#হায়েনা,শেষ পর্ব
নাহিদ ফারজানা সোমা
“সতীন আর তার ঝি কে তাড়া।দুই মাস তো হয়ে গেল,কিছুই তো করতে পারলিনা।”
“কিছু করতে পারলাম না কই? এই ফ্ল্যাট এখন আমার মামনি,শুধুই আমার।তিন হাজার স্কোয়্যার ফিট।”
“জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছিলাম। সেই কাজ হয়েছে?”
“ইয়েস মম।”
“দেনমোহরের ত্রিশ লাখ তো তোর একার অ্যাকাউন্টটাতে,তাই না?”
“হ্যাঁ। ”
“পরে আর টাকা ঐ অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছিস?”
“না মা।আর দেওয়া হয়নি।”
“গাধা মেয়ে,জামাই কে বলবি প্রতি মাসে একটা থোক টাকা যেন তোর অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। শুধু হাতখরচ দিলে চলবে? নিজের আখের নিজেকে গুছাতে হবে। টাকা-পয়সা এ বেলা গুছিয়ে নাও। আর ঐ সতীন তাড়াও। ”
“সে তার মেয়েকে নিয়ে আমার শ্বশুর -শাশুড়ির কাছে থাকে। তাদের খরচ আমাদের দেয়া লাগেনা।”
“আরে বোকা মেয়ে, তারপরেও পথে কোন কাঁটা রাখতে হয়না। জামাই তাদের খরচ দেয়না,ভালো কথা, কিন্তু আল্লাহ মাফ করুন,জামাই এর ভালো মন্দ কিছু হয়ে গেলে সম্পদ কি তুই একা পাবি? ঐ বৌওতো পাবে। তার মেয়ে পাবে।সময় থাকতে থাকতে যা যা পারো,নিজের নামে করে নাও। আজ সকালেওতো গুলি খেয়ে এক ব্যবসায়ী মরলো। আর হ্যাঁ, বাচ্চা নিয়ে নে তাড়াতাড়ি। ছেলে হলে ফকির খাওয়াবো।”
আরিশা আর জোহরার মিটিং খুব ঘন ঘন হয়।জোহরাই দুদিন পরপর রাজ্যের রান্নাবাড়া করে আরিশার বাড়ি এসে উপস্থিত হন।
“এখন আর আমার উপরে রাগ আছে?যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। জামাইকে হাতের মুঠোয় রাখবি।মুঠো যেন আলগা না হয়।”
এই বুদ্ধি আরিশাকে না দিলেও চলে। সে জোহরার থেকেও পাকা খেলোয়াড়। স্বামী তার আঁচলে বাঁধা।
প্রতি মাসের শুরুতে বাড়িভাড়া তুলে আনিলা আর আরিশার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেন জোহরা। ইদানিং সুমন টাকার জন্য খুব বায়নাক্কা শুরু করেছে।
“ওদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাও আর আমার ভাগের টাকা দিয়ে সংসার চালাও,এ কেমন কথা?”
“সংসার চালানো লাগবে না?তোর বাপ কি এখন চাকরি করে? ”
“ব্যাংক থেকে তো প্রতিমাসে টাকা তুলোই।”
” তোর দুশ্চিন্তার কিছু নাই বাপ। আরও বড় হ,পড়াশোনা শেষ হোক,তখন অ্যাকাউন্ট খুলে দিব।”
“আমাকে কিন্তু ঠকাচ্ছ মা। আমার অ্যাকাউন্ট খোলারই পারমিশন দিচ্ছনা,আর আপাদের ব্যাংক-ব্যালান্স হিমালয়ের সমান উঁচু করে দিচ্ছ। আর ওদেরও বলিহারি। একেকজনের স্বামী টাকার কুমির, তাও বাপের বাড়ির ভাগ পাইপাই করে বুঝে নেওয়া চাই। ”
জোহরা মনে মনে প্রমাদ গুনেন।সুমন খুবই মেধাবী, একসময় ফাটাফাটি রেজাল্টও করতো, কিন্তু এখন তার লেখা পড়ায় ধ্বস নেমেছে। আর ছোট বেলা থেকেই এই ছেলে চরম স্বার্থপর। মানবিক গুণাবলি নিয়ে তিনি খুব একটা মাথা ঘামান না,কিন্তু তাঁর বড় আশা ছিল লেখাপড়ায় অন্তত এই ছেলে অশ্রুকে টেক্কা দিবে। হোল না।
এক সন্ধ্যায় আনিলার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার পর জোহরা আর সামাদ সাহেব সবিস্ময়ে দেখলেন,আলমারীর পাল্লা খোলা,লকার ভাঙা,জোহরার হিসাব মতে, প্রায় লাখ টাকা গায়েব।
বাসায় শুধু সুমনই ছিল। এখন নেই। তার কাছে বাসার সদর দরজার এক্সট্রা চাবি আছে। কাজের মেয়ে ফুলিকেও নিয়ে গেছিলেন নিজেদের সাথে। মেয়েটার বয়স চৌদ্দ -পনেরো। রাতে রান্নাঘরে ঘুমাতো। এক সকালে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ করেছিল, রাতে সুমন ভাইয়া তার গায়ে হাত দিয়েছে। ঠাস করে চড় লাগিয়েছিলেন জোহরা।
“জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো হারামজাদি। আমার ছেলের নামে মিথ্যা কথা।ফের যদি এমন কথা শুনি বা কাউকে যদি এসব বানানো কথা বলিস আর আমার কানে আসে,বাড়িতে তোর লাশ পৌঁছাবে বলে দিলাম।”
চোটপাট করলেন বটে কিন্তু সত্যিটাতো ভালো করেই জানেন। ছেলেকে গোপনে বুঝাতে গেলেন তার ঘরে।
“এই বয়সে ভুল -ত্রুটি হয় বাবা। তবে এমন ভুল আর কোরোনা,লক্ষ্মী বাপ আমার। এরা ছেনাল ধরনের মেয়ে,কিভাবে তোমাকে ফাঁসিয়ে দিবে,তুমি সরল মানুষ, টেরও পাবেনা।”
“যেমন ভাবে নানী ফাঁসিয়েছিল নানাকে?”
