হারানো সুর-৪র্থ পর্ব,৫
শাহরিয়ার
পার্ট-৪
রুমন এক নাগারে কথা গুলো বলে চলছে চাচীকে। খুব মায়া লাগছে ভাইটার জন্য। কিন্তু সব মায়া যে আমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাকে যে আমার ছোট সাবার জন্য বেঁচে থাকতে হবে। আমি জানি আমাকে লড়াই করতে হবে এ সমাজে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা মুহুর্তে আমাকে লড়াই করতে হবে। যে সমাজে নারীর স্বামী থাকতেও একা বেঁচে থাকতে হয় সে সমাজে তাকে কতটা লড়াই করে বাঁচতে হয় একমাত্র সেই নারীই জানে। কত রকমম কলংক, কত রকম মানুষের জগণ্যতম ভাষা শুনে বাঁচতে হয়। কত মানুষের হিংস্র খারাপ হাত ছুটে আসবে আমার দিকে। ভয়ংকর লোভার্ত চোখ গুলো প্রতিটা মুহুর্তে গিলে খাবে, খাবরে ছিড়ে খেতে চাইবে আমাকে। নিজেকে শক্ত করতে হবে আমাকে, এমন ভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে যেন সে সকল নরপশুরা কাছে আসার সাহস না পায়।
এ সমাজে অংসখ্য স্বামী পরিত্যক্ত নারী রয়েছেন, যারা বেঁচে রয়েছে, সমাজে নিজের একটা অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। সন্তানদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে ঘরে তুলেছেন তবে আমি কেন পারবো না? আমিও নারী অন্ন বস্ত্র গৃহের জন্য লড়াই করার ক্ষমতা আমারও আছে।
কতক্ষণ যাবৎ রুমান ডেকে চলছে সেদিকে আমার কোন খেয়ালই নেই, আমিতো আমার আগামির চিন্তায় মশগুল ছিলাম। যখন ওর কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসলাম, তখন ওর দিকে তাকাতেই ও প্রশ্ন করলো কি হয়েছে বুবু তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে? আমি কি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসবো?
আমি রুমনকে বাঁধা দিয়ে বললাম না আমি একদম ঠিক আছি ডাক্তার ডাকতে হবে না। এতো সময় আমি যখন অন্য কিছু চিন্তা করছিলাম তখন রুমন চাচীকে হয়তো অনেক কিছু বলছে যার কারণে চাচী সেখান থেকে চলে গেছে।
রুমান, আচ্ছা তাহলে চলো ভাত খাবে মুখটা কেমন শুকিয়ে রয়েছে সারাদিন নিশ্চই পেটে কোন দানা পানি পরেনি। এ বাড়িতে একজন আছে কেউ খেয়ে আছে কিনা সেদিকে খেয়াল না করে পাশের বাড়ির মানুষ কি বললো সে সকল কান পরা নিয়ে পরে আছে।
রুমনের কথায় আমি কাঁদবো না হাসবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কবে থেকে ও মেয়ে মানুষের মত করে ঝগড়া করতে শিখেছে? যে ছেলে দু’বছর আগেও শরমে ঠিকমত কথা বলতো না, সে ছেলে ঝগড়া করে চলছে কি এক অদ্ভুত ব্যপার। সময় মানুষকে সব পরিস্থিতে মানিয়ে নিতে শিখিয়ে দেয়। তাইতো বলা হয় সময়ের চেয়ে বড় আর কোন শিক্ষক হয় না। সময় আপনাকে আসল শিক্ষাটা দিয়ে থাকে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমন খাবার বেড়ে রেডি করে ফেলেছে। আমার দিকে তিকিয়ে সাবা কি ভাত খায় বুবু?
নারে ভাই ও ভাত খায় না।
রুমন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ভাত খেয়ে নাও। আমি ওর জন্য জুস, বিস্কুট, দুধের প্যাকেট, ফিটার সব কিনে নিয়ে আসবো।
আমি রুমনের ব্যবহারে বেশ অবাক হলাম, ও হঠাৎ কি করে এতোটা কেয়ারিং হলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম তুই এতো টাকা কোথায় পাবি?
