হারানো সুর- ২২তম (শেষ পর্ব)

0
1613

হারানো সুর- ২২তম (শেষ পর্ব)
শাহরিয়ার

স্যার অপলক আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি মাথাটা নিচু করে নিলাম। কারণ আমিও স্যারের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয় বার আর স্যারের দিকে তাকানোর মত সাহস আমার হয়ে উঠলো না। নিজেকে খুব শক্ত করলাম। রুমন একটা হাত আমার হাতের উপর রেখে ভরসা দিচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলাম।

রূপ যৌবন আমার কম ছিলো না, চাইলেই শাকিলের সংসার ছাড়ার পর যে কাউকে বিয়ে করেই আমি সংসার করতে পারতাম। কিন্তু শুধু মাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি করিনি। গ্রামে রেখে যাওয়া ওর বাবার বিপুল সম্পত্তি যদি বেঁচে দিয়ে আরাম আয়েশের জীবন আমি বেছে নিতাম, তাহলে এক জীবনে আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন পরতো না।

আমি আমার জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়েছি শুধু মেয়ের জন্য। সেই ছোট শিশু ছিলো যখন ঘর বাড়ি সব ছেড়ে ছিলাম। এই পৃথিবীতে একা একটা নারীর বেঁচে থাকতে কতটা লড়াই করতে হয় তা ও জানে না। বড় হবার পর সব সময় আমার হাসি মাখা মুখটাই দেখেছে কখনো আমার ভিতরে পুড়তে থাকা ক্ষত বিক্ষত হৃদয়টা ও বুঝার চেষ্টাই করেনি।

এই এতো গুলো বছরে আমার দেহে কোন পুরুষের স্পর্শ পরেনি, এর জন্য আমাকে কম সংগ্রাম করতে হয়নি। এটা আমার মেয়ে না বুঝলেও আপনি বুঝবেন স্যার। আমি ওর ছোট বেলা থেকেই চেয়েছিলাম ও আমার মত শক্ত মনের হোক। তাই বুকে পাথর বেঁধে ওকে আমার থেকে দূরে এই শহরে রেখে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। কত রাত ছটফট করতে করতে ঘুমিয়েছি ওকে দেখার জন্য, শুধু ভয়ে এসে দেখা করিনি। যেন ও আমার সাথে চলে যেতে না পারে।

প্রতিটা ছুটিতে যখন মেয়ে রাঙ্গামাটি আমার কাছে আসতো। তখন প্রতিটা মুহুর্ত আমার কতটা আনন্দে কাটতো স্যার আমি কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না। যখনি হোস্টেলে চলে আসার দিন হতো আমার ভিতরে তীব্র যন্ত্রনা হতো, মনে মনে ভাবতাম আবার কবে আসবে আমার কলিজা। আমি চাইলে মেয়েকে আমার কাছে রেখেই পড়ালেখা করাতে পারতাম। ওর বাবার সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করলে আমাদের জীবনে কোন রকম কষ্ট থাকতো না। আমি তা করিনি হয়তো এটাই আমার সব চেয়ে বড় অপরাধ।

মেয়ের অভিযোগে আমার বিন্দু পরিমাণও কষ্ট লাগেনি স্যার। কষ্ট পেয়েছি এটার জন্য আমি ভাবতাম মেয়ে আমাকে বন্ধু মনে করে আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিলো। স্যার কালো গাড়িটা এখনো আপনার বাড়ির পার্কিং এ রয়েছে। গাড়িটা রুমনের, সেদিন রাতে রুমনই আমাকে নামিয়ে দিতে গিয়েছিলো বাড়িতে। কেননা সাবার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু সম্পত্তি আমার নামে ছিলো। সেগুলো বিক্রি করে গ্রামের বড় বাজারে সাবার নামে থাকা জায়গার উপর আমি একটা হাসপাতাল নির্মান করাচ্ছিলাম। যার পুরো দায়িত্ব রুমনের উপর দেয়া হয়েছে। রুমন সেদিন সে জন্যই আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। রাতে থাকারও কথা ছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই ওর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পরাতে আমিই জোর করে ওকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠাই।

