হারানো সুর- ৬ষ্ঠ পর্ব,৭
শাহরিয়ার
পার্ট-৬
ট্রেন এগিয়ে চলছে নিজের মত করে, নিজের গতিতে। চের চেনা শহরটা ছেড়ে দূর বহুদূরের কোন এক অজানা শহরের উদ্দেশ্যে। মেয়েটাকে বুকের সাথে লাগিয়ে ধরে জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে রয়েছি। কত দ্রুতই না ট্রেন ছুটে চলছে, মুহুর্তে সব কিছু পিছু পরে যাচ্ছে।
কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা সব ফেলে আমি ছুটে চলছি অজানা শহরে। অনিশ্চয়তায় ভরা এক শহরে, যার নাম ঢাকা শহর, যেখানে নাকি কাজের অভাব নেই, যেখানে নাকি টাকার অভাব নেই। সব
আধুনিক কল কারখানা, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, ভার্সিটি। সব কিছুই রয়েছে এই স্বপ্নের শহরে। তবে এখানে নিজেকে সামলে, বেঁচে থাকাটাই সব চেয়ে কষ্টকর ব্যাপার। এখানে বাঁচতে হলে প্রতি মুহুর্তে লড়াই করে বাঁচতে হবে, ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচতে শিখতে হবে। সব কিছুই জানা আছে। তবুও ভয় আর ভয়ে চারিদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসছিলো।
রাত দশটার সময় ট্রেন ঢাকার কমলাপুর এসে থামলো। এতো রাতে কোথায় যাবো কি করবো কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চেনা জানাও কেউ নেই এই শহরে। শরীর ও বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে রেল লাইন থেকে বের হয়ে বড় ফ্লাইওভারটার উপরে যেয়ে উঠে, মাঝ বরাবরা এসে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পরলাম। বাতাসে ক্লান্ত শরীর কিছুটা হালকা হচ্ছে। এক অন্য রকম প্রশান্তি খেলে যাচ্ছে মনের ভিতর। এতো সময় যে দম বন্ধ দম বন্ধ ভাব লাগছিলো তা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে মাথা ব্যথাটা এখনো কাটেনি।
হঠাৎ করেই অচেনা এক কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, কিরে যাবি নাকি? আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। পেছনে ঘুরে তাকে দেখার মতও আমার সাহস হচ্ছে না। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।
কণ্ঠটা আরও একটু কাছে এসে আবার বলতে শুরু করলো চল আজ রাতের জন্য আমার সাথে রেট বাড়াইয়া দিমুনি। তোর ভালোই পুষাইবো, দুইজন আছি আমরা।
আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে ঘুরে বললাম, ভাই আপনার ভুল হচ্ছে, আপনি যাকে ভেবেছেন আমি সে না।
লোকটার মুখ দিয়ে নেশার প্রচন্ড রকম বাজে গন্ধ বের হচ্ছিলো। সে আমার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলছিলো, তুই খুব সুন্দরি আরও পাঁচশত টাকা বাড়িয়ে দিবো। চল আজ রাতে মজা দিবি।
আমার চোখ দু’টো জলে ভিজে উঠলো, আমি বুঝতে পারলাম এরা আসলে এভাবে যাবে না। তাই নিজেকে শক্ত করে আমার দিকে এগিয়ে আসা তার হাতটা শক্ত করে ধরে। মোচড় দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম। হারামজাদা ঘরে মা বোন নেই? রাস্তা ঘাটে যাকে দেখবি তাদেরই তোদের বাজারের মেয়ে মনে হয়। কুত্তার বাচ্চা আর কোন দিন যদি আমার চোখের সামনে পড়েছিস তবে হাত ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিবো।
লোকটা ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেলো। অনেক রাত ওভারব্রীজের উপর দিয়ে দুই চারজন যারা চলাচল করছিলো তারা আমার চিৎকারে কিছুটা ভয় পেয়ে দূর দূর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
রাগে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর তখনো কাঁপছিলো। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্রীজের মাঝ বরাবর এক সাইডে চেঁপে বসে পরলাম। শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। কোথাও হেঁটে যাবো তেমন শক্তি ও পাচ্ছি না, সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে শরীর প্রচন্ড দূর্বল হয়ে গিয়েছে। সারাদিন ট্রেনে বসে থাকার কারণে শরীরের জামা কাপড় সব ময়লা হয়ে গিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এই মুহুর্তে আমাকে ঠিক ভালো ঘরের মেয়ে মনে হচ্ছে না।
