হারানো সুর-৮ম পর্ব,৯ম পর্ব

0
822

হারানো সুর-৮ম পর্ব,৯ম পর্ব
শাহরিয়ার
পার্ট-৮

দৌঁড়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলাম। বুঝতে পারলাম ওকে খাওয়াতে হবে। তাই দেরী না করে সাবাকে বুকের সাথে লাগিয়ে রুম থেকে বের হলাম। কিচেনে গিয়ে দেখলাম দুধ গরম করা আছে। মাকে ডাক দিয়ে বললাম আমি এখান থেকে দুধ নিবো সাবাকে খাওয়ানোর জন্য। মা বললেন অবশ্যই নিবে। এই দুধ ওর জন্যই গরম করেছি। আমি মেয়ের জন্য ফিডারে দুধ ভরে নিলাম। আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। কার রিজিক কোথায় কিভাবে রেখেছেন একমাত্র তিনিই তা জানেন। কোন না কোন ভাবে, কোন এক উছিলায় তা ঠিকই আপনার কাছে চলে আসবে।

দেখতে দেখতে সাতটা দিন এ বাড়িতে কেটে গেলো। নিজেকে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছি। বাড়িতে তেমন কাজ নেই সারা দিন আমি আর মা গল্প করেই কাটিয়ে দেই। তবে সব চেয়ে মজার ঘটনাটা ঘটিয়েছেন মা। আমার জন্য বই কিনে নিয়ে এসেছেন। বই গুলো আমার হাতে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করেন। রত্না তুইতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাস, নিজে কিছু করতে চাস তাই না?

আমি বললাম হ্যাঁ মা চাই।

মা: তাহলে এই বই গুলো ধর এই গুলো পড়তে হবে তোকে। শিক্ষিত হতে হবে। আমি যেহেতু একজন প্রফেসর। আমি তোকে বোর্ডে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিবো। তোকে সব পড়া আমিই পড়াবো। কিন্তু তোর নিজের আগ্রহটা আসল।

আমি মাকে বললাম, আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সব করতে পারি। তারপর বই গুলো হাতে তুলে নিলাম। কাজের শেষে অবসর সময় গুলোতে মা আমাকে পড়া দেখিয়ে দেন। আর আমি পড়া শিখি। এভাবেই দিন গুলো এগিয়ে যাচ্ছে বেশ।

জাহাঙ্গীরকে এখনো আমার প্রচন্ড রকম ভয় লাগে, উনি যে ভাবে তাকায় মনে হয়। আমি কোন বড় অপরাধী থানার তালা ভেঙ্গে পালিয়ে এসেছি। যদিও উনার সাথে আমার খুব একটা দেখা হয়না। সকালে নাস্তার টেবিল আর রাতে খাবার টেবিলে দেখা হয়। আমি নিজেও উনার থেকে কিছুটা দূরে দূরে থাকি। সত্যিই এই পুলিশকে আমি ভীষণ রকম ভয় পাই। যদিও ভয় পাবার কোন কারণ নেই তবুও ভীষণ ভয় পাই।

আমাকে এমন ভয় পেতে দেখে মা হাসে মাঝে মাঝে আমাকে বলে রত্না তুই কি কিছু চুরি করেছিস? ওকে দেখে এতো ভয়ে ভয়ে কেন থাকিস? আমি লজ্জা পেয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলি। মা আপনার ছেলের মনে সব সময় সবার জন্যই সন্দেহ থাকে হোক সেটা বাড়িতে কিংবা ডিউটিতে। দেখেন না বাড়িতে যতক্ষণ থাকে চোখ বড় করে তাকিয়ে তাকিয়ে এদিক সেদিক কি কি যেন খোঁজে। মনে হয় চোর ডাকাত ঘরের ভিতরে এসেও লুকিয়ে আছে। এভাবেই হাসি আর আনন্দে আমার দিন গুলো বেশ কেটে যাচ্ছে।

আজ এ বাড়িতে আমার পনের তম দিন। আজ সকাল থেকেই মা খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার কারণ কি আমি জানি না। বাড়ি ঘর সমস্ত পরিষ্কার করতে শুরু করেছে আমাকে সাথে নিয়ে। বিশাল বাড়ি দু’জন পরিষ্কার করতে করতে সকাল থেকে দুপুর হয়ে গেছে।

