হারানো সুর-২০তম পর্ব,২১তম পর্ব
শাহরিয়ার
২০তম পর্ব
আজ অনেক গুলো বছর পর গ্রামের বাড়ি আসলাম রুমনের বিয়ে উপলক্ষে। দুই বছরের সাবা এখন সাত বছরের হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই রুমন দৌঁড়ে আসলো। পুরো রাস্তায় ফোনের পর ফোন করেছে। সেই ভোর থেকে এসেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাত দিয়ে সাবাকে কোলে নিয়ে,
রুমন: বুবু আসতে কোন কষ্ট হয়নিতো?
না কষ্ট হয়নি, কেমন আছিস তুই?
রুমন: “আলহামদুলিল্লাহ” খুবি ভালো আছি।
রুমন সাথে করে রিক্সা নিয়ে এসেছিলো। রিক্সায় বসে গল্প করতে করতে চলে আসলাম বাড়ির সামনে। রিক্সা থেকে নামতেই রুমন বাবা মা বলে ডাকতে ডাকতে সাবাকে কোলে নিয়ে, বাড়ির ভিতর ঢুকলো। আমি রুমনের পিছু পিছু ভিতরে ঢুকলাম। বাড়িটা আমার কত দিনের চেনা। এ বাড়িতেই কেটেছে শৈশব কিশোরের দিন গুলো।
বাড়ির ভিতর ঢুকতেই চাচা চাচী ছুটে আসলো। বেশ ভালোই বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে দু’জনের মুখেই। চাচা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করলো কেমন আছি। চাচি শাড়ির আচল দিয়ে মুখটা চেপে ধরে কাঁদছে। আমি হাত বাড়িয়ে দু’জনকে ধরে বললাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে যেভাবে রেখেছেন খুব ভালো রেখেছেন। তোমরা কেমন আছো? কতদিন পর তোমাদের দেখলাম। টুকটাক কথা বলতে বলতে সেই পুরাতন আমার রুমটাতে ঢুকে পরলাম। ভিতরে ঢুকতেই আর পুরাতন মনে হলো না ঘরটা। নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কাভার। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো রুমটা। রুমন সেই আগের মতই আমার ঘরের খেয়াল রাখে।
ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলাম। আজ কত গুলো বছর পর সকলে এক সঙ্গে নাস্তা খেতে বসলাম। চাচী অনেক রকম পিঠা বানিয়েছে আমারা আসবো তাই। পুলি পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, রসে ভিজানো চিতই, ভাপা পিঠা, হরেক রকম নকশী পিঠা দিয়ে পুরো টেবিল সাজানো।
সাবা: চোখ বড় বড় করে এতো পিঠা।
রুমন: হাসতে হাসতে সব আমার মামুনি খাবে।
সাবা: না না আমি এতো খাবো না। আমিতো সব গুলো থেকে একটা একটা করে খাবো।
ওর কথায় সকলে হেসে উঠলাম। নাস্তার পর্ব শেষ করার পর নিজের রুমে চলে আসলাম সাবাকে নিয়ে। রাতে গাড়িতে করে এসেছি তাই ঘুম হয়নি ঘুমানোর দরকার। আসার সময় রুমনকে বললাম বিকেলে তোর শ্বশুড় বাড়ি থেকে লোক আসার আগে আমাদের ডেকে তুলিস।
রুমন: দুপুরে খাবা না তোমরা? না খেলেতো শরীর খারাপ করবে।
কিছু হবে নারে, যখন উঠবো তখন খেয়ে নিবো।
রুমন আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের রেস্ট করার সুযোগ করে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি সাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলাম। এরপর গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে গেলাম।
দুপুর আড়াইটার সময় ঘুম ভাঙলো, চাচীর ডাকে।
চাচী: মাথা হাতিয়ে দিতে দিতে মা রুমন তোদের উঠতে বললো। ওরা নাকি চারটার সময় আসবে। তোরা উঠে গোসল করে খাওয়া করে নে।
