিই খুব আনন্দের ছিলো। কিছু কিছু দিন কিছু কিছু মুহুর্ত মানুষ চাইলেও ভুলতে পারে না।
মা আর আমি কথা বলতে বলতে স্যার যেয়ে বাজার করে চলেও আসলো। আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে এর ভিতর যা যা আসে সবই তোমার কাজে লাগবে। সেদিন কিনে দিতে মনে ছিলো না।
আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখি মেহেদীর পাশাপাশি অনেক রকম কসমেটিক, আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম এসব না আনলেও পারতেন।
জাহাঙ্গীর: ঈদতো আর প্রতিদিন আসে না, একটা বছরে দুটো ঈদ আসে। মানুষ একটু সাজবে আনন্দ করবে এটাইতো নিয়ম।
স্যার আরও বকবক করে যাচ্ছে আর আমি মাথা নিচু করে উনার কথা শুনে যাচ্ছি। মানুষটা যে কি করে এতো সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে কথা বলে মাঝে মাঝে আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই।
রাতের খাবার খাওয়া শেষ হবার পর আমি মা আর সাবা বসে আছি। স্যার বাহিরে কোথায় যেনো বের হয়েছে। আমি সাবার হাতে মেহেদী দিচ্ছি আর মায়ের সাথে গল্প করছি। সাবাকে বেশী মেহেদী দেয়া সম্ভব হলো না ছোট মানুষ প্রচন্ড নড়াচড়া করে বার বার নষ্ট করে ফেলছে। তাই সাবাকে বাদ দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম হাত বাড়িয়ে দেন।
মা: আমার নিতে হবে না, তারচেয়ে বরং তুই নে।
তা হচ্ছে না আপনাকেও নিতে হবে। আমার সাথে মা পেরে উঠলো না। বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি মেহেদী দিতে দিতে অতীতে হারিয়ে গেলাম। বিয়ের পর পাঁচটি বছর ভাটা মেহেদী আমার শাশুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে দিতাম। সে কি খুশি হতেন উনি। মায়ের হাতে মেহেদী দেয়া শেষ হলেই শাকিলের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতাম। দিন গুলো সত্যিই অসাধারণ ছিলো। জীবনে হয়তো আর কোন দিনও সে সকল দিন আর মুহুর্ত ফিরে আসবে না। যে দিন চলে যায় সে দিন সে সময় আর কখনো ফিরে আসে না। মানুষের জীবনে এটাই সত্যি এটাই বাস্তবতা। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম। স্যার এসেছে বুঝতে পারলাম। মায়ের হাতে মেহেদী দেয়া শেষ। দরজা খোলার জন্য আমি উঠবো।
মা: তুই বসে থাক আমি খুলে দিচ্ছি।
মা যেয়ে দরজা খুলে দিতেই স্যার ঘরের ভিতর ঢুকে পরলো। স্যার উপরে উঠার আগ মুহুর্তে আমি বললাম স্যার আসেন মেহেদী দিয়ে দেই।
স্যার কিছু বলার আগেই মা যেয়ে উনার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতে আসতে বললো রত্না খুব সুন্দর করে মেহেদী দিতে পারে।
স্যার কিছু না বলে আমার সামনে বসে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে স্যারের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ করেই আজ শাকিলের কথা এতো বেশী মনে পরছিলো যে আমি দু’চোখে যেন আর কিছুই দেখতে পারছিলাম না। জলে ভরে উঠলো দু’চোখ নিজেকে সামলে নেবার আগেই টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি ফ্লোরে আর স্যারের হাতের উপর পরলো।
জাহাঙ্গীর: একি তুমি কাঁদছো কেন?
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না, সাবাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে ছুটে চললাম।
চলবে…