রুমন, হাসতে হাসতে আমার কাছে টাকা আছে, আমি টিউশনি করাই সেখান থেকে যে টাকা পাই পুরোটাইতো আমার জমা থেকে যায়। আমার ভাগিনি এসেছে সেখান থেকে না হয় একটু ভাগ নিবে।
আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি, ছোট ভাইটা আজ সত্যিই বড় হয়ে গেছে, নিজের কি দায়িত্ব তাও সে বুঝে। হয়তো আর তিন চার বছর পর ওর নিজের ছোট সুখের সংসার হবে। আচ্ছা তখন কি শাকিলের মত রুমন ও বদলে যাবে? নারীর শরীর লোভ কি ওকে মানুষ থেকে অমানুষ বানিয়ে দিবে?
আজকের এই দিনে আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। সময় এর সঠিক উত্তর বলে দিবে।
রুমন, আপু খাচ্ছিস না কেন?
রুমনের কথায় আমি মাথা নাড়া দিয়ে খেতে শুরু করলাম। আজ দু’দিন আমি ঠিক মত খায়নি। খাবার যেন অমৃতর মত লাগছিলো। অনেক তৃপ্তি নিয়ে পেট ভরে খেলাম। আমার খাবার খেতে দেখে এক দৃষ্টিতে রুমন আমার দিকে চেয়ে ছিলো। খাওয়া শেষ হতেই রুমন বলে উঠলো। আপু আর কয়টা ভাত দেই। তোর মনে হয় খুব ক্ষুদা পেয়েছে।
আমি নারে ভাই আর লাগবে না পেট ভরে গেছে। তুই খুব ভালোরে ভাই।
রুমন, কি যে বলো না , আচ্ছা তুমি রুমে যেয়ে রেস্ট করো আমি সাবার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে আসি।
তুই রুমে নতুন চাদর লাগিয়েছিস তাই না?
রুমন, হুম আমি জানতাম তুমি আসবে।
আচ্ছা যা, রুমন চলে গেলো বাজারের দিকে সাবার জন্য কেনাকাটা করতে আমি রুমে এসে সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে নিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। শরীর এতোই ক্লান্ত যে চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরলাম। দুদিনের ক্লান্ত শরীর খুব বেশী সময় জেগে থাকতে পারলো না।
তবে ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, চাচীর চেঁচামেচিতে খুব বেশী সময় আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই চোখ মেলে তাকালাম। পাশের রুমে চাচী চাচার সাথে চেঁচামেচি করছে আর তাদের চেঁচামেচির বিষয় আমি।
চাচী চাচাকে বলে চলছে তোমার ভাইয়ের মেয়েকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি তাড়াও। আমার ছেলে বড় হয়েছে দশ জনে দশ রকম কথা বলে। আমার ছেলেটার শেষে ভালো ঘরে বিয়ে হবে না।
চাচীর এমন কথায় আমার মাথায় যেনো পুরো আকাশ ভেঙে পড়লো। যাকে আমি নিজের আপন ছোট ভাই ভাবি তাকে নিয়েই আমার দিকে খারাপ ইঙ্গিত। ছিঃ ছিঃ আমি না হয় পরের মেয়ে কিন্তু রুমনতো তার নিজের সন্তান। মানুষ কি করে এতোটা নিচু মনের হতে পারে। কি করে এতোটা হীন, নিচ চিন্তা করতে পারে। এই মুহুর্তে নিজের উপর নিজের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। কেন মরতে মরতে এখানে আসছিলাম।
চাচী এতো কথা বলছিলো অথচ চাচা তার একটুও প্রতিবাদ করলো না। চাচা এক সময় বলতো আমার দু’টো সন্তান একটা মেয়ে আর একটা ছেলে। আমি নাকি উনার বড় মেয়ে অথচ আজ আমার বিরুদ্ধে চাচী এতো এতো জগন্য ভাষা ব্যবহার করছে চাচা এর কোন প্রতিবাদ করছে না।
মাথাটা কেমন ভারী ভারী হয়ে আসছিলো, মনে হচ্ছিলো ছিড়ে পরে যাবে। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দু’চোখের পাতা বন্ধ করে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় হঠাৎই রুমনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সাথে সাথেই চাচী সব শব্দ বন্ধ করে দিলেন।