আমি উঠে বসলাম, আমি বেশ বুঝতে পারছি আমি না খেয়ে থাকবো একবেলা রুমন তা হতে দিবে না। চাচীকে বললাম তুমি যাও আমি সাবাকে নিয়ে আসছি। চাচী ঘর ছেড়ে বের হতে আমি সাবাকে ডেকে তুললাম। মা মেয়ে জামা কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে দুপুরের খাবার ভেয়ে নিলাম। সাড়ে চারটার দিক কনের বাড়ি থেকে লোকজন আসলো। উনাদের আপ্যায়ন আর গল্প করতে করতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেলো। দুই পক্ষের মাঝে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো আগামি কাল বর কনে দু’জনেরই গায়ে হলুদ দেয়া হবে সন্ধ্যার পর পর। এরপর কনে পক্ষের লোকজন বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
পরদিন নাস্তার পর আমি রুমনকে বললাম আমার সাথে পাশের গ্রামে, মানে আমার শ্বশুড় বাড়িতে যাবার জন্য।
রুমন: কি করবা বুবু ঐখানে যেয়ে। যেখানে কেউ নেই।
কেউ নেই তাতে কি ঐখানে আমার অনেক অনেক স্মৃতি জমা রয়েছে।
রুমন আমি আর সাবা রওনা হলাম আমার শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির চাবি রুমনের কাছে। শাকিল মারা যাবার পর রুমন তাকে মাটি দিয়ে বাড়ি তালা মেরে চাবি সাথে করে নিয়ে যায়। কেননা শাকিল মারা যাবার আগে এ বাড়ি সাবার নামে লেখে দিয়ে গিয়েছে। আর সাবাই হচ্ছে মির্জা বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। আমাদের বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখে আসে পাশের অনেকেই আমাদের দেখার জন্য ছুটে আসলো।
প্রতিবেশীরা আমাকে বললো কোথাও না যেয়ে থেকে যাবার জন্য। যে সম্পত্তি রয়েছে তা আমি আর সাবা সারা জীবনেও শেষ করতে পারবো না। আমি তাদের বললাম সম্পত্তির লোভ আমার কোন দিনই ছিলো না থাকলে আমি এখান থেকে কখনোই যেতাম না। তার চেয়ে বরং আপনারা দোয়া করবেন আমি যেখানেই থাকি যেন আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি। মেয়েটাকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। তাদের আরও জানালাম, যত জায়গা জমি রয়েছে সব রুমন দেখা শোনা ও আবাদ করবে। মানুষ জন কমার পর আমি আমাদের থাকার রুমে ঢুকলাম অসংখ্য স্মৃতি জড়ানো রুমটাতে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো অসংখ্য পুরনো স্মৃতি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে। সে সব স্মৃতি মধুময় দিন গুলোর কথা ভাবতেই।
সাবা: শাড়ির আঁচল টেনে ধরে মা তুমি কাঁদছো কেন?
কিছু না মা এমনি। এটা তোমার বাড়ি, তোমার গ্রামের বাড়ি। রুমনের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি মা আর শাকিলের কবর দেখতে যাবো দূর থেকে দেখেই চলে আসবো। রুমন আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো। আমি দূর থেকে তাদের দু’জনের জন্য দোয়া করে বিকেলের আগে আগে চলে আসলাম বাড়িতে।
সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। এ বাড়ি ঐ বাড়ি দুই বাড়িতে গায়ে হলুদ দিতে দিতে রাত হয়ে এলো। পুরো বাড়ি মেহমানে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। পরদিন বিয়ের আয়োজন পুরো বাড়ি আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যার পর পর আমরা কনের বাড়িতে এসে পৌছালাম। সময় মত বিয়ে হয়ে গেলো। একে একে বিয়ের সব আয়োজন শেষ হয়ে গেলো। দুই দিন কেটে গেলো আমার ছুটিও শেষ হয়ে এলো। রুমন আর ওর নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসলাম রাঙা মাটি। সকালে বাচ্চাদের পড়াচ্ছি আর বিকেলে ওদের নিয়ে ঘুরতে বের হচ্ছি। উচু উচু পাহাড়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা কাপাই হ্রদ, কখনো বা ঘুরে বেড়িয়েছি ঝুলন্ত ব্রীজ। এভাবেই কেটে গেলো আরও সাতটি দিন।