মা: হাঁপাতে হাঁপাতে কোমরে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরে বলতে শুরু করেছে আমি আর পারবো না বুড়ি হয়ে গেছি। আগে একাই এ বাড়ি পরিষ্কার করেছি। নিজ হাতে গুছিয়েছি আর এখন একটুতেই হাঁপিয়ে উঠি।

আমি মায়ের পাশে বসে তার হাত চেঁপে ধরে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আপনি এখন গোসল করবেন। তারপর আমাকে দেখিয়ে দিবেন, কোথায় কি রাখতে হবে, কি কি করতে হবে আমি সব করে নিবো। আপনার এখন রেস্ট নিতে হবে, এই বয়সে এতো কাজতো করা যাবে না।

মা: চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আমি কি আর স্বাদে করি এতো কাজ। ছেলেটাকে কবে থেকে বলছি বিয়ে কর বিয়ে কর শোনে না আমার কথা। শুনলেতো বাড়ির দ্বায়িত্ব তার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি আরাম আয়েশ করে জীবনের বাকি দিন গুলো কাটিয়ে দিতে পারতাম। সে কপাল বোধহয় আমার নেই।

কথা গুলো বলতে বলতে মন খারাপ করে মা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও মায়ের কথাই ভাবছি উনার ছেলের বেশ ভালোই বয়স হয়েছে কিন্তু বিয়ে কেন করছে না? আগে কি প্রেম টেম করে ছ্যাকা খাইছে নাকি এখনো কাউকে চুপি চুপি ভালোবাসে যার কারণে বিয়ে করছে না। কোন না কোন একটা কারণ নিশ্চই আছে।

এ সব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই আমার শাকিলের কথা মনে পরে গেলো। আজ পনের দিনে খুব বেশী শাকিলের কথা মনে পরেনি। আমিও চাইনি ওর কথা মনে পরুক। আমি যথা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু ভালোবাসার কথা মনে পড়তেই ওর কথা মনে পরে গেলো।

সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো, আমি শাকিলের জন্য অপেক্ষা করছি, শাকিল আসবে আমাকে কথা দিয়েছে। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলেছে, আমি একটা টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ওর আসার অপেক্ষায়। হঠাৎ দূর থেকে মাথার উপর কচু গাছের পাতা নিয়ে তাকে আসতে দেখি। তার এমন অবস্থা দেখে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে মনে প্রচন্ড হেসে নিলাম।

শাকিল: কাছে এসে পাশে দাঁড়িয়ে একটা পাতা আমার মাথার উপর ধরে বলতে শুরু করলো তুমিতো ভিজে গেছো।

এতো সময় আমি খেয়ালই করিনি আমি যে ভিজে গেছি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললাম। আর কিছু ছিলো না? এই কচু গাছের পাতা নিয়ে আসতে হলো আপনাকে?

শাকিল: কি করবো যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তখন কি আর জানতাম এমন বৃষ্টি আসবে? তাহলেতো ছাতা নিয়েই বের হতাম। আর তুমি এখানে আসছো বলেইতো এই বৃষ্টির মাঝেও আমি ছুটে এসেছি না হলে কি আসতাম? ঠিকই বাড়িতে ফিরে যেতাম।

আমি শাকিলের দিকে তাকিয়ে বললাম বেশতো এখন চলে যান। আমিতো আপনাকে বেঁধে রাখিনি।

শাকিল: বেঁধে রাখোনি, কিন্তু তোমাকে একা রেখেই বা যাই কি করে? যে আমার জন্য এতোটা পথ হেঁটে এসেছে এই বৃষ্টির মাঝে তাকে রেখে আমি কি করে চলে যাবো? তারচেয়ে বরং না হয় এই কচু গাছের পাতার ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় গল্প করি।

আমি অবাক দৃষ্টিতে শাকিলের দিকে চেয়ে রইলাম অনেকটা সময়। সে আমার মাথার উপর পাতা রেখে দূর আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম বিকেল হয়ে আসছে আমাকে যেতে হবে।

শাকিল: যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু বেঁধে রাখার মত অবস্থাও নাই। কি করতে কি করি তুমি কি বলতে পারো?

আমি হাসতে হাসতে আমি কি করে বলবো বলেন? আপনার মন আপনিই ভালো জানেন।

শাকিল: এক কাজ করি এমনি করে তোমার মাথার উপর গাছের পাতা ধরে তোমাকে বাড়ির কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি?