অল্প সময়ের ভিতর চারিদিক বেশ নিরব হয়ে গেলো। সব কিছু ভুলে দু’চোখে কিছুটা তন্দ্রা ভাব এসে গেলো। এমন সময় হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচিতে তন্দ্রা ভাব কেটে যাচ্ছিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন মাথার চুল টেনে ধরলো। ব্যথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। মনে হচ্ছিলো ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাবে। দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে পরছে। আমি বার বার চিৎকার করে বলছি আমাকে ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি আমার মেয়েটা পরে যাবে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। বরং আরও শক্ত করে চেপে ধরে টেনে চলেছে।
আমি মনে মনে বলে চলেছি একেই বুঝি বলে মরার উপর খাড়া ঘা। আল্লাহ যখন বিপদ দেন তখন চারিপাশ থেকে বিপদ দেন। সারাদিন জার্নি করে মাথা যে পরিমাণ ব্যথা হয়েছিলো তার চেয়ে কয়েক গুন বেশী ব্যথা হয়ে গেলো। সাবা কোলের ভিতর থাকা অবস্থায় কান্না করে দিলো। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে রেখেছি।
হঠাৎই কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো। তোদের কতদিন বলছি না, এই ব্রীজের উপর অবৈধ ব্যবসা করবি না? তারপরেও তোরা কেন এসব করিস একটাকেও ছাড়বো না। আজ সব কয়টাকে ধরে থানায় নিয়ে যাবো।
কথাটা শুনে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছিলো থানায় নিয়ে গেলে আমাকে কে ছুটিয়ে আনবে? মিথ্যা মামলায় আমার জেল হয়ে গেলে আমার সাবাকে কে দেখে রাখবে? এসব ভাবতে ভাবতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে যে মহিলা পুলিশ আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো তাকে একটা ধাক্কা মেরে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিলাম। এরপর ছুটে চললাম সেই অফিসারের দিকে, তার সামনে যেয়ে মাথাটা তুলে তার মুখের দিকে শুধু এক নজর তাকালাম। তারপর মাথাটায় চক্কর দিয়ে উঠলো আর আমি ব্রীজের উপর পরে গেলাম।
পরদিন সকাল সাড়ে দশটার সময় চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে সাবাকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছেন এক ভদ্র মহিলা। আমার মাথাটা তখনো প্রচন্ড ব্যথা করছিলো, চোখে তখনো ঝাপসা দেখছিলাম। আমি কোন রকমে চোখটা বন্ধ করেই সেই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললাম মা আমি কোথায় আছি?
ভদ্র মহিলা, আমার মাথায় হাত রেখে বললো, তুমি নিরাপদেই আছো, তোমার কোন ভয় নেই। তোমার মেয়েও ভালো আছে। তুমি আরও কিছু সময় রেস্ট করো। ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলো। তোমার শরীর নাকি খুবি দূর্বল। তুমি আরও কিছু সময় ঘুমিয়ে নাও। তারপর সব জানতে পারবে তুমি কোথায় আছো।
উনার কথায় আমি চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। উনি সত্যি কথাই বলেছেন ডাক্তার আমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে, যার প্রভাবে আমি ঠিকমত চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আবার দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম, মিনিট দুয়েকের ভিতর আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো দুপুর দুইটার দিকে সেই মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে এখন সব কিছু পরিষ্কার। মাথা ব্যথাটাও এখন একদম নেই, তবে শরীর এখনো অনেক দূর্বল। উনি সাবাকে কোলে নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো এখন কেমন লাগছে? আমি মাথা নেড়ে জানালাম ভালো লাগছে, তবে শরীর খুব দূর্বল।
উনি আমার দিকে সুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো খেয়ে নাও ভালো লাগবে।
আমি একটু উঠে বসে উনার হাত থেকে সুপের বাটি নিয়ে একটু একটু করে খেতে খেতে উনাকে প্রশ্ন করলাম মা আমি এখানে কি করে এসেছি?
মা, একটু হেসে তুমি কি পুলিশ খুব বেশী ভয় পাও?
