হারানো সুর-১৮তম পর্ব,১৯ তম পর্ব
শাহরিয়ার
১৮তম পর্ব
দিন গুলো কেটে যাচ্ছে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটা একটা করে আমার পরীক্ষা। মনে বিষাদ ভর করেছে। কতশত অভিমান মনের মাঝে এসে জমা পরছে। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে হাসি মুখে বেঁচে রয়েছি। আমি জানি আল্লাহ যা করেন তার বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। নিশ্চই আল্লাহ আমার জন্য যা কল্যানকর তাই রেখেছেন। পাঁচ বছরের বেশী সময় এ বাড়িতে রয়েছি। সবাইকে কত আপন মনে হয়।
অবশেষে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। অবসর সময় গুলোতে আমি পত্রিকা দেখে চাকরির জন্য যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাও আমাকে বেশ সাহায্য করে চলেছেন। মাঝে মাঝেই আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। আমি ইন্টারভিউ দেবার সময় সাবা মায়ের সাথেই থাকে। সাবা এবার নার্সারি থেকে প্রথম শ্রেণীতে উঠেছে। বেশ চঞ্চল হচ্ছে দিন দিন মেয়েটা। কোথাও থেকে তেমন কোন সারা পাচ্ছি না চাকরির। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। অনেকেই বলছে জানানো হবে। আমি এতে হতাশ হইনি, কারণ আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই চাকরি করার। তাই চাইলেই খুব সহজ চাকরি পাবো না এটা আমি ভালো করেই জানি।
এক সকালে স্যার অফিস চলে গেছে, আমি সাবাকে স্কুলে দিয়ে এসেছি। মা মুখটা কালো করে সোফায় বসে রয়েছে। মাকে কখনো এমন ভাবে আমি থাকতে দেখিনি। আমি দ্রুত মায়ের কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলাম মা আপনার কি হয়েছে?
মা: তুই আমার সাথে কথা বলিস না। আমি এতোদিন যদি জানতাম তোর জন্য আমার এতো বড় ক্ষতি হবে, তাহলে প্রথম দিনেই আমি তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। তোকেতো এতোগুলো দিন আমি নিজের মেয়ের মত দেখেছি।
মায়ের কথার কোন কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। সব কিছু কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছে আমার কাছে। কোথায় আর কি গন্ডগোল লাগলো। মা আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে।
মা: আমার ছেলে বিয়ে করতে চায় না এর কারণ তুই। বলেই কান্না করতে শুরু করলো।
মায়ের এমন কথা শুনে আমি অবাকের শেষ চূড়ায় এসে পৌঁছালাম। কি বলছে মা এসব আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্যার বিয়ে করছে না এর জন্য আমাকে কেন দোষী বলছে। আমি কি এমন ভুল করলাম? যতটা পেরেছি নিজেকে সামলে রেখেছি। স্যারকে ভালোবেসেও তা প্রকাশ করিনা ভুল করেও। কখনো ভুলেও মনের কথা একটি বারের জন্যও মুখে নিয়ে আসিনি। অথচ আমি কি করে তার বিয়ে না করার পেছনে দায়ী এটাই বুঝতে পারছি না।
মা: রত্না তুই কোথাও চলে যা আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করিস না। তোর কাছে আমি অনুরোধ করছি। তোর যত টাকা লাগে আমি দিবো তবুও তুই সাবাকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা।
বেশতো মা আপনি বলছেন আমি চলে যাবো। কিন্তু আমার অপরাধটা কি? সেটা কি আমি জানতে পারি কি ভুলের জন্য আমাকে দোষী করা হচ্ছে।
মা: কান্না থামিয়ে দোষ তোর না আমার ছেলের আমি জানি না। কিন্তু আজ যখন আমি ওর রুমে যাই তখন একটা ডায়েরী পাই টেবিলের উপর। ছেলের আমার ডায়েরী লেখার শখ কখনোই ছিলো না। তাই কৌতুহল না থামাতে পেরে আমি ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় শুধু তোকে নিয়েই লেখা। আমার ছেলে নাকি তোকে ভালোবেসে ফেলেছে। তুই বল এটা কি মেনে নেয়া সম্ভব? আমাকেতো সমাজের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে হবে। এ সমাজে বসবাস করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমি যে আমার বোনকে কথা দিয়েছি ঝর্ণাকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে নিয়ে আসবো। এখন তুই বল আমি কি করবো?