রুমন, ওর নতুন বউ সাবা সকলেই বেশ খুশি। সাবা এর আগে কখনো এতো ঘুরাঘুরি করেনি। আমারও মন বেশ ভালো হয়ে গেলো। নতুন করে যেন আমার জীবনে সব কিছু শুরু হলো। রুমন বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আবারও একা হয়ে পরলাম। সকালে স্কুল করে বাড়ির টুকটাক যে সকল কাজ থেকে সব শেষ করে সাবাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে পরি। যখন যেখানে মন চায়। রাতে ফিরে এসে সাবাকে পড়াতে বসাই। আর যখন মন খুব খারাপ থাকে তখন বের করি স্যারের লেখা ডায়েরিটা। স্যারের কথা মায়ের কথা অনেক মনে পরে। নিজেকে বুঝিয়ে রাখি। স্যার ঝর্ণাকে বিয়ে করুক। তাকে নিয়ে সুখে থাকুক এতে করে মা ভালো থাকবে স্যার ও ভালো থাকবে।
দিন গুলো কেটে যাচ্ছে বেশ ভালোই খারাপ বলা যাবে না। দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেলো। সাবাকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করাতে হবে। রুমনকে ফোনে বললাম আমি চাই ও ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক, অনেক বড় হোক। তার জন্য যদি ওকে দূরে কোথাও রেখে পড়াতে হয় তবে তাই করবো।
রুমন প্রথমে ওর কাছে রেখে পড়াতে বললো। আমি মানা করলাম। বললাম ওকে একা একা লড়াই করতে শিখতে হবে। রুমন বললো তাহলে ও ঢাকায় কোন ভালো স্কুলে যেয়ে কথা বলবে। যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি ভালো থাকার পরিবেশ থাকবে। রুমন ভালো একটা স্কুলের খোঁজ জানালো। আমি সাবাকে নিয়ে গেলাম সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলাম।
সাবা অনেক কান্নাকাটি করলো সে একা থাকবে না। আমি অনেক বুঝিয়ে রেখে আসলাম তাকে। হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। আমিই বা কি করে একা থাকবো তাকে ছেড়ে। তবুও নিজেকে নিজের মনকে পাথরের মত শক্ত বানিয়ে তাকে রেখে চলে আসলাম রাঙামাটিতে। আমার ছোট বাড়িটা একদম নিরবতায় ভরে গেলো। চারিদিকে শূন্যতার হাহাকার। প্রতিটা মুহুর্তে যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। কষ্টের মুহুর্তের দিন গুলোও যেন কাটতে চাচ্ছিলো না। রুমনকে জানানোর পর ও স্ত্রীকে আর ছোট ছেলেটাকে নিয়ে বেড়াতে চলে আসলো আমার এখানে। এক বছর আগে ওদের ঘর আলো করে এসেছে ছোট শিশুপুত্র দেখতে অবিকল রুমনের মত। ওরা আসায় পুরো বাড়িটা আবার আনন্দে ভরে উঠলো। মন আবার ভালো হয়ে গেলো। রুমন আর ওর স্ত্রী আমাকে ভরসা দিয়ে চলেছে যা হবে ভালোই হবে মন খারাপ করো না। দেখবে একদিন সাবা আমাদের সকলের মুখ উজ্জল করবে। আমিও সেই বিশ্বাস করি। রুমনরা চলে গেলো। আমি প্রতি তিন মাসে একবার করে যেয়ে সাবাকে দেখতে আসতে লাগলাম আর ঈদের সময় ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি। এভাবেই কেটে গেলো আরও দশটি বছর।
হঠাৎ এক রাতে আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠে অপরিচিত এক নাম্বারে। আমি ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত এক কণ্ঠ বলে উঠলো রত্না?
আমার সমস্ত পৃথিবী যেন আরেক বারর উত্তাল পাতাল করে দিলো। সেই কণ্ঠ স্বর। আমার মাঝে এক শীতল প্রবাহ বয়ে যেতে শুরু করলো সে কণ্ঠ শুনে। আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে সে কণ্ঠ আরেক বার বলে উঠলো রত্না।
চলবে…
হারানো সুর-২১তম পর্ব
শাহরিয়ার
স্যার আপনি এতো বছর পর, কেমন আছেন আর আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
জাহাঙ্গীর: সব প্রশ্নের উত্তর পাবে, তবে তোমাকে আমার বাড়িতে আসতে হবে।
কেন স্যার? আমি যেতে পারবো না ঐ বাড়িতে।
জাহাঙ্গীর: সাবা কোথায় তুমি কি জানো?
