হায়েনা,পর্ব ২

0
569

হায়েনা,পর্ব ২
নাহিদ ফারজানা সোমা

জোহরা বেগম এলাহী আয়োজন করেছেন। পোলাও,রোষ্ট,কাবাব, রেজালা।সুমন আর আরিশার এসব খাবার খুব পছন্দ। আনিলা আসবে আজ,ওর পছন্দের খাবারও বাদ যায়নি।ভাত,শুটকি ভর্তা,নানাপদের সব্জি,ছোট মাছের চচ্চড়ি,মুরগির ঝোল,মুগের ডাল।

টেবিল জুড়ে সবাই খেতে বসেছে। জোহরা সায়নকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। সায়নের বয়স পাঁচ বছর,আনিলার একমাত্র ছেলে।জোহরা বেগমের সাত রাজার ধন।

জোহরা আবিষ্ট গলায় বললেন, “সবাই যখন একসাথে খেতে বসিস,বেহেশতি সুখ পাই।”

“সবাই তো একসাথে নেই। তিন-তিনজন বাদ।দাদাভাই -ভাবী-বাবু।”

জোহরা কিছু বললেন না,কুৎসিত ভাবে মুখ বাঁকালেন।

“কোন খাবারই আমার গলা দিয়ে নামছে না।আব্বার নামছে?”

সামাদ সাহেব গলা খাঁকারি দিলেন। চট করে কিছু বলতে পারলেন না।

জোহরা বিরক্ত গলায় বললেন,”সব সময় এতো পাকামি করিস কেন আনিলা?নিজে না খাস,অন্যদের খেতে দে।”

“তোমাদের জামাই আর তার বাবা-মা কি বলেছেন জানো?আমাকে আসিফ ডিভোর্স দিবে। তোমাদের পাপে।”

রাগে জোহরা বেগম টকটকে লাল হয়ে গেলেন।
“ডিভোর্স দেবে?দিক।আমার মেয়ে এখানে রানি হয়ে থাকবে।”

” সায়নকে ছাড়া থাকবো কি ভাবে? ”

“সায়ন আমাদের কাছেই থাকবে। আমার নাতির নামে আমি ফ্ল্যাট লিখে দিব।”

“দাদাভাই এর ফ্ল্যাটটা?”

জোহরা মুখ শক্ত করে বললেন,”তার জিনিস তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে তার কোন ফ্ল্যাট নেই। ”

“তার মায়ের গয়না, তার নানার দেওয়া দশ বিঘা জমি,মফস্বলের একেবারে সদর এলাকায়,এগুলো বুঝিয়ে দিয়েছ তো?”

“এগুলো সব ভুয়া কথা। তার যা পাওনা,মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ”

“তোমরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে?পরকালের ভয় এতোটুকু পাওনা?”

“কি শুরু করলি আপা?খেতে দে।”

“তোদের এতোটুকু খারাপ লাগে না দাদাভাই এর জন্য? নেমকহারাম দুইটা। কম পাসনিতো তার কাছ থেকে?”

আরিশা-সুমনের কোন হোল-দোল নেই দাদাকে নিয়ে।দাদা থাকলেও ক্ষতি নেই, না থাকলেও না। তারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে।

“আনিলা, খাওয়ার সময় এতো কথা বোলো না।খাও।”
সামাদ সাহেবের গলা।

কিন্তু আনিলাকে আজ ভুতে পেয়েছে। দাদাভাইদের জন্য বুকভরা কষ্ট, নিজের বাপ-মায়ের চরম নীচতা,শ্বশুরকুলের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তার মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে। বাবা-মায়ের জন্য একফোঁটা মায়া কাজ করছে না।

“আসিফ বলেছে আবার বিয়ে করবে।”

“করুক না।দেখি ওর ঘাড়ে কয়টা মাথা।”