আমি না ঠিক ভয় পাই না, কিন্তু গতরাতে যা যা হয়েছে আমি উনাকে সব খুলে বললাম। মা সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো দেশে ক্রাইম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নেশা করার জিনিস গুলো খুব সহজে মানুষ হাতে পেয়ে যাচ্ছে। আর এগুলো বেশী বিক্রি হচ্ছে বস্তি গুলো আর ফুটপাত ওভার ব্রীজের উপরে। তাই গতরাতে আমার ছেলে এস আই জাহাঙ্গীর আর তার টিম ঐ ব্রীজের উপর রেট দেয়। ঐ ঘটনার সময় হঠাৎ করে তুমি তার সামনে যেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পরে যাও। এরপর সে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে ডাক্তার খবর দেয়, ডাক্তার এসে তোমাকে দেখে ঔষধ দিয়ে যায়। আমার ছেলেটা পুলিশ হলে কি হবে মনটা খুবি নরম। তোমার এমন অবস্থা দেখে ভয়ে সেও সারা রাত ঘুমায়নি।
মায়ের কথা শুনে, আমার রাতের শেষ দিকের ঘটনা গুলো মনে পরছিলো। যখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাবাকে কোলে নিয়ে আমি ছুটে এসেছিলাম। সেই কণ্ঠের কাছে। তখন আর দু’চোখ খোলা রাখদে পারছিলাম না। শেষ মুহুর্তে যখন আমি সেই চেহারাটা দেখেছিলাম, তখন সুন্দর একজন মানুষকে আমি দেখেছিলাম। এরপর কিছু বলার আগেই আমি মাথা ঘুরে ব্রীজের উপর পরে যাই।
মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো তুমি খেয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার মেয়েকে দেখে রাখি ও তো খুবি ভালো একটা মেয়ে একটুও জ্বালাতন করে না। আমার শরীর এতোটাই দূর্বল ছিলো যে আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক বুঝিয়ে দিলাম। অথচ মেয়েকে আমার বুকের মাঝে নিয়ে শুয়ে থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু তা আমি পারলাম না। আমি কোন রকমে সুপটা খেয়ে শেষ করে পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া জানিয়ে খাটের সাথে মাথাটা লাগিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম।
চলবে…
হারানো সুর-৭ম পর্ব
শাহরিয়ার
বিকেলে চোখ মেলে তাকালাম, জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়া। বাহির থেকে সূর্যের আলো বেশ খানিকটা ঘরে ঢুকে আমার মুখের উপর পরছে। আমি উঠে বসলাম। এমন সময় মা ঘরে ঢুকলো সাবাকে কোলে নিয়ে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। মা সাবাকে আমার কোলে তুলে দিলো। আমি বললাম খুব জ্বালিয়েছে আপনাকে তাই না?
মা, হেসে দিয়ে মোটেও না, এতো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা আমি এর আগে খুব কমই দেখেছি। বিন্দু পরিমাণ কান্নাকাটি বা জ্বালানত করেনি। মনেই হয়নি সারা দিন এ বাড়িতে কোন বাচ্চা আছে। তোমার কথা বলো এখন কেমন লাগছে?
জ্বি “আলহামদুলিল্লাহ” আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি আমি।
মা, আচ্ছা তোমার নাম কি? কোথায় থেকে তুমি এসেছো আর কোথায় যাবে তুমি?
আমার নাম রত্না, এরপর আস্তে আস্তে সব খুলে বললাম। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। আর জানালাম এ শহরে আমার যাওয়ার বা থাকার কোন জায়গা নেই।
মা, সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললো মন খারাপ করো না মা। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। আর আমাকে যেহেতু মা বলে ডেকেছো সেহেতু তোমার আর কোন চিন্তার কারণ নেই। তুমি আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকবে। আমি আর জাহাঙ্গীর ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না। আমি ভার্সিটির প্রফেশর ছিলাম অবসর নিয়েছে। ওর বাবা সেনাবাহিনিতে ছিলো। দীর্ঘ দিন দেশের সেবা করে অবসর নেয়। বেশ ছিলো আমাদের সংসার। হঠাৎ একদিন রাতে হার্ট এট্যাক করে মারা যায় লোকটা। তারপর থেকে আমার সময়ও কাটে একা একা। ছেলেটার নেশাও হয়েছে বাবার মতই দেশের সেবা করবে। তাই পুলিশে চাকরি নিয়েছে। কতবার করে বললাম আমার বয়স হয়েছে ওবার একটা বিয়ে করে নে। কিন্তু আমার কথা শুনতেই চায়না। কি আর করার ছেলের মতের বিরুদ্ধেও যেতে পারি না। সারাদিন এতো বড় বাড়িতে আমার একা কাটে। আমি বলি তুমি আমার সাথে এখানেই থেকে যাও। আর আমার ছেলে যেহেতু পুলিশ, তুমি তোমার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে দাও। ওকে জেলে ঢুকিয়ে দেই।