সাবার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কোথায় মানে? ওরতো মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে থাকার কথা।
জাহাঙ্গীর: সাবা এখন আমার বাসায়। তাই তোমাকে এখানে আসতে হবে।
কিছু মুহুর্তের জন্য সব কিছু থমকে গেলো। সাবা কি করে স্যারের বাসায় গেলো। ফোনটা কেটে দিলাম, জীবন থেকে এতো গুলো বছর কেটে গিয়েছে বহুবার ঢাকায় গেলেও কখনো স্যারের সামনে যাবার সাহস পাইনি। এই ভেবে মানুষটা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক সংসার করুক। মাকে যে আমি কথা দিয়েছিলাম আমি বহুদূর চলে আসবো। স্যারের জীবন থেকে সরে।
না কিছুই ভেবে পাচ্ছি না সাবা কি করে স্যারের বাড়িতে গেলো। সাবার নাম্বারটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। রুমনকে কল দিয়ে জানালাম ঢাকায় আসার জন্য। আমি ভোরের গাড়িতে ঢাকার পথে রওনা দিবো।
সারাটা রাত নানান চিন্তায় কেটে গেলো ঘুমতে পারলাম না। এই মানুষটার সামনে আমি কি করে যেয়ে দাঁড়াবো। এতো গুলো বছর কেটে গেছে অথচ মানুষটার কণ্ঠের একটুও পরিবর্তন হয়নি। নিশ্চই ঝর্ণার সাথে বিয়ের পর উনার ছেলে মেয়ে হয়েছে তারাও অনেক বড় বড় হয়ে গিয়েছে। নানান রকম চিন্তায় পুরো রাত আর ঘুম আসলো না। ফজরের নামায আদায় করে। এক কাপ চা বানিয়ে খেয়ে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠে বসতেই আবারও স্যারের কল আসলো। স্যার জানালো ভয়ের কোন কারণ নেই সাবা ভালো আছে।
রুমনকে কল করে জানিয়ে দিলাম তিনটার দিকে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসার জন্য। সারাদিন শুধু পানি ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। বাস থেকে নামার পর রুমনকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে রুমন একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। আমি বললাম তোর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তুই পেয়ে যাবি। মনের ভিতর ভয় বাসা বেঁধে রয়েছে। গত পনেরোটা বছর বুকের ভিতর যে কষ্ট মাটি চাপা দিয়ে রেখেছি তা যদি আবারও সামনে চলে আসে।
প্রায় আধঘন্টা পর বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি চলে আসলো। হর্ণ বাজাতেই দারোয়ান দরজা খুলে বের হয়ে আসলো। স্যারের নাম বলতেই দরজা খুলে দিলো। হয়তো স্যার আগে থেকেই বলে রেখেছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে ভিতরে ঢুকলাম, আর রুমনকে বললাম গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে।
বাড়ির ভিতর পা ফেলতেই একটা প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো সমস্ত শরীরে। এই বাড়ির প্রতিটা স্তর আমার পরিচিত। দীর্ঘ পাচটি বছর এ বাড়িতে কাটিয়েছি। ছোট ফুলের বাগাানটি ঠিক আগেরই মত আছে শুধু মাঝে একটা দোলনা লাগানো হয়েছে। হয়তো স্যারের সন্তানদের জন্য। সবকিছু ঘুরে ফিরে দেখছি চোখ বেয়ে কেন জানি পানি পরছে, এমন সময় রুমন।
রুমন: বুবু আমি কিন্তু কিছুই বুঝতেছি না, কোথায় এলাম কার বাড়ি আর কেনই বা এলাম।
অন্যদিকে ঘুরে ছিলাম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে রুমনের দিকে ঘুরে তাকালাম। মুখে হাসি ফুটিয়ে রুমনকে বললাম তোর মনে আসে তোকে বলেছিলাম ঢাকায় আমি একটি বাড়িতে আশ্রিতা ছিলাম। যারা আমাকে সাবাকে নিজের পরিবারের মত দেখেছিলো। এটা সেই বাড়ি। আমার কথা শুনে রুমন বলে উঠলো বলিস কি,।হঠাৎ এতোদিন পর কেন এ বাড়িতে?