“আমাকে বের করে দিবে,সায়নকে রেখে দিবে ওদের কাছে। ওদের ফ্যামিলিতে অনেক বড় বড় আইন বিশারদ আছে।তারা ঠিকই সাত বছর বয়স হলে সায়নকে বাপের কাছে রাখার ব্যবস্থা করবে।”

“করুক।রাখুক ওদের ছেলেকে নিজেদের কাছে।”

“রাখুক ওদের ছেলেকে নিজের কাছে?তারপরতো ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি হবে। বাবুর বাপ আবার বিয়ে করবে, সৎ মা বাবুর উপরে লাগাতার অত্যাচার চালাবে, একসময় বাপ আর সৎ মা মিলে বাবুকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বলবে,এখানে ওর কোন অধিকার নেই। ”

সবাই খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর জোহরা বললেন,”আমরা থাকতে বাবুর কোন সমস্যা হবেনা।”

” সায়নকে যা দিবে তোমরা,ওরা তোমাদের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিক সেগুলো নিজের করে নিবে।দেখবে,তোমাদের ফ্ল্যাটে বাবু নেই, বাবুর সৎ ভাই সুখে শান্তিতে বাস করছে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না।”

আনিলা খাওয়া ফেলে উঠে আসে।সে আসলে খাচ্ছিলো না কিছুই, শুধু ভাত নড়াচড়া করছিল।

আরিশা দেখতে খুব সুন্দর। সে তার সৌন্দর্য নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকে। কোন ভাবে অনার্স করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। বাপ-মায়ের লোভ,স্বার্থপরতা সে আর সুমন উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুটা পেয়েছে। তার নিজের নামে
একটা ফ্ল্যাট থাকবে,এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে তার সুখ, সৌন্দর্য চর্চা,অহংকার আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। মালিবাগে মা আপার জন্য জমি কিনেছে শুনে তার আর সুমনের কিছুটা রাগ আর অভিমানও হয়েছে।
তারা এ ব্যাপারে মা’কে জিজ্ঞাসাবাদ ও করেছে।

“মা,আপার এখানেও ফ্ল্যাট, ওখানেও জমি,তা হবে কেন?আমাদের নামে জমি কই?”

“হবে,হবে। তোমাদের তিন ভাই -বোনের সমান সমান সম্পত্তি হবে।”

“ছেলেরা না মেয়েদের দ্বিগুণ পায়?”

“সব সম্পত্তি আমার নামে সুমন। মা যাকে যেমন ইচ্ছা,তেমন দিবে। কারোর বলার কিছু নেই। আমি তিনজনকেই সমান দিব।”

“তিনজনকেই সমান দিচ্ছ কোথায়?সায়নকেও দিচ্ছ।আপার ভাগে বেশি হয়ে যাচ্ছে না? ”

জোহরা বুকে একটা ধাক্কা খেলেন। এই ছেলেমেয়ে দুটো দেখি ভালোই বৈষয়িক। বাবুকে পর্যন্ত হিংসা করে!

“ওরে,তোদের বাচ্চা -কাচ্চা হোক,ওদেরও দিবো।”
“হ্যাঁ, কবে আমাদের বিয়ে হবে,কবে বাচ্চা, তখন তুমি বেঁচে থাকবে কি না,তার নেই ঠিক, বাচ্চা-কাচ্চার ভাগ আমাদের আগেভাগেই দিয়ে দাও।”

লঘু স্বরে বলা, কিন্তু এটা যে ঠাট্টা করে বলা না, তা জোহরা বেগমের থেকে ভালো কে বুঝবে? ছোট দুইটা ভালোই সেয়ানা হয়েছে।

মেয়েটা দুপুরে খায়নি কিছু। জোহরা প্লেটে ভাত নিয়ে আনিলার ঘরে গেলেন। তিন ছেলেমেয়েকে এখনও নিজের হাতে খাওয়াতে খুব ভালোবাসেন তিনি।

আনিলা খেলো না। জোহরা যতোবার হাত বাড়ালেন, সে হাত সরিয়ে দিলো। তার খিদে নেই।

“এক গ্লাস দুধ এনে দিই।”
“না।”
“চা খাবি?”
“না”।
” যা করেছি,তোদের ভালোর জন্য করেছি।”
“আমাদের ভালোর জন্য? তোমার এই লোভ আর প্রতারণার জন্য আমাদের প্রত্যেকের চরম অকল্যাণ হবে,নিশ্চিত থাকো। ”

“বালাই ষাট। তোমার ভাই তাহলে তোমাদের অভিশাপ দিবে?”