কথা গুলো শেষ করে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না করছি, আমার সামনে বসে থাকা স্যারের চোখ বেয়েও পানি গড়িয়ে পরছে। পাশে বসা রুমনের ও চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। যে মেয়ের জন্য এতো কষ্ট করলাম সে মেয়ের এমন অভিযোগে। হঠাৎই কেউ একজন পেছন থেকে এসে পা জড়িয়ে ধরলো। আমি চমকে তাকাতেই সাবার মুখটা দেখতে পেলাম। এ কি করছিস ছেড়ে দে পা।

সাবা: মা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি, ঐ ছেলের কথায় আমার খুব কষ্ট লেগেছিলো। ছেলেটাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তাই তোমার প্রতি আমার অবিশ্বাস জন্মেছিলো। আর কখনোই এমনটা হবে না। এ জীবনে তুমি আমার সব, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। এমন ভুল আর কোন দিন ও হবে না।

সাবার চোখের পানিতে পা ভিজে যাচ্ছে, মে যত বড়ই অপরাধ করুক, মায়ের মন তাকে অপরাধী বানিয়ে রাখতে পারে না। রত্নাও পারলো না, মেয়েকে তুলে নিয়ে বুকের সাথে লাগিয়ে নিলো। মুহুর্তেই যেন পরম শান্তি ফিরে আসলো রত্নার বুকে। মনে হচ্ছে এতো দিনের ত্যাগ, কষ্ট সব আজ সফল হয়েছে। মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখছে রত্না। যেন আর কোথাও হারাতে না পারে।

স্যার আর রুমনও নিজেদের চোখের পানি মুছে নিলো। মা আর মেয়ের পূর্ণমিলনিতে। পুরো বাড়িটায় আজ বহুদিন পর যেন কোন আনন্দের কারণ খুঁজে পেলো। জাহাঙ্গীর বলে উঠলো, আজ খুব আনন্দ হবে পায়েস হবে পোলাও হবে কথাটা বলেই আবার চুপ হয়ে গেলো। কেননা মা মারা যাবার পর এ বাড়িতে কখনোই এগুলো রান্না হয়নি।

অবশ্যই হবে স্যার, আপনার জন্যই আমার মেয়েটা সুস্থ আছে ভালো আছে, আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো আমি। আর আমি জানি এ খাবার গুলো আপনার খুব প্রিয়। আপনারা বসুন আমি সব তৈরি করে দিচ্ছি।

জাহাঙ্গীর: না মানে বলছিলাম, পোলাওর চাউল, গোশত, দুধ এসব কিনে নিয়ে আসতে হবে।

রুমন: হেসে দিয়ে আপনারা গল্প করুন আমি নিয়ে আসছি।

বলে রুমন বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। সাবাও চায়ের মগ হাতে নিয়ে ছাঁদে উঠে গেলো। সোফায় সামনা সামনি আমি আর স্যার বসে রয়েছে। মানুষটার উপর দিয়ে আমার চাইতেও অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিলো না।

জাহাঙ্গীর: কোথায় হারালে রত্না?

স্যারের এমন প্রশ্নে চমকে উঠে কোথাও না স্যার।

জাহাঙ্গীর: এতো গুলো বছরে আমাকে মনে পরেনি কখনো?

মনে পরবে না কেন? যখন খুব বেশী মনে পরেছে তখন আপনার লেখা ডায়েরিটা পরেছি আর দু’চোখের পাতা ভিজিয়েছি।

রান্না করে খেতে খেতে গভীর রাত হয়ে গেলো। তাই রাতে ফিরতে পারলাম না। যে ঘরটায় দীর্ঘ পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি সে ঘরেই সোবার জন্য এসে চমকে উঠলাম। ঘরটা আগের মতই সাজানো গুছানো রয়েছে। বরং ঘরের দেয়ালে আমার আর সাবার ছোট বেলার বেশ কিছু ছবি টাঙ্গানো। ছবি গুলো স্যারের একটি জন্মদিনে তোলা হয়েছিলো। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো।