মায়ের কথা শুনে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এসব আমি কি শুনছি, নিজের কানকেই যেনো আমি বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। স্যারের মনের ভিতর এতো কিছু ছিলো অথচ বাহির থেকে পৃথিবীর কোন মানুষের বুঝার ক্ষমতা হবে না। তার ব্যবহারে এই পাঁচ বছরের ও বেশী সময়ে আমি ভুল করেও বুঝতে পারিনি তার মনের কোনে আমার জন্য জায়গার সৃষ্টি হয়েছে।
হুট করেই মা দু’হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলো। মিনতি করে বলতে শুরু করলো প্লীজ রত্না তুই চলে যা। নয়তো সব কিছু ছেড়ে আমাকেই চলে যেতে হবে। হয় এ বাড়ি ছেড়ে নয়তো এ দুনিয়া ছেড়ে। আমি জীবনে কখনো অসম্মানিত হয়নি। আর তাই হতেও চাইনা।
আমি চোখের পানি মুছে এ কি করছেন মা? আপনি আমাকে আদেশ করবেন এ বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য। আপনি মা আমি সন্তান। আমি আপনার অসম্মানের কারণ হয়ে কখনোই বেঁচে থাকতে চাই না। আমি চলে যাবো বহুদূর চলে যাবো। আপনাকে কোন রকম টেনশন করতে হবে না।
মা: তোর যখন যত টাকা লাগবে যে কোন সাহায্য লাগবে আমাকে বলবি আমি তোকে সাহায্য করবো। বলতে বলতে মা উপরে উঠতে শুরু করলো।
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। অসময়ে কে এলো চোখের পানি মুছে যেয়ে দরজা খুলতেই দারোয়ান চাচা বললো আপনার নামে এই কুরিয়ারটা এসেছে।
আমি অবাক হয়েছে খামটা হাতে নিলাম। কেননা আমি এখানে থাকি এটা আমার কোন পরিচিত জনরা জানে না। তাহলে কোথায় হতে আসলো এ চিঠি? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম নিজের রুমের দিকে। ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে খামটা খুলতেই মনের ভিতর আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। আমি আরও একবার প্রমাণ পেলাম আল্লাহ যা করেন তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। আমি চিঠিটা খামের ভিতর ঢুকিয়ে নিলাম। এরপর আমার আর সাবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জামাকাপড় দু’টো ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম সাবার স্কুলের পথে। সাবাকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।
সাবাকে ফ্রেশ হতে বলে আমি দু’তলায় চলে আসলাম। স্যারের রুমের ভিতর ঢুকে টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিটা লুকিয়ে নিয়ে মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম।
মা রুমের ভিতর থেকে বের হয়ে আসলো। তার মন ভালো নেই আমি জানি। চলুন দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন।
মা: আমার ক্ষুধা নেই, তোরাই খেয়ে নে।
খাবো মা আজ না হয় তিনজন শেষ বারের মত এক সাথে খেয়ে নেই। স্যার আসার আগেই আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তাই মা প্লীজ চলুন না শেষ বারের মত এক সাথে বসে খেয়ে নেই। হয়তো আর কখনোই আপনার সাথে বসে খেতে পারবো না। গল্প করতে পারবো না।
মা: আজই চলে যাবি মানে কোথায় যাবি? এই শহর কত ভয়ংকর সে কি তুই জানিস না? আগে একটা ব্যবস্থা করে তারপর না হয় বাড়ি থেকে বের হবি।
কিছু হবে না মা, যার কেউ নেই তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট্য এই যে গত পাঁচটি বছরের ও বেশী সময় আমি এখানে ছিলাম। এই ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছিলেন বলেই থাকতে পেরেছিলাম। এখন যদি আল্লাহ চান আমাকে অন্য ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারবেন।
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মায়ের চোখে পানি টলমল করছে। তাই মাকে হাসানোর জন্য বললাম এখন কি খাওয়ার জন্য যাবেন? নাকি এ বাড়িতে আমার রিজিক সকালেই শেষ হয়ে গেছে?