“আমার ভাই অভিশাপ দেওয়ার মানুষ না,তা তুমি খুব ভালোই জানো। তার মায়ের রক্ত আর তোমার রক্ত এক নয়। ইস্,আমার শরীরে যদি বড় আম্মার রক্ত থাকতো!”

জোহরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

“আমি উঠলাম।”
“চটপটি করেছি,খেয়ে যা।”
“আমি দাদার বাসায় যাচ্ছি, ওখানেই দুপুরের ভাত,বিকালের নাস্তা, রাতের খাবার সব খাবো। আসি।”

সায়ন আর বাবু খেলা করছিল। সায়ন পাঁচ, বাবু ছয়। বাবু মাঝে মাঝে সায়নের চুল টানার চেষ্টা করছিল। বাচ্চাটা ঠিক স্বাভাবিক না। পা টাও জন্ম থেকে বাঁকা। প্রথম সন্তানের এই অবস্থা দেখে দাদাভাই -ভাবী কষ্ট পেয়েছিল ঠিকই, ভেঙে পড়েনি একদম।বিয়ের চার বছর পরও যখন বাচ্চা হচ্ছিল না রেণুর,জোহরা বেগমের তখন কত কথা! প্রতিবেশীরা জানতেন না অশ্রু জোহরার নিজের সন্তান নয়। তাদের সামনে ভাবীকে শুনিয়ে জোহরার কত আক্ষেপ!
“নাতির মুখ দেখবো বলে বেঁচে আছি,তা বুঝি আর দেখা হলোনা। ” তারপর বাবু পেটে এলো। মায়ের মুখে আষাঢ়ের মেঘ।ভাবীকে আরও খাটানো,বাপের বাড়ি আর চেহারা নিয়ে আরও খোঁটা দেওয়া। বাবু যখন জন্মালো বাঁকা পা নিয়ে, আনিলা তার মায়ের চোখে দেখেছিল চাপা উল্লাস। নানী-খালা-মামাদের সাথে কথা বলতে গেলেই মায়ের আনন্দিত গলা,”ল্যাংড়া বাচ্চা,মায়ের মতোই কাইলা-কুইলা।” আব্বার সামনেও আম্মা দিব্বি “ল্যাংড়া বাচ্চা” শব্দটা অবলীলায় বলতেন,আর আব্বাও চুপ করে থাকতেন কোন প্রতিবাদ ছাড়া।

বাবুর এক বছর বয়স হতে না হতেই সায়নের জন্ম। নাতি নিয়ে জোহরার আদিখ্যেতার সীমা রইলো না।নাওয়ানো,খাওয়ানো,ঘুম পাড়ানো,রাজ্যের জিনিস কেনা, কথায় কথায় আব্বার কোলে দেওয়া। আনিলার অসহ্য লাগতো।ভাইয়া-ভাবী এসব দেখে কতো কষ্ট ই না পাচ্ছে। সে বাবুকে গোসল করাতো,খাওয়াতো।জোহরা বেগম তখন গজগজ করতেন,”তোর নিজের ছেলে নাই?পরেরটা নিয়ে টানাটানি? ” আনিলা বলতো,”বাবু তোমার পর কিন্তু আমার একান্ত নিজের।আমার ভাই পো।” জোহরা আর কথা বাড়ানোর সাহস পেতেন না।