লোকে দেখলে যে বদনাম হয়ে যাবে। তখন আমি সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?

শাকিল: তখন না হয় আমার বুকে মাথা রেখে সমাজের মানুষ গুলোকে দেখিয়ে দিবে ভালোবাসার মানুষ মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে যায় না। কেউ কেউ ভালোবেসে বুকের মাঝেও আগলে রাখতে জানে।

আমি তার কথায় মুগ্ধ হই, যতই তার কথা শুনতাম ততই তাকে ভালোবেসে ফেলতাম। মানুষটার কথায় যাদু ছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি তার কথা শুনতাম। যেমন কেউ গল্প বললে আমরা মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে তার গল্প শুনি। তেমনি এই মানুষটার কথা আমি শুনতাম।

মা: কিরে তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, গোসল করবি কখন?

মায়ের কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসি। মাথাটা নিচু করে একটু পরেই করবো এখন বলো কি করতে হবে আমাকে?

মা: আচ্ছা তুই কি পায়েস রান্না করতে পারিস?

হ্যাঁ পারিতো কেন করতে হবে?

মা: হ্যাঁ করলেতো ভালোই হয় ছেলেটা আমার পায়েস খুব পছন্দ করে।

আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি এখুনি করে দিচ্ছি। তুমি শুধু একটু বলে দিও। যেভাবে ভালো হয় সেভাবে।

মা: আচ্ছা ঠিক আছে তা না হয় করলাম।

আমি মায়ের সহযোগিতায় রান্না শুরু করে দিলাম। আমি নিজেও বহুবার পায়েস রান্না করেছি। তবুও শহরের রান্না আর আমার গ্রামের রান্না যদি আলাদা রকম কিছু থেকে থাকে। তাই বার বার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে আমি সব কিছু দিচ্ছিলাম। না রান্নার নিয়ম সব উপকরণ একই, তাই রান্না করতে আমার কোন রকম সমস্যা হলো না। বরং মা বেশ খুশিই হলো আমার রান্না দেখে। পায়েস রান্না শেষ হতেই মা আমাকে প্রশ্ন করলো পোলাউ রান্না করতে পারি কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ পারি।

মা আমাকে দেখিয়ে দিলো কোথায় পোলাউর চাল আছে, আমি চাল নিতেই মা বললেন আজ কিছু মেহমান আসবে। বেশী করে রান্না করার জন্য। আমি চাল নিতে নিতে মাকে প্রশ্ন করলাম আজ কি কোন বিশেষ দিন?

মা: হেসে দিয়ে হ্যাঁ খুবি বিশেষ একটা দিন।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম কি দিন মা?

মা: হাসতে হাসতে বললো পরেই জানতে পারবি।

এমন সময় পাশের রুম থেকে সাবা কেঁদে উঠলো, মা আমাকে বললো তুই রান্না কর আমি যেয়ে ওকে নিয়ে আসছি। মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে সাবাকে নিয়ে আসতে গেলো। আমি রান্না বসিয়ে দিলাম চুলোয়।

মা সাবাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমি মায়ের দিকে কৌতুহলি চোখে চেয়ে রয়েছি।

মা: কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই কি রোস্ট রান্না করতে পারিস?

আমি মাথা নেড়ে বললাম না পারি না তবে দেখিয়ে দিলে পারবো।

মা: হাসি দিয়ে আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিবো। রোস্ট বানানো খুবই সহজ। এখন তুই ওর জন্য খাবার রেডি কর।

আমি মাথা নেড়ে সাবার জন্য ফিডার রেডি করতে শুরু করলাম। ফিটার রেডি হতেই মায়ের হাতে তুলে দিলাম মা ফিটার আর সাবাকে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি রান্নায় মনোযোগ দিলাম।

চলবে…

হারানো সুর-৯ম পর্ব
শাহরিয়ার

মা সাবাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমি মায়ের দিকে কৌতুহলি চোখে চেয়ে রয়েছি।

মা: কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই কি রোস্ট রান্না করতে পারিস?