মা: দু’হাতে চোখের পানি মুছে কি বলিস এসব। দু’জন এক সাথে নিচে নেমে আসলাম। ডাইনিং এ এসে সাবাকে ডাক দিতেই সাবা দ্রুত চলে আসলো ডাইনিং এ। এসে রোজকার মত মায়ের পাশের চেয়ারটাতেই বসলো। মা সাবার মুখে তুলে খায়িয়ে দিচ্ছে আমি জানি এই দৃশ্য আর কোন দিন দেখতে পারবো না। আমার কাছে ক্যামেরা থাকলে শেষ বারের মত ঘটা এই দৃশ্যটা আমি ক্যামেরা বন্দী করে রাখতাম। মায়ের চোখে পানি চলে এসেছে হয়তো মাও বুঝতে পারছে এরপর আর কেউ নানু নানু বলে ছুটে আসবে না তার কাছে। হয়তো এইটুকুন বাচ্চা মেয়েটা আর জ্বালাবে না তাকে। সেই দুই বছর বয়সে আসা সাবা আজ সাত বছর বয়সের বেশী হয়ে গিয়েছে। আদর যত্ন মায়া মমতা কোন কিছুর কমতি ছিলো না মায়ের।
তবুও দিন শেষে সব মায়েরাই চাইবে তার ছেলেটা কিংবা তার মেয়েটা ভালো থাকুক। এর জন্যইতো সারাটা জীবন এতো কষ্ট করা। নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে তাদের মানুষ করা।
দুই মগ গরম গরম চা করে নিয়ে এসে, এক কাপ মায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম আর এক কাপ নিজের কাছে রাখলাম। মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, আমি যদি কোন অন্যায় করে থাকি তবে আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনোই আপনাকে কষ্ট দেইনি বা দিতে চাইনি তবুও যদি আমার ব্যবহারে আপনি কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে ক্ষমা করে দিবেন। আমি জানিনা আমি আল্লাহর দুনিয়াতে কি অন্যায় করেছি যার শাস্তি সরূপ আমি তিন তিনটা মাকে হারাতে চলেছি।
মা: আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে রত্নারে আমার হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি পৃথিবীর কাউকেই দেখাতে বা বুঝাতে পারবো না। আমি জানি আমি তোর প্রতি অন্যায় করছি, যা করছি তা ঠিক না। কিন্তু আমি তোদের বুঝাতে পারবো না। আমার কেমনটা লাগছে।
ইনশা আল্লাহ মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কোন রকম চিন্তা করবেন না। আর হ্যাঁ নিয়মিত ঔষধ খাবেন। আমি ভালোই থাকবো আমাকে নিয়ে সাবাকে নিয়েও একদম চিন্তা করতে হবে না না।
মা: কিন্তু তোরা যাবি কোথায়?
আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে আল্লাহ যেখানে রিজিকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেখানেই যাবো।
বাড়ি থেকে বের হবার ঠিক আগ মুহুর্তে মা তার নিজের গলা থেকে সোনার চেইনটা খুলে সাবার গলায় পরিয়ে দিলেন। আমি অনেক নিষেধ করলেও মা শুনলেন না।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলাম। বেশী দেরী করলে স্যার চলে আসবে আর তখন বের হওনা সম্ভব হবে না। সোজা রওনা হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আসতে আসতে রাত আটটা বেজে গেলো। টিকিট কাটতে যেয়ে জানতে পারলাম রাত সাড়ে দশটার আগে কোন বাস ছাড়বে না রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। কাউন্টারে বেশী সময় বসে থাকতে পারবো না। তাই সাবাকে নিয়ে একটা হোটেলে যেয়ে বসে সাবার জন্য নাস্তা কিনে খাওয়াতে শুরু করলাম। সময় যেনো কাটতে চায় না। প্রতিটা মিনিট কতটা কষ্টে কাটছিলো সে শুধুই আমি জানি। অবশেষে রাত সাড়ে দশটায় বাস ছাড়লো।
দীর্ঘ সময় বাসে বসে থেকে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাস থেকে নামলাম। চিঠিতে থাকা ঠিকানাটা আরেক বার দেখে সে জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।
এতো এতো সকাল সকাল আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন এবং বললেন আপনি জার্নি করে এসেছেন ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনাকেতো তিন দিন সময় দেয়া হয়েছিলো রিপোর্ট জানানোর জন্য আপনি জয়েন করবেন কিনা।
আমি হাসি মুখে জানালাম আসলে ফ্রী ছিলাম তাই চলে আসলাম।
বেসরকারি ভাবে পরিচালিত এই সংস্থার কাজ হচ্ছে উপজাতি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার কার্যকম পরিচালনা করা। আমি সব কিছু বুঝে নিলাম। আমাকে থাকার ব্যবস্থা করা হলো স্কুলের কাছেই দুই রুমের একটা বাসা। নিরিবিলি পরিবেশে বাসাটা বানানো। এখানের বাড়ি ঘর গুলো একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই।
সকাল থেকেই সাবার শরীর খুব অসুস্থ। ভালোই জ্বর এসেছে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেকআপ করে কিছু ঔষধ দিলো।
রাতে বিছানায় বসে রুমনের কাছে চিঠি লেখতে শুরু করলাম। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। কেমন আছে কি করছে জানা খুব দরকার।
জাহাঙ্গীর মাকে অনেক বলর কয়ে বুঝিয়েছে। সারা রাত পুরো শহরের অলিতে গলিতে রত্নাকে খুঁজেছে কোথাও ওদের পায়নি।
পরদিন সকাল থেকেই আমি আদিবাসী শিশুদের পড়াতে শুরু করলাম। জীবনের আরেক সংগ্রাম শুরু হলো আমার। একজনকে দিয়ে চিঠিটা পোষ্ট করে দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। রুমন চিঠিটা পেলে নিশ্চই উত্তর দিবে এ বিশ্বাসে।
চলবে…
হারানো সুর- ১৯ তম পর্ব
শাহররিয়ার
সাবার শরীরের জ্বর কমেনি খুব চিন্তা হচ্ছে। সাবাকে রেখে বিকেলে আমি একাই ডাক্তারের কাছে আসলাম। এবং তাকে সবটা জানালাম।
ডাক্তার: দেখুন ভয়ের কোন কিছু নেই, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আসলে আবহাওয়ার পরিবর্তনটা ও মানিয়ে নিতে পারেনি। দুই চার দিনের ভিতর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আরও কিছু ঔষধ দিচ্ছি চালিয়ে নিন।
ডাক্তার আরও কিছু ঔষধ দিলো, আমি সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। সাবার পাশে বসে ওর মাথা হাতিয়ে দিচ্ছি। এমন সময়
সাবা: মা আমরা নানু বাড়িতে যাবো না?
তুমি বড় হলে আমরা যাবো। আমি যে চাকরি নিয়েছি মা। অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে পড়াবো তোমার মত।
সাবা: নানু, আংকেল আসবে না আমাদের সাথে দেখা করতে?