যখন বোঝা গেলো,বাবু মানসিক ভাবে ভালো রকমের অসুস্থ, আনিলা ভেঙে পড়লো। দাদাভাই -ভাবীর হাতে -পায়ে ধরে বাবুকে বিদেশে নিয়ে যেতে বললো। অশ্রু -রেণুও ছেলের জন্য কম দৌড়াদৌড়ি করে নি। জোহরা বেগম একই সাথে আনন্দিত, যদিও আনন্দের ভাবটা গোপন রাখতে হতো, পাশাপাশি সায়নের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।বাচ্চাটা যদি সায়নকে ধাক্কা দেয়?মারে?রেণু যদি সায়নের ক্ষতি করার চেষ্টা করে?

জোহরা একদিন সবার সামনে নিজের উদ্বেগের কথা
প্রকাশ করলেন। উপসংহার টানলেন এইভাবে, “পাগল-ছাগল বাচ্চা যদি আমার নাতির কোন ক্ষতি করে?তোমরা বাপু অন্য বাসা খুঁজো।”

মা’কে ঐদিন চরম ঘেন্না লেগেছিল আনিলার।বাবা নামের কুৎসিত জীবটাকেও। সে হিসহিস করে বলেছিল,”এটা বাবুর বাড়ি,সায়নের বাড়ি নয়।যেতে হলে সায়ন যাবে,বাবু না।” সবার শত নিষেধ, জোহরা বেগমের কান্না, দাদা-ভাবীর অনুনয় স্বত্বেও সে পরের দিন সকালে চলে এসেছিল শ্বশুর বাড়ি। আসার সময় অশ্রু -রেণুকে বলেছিল, “বাবুকে খুব সাবধানে রেখো। পালা করে অফিস কোরো। দরকার হয়,ডে কেয়ার সেন্টারে রেখো। এই মহিলা মানুষ না,ডাইনী।”
অশ্রু বোনকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলো অনেকক্ষণ। রেণু অঝোরে কেঁদেছিল ননদের ভালোবাসায়।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ঠান্ডা গলায় আনিলা তার মা’কে বললো,”বাবু,দাদা বা ভাবীর যদি কোন ক্ষতির চেষ্টা করো,আমার লাশ দেখতে পাবে।”

অশ্রুর বিয়েতে জোহরা বেগম কৌশলে কোন অনুষ্ঠান হতে দেননি। বৌ পছন্দ না, তাই তাঁর অনুষ্ঠানের ইচ্ছা নেই। বৌএর বাড়ি যে অনুষ্ঠান করবে,তা না করলেই বেশি ভালো। আত্মীয়-স্বজন নিয়ে নাক কাটা যাবে। পরে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দাদা কয়েকজনকে খাইয়েছিল। তাও নানা নাটক করে জোহরা বেগম আসেন নি।

দাদা ভাবীকে বেতনের টাকায় একসেট নেকলেস আর কানের দুল কিনে দিয়েছিল। আর একটা আংটি। রেণুর বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের জন্য একটা চেইন,জামাই এর জন্য ঘড়ি,স্যুট পিস। আনিলা সামাদ-জোহরাকে ধরেছিল, “বড় আম্মার গয়না কই?ওগুলো তো ভাবীর
পাওনা।”

“কি গয়না রেখে গেছিলো তোমার বড় আম্মা?কারা এসব অদ্ভুত কথা ছড়ায়?তার বাপের বাড়ি থেকে অল্প কিছু দিয়েছিল, তাতো ওর চিকিৎসা করতে যেয়েই বিক্রি করতে হয়েছে। ”

“তা তুমি কিছু দাও,আব্বা। তোমার বড় ছেলের বিয়ে।তোমার দায়-দায়িত্ব নাই? ”

“নাই।থাকতো যদি বিয়ে আমাদের পছন্দ মতো হতো।”