রুমন আমার রুমের দিকে ছুটে আসলো। রুমে এসে সব কিছু আমার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সাবাকে কোলে তুলে নিয়ে বসলো।
আমি ওকে সাবাকে নিয়ে রুমে বসতে বলে দুধ গরম করার জন্য রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফিটারটা ভালো করে গরম পানি করে দুয়ে নিলাম। তারপর দুধটা গরম করে ফিটারে ঢেলে নিয়ে আসলাম। রুমনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম সাবাকে আমার কাছে দে।
রুমন সাবাকে আমার কোলে দিয়ে পাশেই বসে রইলো। আমি সাবার মুখে ফিটার তুলে দিয়ে রুমনের দিকে তাকিয়ে বললাম। আমি আজ রাতটাই শুধু এখানে থাকবো। কাল ভোর হলেই চলে যাবো।
রুমন, আমার কথা শুনে জেনো চমকে উঠলো। কি সব বলছিস বুবু কোথায় যাবা তুমি? আর আমার ভাগিনিই বা কোথায় যাবে কার কাছে থাকবে?
আমি একটু হেসে শোন ভাই আল্লাহর দুনিয়াতে মানুষের থাকার জায়গার অভাব নাই। এই দুনিয়াতে যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন। কোথাও না কোথাও নিশ্চই আল্লাহ একটু জায়গা এক টুকরো আহার আমার জন্যও লেখে রেখেছেন। আর আল্লাহ যার আহার যেখানে লেখে রেখেছেন সেখানে যেয়েই তাকে তা গ্রহণ করতে হবে। এ বাড়িতে কিংবা এ শহরে হয়তো আমার আর রিজিক নেই। তাই যেখানে আমার রিজিক আছে সেখানেই যেতে হবে আমাকে।
রুমন, আমি কি তবে তোমার কেউ না?
পাগল একটা কে বলছে তুই আমার কেউ না? তুইতো আমার সাত রাজার ধন। একদিন তুই অনেক বড় হবি। যেনো কেউ তোর বুবুরে কিছু বললে প্রতিবাদ করতে পারিস। পুরো সমাজের সাথে লড়াই করার মত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবি। দেখবি বুবু ঠিকই তোর পাশে তোর সাথে আছি।
আমার কথার কি বুঝলো রুমন আমি বুঝতে পারিনি। তবে রুমন বুঝতে পেরেছে আমি আর বেশী সময় এ বাড়িতে নেই, তাই রুমন আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। বুবুরে মা তোকে কিছু বলে থাকলে আমাকে বল আমি মাকে বকে দিবো তবুও তুই যাসনে। কোথায় যাবি একা একা এই ছোট বাচ্চাটারে নিয়ে। নানান রকম কথা বলছে আর কান্না করছে রুমন।
আমি রুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর বলছি কাঁদিস না ভাই, পুরুষ মানুষকে খুব শক্ত হতে তাদের চোখে পানি মানায় না। আমি রুমনের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে রুমন আমাকে একটা কথা দিবি ভাই।
রুমন, বলো বুবু কি শুনতে চাও।
জীবনে কোন মেয়েকে কষ্ট দিবি না। যেমন তোর দুলাভাই করছে তেমন কাজ ভুলেও কোন দিন করবি না আমাকে তুই কথা দে।
রুমন, আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কথা দিলাম বুবু জীবনেও এমন কাজ করবো না। আমার বুবুকে দেয়া ওয়াদা আমি মরে গেলেও ভাঙবে না।
আমার নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে আমি রুমনকে বললাম। কাল সকালেই আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। তুই এখন তোর রুমে যা আমি নামায পড়ে একটু ঘুমাবো।
রুমন বাধ্য ছেলের মত রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কলপাড়ে এসে ওযু করে নিজের রুমের ভিতর ঢুকে নামাযে দাঁড়িয়ে পরলাম। এই নামাযে দাঁড়ালে হৃদয়ের সব ব্যথা গুলো হালকা হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে এই নামাযের মাধ্যমেই আমি আমার সব কষ্ট গুলো জানাতে পারি। সিজদায় লুটিয়ে আমি আমার আল্লাহর কাছে কষ্ট গুলোকে বলি। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। কেননা,
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি!”