হুম আসবেতো তুমি বড় হলেই আসবে এখন কথা না বলে চুপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকো।
সাবা চুপ করে শুয়ে রইলো। আমি উঠে যেয়ে ব্যাগ খুলে ডায়েরিটা বের করে নিয়ে এসে সাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম।
ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা থেকে: আমার তেমন ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই, আজ কত বছর পর ডায়েরিতে লেখছি তা মনে করতে পারছি না। বেশ কিছুদিন আগে রত্না নামক একটা মেয়েকে বাসায় নিয়ে এসেছি ওর সাথে ছোট একটা বাচ্চা মেয়েও রয়েছে নাম সাবা। খুবি মিষ্টি চেহারা বাচ্চা মেয়েটার আমার ভীষণ ভালো লাগে সাবার সাথে খেলা করতে।
অপর পৃষ্ঠায়: দেখতে দেখতে ছয় মাসের বেশী ওরা দু’জন আমার বাড়িতে। মাকে টুকটাক কাজে সহযোগিতা করে। মা রত্নাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। যখন জেনেছে মেয়েটা খুব অসহায় ওর কেউ নেই। সবচেয়ে বড় কথা স্বামী পরিত্যাজ্য। মা চায় মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। শিক্ষিত হবে। সকলে মিলে এক সাথে ঈদের মার্কেটিং করলাম। বাসায় এসে মেয়েটাকে খুব কান্নাকাটি করতে দেখে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আমার মনে হলো মেয়েটা তার স্বামী সংসারের কথা মনে করেই কাঁদছে। তাই আমি ঈদের পর দিন সেখানে চলে আসলাম সকল ঘটনা জানার জন্য। বাসায় জানে আমি কলিগের গ্রামের বাড়িতে এসেছি। কিন্তু না আমি এসেছি রত্নার শ্বশুড় বাড়িতে। কিন্তু ওর স্বামীকে পেলাম না। সে সত্যি সত্যিই বিয়ে করেছে আর সে স্ত্রীকে নিয়েই তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।
সব কিছু আমি জানতে পারি রত্নার শাশুড়ির কাছে। সত্যিই রত্নার শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। আমি উনার কাছে মিথ্যা বলতে পারলাম না। বলে দিলাম রত্না আমার বাড়িতেই আছে। উনি কান্না করে দিলো। দু’হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললো আমার মেয়ে আর নাতনীটাকে দেখে রাখবেন বাবা। এই অশান্তি থেকে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে আমি আল্লাহর কাছে নামায শেষে ওর ভালোর জন্য দোয়া করি। আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে বাবা। এখানে থাকলে আমার নাতনী রত্না কেউ বাঁচতো না।
আরও অনেক কথা হলো উনার সাথে। আশেপাশের মানুষ জনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম রত্না সত্যিই খুবি ভালো একটা মেয়ে ছিলো। স্বামীটার চরিত্র খারাপ হওয়াতে আর সংসার করতে পারলো না।
আমি রত্নার স্বামীকে বুঝিয়ে রত্নাকে তার কাছে ফেরৎ দেবার জন্য গেলেও। রত্নার শাশুড়ি আর গ্রামের অন্য মানুষ জনের কথায় বুঝতে পারলাম তাকে আর এখানে ফেরৎ পাঠানো যাবে না। আসলে সে চলে যেয়ে খারাপ কিছুই করেনি। বরং ভালোই করেছে। এখানে থাকলে হয়তো তিলে তিলে মারা যেতো মেয়েটা। সব কিছু জানার পর মেয়েটার প্রতি খুব মায়া হচ্ছে।
এরপর, এক বছরের বেশী সময় রত্না আমাদের বাড়িতে, আজ ওর ইন্টার এক্সাম ছিলো আমিই সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অফিসের কাজে আটকে যাবার কারণে আসতে দেরী হয়ে যায়। কিন্তু রত্নাকে আমি যেখানে দাঁড়াতে বলেছিলাম ও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। রোদ্দে ঘেমে মেয়েটা একাকার হয়ে গিয়েছিলো।গাড়ির ভিতর বসে যখন হিজাবটা খুলে রাখলো তখন দেখতে পেলাম ওর ফর্সা মুখটা রোদে পুড়ে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। সব দোষই আমার, আমি যদি সময় মত আসতাম তাহলে এমনটা হতো না।