বাড়ির ভিতরে চল সব জানতে পারবি। বলে দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল দিলাম। সম্ভবত কাজের বুয়া রেখেছেন একটু বয়স্ক করে উনি এসে দরজা খুলে দিলো। আমি ভিতরে ঢুকে স্যারের কথা জানতে চাইলে উনি বসতে বললো আর জানালো স্যার উপরে রয়েছে।
ঘরের দেয়ালের রঙ, থেকে শুরু করে সব কিছুই আগের মতই আছে এই পনেরো বছরে কোন কিছুর পরিবর্তন হয়নি। হঠাৎ দুতলার সিঁড়ি ধরে স্যারকে নামতে দেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সব কিছু আগেরী মত থাকলেও এই মানুষটা আগের মত নেই। চুল সাদা হতে শুরু করেছে আগের চেয়ে বেশ খানিকটা মোটা হয়েছে, তবে চোখ দু’টো সেই আগের মতই মায়াময়ী রয়েছে। আমি যেন সে চোখে তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে মাথা নিচু করে নিলাম। স্যার নিচে নেমে আসলো।
জাহাঙ্গীর: কেমন আছো রত্না?
“আলহামদুলিল্লাহ” ভালো আছি স্যার আপনি কেমন আছেন, মা আর ভাবী বাচ্চারা কোথায়?
জাহাঙ্গীর: একটু হেসে নিয়ে “আলহামদুলিল্লাহ” আমিও ভালো আছি।মা আর এই পৃথিবীতে নেই, চা খাবে?
মা নেই শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো, চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো। দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রুমনকে বললাম বসে থাকার জন্য। আমি হাঁটা শুরু করলাম কিচেন রুমের দিকে। কেন জানি অন্য কারো হাতের চা খেতে ইচ্ছে করলো না কিংবা এতো গুলো বছর পর স্যারকে চা করে খাওয়ানোর সুযোগটাই হাত ছাড়া করতে চাইলাম না।
কিছু সময় পর চা নাস্তা নিয়ে চলে আসলাম। ততক্ষণে রুমন আর স্যার নিজেদের ভিতর পরিচয় পর্ব সেরে নিয়েছে। চা খেতে খেতে স্যারকে প্রশ্ন করলাম, সাবা কোথায়?
জাহাঙ্গীর: এখন ভালো আছে ঘুমাচ্ছে।
স্যার ভাবী বাচ্চারা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। উনারা কোথায়?
জাহাঙ্গীর: রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বিয়ে করিনি রত্না। তুমি চলে যাবার পর আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি পুরো শহর দিনের পর দিন খুঁজেছি। এক থানা থেকে আরেক থানা, হসপিটাল এমন কোন জায়গা নেই তোমাকে খুঁজিনি। কিন্তু কোথাও তোমাকে খুঁজে পাইনি। একটা সময় মা বুঝতে পারে আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর অন্য কোন মেয়ে আসতে পারবে না। তাই মা ও হাল ছেড়ে দিয়ে এদিক সেদিক তোমাকে খুঁজতে থাকে। সেও বুঝতে পারে তোমাকে চলে যেতে বলে ভুল করেছে।
ঝর্ণার তবে কি হলো?
জাহাঙ্গীর: স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছে। লন্ডনে থাকে পুরো পরিবার নিয়ে। একটা সময় ঝর্ণা বুঝতে পারে আমি আসলে কখনোই তার হবো না। মেয়ে মানুষ কতদিন অপেক্ষা করবে। মা খালামনিকে বুঝিয়ে বলে সব কিছু। তারপর আর কি ভালো ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন ভালোই সুখে আছে।
আপনার বিয়ে করে নেয়া উচিৎ ছিলো স্যার।
জাহাঙ্গীর: একটা সময় মা মারা গেলেন, আমি ভীষণ একা হয়ে পরলাম। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। বাড়িতে ফিরলে খুব একা একা লাগতো। এতো কষ্ট লাগতো যে বলে বুঝাতে পারবো তোমাকে। অফিসে ওভার টাইম শুরু করে দিলাম। টাকার জন্য না টাকার অভাবতো আমাদের কখনো ছিলো না। কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য দিন রাত ডিউটি শুরু করলাম। একটা সময় বুঝতে পারলাম নিজেকে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছি। তারপর আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করলাম। আমি যখন যেখানেই থাকি যে অবস্থায় থাকতাম তোমাকে খুঁজেছি। আমার দু’চোখ চারিদিকে শুধু তোমাকেই খুঁজে ফিরেছে। এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে। অবশেষে এতো গুলো বছর পর তোমার দেখা পেলাম।
আমি দুঃখিত স্যার, আমি জানতেই পারিনি এতো কিছু হয়ে গিয়েছে আপনার জীবনে। যদি কখনো পারেন আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
জাহাঙ্গীর: এসব কথা ছাড়ো, তুমি কি জানো সাবা মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামি করছিলো?