আমি মাথা নেড়ে বললাম না পারি না তবে দেখিয়ে দিলে পারবো।

মা: হাসি দিয়ে আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিবো। রোস্ট বানানো খুবই সহজ। এখন তুই ওর জন্য খাবার রেডি কর।

আমি মাথা নেড়ে সাবার জন্য খাবার রেডি করতে শুরু করলাম। খাবার রেডি হতেই মায়ের হাতে তুলে দিলাম মা খাবার আর সাবাকে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি রান্নায় মনোযোগ দিলাম। পোলাও রান্না হয়ে যেতেই মা সাবাকে ঘরে শুয়িয়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে আসলো। আমি মাকে বললাম রান্না হয়ে গেছে।

মা: আচ্ছা দেখো কিভাবে রোস্ট রান্না করতে হয়।

এরপর মা আমাকে দেখিয়ে দিতে শুরু করলো কিভাবে রোস্ট রান্না করতে হয়। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মা যেভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে আমি সেই ভাবে রান্না করতে শুরু করলাম। অনেকটা সময় লাগলো রোস্ট হতে।

মা: এবার যেয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। অনেক বেলা হয়ে গেছে।

আমি মায়ের কথা মত রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। নিজের রুমে এসে শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। লম্বা একটা শাওয়ার শেষ করে আমি রেডি হয়ে বের হতেই দেখলাম, দুই তিনজন লোক অনেক গুলো বেলুন ফুলিয়ে বাড়ির ভিতর খুব সুন্দর করে সাজিয়ে চলছে। আমি তাদের কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই মা এসে আমাকে প্রশ্ন করলো কেমন হচ্ছে সাজানো?

আমি মাথা নাড়িয়ে তারপর মুখ দিয়েও বললাম খুব সুন্দর হয়েছে। হঠাৎ এতো আয়োজন নিজেকে আর চুপ করে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলাম না। মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। মা বললেন না এতো আয়োজন কেন?

মা: এবার মা উচ্চ স্বরে হেসে দিয়ে বলতে শুরু করলো, আরে আজ জাহাঙ্গীরের জন্মদিন তাইতো এতো আয়োজন। আমার একমাত্র ছেলের জন্মদিন। আমিতো বিশাল আয়োজন করতে চাই কিন্তু ও করতে দিতে চায় না। অল্প কিছু অফিস কলিগদের সাথে নিয়েই পালন একটু আনন্দ করে এই দিনটা পালন করে থাকে। অথচ একটা সময় ছিলো যখন ওর জন্মদিনে পুরো বাড়ি রঙ বেরঙের আলোক সজ্জায় সাজানো হতো। পুরো বাড়ি ভর্তি মেহমান দিয়ে ভরা থাকতো। আত্মীয় স্বজনদের মিলন মেলা লেগে যেতো আমাদের বাড়িতে। ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে আর কোন রকম বড় ধরণের অনুষ্ঠান করতে চায় না ছেলেটা। আমিই জোড় করে এই সকল অনুষ্ঠান করে থাকি। ওর অফিসের কয়েকজন কলিগদের দাওয়াত করি, যাতে করে ওর ভালো লাগে সে জন্য।

আমি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পানি চিকচিক করছে। তবে এ পানি কষ্টের পানি না, এটা আনন্দের পানি। মায়ের চোখে সন্তানের জন্য যে ভালোবাসা থাকে। সে ভালোবাসায় চোখের কোনে কিছু হীরা চিকচিক করে জ্বলছে। এতো আনন্দ দেখে আমার নিজের চোখের কোনে কখন জল চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। লোক গুলোর ঘর সাঁজানো শেষ হতেই কাছে এসে বললো আমাদের কাজ শেষ আমরা কি চলে যেতে পারি?

মা খুশি হয়ে ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে হ্যাঁ বাবা তোমরা যেতে পারো। আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবে।

ছেলে গুলো খুশি হয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আমি মায়ের চোখে সন্তানের জন্য ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। কতটা ভালোবাসেন একজন মা নিজের সন্তানকে। তা উনাকে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। জীবনে এই প্রথম আমি এতো বড় বাড়ির কোন অনুষ্ঠান দেখছি। আর এতো বড় আর সুন্দর জন্মদিনের আয়োজন এই প্রথম দেখছি। কত টাকা না খরচ হয় এমন একটা আয়োজন করতে। আমার মেয়ের জন্মদিনে কেক নিয়ে যেতো শাকিল সে কেক কাটতাম সবাই মিলে। তাতেই আমার কাছে বেশ আনন্দ লাগতো। আর এতো বড় বাড়ি এতো আয়োজন। তাহলে এদের আনন্দের শেষ কোথায়?