[সূরা ইনশিরাহ: ৬]
চলবে…
হারানো সুর-৫ম পর্ব
শাহরিয়ার
নামায শেষ করে সাবাকে বুকের সাথে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শরীর খুবই ক্লান্ত থাকায় অল্প সময়ের ভিতর দু’চোখে ঘুম চলে আসলো। এবং এক সময় দু’চোখ গভীর ঘুমে বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানে। বিছানা থেকে উঠে ওযু করে নামায আদায় করে নিলাম। সাবা তখনো গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। আমি অপেক্ষা করছি রুমনের জন্য। আমি জানি রুমন কিছু ক্ষণের ভিতর চলে আসবে আমার সাথে দেখা করার জন্য।
হ্যাঁ তাই হলো, অল্প সময়ের ভিতর রুমন আমার রুমে চলে আসলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে কিরে ভাই মন খারাপ?
রুমন, বুবু তুমি কি সত্যিই চলে যাবা?
হ্যাঁ চলে যাবোরে ভাই, সকলের ভালোর জন্য যেতে হবে। তুই যেয়ে এগিয়ে দিয়ে আসবি আমাকে।
রুমন, কোথায় যাবা বুবু? কার কাছে যাবা?
আমি জানি নারে কার কাছে যাবো। তবে আমাকে যেতে হবে। তোর ভালোর জন্য, সাবার ভালোর জন্য, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য যেতে হবে। আর যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।
রুমন, আমাকে ভুলে যাবে নাতো?
আমি হেসে দিয়ে পাগল কি বলিস তোকে কি করে ভুলবো। তোকে কি কখনো ভুলা সম্ভব? তোর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবেই। আমি যেখানেই থাকি না কেন ঠিকই তোর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবেই।
রুমন, সত্যিতো বুবু?
হ্যাঁরে সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি। আচ্ছা শোন তোকে কিছু কথা বলি।
রুমন, হ্যাঁ বলো।
তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে এমন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেন। কেউ তোর দিকে আঙুল তোলে কিছু বলার আগে হাজার বার কল্পনা করে। আমি যেনো সবার সামনে গলা উচু করে বলতে পারি এটা আমার ভাই।
রুমন, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ঠিক আছে বুবু আমি তোর প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমি নিজেকে ঠিকই একদিন প্রতিষ্ঠিত করে তুলবো ইনশা আল্লাহ।
ঠিক আছে এখন তুই যা আমি রেডি হই। তারপর তোকে ডাক দিবো তুই আমাকে নিয়ে যাবি। রুমন চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রত্না কিছুটা সময় নিরব বসে রইলো। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠছে। রুমন মনে অনেক আঘাত পেয়েছে বুঝতে পেরেও তাকে কোন রকম শান্তনা দিতে না পারাটা কি যে যন্ত্রনার তা কাউকে বুঝানো সম্ভব না। নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে, সাবাকে বিছানা থেকে তুলে বসিয়ে ওর জামা কাপড় চেঞ্জ করে দিয়ে, নিজের শাড়িটাও চেঞ্জ করে নিলাম। কতদিন আয়নাতে নিজের মুখ দেখি না। আয়নাটা চোখের সামনে ধরতে পরিচিত মুখটাও আজ বড্ড অচেনা লাগছে নিজের কাছেই।
ক্ষুদার্ত আর ঠিকমত না ঘুমাতে পারায় মুখটা কেমন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো কালো দাগ হয়ে গেছে। মানুষ দেখলে ভাববে কত দিনের না রোগী। অথচ এই মুখে ছিলো উজ্জলতা, ছিলো মায়া যে কারো চোখে প্রথম নজড় পরলে হারিয়ে যেতে বাধ্য হতো এ চোখের মায়াতে। শাকিল অসংখ্য বার এ চোখে তাকিয়ে বলেছে ভালোবাসি। অসংখ্য বার বলেছে এ চোখের মায়া কাটিয়ে উঠা নাকি এক জনমে সম্ভব নয়। হয়তো তার বলা কথা গুলো মিথ্যা ছিলো, অভিনয় ছিলো। কিন্তু সত্যিই আমার মুখে চোখে মায়া ছিলো, লাবন্য ছিলো তা আমি জানি।
নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না, ব্যাগ খুঁজে কাজলটা বের করে চোখে লাগাতে শুরু করলাম। টিপের পাতাটা খোঁজে তার থেকে কালো টিপটা বের করে কপালের মাঝে বসিয়ে নিলাম। নিজেকে আজ নতুন করে সাজাতে খুব ইচ্ছে করছে। যেমন আকাশে রংধনু সাত রঙে সাজে ঠিক তেমন করে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছে করছে। ব্যাগ থেকে খুঁজে লিপস্টিকটা বের করে ঠোঁটের নিচে লাগাতেই পুরনো দিনের কথা মনে পরে গেলো।
বিয়ের পরদিন সকালে গোসল করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজতে ছিলাম, পাশেই খাটে শাকিল ঘুমিয়ে ছিলো। আমি চোখে কাজল, কপালে টিপ, নেয়ার পর ঠোঁটে লিপস্টিক নিয়ে ঘুরতেই চমকে উঠি, শাকিল বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি তা খেয়াল করিনি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলাম। শাকিল আমার আরও কাছে চলে আসলো, আমি ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। হঠাৎ করেই পিঠের উপর ওর হাতের স্পর্শে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। আমি বসা থেকে এ লাফে যেনো দাঁড়িয়ে গেলাম। ভয়ে চোখ মেলে তাকাতে পারছি না, ঠোঁট দুটো ভীষণ রকম কাঁপছে।
হঠাৎ কানের কাছে ফিঁসফিঁস করে শাকিল বলে উঠলো তোমাকে অপূর্ব লাগছে, গতরাতে মন ভরে দেখতে পাইনি আজ দেখে যেনো জীবনের পরিপূর্ণতা পেলো। আমি চোখ মেলে তাকাতে যাবো ঠিক সেই মুর্হুতে কোমড়ের উপর দিয়ে দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাজা কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এসে শুয়িয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় বললাম কি করছেন আম্মা চলে আসবে ছাড়েন। শাকিল হেসে উঠলো, ভয়ংকর হাসি এরপর আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওর ঠোঁট দু’টো আমার ঠোঁটের মাঝে নামিয়ে নিয়ে আসলো।
দরজায় টোকা পরলো, আম্মা এসে ডাকছে, শাকিল আমাকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম আম্মা এক দৃষ্টিতে শাকিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমিও শাকিলের দিকে তাকাতে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ওর ঠোঁট দু’টো লিপস্টিকের দাগে লাল টকটকে হয়ে রয়েছে। আম্মা ছিঃ বলে রুম থেকে বের হতে হতে বলতে শুরু করলো বউ পাগলা ছেলে আমার। আম্মার এমন কথায় সেদিন সব লজ্জা শরম ভুলে আমি হা হা করে হেসে উঠি। আমার সাথে সাথে শাকিল ও হেঁসে উঠে।
তবে এতো দিনের পুরনো কথায় দু’চোখের পাতা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। স্মৃতি গুলো বড় মধুর হলেও, সে স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষটা যখন বদলে যায়, তখন সে স্মৃতি গুলো আর আনন্দের থাকে না। বেদনায় ভরে উঠে চারিদিক সব কিছু। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে রুমন দরজার সামনে এসে ডাক দিলো। আমি তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে ওকে ভিতরে ডাক দিলাম।
রুমন, আমার দিকে কিছুটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তুমি কাঁদছিলে তাই না?
আমি কই নাতো কাঁদবো কেন আমি?