আমি মাকে বললাম না মা এমনটা করবেন না প্লীজ। সে যদি আমাকে ছাড়া যদি সুখে থাকে তবে থাকুক সুখে। সব কিছুর শেষেও সে আমার সন্তানের পিতা। আমি চাইনা আমার আর উনার ভুলে আমার সন্তানের জীবনটা নষ্ট হয় যাক।
মা, আমরা বাঙালী মেয়েরা সারা জীবন সহজ সরল থেকে যাবো এমনি করে। আর স্বামীরা দিনের পর দিন অত্যাচার করে যাবে। এর জন্য আমরা দ্বায়ী, আসলে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাই না।
আমি জানি মা আমি চাইলেই শাকিলকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি। তার অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু মা আপনার মত সেখানে আমার শাশুড়ি রয়েছে সে আমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবেসেছে। সে এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। আর আমি সন্তান হয়ে মাকে কি করে কষ্ট দিবো? আমি জানি আমি ঐ বাড়িতে নেই, তাতেই খুব কষ্টে আছেন উনি। তার উপর যদি শাকিলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে উনি হয়তো সে কষ্ট সহ্যই করতে পারবে না।
মা, বেশতো আমি তোমাকে কোন রকম চাপ দিবো না। তুমি রেস্ট করো, আমি পরে আসবো আবার।
মা, চলে গেলেন আমি সাবাকে পাশে শুয়িয়ে দিলাম, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সাবা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। জানিনা আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি রেখেছে। শুধু জানি ওর জন্য আমি পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারবো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম।
মুহুর্তে পুরো ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো। জানালার পর্দা লাগানোর জন্য সেদিকে যেয়ে জানালার বাহিরে চোখ রাখতেই আলোকিত একটা শহর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। গতকাল রাতে আসলেও এভাবে এই শহরটাকে দেখা হয়নি। আজ যতটা ভালো লাগা নিয়ে দেখছি। আমার জীবনেও একদিন এমন আলোয় আলোকিত হবে এটা আমার বিশ্বাস।
হঠাৎ করেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠায় আমি কিছুটা চমকে উঠি, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় যেয়ে সাবাকে জড়িয়ে ধরি। একটু পরেই দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে আসে। আমি মেয়ের পাশে বিছানায় বসে আছি এমন সময় আমার কানে ভেসে আসে।
মা মেয়েটার কি জ্ঞান ফিরেছে?
মা, হ্যাঁ ফিরেছে কেন?
জাহাঙ্গীর, মেয়েটার বাড়ি ঘর কোথায়? কোথায় যাবে কিছু কি জেনেছো?
মা, মেয়েটার যাবার মত কোন জায়গা নেই, এই শহরে নতুন এসেছে। মেয়েটার জীবনে অনেক কষ্ট আমি মেয়েটাকে আমার সাথেই থাকতে বলেছি। মেয়েটা এখন থেকে এখানেই থাকবে।
জাহাঙ্গীর, চিনো না, জানো না, হুট করে একটা মেয়েকে বাড়িতে রেখে দিবে? যদি মেয়েটার খারাপ কোন মতলব থাকে। যদি বাড়ি থেকে চুরি করে পালিয়ে যায় তখন তুমি বুঝবে।
মা, সব কিছুতেই পুলিশের চোখে দেখা বাদ দে, মানুষের মত করে একটু দেখার চেষ্টা কর। দেখবি পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ না। আর আমি একজন মা আমার চোখে ফাঁকি দেয়া এতো সহজ না। ওর ঐ নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় মেয়েটা কত কষ্ট করে বেঁচে আছে।
জাহাঙ্গীর, হয়েছে হয়েছে বুঝতে পেরেছি, তোমরা মায়েরা সব বুঝ আর আমরা কিছুই বুঝি না।
মা, তোকে এতো বুঝতেও হবে না, যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি নাস্তা দিচ্ছি নাস্তা করে নিবি।
জাহাঙ্গীর, মেয়েটা কিছু খেয়েছে কি? আর ঐ পিচ্চি বাচ্চাটা?