আমি আর রুমন স্যারের কথায় চমকে উঠলাম কি বলছে এসব। স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। সাবা কখনোই এমনটা করতে পারে না। ও ভালো ছাত্রী, মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করে। ও কেন নেশা করবে?
জাহাঙ্গীর: সাবার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হয়েছে, তবে এটা আসল কারণ নয়, সাবার কথামতে, তোমার কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। যা সে মেনে নিতে পারছে না। ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপের কারণ ও অনেকটা এটাই আর তোমার নাম্বারও আমি সাবার কাছেই পেয়েছি। সাবা দেখতেও অনেকটা তোমার মতই হয়েছে। তাই ওকে চিনতে আমার তেমন অসুবিদা হয়নি। সাবার ভাষ্যমতে ও দুদিন আগে তোমার ঐখানে চলে যায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাআপ হবার পর কিন্তু তোমাকে পায়নি বলে অপেক্ষা করতে থাকে। এক সময় গভীর রাতে তোমাকে একটি কালো গাড়ি থেকে নামতে দেখে ও লুকিয়ে পরে বাড়ির পাশে। গাড়ি থেকে নামতেই গাড়িটা সোজা চলে যায়। কে ছিলো তোমার গাড়িতে, তবে কি ওর বয়ফ্রেন্ড যা বলেছে তার সবই সত্যি? তোমাকে কিছু জানানোর বা তোমার সামনা সামনি হবার সাহস ও যোগাতে পারেনি। তাই ভোর হতেই ও তোমার সাথে দেখা না করে ঢাকায় ফিরে আসে। এরপরেই ও নেশা করে রাতে। আমি ডিউটি শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে রাস্তায় হাঙ্গামা করতে দেখে ছুটে যাই। প্রথম দেখে আমি চমকে উঠি অবিকল তোমার মত চোখ, মুখ। আমি ওর কাছে নাম জানতে চাইলে সাবা বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আমি ওকে বাসায় নিয়ে আসি। এরপর সাবার ফোন থেকে তোমার নাম্বার নিয়ে ফোন করি। বাসায় আসার পর নেশার ঘরে সারা রাত সাবা এসব প্রলাপবাক্য বকতে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছদছেড়ে আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি, রত্না নামক যে মেয়েটাকে আমি চিনি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কখনোই সত্যি হতে পারে না। যদি সে এমনই হতো, তবে আমার ভালোবাসাতে উপেক্ষা করে সে চলে যেতে পারতো না। তবুও আমি জানতে চাই সাবার এমন মনে হবার কারণ কি?
স্যার কথা গুলো বলছিলো আমার চোখ বেয়ে পানি টপটপিয়ে পরছিলো। কি বলবো আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। ইচ্ছে করছিলো এক দৌঁড়ে ছাঁদে উঠে এক লাফে নিজের জীবন দিয়ে দেই। কিন্তু আমি জানি আত্তহত্যা করা মহা পাপ। আমি সে পাপ করতে পারবো না জীবনের এতো গুলো দিন আমি যে আল্লাহকে বিশ্বাস করেই বেঁচে আছি। দুই বছরের সাবা আজ বাইশ বছরের হয়ে গিয়েছে। যার জন্য পুরো জীবনটা শেষ করে ফেললাম সেই আমাকে ভুল বুঝলো। চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীর: প্লীজ কাদঁবে না, আমার খুব কষ্ট হয়, কারণ এতো গুলো বছরের ও আমি তোমার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পারিনি তোমাকে ভুলতে।
আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে, নিজেকে শক্ত করে স্যারের দিকে তাকালাম।
চলবে…