কথা গুলো ভাবছিলাম যখন ঠিক তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দৌঁড়ে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলাম একটা লোক বিশাল একটা কেক এর প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতো বড় কেকে এর আগে আমি কখনোই দেখিনি। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি কেকটার দিকে। ডেলিভারির ছেলেটা বলে উঠলো ম্যাম কেকটা কোথায় রাখবো।

আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে বললাম। ছেলেটা কেক নিয়ে যেয়ে ডাইনিং এর উপর রাখলেন। মা এসে কেকটা চেক করে ছেলেটাকে বিল সাথে কিছু টাকা বেশী দিয়ে বললো আজ আমার ছেলের জন্মদিন আজ আমি অনেক খুশি। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আজ কত খুশি এই মানুষটা। আর খুশি হবারই কথা ছেলের জন্মদিন বলে কথা।

আরও কিছু টুকটাক কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে আসলো। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আমি সালাদ রেডি করছিলাম। মা বললো তুই কাজ কর আমি যেয়ে দেখি কে আসলো।

মা যেয়ে দরজা খুলতেই জাহাঙ্গীরের বেশ কিছু সহকর্মী বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। মা ওদের বসতে বললো। ওরা সকলে বসে গল্প করছে। মা আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আর কতক্ষণ লাগবে। আমি তাকে জানিয়ে দিলাম আমার শেষের দিকে।

মা: আচ্ছা আমি মেহমানদের হালকা নাস্তা দেই, ততক্ষণে তুই তোর কাজ শেষ করে নে। হয়তো আর অল্প সময়ের মাঝেই জাহাঙ্গীর চলে আসবে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে, মা চলে গেলেন মেহমানদের নাস্তা দেবার জন্য। অল্প সময়ের ভিতর আমার সব কাজ শেষ হয়ে গেলো। আমি সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে নিলাম। এমন সময় আবারো কলিং বেল বেজে উঠলো আমি বুঝতে পারলাম জাহাঙ্গীর এসেছে। মা দরজা খুলে দিতেই উনার সহকর্মীরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করলো।

মা টেবিলের উপর বিশাল কেকটা রেখে আমাকে ডাক দিতে রান্না ঘরে আসলো।

মা: তাড়াতাড়ি সাবাকে নিয়ে আয় কেক কাটবো এখুনি।

আমি কি করবো? এতো মানুষের ভিড়ে আমার লজ্জা লাগবে মা। তার চেয়ে বরং আপনারাই কেক কাটুন। আমি পরে খাবার পরিবেশন করবো।

মা: মেয়ে বলে কি পাগল নাকি তুই? তুই আর সাবা দু’জনই এ বাড়ির সদস্য তোদের রেখে কেক কাটবো অসম্ভব। তাড়াতাড়ি সাবাকে রেডি করে নিয়ে আয়।

আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে। মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমিও তার পিছু পিছু বের হয়ে রুমে গিয়ে সাবাকে ঘুম থেকে তুলে সুন্দর দেখে জামা পরালাম। তারপর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম অনুষ্ঠানের দিকে। আমি জীবনে কখনো এতো বড় লোক বাড়ির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হইনি। তার উপর এতো অপরিচিত মানুষ এসব ভাবতেই ভীষণ ভয় লাগছিলো আমার। ভাবতে ভাবতে ভয়ে ভয়ে অবশেষে উপস্থিত হলাম সেই টেবিলের সামনে। সকলে জাহাঙ্গীরকে ঘিরে রেখেছে। টেবিলের উপর রাখা কেকের উপর মোমবাতি জ্বলছে। আমি যাবার পর জাহাঙ্গীর এসে সাবাকে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যেয়ে আবার দাঁড়ালো কেকের সামনে। তারপর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি গুলো নিভিয়ে ফেললো। এরপর ছুড়ি দিয়ে কেক কাটতে শুরু করলো। সকলে এক সাথে হাত তালি দিচ্ছে সাথে বলতে শুরু করলো হ্যাপি বার্থডে টু ইউ জাহাঙ্গীর। আমিও সবার সাথে সাথে হাত তালি দিচ্ছি কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।