আনিলার বিয়ে খুব ধুমধামের সাথে দিয়েছিলেন জোহরা বেগম। গয়নায় মুড়িয়ে দিয়েছিলেন। দাদা এত খরচ করেছিল যে কষ্ট আর অপরাধ বোধে আনিলার বুক ভেঙে গিয়েছিল।

বিয়ের কয়দিন পরে সে স্বামীর অনুমতি নেয় আসিফের দেওয়া ছয়টি চুড়ি ভাবীকে দেওয়ার জন্য, সাথে একটা লম্বা চেইন।আসিফের টাকার অভাব নেই। তাই আপত্তিও নেই।দাদা আর ভাবীকে তারও খুব পছন্দ।

আনিলা মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে রেণুর গলায় হার পরিয়ে দিল, হাতে ছয়খানা চুড়ি। ভাবী তীব্র আপত্তি করলো,অশ্রু কঠিন বকা দিলো, কিছুতেই কাজ হোলনা।

হতভম্ব ভাব কাটিয়ে জোহরা বললেন,”আর কার জন্য কি আনলি?”

আনিলা হাসিমুখে দাদার গায়ে একটা দামী পান্জাবী মেলে ধরে, অনেক পছন্দ করে প্রিয় ভাই এর জন্য সে কিনেছে, তারপর ভাবীর হাতে একটা খাম দেয়।

“ভাবী,আমার শ্বশুরকুল ফাটাফাটি বড়লোক। বিয়েতে নগদ টাকা পেয়েছি অনেক। এই পঞ্চাশ হাজার বাবুর নামে ব্যাঙ্কে রেখো,প্লিজ। আম্মা,এই বাড়ির সবচেয়ে ভালো,সবচেয়ে প্রিয় তিনজনের জন্যই শুধু উপহার এনেছি, আর কারো জন্য কিছু না।” আরিশা দেখতে ভালোই সুন্দর। আর এ ব্যাপারে সে খুব ভালোই ওয়াকিবহাল, আর তাই মাত্রাতিরিক্ত সচেতন। খুব ছোট বেলা থেকে অতিমাত্রায় রূপসচেতন থাকলে যা হয়, সেও তা হয়েছে। লেখা পড়ায় অ্যাভারেজেরও কম। কোন মতে পাশ করে যায় আরকি। বিএ পাশ করেছে টেনেটুনে। জোহরা বেগমের ভারী মনোকষ্ট। আনিলা খুব লক্ষী,এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েটা পড়ালেখাই খুব সাধারণ। চেহারাও সাদামাটা। সতীনপুত্র দেখতে রাজকুমার, ক্লাসে সবসময় টপার, বুয়েট থেকে ফাটাফাটি রেজাল্ট
করেছে,বিদেশে পালা করে সে আর তার বৌ নাকি যাবে অনেক বড় ডিগ্রি নিতে,সেখানে নিজের মেয়েদের এই ছিরি। নিজের তিন ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে তিনি কম করে হলেও দৈনিক দুই গ্লাস দুধ খাইয়েছেন, দুইটা করে ডিম খাইয়েছেন, কচি মুরগির স্যুপ করে খাইয়েছেন, প্রতিদিন ভাতের পাতে গাওয়া ঘি দিয়েছেন, ঘি নাকি ব্রেইন ভালো করে, মুখে তুলে খাইয়েছেন অনেক বড় পর্যন্ত, যেন পেটটা ভরে খায়। না খেতে চাইলে ঠাসঠাস করে মেরেছেন, গয়না বিক্রি করে দুই মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করেছেন ডোনেশন দিয়ে, ভালো ভালো টিচারের কাছে দিনমান রিক্সা নিয়ে ছুটে বেরিয়েছেন কোচিং করানোর জন্য, কিছুতেই কিছু হলো না।মেয়ে দুটো লেখা পড়ায় একদমই সুবিধার না।