ওকে নিয়ে আইসক্রিম খেলাম। ওর আইসক্রিম খুব পছন্দের আমি বুঝতে পারলাম। আমি অপলক ও খাওয়া দেখে চলেছি ও মাথা নিচু করে খাচ্ছে।
ডায়েরির এই পর্যন্ত পড়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মানুষটা আমার জন্য আমাদের গ্রামে গিয়েছিলো। যাতে করে আমি শাকিলের কাছে যেতে পারি। আমার এই মুহুর্তে আর সামনের পৃষ্ঠা গুলো পড়ার মত সাহস হচ্ছে না। তাই ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিলাম। সাবা ঘুমিয়ে রয়েছে আমি ওর ঘুমন্ত মুখে আলতো করে চুমু এঁটে দিলাম।
দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে গেলো। সাবার শরীরও অনেকটা সুস্থ আমি স্কুলে ক্লাস নিচ্ছি এমন সময় পরিচিত একটা কণ্ঠ দরজার বাহির থেকে বুবু বলে ডেকে উঠলো। আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আমি এই ডাকটা শুনতে পেলাম। রুমন এসেছে, আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও চিঠি পায়নি, তাই কোন উত্তর আসেনি। কিন্তু ও নিজেই আমার সাথে দেখা করতে ছুটে এসেছে। আমার দু’চোখে পানি টলমল করছে। আমি ছুটে যেয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।
রুমন ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
রুমন: বুবু কতদিন পর তোমাকে দেখছি, তোমার মুখটা এতো মলিন হয়ে আছে কেন? আমাদের সাবা বুড়িটা কোথায় কেমন আছে?
আমি বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে দিলাম। সাবা ভিতর থেকে বের হতেই দেখিয়ে দিলাম। রুমন ছুটে যেয়ে সাবাকে কোলে তুলে নিলো। রুমনকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। রুমন আর সাবা দুষ্টমি করছে, কেমন আছিস ভাই?
রুমন: খুব ভালো আছি বুবু কতদিন পর তোদের দেখা পেয়েছি আমি কি ভালো না থেকে থাকতে পারি?
চাচা, চাচী কেমন আছে?
রুমন: হুম দু’জনেই ভালো আছে। মা বাবা তোকে খুব করে মনে করে। তোর জন্য কিছু খবর আছে।
কি?
রুমন: তোর শাশুড়ি আর শাকিল ভাই দু’জনেই মারা গেছেন।
আম্মা মারা গেছেন কথাটা শুনে যেন হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে। খুব কষ্ট লাগছে আমার মেয়েটা অল্প বয়সে এতিম হয়ে গেছে। কি করে হলো এমনটা?
রুমন: তোর শাশুড়ি তুই চলে আসার পর থেকেই অসুস্থ থাকতো শাকিল ভাই তেমন কেয়ার করতো না। তুই আসার বছর খানিক পরেই উনি মারা যান। ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে দিয়ে এটা শাকিল ভাই তোকে দেবার জন্য আমাকো দিয়েছিলো।
আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
প্রিয়, রত্না জানিনা কোথায় আছো, কেমন আছো? তবে বিশ্বাস করি আমার কাছ থেকে চলে যেয়ে ভালোই আছো। কেননা আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার সাথে বেঈমানি করেছি। তোমার ভালোবাসা নিয়ে করেছি প্রতারণা। তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আর অভিমান নিয়েই এ বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে গেছো। আমি নষ্ট ছিলাম না। কিন্তু তোমার মনে আছে সাবা হবার কিছুদিন পর আমি বন্ধুদের সাথে ঢাকা শহরে বেড়াতে যাই। সেখান থেকেই আমার নষ্ট হওয়া শুরু হয়। ওদের পাল্লায় পরে আমি অন্য নারীতে আসক্ত হই। যেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারিনি। হয়তো তুমি কোন দিনও জানতে না যদি আমি ধরা না খেতাম আর আমার বিয়ে না হতো। আমি তোমার সাথে আর মায়ের সাথে