কেক কাটা শেষ হতেই মায়ের মুখে কেক তুলে দিলো। মা আবার উনার ছেলের মুখে কেক তুলে দিলো। কি সুন্দর এক অপূর্ব দৃশ্য। আমার মা বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো কোনদিন আমার জন্মদিন পালন করলে নিশ্চই এভাবে আমার মুখে কেক তুলে দিতো। এরপর জাহাঙ্গীর উনার হাতে থাকা কেক থেকে কিছুটা অংশ সাবার মুখে তুলে দিলো। মা আমাকে ডাক দিলেন। সাথে সবাইকে সোফায় বসতে বললো। মা কেক কেটে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো সবাইকে দিয়ে দেবার জন্য। আমি একে একে সবার হাতে তা পৌঁছে দিলাম। কেকের সাথে পায়েস আর কোল ড্রিংস, পানিও সবার কাছে আমি আর মা দু’জন মিলে দিয়ে দিলাম।

সবার কেক খাওয়া শেষ হবার পর মা সবাইকে ডাইনিং এ এসে বসতে বললো খাবার খাওয়ার জন্য। জাহাঙ্গীর বললো সবাইকে খাবার দিতে সে পরে খাবে। বলেই সাবাকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। আমি আর মা সবাইকে খাবার দিলাম। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলো সকলে খুব প্রশংসা করলো খাবারের। মা বললো এসব রত্নাই রান্না করেছে। সকলের খাবার শেষ হবার পর জাহাঙ্গীর আসলো। সকলে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর। জাহাঙ্গীর সাবাকে আমার কোলে তুলে দিলো।

মা: নে সবাইতো চলে গেলো এবার তুই খেয়ে নে।

জাহাঙ্গীর: তোমরাও সাথে বসো।

আমি না না স্যার আপনি আর মা খেয়ে নিন আমি পরে খাবো।

আমি উনাকে স্যার বলেই ডাকি, কেন জানি উনাকে দেখলে আমার প্রচন্ড রকম ভয় লাগে। হয়তো পুলিশ অফিসার বলেই এমনটা লাগে। উনি মুচকি হেসে খেতে বসলেন। এই হাসির কারণ আমি জানি উনাকে আমি যতবার স্যার বলি ঠিক ততবারই উনি এভাবে হাসেন।

আমি দু’জনকে খাবার বেড়ে দিলাম। প্রথমে পায়েস দিলাম, পায়েস খাওয়া শেষ হবার পর পোলাও আর রোস্ট তুলে দিলাম।

জাহাঙ্গীর: খেতে খেতে আজ খাবারে কেমন জানি ভিন্ন রকম স্বাদ পাচ্ছি।

মা: কেন রে বাবা কোন সমস্যা?

জাহাঙ্গীর: না মা কোন সমস্যা নেই। খাবার খুব ভালো হয়েছে।

মা: আজ সব রান্না রত্নাই করেছে আমি শুধু একটু আধটু দেখিয়ে দিয়েছি।

জাহাঙ্গীর: বলো কি মা এ মেয়ে রাঁধতেও জানে নাকি? আমিতো ভেবেছিলাম শুধু ভয়ে কাঁপতে আর কাঁদতে জানে। পেয়াজ কাটলে যে মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে সে মেয়ে এতো ভালো রান্না করতে পারে আগে জানতাম না।

স্যার যে মেয়ে কান্না করতে পারে, সে মেয়ে রান্নাও করতে জানে। ঐযে একটা কথা আছে না যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে। কথাটা বলেই জিব্বায় কামড় দিলাম হায় আল্লাহ আমি কি বলতে কি বলে ফেললাম।

জাহাঙ্গীর: হাসতে হাসতে বাহ বাহ বেশ ভালো কথাওতো বলতে পারো দেখছি।

এবার আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। কি বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। জাহাঙ্গীর খাবার শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠতে উঠতে বললো বেশ ভালো রেঁধেছো।

ধন্যবাদ স্যার বলেই মাথা নিচু করে সাবাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে একটা দৌঁড় দিলাম।
আর মনে মনে বলছি এই মানুষটাতো বাঘ ও না ভাল্লুক ও না তবুও কেন আমি এতো ভয় পাই?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here