ছোট্ট বেলা থেকে শুনে শুনে আরিশা নিজেকে মহাসুন্দর মনে করে। নিত্য নতুন জামাকাপড়, জুতা,লিপস্টিক, নেইল পলিশ,পারফিউম,ঘড়ি,ব্যাগ,মেকাপ বক্সের যোগান দিতে দিতে জোহরা বেগমের নাভিশ্বাস অবস্থা। মহারানির আবার ব্র্যান্ড ছাড়া চলবে না। আনিলার হাতে ভালোই টাকা-পয়সা থাকে, মেয়েটা ভাই বোনদের দেয়না,ঈদ পার্বণ ছাড়া। তার বক্তব্য, এই বয়সী ছাত্র -ছাত্রী টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ চালায়, আরিশা-সুমনকেও তাই করতে হবে। অশ্রুর কাছ থেকে ছোট দুই ছেলেমেয়ের জন্য নিয়মিত ভালো টাকা আদায় করেছেন জোহরা,কিন্তু এখনতো ওরা এখানে থাকে না। আসেওনা।

দুই মেয়ের বিদ্যার হাল দেখে সুমনের জন্য জান দিয়ে চেষ্টা করেছেন জোহরা বেগম। আল্লাহর রহমত,এই ছেলের ব্রেইন ভালো। নিজের আর অন্তত ছজন টিউটরের সাধ্য সাধনায় ছেলে সব পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। সেও দাদাভাই এর মতো ভর্তি হয়েছে বুয়েটে। জোহরা বেগম সারাক্ষণ কানের কাছে পিনপিন করেন,”ঐ ছেলের থেকে তোকে ভালো করতে হবে।” ঐ ছেলে মানে অশ্রু।

সুমন বলে,”পাশ করে কিন্তু আম্মা আমি সাথে সাথে বিদেশ চলে যাবো।বাংলাদেশে থাকবো না।এম এস করবো,পিএইচডি করবো।”

আনন্দে জোহরার দম বন্ধ হয়ে আসে।”অবশ্যই করবি বাপ।এই দিন দেখার জন্যই তো বেঁচে আছি।”

“অনেক,অনেক খরচ। টাকা পাবো কই?”

“ওই ছেলে যাবে কি করে?ওর বৌ? বাপে আদিখ্যেতা করে খিলগাঁতে জমি কিনে দিয়েছে, ওইটা বেচে দিয়েছে নাকি হারামজাদা? ”

“কি সর্বনাশ! এই বাড়িতে তোমার অজান্তে কিছু হয়,আমিতো স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না।দাদা জমিটা নিবেনা। আব্বাকে ফেরত দিয়েছে। ”

“তোর বাপের এতো বড় সাহস!আমাকে বলেনি?”

ভালো লাগার বদলে জোহরা বেগম বেশ অপমান বোধ করলেন।দুই পয়সার ছেলে, জমি ফেরত দিয়ে দিল।তেজ কত?

“আম্মা,বিদেশেও আমি কষ্ট করতে পারবো না। দেশ থেকে টাকা পাঠাতে হবে। ”
“পাঠাবো। আমার টাকা-পয়সা কার জন্য? ”

“আরেকটা কথা আম্মা। দাদাভাই এর সাথে উনার মামা-খালাদের ভাব হয়েছে। ছোট মামা এ আইজি।বেশি তেড়িবেড়ি করলে সমস্যায় পড়তে পারো।বড় মামা বড় ব্যবসায়ী, মেজমামা কলেজের প্রফেসর, মামীও,ছোট মামা পুলিশের এতো বড় অফিসার, মামী ডাক্তার। খালা কলেজে পড়ান, খালু ডিআইজি। বড় মামীও একটা স্কুলে পড়ান।উনারা কিন্তু কঠিন অ্যাকশন নিতে গিয়েছিলেন, দাদার জন্য পারেন নি। না হলে তোমাকে আর আব্বাকে গারদের পিছনে থাকতে হতো কয়েক বছর। দাদা-ভাবী-বাবুর পিছনে আর লেগো না।বাড়ি থেকে তাড়িয়েছ, তার মাল-সামাল ভোগ করেছ,বিস্তর জ্বালিয়েছ, আর ওদের ঘাঁটিও না।পিতৃদেব জানেন,তাও স্মরণ করিয়ে দিও।”