যে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আল্লাহ আমাকে দিতে ভুল করেন নি। এটকু দেরীতে হলেও আল্লাহ তার শাস্তি দিয়েছেন। আমার শরীরে ক্যান্সার ধরা পরেছে। আমি জীবনের শেষ মুহুর্তে রয়েছি। জানি না আর কতদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাবো। তোমাকে আর সাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি তোমাদের অনেক জায়গায় খুঁজেছি। জানি পাবো না, তবুও খুঁজেছি। জানি তোমাদের না দেখার অপূর্ণতা নিয়েই আমাকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে। আমার খারাপ সময় দেখে দ্বিতীয় স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে। আমার যাবতীয় সম্পত্তি আমি তোমার আর সাবার নামে লেখে দিয়েছি। যার দলিল রুমনের কাছে আমি দিয়ে দিচ্ছি। যদি কখনো পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো খুব ভালো থেকো।
এরপর আর কিছুই লেখা নেই। নিজের চোখের পানি মুছে নিলাম। না শাকিলের মৃত্যুতে আমার খুব কষ্ট লাগছে না। সে তার শাস্তি পেয়েছে। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। কষ্ট লাগছে মেয়েটার জন্য, সে আমার মতই অল্প বয়সে বাবা ছাড়া হয়েছে। যদিও সারাটা জীবন আমি ওকে বাবা ছাড়াই মানুষ করতাম। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট লাগছে।
রুমন: বুবু কাঁদিস না। আল্লাহ যা করেন সকলের ভালোর জন্যই করেন। চল গ্রামে ফিরে যাবি। তুই না বলেছিলে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে। বুবু আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। আমি এখন একজন ইঞ্জিনিয়ার। তোর আর সাবার দায়িত্ব নিতে আমার একটুও কষ্ট হবে না।
রুমন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি আর গ্রামে ফিরবো নারে। আমি এখানেই ভালো আছি। দোয়া করি তুই অনেক বড় হবি একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবি।
রুমন: কি বলো বুবু তোমাকে ছাড়া আমি বাড়ি ফিরবো না। আর আগামি মাসে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছে। তুমি না গেলে সব আয়োজন কি করে হবে?
ঠিক আছে আমি তোর বিয়ের আগেই চলে যাবো বাড়িতে তবে। শুধু তোর বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। তারপর আমি আবার ফিরে আসবো।
বিকেলে আমি রুমন আর সাবা বের হলাম ঘুরার জন্য। রুমন মার্কেট থেকে আমাকে একটা মোবাইল আর সিমকার্ড কিনে দিলো। ওর নাম্বারটা সেইভ করে দিলো। বললো এখন আমরা যতটা দূরেই থাকি না কেন আমাদের রোজ কথা হবে।
রুমন দুই দিন থেকে গ্রামে চলে গেলো। আমার জীবনের সংগ্রাম চলতেই থাকলো। বাচ্চাদের স্কুলে আমি সাবাকেও পড়াচ্ছি। সাবাও ওদের সাথে মিলে বেশ আনন্দেই আছে মাঝে মাঝে মা আর স্যারের কথা জানতে চায়। আমি ওর প্রশ্নের জবাবে শুধু বলি তুমি বড় হলে নানু আর আংকেল তোমার সাথে দেখা করবে। তার জন্য তোমাকে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হতে হবে। সাবা কি বুঝে জানি না, সে খুশি হয়ে বলে আমি অনেক পড়ালেখা করবো।
অবসর সময়ে আমি মাঝে মাঝেই স্যারের লেখা ডায়েরিটা পড়ি। এ মানুষটা কেমন করে জানি আমাকে ভালোবেসে ফেলে। এতোটা ভালোবাসে অথচ মুখ ফুটে কখনো বলেনি। হয়তো বলার সুযোগই তৈরি হয়নি। মানুষটাকে আমিও অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভাগ্যে না থাকলে অনেক কিছু চেয়েও পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝেই ডায়েরিটা পড়ে দু’চোখের পানি ফেলি সকলের অগোচরে।
চলবে…