রুমন, তোমার চোখের কাজল গুলো নষ্ট হয়ে গেছে ভালো ভাবে ঠিক করে নাও।
যার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে ভাই তার চোখের কাজল দিয়ে কি হবে। কথাটা বলেই হো হো করে কেঁদে উঠলাম। আমি চাইনি রুমনের সামনে কাঁদতে তবে আজ আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। হয়তো আর কিছু সময় ওর সাথে আছি বলেই এমনটা হয়েছে।
রুমন, হাত বাড়িয়ে চোখ থেকে পানি মুছে দিয়ে কেঁদো না বুবু। নিশ্চই আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।
নিজেকে শান্ত করে রুমনকে বললাম ব্যাগটা তুলে নিতে আমরা বের হয়ে যাবো রেলস্টেশন এর উদ্দেশ্যে। রুমন বললো কিছু খেয়ে তারপর রওনা হওয়ার জন্য। আমি বললাম বেশী সময় নাই এখন না গেলে ট্রেন মিস করবো পরবর্তি ট্রেন দুপুরে আসবে। রুমন আর কথা বাড়ালো না ব্যাগ কাঁদে তুলে নিয়ে সাবাকে আরেক হাতে কোলে তুলে নিলো।
ঘরের ভিতর থেকে বের হতেই চাচা, চাচীর সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমি চাচাকে জড়িয়ে ধরে কিছুটা সময় কান্না করে চোখের পানি ফেলে মন হালকা করে নিলাম। এরপর চাচীকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই দু’টো মানুষকে আমি আর কখনোই দেখতে পাবো না। চাচীর দু’হাত শক্ত করে ধরে বললাম চাচী তোমার ছেলেটাকে আর কিছু সময়ের জন্য আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি, আর একটু মানুষের কথা সহ্য করে নিও।
চাচী আমার কথা শেষ হতেই হাউমাউ করে কান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি এমনটা আশা করিনি। আমার প্রচণ্ড মায়া হচ্ছিলো চাচীর জন্য। আমি চাচীর পিঠে হাত দিয়ে বললাম তুমি কাঁদছো কেন? জবাবে চাচী বললো অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে পারলে ক্ষমা করে দিস। আমি চাচীর দু’হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে বললাম। বাবা মায়ের কোন অন্যায় থাকে সন্তানের কাছে। বরং তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক কষ্ট দিয়েছি জ্বালিয়েছি, মানুষের কথা শুনিয়েছি, তার জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
চাচা চাচীর সামনে দাঁড়ানোর মত শক্তি যেন আর পাচ্ছিলাম না। রুমনের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুটা পথ হাঁটার পরেই একটা ভ্যান পেলাম তাতে উঠে বসলাম। ভ্যান এগিয়ে চলতে শুরু করলো ইস্টেশনের দিকে আমি রুমনের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছি। ওর মন খারাপ আমি জানি গল্প করলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে। ইস্টেশনে এসে আমার জন্য টিকেট কেটে নিয়ে আসলো। ট্রেন আসার সাথে সাথেই আমাকে তুলে দিয়ে সিটে বসিয়ে দিলো। আমি ওর চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। তাই দুষ্টমি করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। ভাই এরপর যখন আমাদের দেখা হবে তখন যেনো তোর সাথে পরীর মত একটা মিষ্টি বউ থাকে। আমার কথা শুনে রুমন হেসে দিলো। এদিকে ট্রেনের হুইশেল বেঁজে উঠলো। আমি রুমনকে নেমে যেতে বললাম রুমন নেমে গেলো ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমার মনের ভিতর শূণ্যতার ক্ষত সৃষ্টি হতে শুরু করলো। আমি ভয়ে ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম। আর মনে মনে বলতে শুরু করলাম।
“আল্লাহ্ কোনো ব্যক্তির উপর তার সাধ্যের চাইতে বেশী, এমন বোঝা চাপিয়ে দেন না!”
[সূরা বাক্বারা: ২৮৬]
আমিও নিশ্চই সব দুঃখ কষ্টকে দূরে ঠেঁলে ঠিকই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
চলবে…