সুমন হাসিমুখে কি অভদ্র ভাবেই না কথাগুলো বললো। আনিলা আর সুমন কি ঘেন্না করে বাপ-মা’কে? আর অশ্রুর মামা-খালাদের এই হাল? বেয়াদবী করলেও সুমন সাবধান করে দিয়ে ভালো কাজই করেছে।

“তুই কি ওদের বাড়ি যাস?ওই ওর মামা-খালার বাসায়?”

“দু’ তিনবার গেছিলাম। অসম্ভব ভালো।”

“যাওয়া লাগবে না। কি না কি ক্ষতি করবে। যাস না ওদের বাড়ি, আনিলাকেও না করবি,নইলে কোন বড় ক্ষতি করে দিবে বললাম। ”

“আম্মাজান, আপনার বাপের বাড়ি আর বড় আম্মার বাড়ির লোকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ”

জোহরা বেগম হতভম্ব হয়ে বসে থাকেন।

রাতে সামাদ সাহেবকে সব বলার পরে তিনি বললেন,”সাবধানে থেকো।এরা দেখি সব বড় বড় পজিশনে উঠে গেছে। একটু আধটু খাতির করা দরকার। অশ্রুকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।ছেলেটার সাথে, বৌএর সাথে ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করো।আফটার অল,অশ্রু আমার ছেলে। তার সাথে তুমি যা করেছো বা করো,তাতে আমার কষ্ট লাগে।”

জোহরা বেগম বিকট মূর্তি ধারণ করলেন, “আমি একা অত্যাচার করি?তুমি সাধু?”

“আমি ভন্ড,আমি অত্যাচারী। তবে তোমার মতো না।তোমার মিথ্যা কথা,ভন্ডামী,তোমার মা-বোন-ভাইদের অনর্গল মিথ্যা বুঝতে পারলেও আমি না বুঝার ভান করেছি। সংসারের শান্তির জন্য, তোমার ছলাকলায় মজে থাকার জন্য। ”

পরের দিন বিকালে আরিশা মা’কে এসে বললো,”মা,তোমার একটা কাঞ্চিপুরম শাড়ি আছে না,ওটা একটু পরবো। বিকালে খুকুর বাড়িতে যাবো। সন্ধ্যায় নানুবাড়িতে যেয়ে রাত আটটার মধ্যে চলে আসবো।”

“ঠিক আছে,শাড়ি বের করে দিচ্ছি। ”

“আমিই বের করে নিচ্ছি।ভালো কথা,আপা ফোন করেছিল।তোমার মোবাইলে পায় নি। একটু পরেই আসবে।সায়ন নাকি নানু নানু করছে।সে নাকি নানুর হাতে কাস্টার্ড খাবে। আপাও বলেছে রাতে খেয়ে যাবে।”

জোহরা বেগম আহলাদে আটখানা হয়ে গেলেন।

“আগে বলবি না বোকা?আমি রান্নাঘরে যাই।সকাল সকাল ফিরিস।একসাথে তিন ভাই বোন খাবি।”

সন্ধ্যা সাতটায় আনিলাকে ফোন করে জোহরা বেগম বললেন,”কি রে মা,এতো দেরি করছিস কেন? খাবার সব রেডি।”

আনিলা আকাশ থেকে পড়লো।জোহরা বেগম পড়িমরি করে আলমারী খুললেন। নেই। তাঁর ৩ বাক্স গয়না নেই, বিশ ভরিতো হবেই।চল্লিশ হাজার নগদ টাকা নেই। দশ-বারোটা ভালো শাড়ি নেই। সামাদ সাহেবের দামী ক্যামেরা নেই। সবচেয়ে বড় কথা,আরিশার কোন পাত্তা নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here