সাবা ঘুমিয়ে পরলেই সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। সকালে স্যার আর রুমন উপর থেকে নেমে আসলো, ততক্ষণে আমার নাস্তা বানানো শেষ হয়ে গিয়েছে। সকলে এক সাথে নাস্তা খেয়ে নিলাম। বিদায় লগ্নে এসে যেন হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। স্যারের চোখ দু’টো ভয়ংকর রকম লাল হয়ে এসেছে। মুহুর্তেই যেন টপটপ করে পানি পরতে শুরু করবে। পৃথিবীর নিয়মই হয়তো এটা প্রিয় মানুষের বিদায়ে যেন সবকিছু থমকে যায়। শত চেষ্টাতেও মুখে হাসি ফুটাতে পারলাম না। নারীর মন অনেক শক্ত হতে হয়। সাবার হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে চললাম নিজের গন্তব্যের দিকে। হয়তো আর কখনোই আসা হবে না দেখা হবে না স্যারের সাথে।

যারা স্যাড এন্ডিং পছন্দ করেন তাদের জন্য সমাপ্ত। বাকি টুকু যারা হ্যাপি এন্ডিং চেয়েছেন তাদের জন্য।

দেখতে দেখতে ছয়টি বছর পার হয়ে গেলো, আমি নিশাদকে কোলে নিয়ে বসে আছি পাশেই স্যার কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিশাদ সাবার একমাত্র ছেলে। সেদিন দরজার সামনে পর্যন্ত আসতেই স্যার পেছন থেকে শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরে। আমি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে যাই। স্যার বলে উঠে এভাবে বিদায় নিয়ে না গেলে হয়না। জীবন হয়তো থেমে থাকবে না তবে তুমি যদি আজ চলে যাও তবে বাকিটা জীবন হয়তো আমাকে এখানেই থমকে থাকতে হবে। আমি স্যারের দিকে ফিরতে ফিরতে সাবা আমার হাত ছেড়ে দিলো। রুমন ও দাঁড়িয়ে পরলো। স্যারের চোখ বেয়ে পানি পরছে। আমি কি বলবো কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

হুট করে সাবা বলে উঠলো। মা আমার জন্য তুমি তোমার গত বাইশটা বছর তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছো আর না। মানুষ কি বলবে, সমাজ কি বলবে তা ভেবে লাভ নেই। আজ বাদে কাল যদি আমার বিয়ে হয়ে যায় তখন তোমাকে কে দেখবে। পৃথিবীতে যদি কেউ তোমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে থাকে তবে সেটা আংকেল। আর এতো ভালোবাসাকেকে উপেক্ষা করে আজ তোমার চলে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না। আমি জানি তুমি মানো, তুমি বিশ্বাস করো আল্লাহ যা করেন তা তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। তবে মনে করো তোমার এখানে আসা আংকেলের সাথে আবার দেখা সব কিছুই আল্লাহ তোমার জন্য লেখে রেখেছিলো। আর আগামিতে যা হবে তাও তোমার ভালোর জন্যই হবে ইনশা আল্লাহ।

রুমন: বুবু সাবা ঠিকই বলেছে, আজ তোমার দিন আর আগামির দিন গুলোও তোমার জন্য। তোমরা দু’জন কথা বলো আমরা অপেক্ষা করছি।

সেদিন আর স্যারের চোখের পানি উপেক্ষা করে ফিরে আসতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে আজ ছয়টি বছর একই ছাদের নিচে রয়েছি দু’জন। এর ভিতর সাবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওর বর ও ডাক্তার। দু’জন মিলে হাসপাতাল দেখা শোনা করে। আর মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। আজ আমাদের ষষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকিতে বেড়াতে এসেছে। আমিও আল্লাহর অশেষ রহমতে বেশ ভালোই আছি। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সুর নতুন করে জীবনে ফিরে এসেছে। সত্যিই আল্লাহ যা করেন তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। তাই কখনো হতাশ হতে নেই। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে নেই। নিশ্চই আল্লাহ চাইলে আপনার জীবন অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারেন। তার কাছে চাইতে হবে অন্তর থেকে। আল্লাহ আপনাকে কখনোই নিরাশ করবে না ইনশা আল্লাহ।

স্যার কি ভাবছো এতো মনোযোগ দিয়ে?

ভাবছি আমার জীবনটা আজ পরিপূর্ণ হয়েছে, আল্লাহর অশেষ রহমতে।

স্যার “নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী।” [আল আনফাল :৩০]

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here