মা, হ্যাঁ খেয়েছে দুপুরে, এখন নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাক দিবো। তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়।
মা ছেলের কথা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিলো, কোন রকমে হাসি চেপে দু’জনের কথা শুনে চলছিলাম। মানুষটাকে বাহির থেকে যতটা শক্ত মনে হয় ভিতর থেকে ঠিক ততটাই নরম।
মা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাক দিলো। আমি উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দিয়ে মাকে ভিতরে আসতে বললাম।
মা, ভিতরে ঢুকে বিছানায় সাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে। ওতো ঘুমাচ্ছে তুমি চলো চা নাস্তা খেয়ে নিবে। জাহাঙ্গীর এসেছে যদি কোন কিছু প্রশ্ন করে তবে খুব সাবধানে উত্তর দিও। এ ছেলেকে কোন বিশ্বাস নেই, সবাইকে ওর কাছে চোর মনে হয়। সবাইকে সন্দেহ করে, এই ছেলেকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি।
আমি মায়ের হাত শক্ত করে চেপে আপনার কোন ভয় নেই মা। আমি সব কিছু সামলে নিবো। আর আপনার ছেলে মানুষ হিসেবে অনেক ভালো নয়তো আমার মত অপরিচিত একজন মানুষকে নিশ্চই রাস্তা থেকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে আসতো না।
মা, এটা তুমি ঠিক বলেছো, আমার ছেলের মনটা বিশাল বড়।
এমন সময় বাহির থেকে মা বলে ডেকে উঠলো। মা আমাকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বের হতে বলে, বাহিরের দিকে হাঁটা শুরু করলো। মা রুম থেকে বের হয়ে যেতে আমি ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। সাবা ঘুমাচ্ছে তাই ওকে আর ডাক দিয়ে তুললাম না। আমি একাই ভয়ে ভয়ে রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে যেতে।শুরু করলাম। ডাইনিং এর সামনে যেয়ে চমকে গেলাম। সেখানে শুধু জাহাঙ্গীর বসে আছে মা নেই, মা সম্ভবত কিচেন রুমে আমি কি করবো না করবো দ্বিধাদ্বন্দ্বয় পরে গেলাম। একবার ভাবলাম রুমে ফিরে আসবো। পরক্ষণে ভাবলাম ব্যাপারটা তাহলে ভালো দেখাবে না। তাই আরও কয়েক পা গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখে জাহাঙ্গীর টেবিলে বসা অবস্থায় কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো এদিকে এসে বসুন।
উনার কণ্ঠ শুনে ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে, হয়তো উনি পুলিশ সে জন্যই এমনটা হচ্ছে। গতরাতে উনি যে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে সেই সব ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে উঠছে। আমি কোন রকমে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। বেশী সময় দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো ভয়ে গলা শুকিয়ে মাথা ঘুরে আরেক পরে জ্ঞান হারাতে হতো।
হঠাৎ করেই জাহাঙ্গীর আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পানি খেয়ে নিন। আপনার কি খারাপ লাগছে?
আমি দ্রুত পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে গ্লাসের সব পানি টুকু খেয়ে নিলাম। তারপর মাথা নিচু করে খুব আস্তে উত্তর দিলাম জ্বি না আমি ঠিক আছি।
জাহাঙ্গীর, ঠিক থাকলেই ভালো, আপনার বেবীটা কোথায় সাথে নিয়ে আসলেন না?
আমি মাথা নিচু অবস্থায় উত্তর দিলাম ও ঘুমাচ্ছে, পরে উঠলে তখন নিয়ে আসবো।
এমন সময় মা চা আর নাস্তা নিয়ে ডাইনিং এ আসলো। আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো কি তোদের দু’জনের কি আলোচনা হলো।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি, জাহাঙ্গীর হেসে দিয়ে বলতে শুরু করলো। এ মেয়েতো এখনো মনে হয় ভয়ে আছে। আর একটু হলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। এর ভিতর থেকে ভয় এখনো কাটেনি। দেখো এখনো কেমন করে কাঁপছে।
আমি অবাক নয়নে লোকটার দিকে চেয়ে ভাবছি, একটু আগেও যে মানুষটাকে আমার কাছে প্রচন্ড কঠিন মনে হয়েছে। সেই মানুষটাকে এই মুহুর্তে একদম সহজ সরল মনে হচ্ছে। কেউ এই মুহুর্তে দেখলে বুঝতেই পারবে না। মানুষটা একজন পুলিশ অফিসার। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে মানুষটার হাসি দেখছি। একজন কঠিন মানুষও এতো সুন্দর করে হাসতে পারে। তা আমি আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম। আস্তে আস্তে আমার ভয় কেটে যেতে শুরু করলো।
আমি মনে মনে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করলাম। এতো ভালো একটা পরিবারে আমাকে থাকার জন্য আশ্রয় করে দেবার জন্য এবং আমি বিশ্বাস করি।
“আল্লাহ্ কষ্টের পর সুখ দিবেন!”
[সূরা ত্বলাক: ৭]
ইনশা আল্লাহ আমার ও সুখের দিন শুরু হবে। কথা গুলো যখনি ভাবছিলাম ঠিক তখনি সাবার কান্নার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড়ে সেদিকে ছুটলাম। আমার সব সুখ বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমার মেয়ে, তার কান্না যে আমি সহ্য করতে পারি না।
চলবে…