এরপর থেকে ফুলিকে নিয়ে আলাদা ঘরে ঘুমান জোহরা।যেখানে যান,সাথে করে মেয়েটাকে নিয়ে যান।
রাতে সুমন বাসায় ফিরলে তার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে আসলেন জোহরা। সামাদ সাহেবও ঘরেই ছিলেন।
“লকার ভেঙে টাকা নিলি কেন?লাখ খানিক টাকা। এতো টাকার কি দরকার তোর?”
“কি যা তা বলছো?তোমার ঘরে আসিইনি আমি। দুপুরে ঘুমালাম।ঘুম থেকে উঠে ক্যাম্পাসে গেলাম আড্ডা দিতে। কি ঘটনা?আলমারী,লাখ টাকা…এগুলো কি বল?”
“টাকা কোথায়?”
“কি বলো মা,কিছু বুঝতে পারছি না। ”
ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিলেন জোহরা বেগম, সুমনের গালে।
ছেলে খপ করে মায়ের হাত চেপে ধরলো।
“তোমার এতো বড় সাহস,আমার গায়ে হাত তোলো। পৃথিবীর এক নম্বর বাজে মহিলা! আমি টাকা নিয়েছি প্রমাণ কি? তোমার মেয়েদের কাছে এক্সট্রা চাবি নেই? তোমার ছোট মেয়ে এসে গোপনে এই কাজ করতে পারে না?সেওতো তোমার মতো লোভী।”
জোহরা অন্য হাতে আরেকটা চড় কষালেন। সুমন মায়ের ডান হাত মুচড়ে দিলো। জোহরা ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
“দিই হাতটা ভেঙে? এতো বড় সাহস,তুমি সুমনের গায়ে হাত তোলো? তোমার দুই টা হাতই ভেঙে টুকরো করে ফেলবো।”
জোহরা আর সামাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাস্তব জগতে আছেন না স্বপ্ন দেখছেন?
প্রথম সামলে উঠলেন সামাদ সাহেব।
“বদমাশ ছেলে, মায়ের হাত ছাড়ো। এতোটা অধঃপতন তোমার? ”
“বুড়ো,তুমি চুপ করো। আমাকে শাসন করতে এসোনা। যে লোক নিজের মা মরা ছেলেকে ঠকায়,সে আমাকে
বদমাশ বলে? টাকা নিয়েছি,বেশ করেছি। যখন লাগবে তখনই নিবো। জোড়া খুন করতেও আমার হাত কাঁপবে না,কথাটা মাথায় রেখো।”
কয়েকদিন পরের ঘটনা। অশ্রুর বাসা।
“”আনিলা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে যে বোন।”
“কেন দাদাভাই, হঠাৎ এ কথা বলছো কেন?”
“বা রে, আসিফের অনেক টাকা-পয়সা আছে বলে তুই নিজে কিছু করার চেষ্টা করবি না? ”
“আমার যে কোন যোগ্যতা নেই দাদাভাই। ঘষটাতে ঘষটাতে কোন ভাবে পাশ করা মেয়েকে কে চাকরি দিবে বলো?”
“কে চাকরি দিবে কথাটাতে আমার আপত্তি আছে। কারোর দেওয়ার অপেক্ষায় কেউ থাকবে কেন? কেউ দিবে এই চিন্তাটাও বা আসবে কেন? নিজের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই তো আসল শিক্ষা নয়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে কি চাকরি ই করতে হবে?আর কিছু করা যায়না?”
“কি করবো? আমারতো কোন গুণ নেই। সেলাই-ফোঁড়াই,ভালো রান্নাবাড়া কিছু পারিনা। একেবারে ওয়ার্থলেস যাকে বলে।”
“এক থাপ্পড় লাগাবো। তুই কি,তোর মধ্যে কি আছে, তা তুই নিজেই জানিস না। আমার চোখে তুই পৃথিবীর এক নম্বর শ্রেষ্ঠ মেয়ে,তবে তিনজন একসাথে। ”
“আমার সাথে নিশ্চয়ই বড় আম্মা আর ভাবী এক সিটে বসে আছে?”
অশ্রু হাসলো।
“শিখে নে। সেলাই, রান্না,বাটিক-বুটিক,মোমের কাজ শিখে নে। আজকাল অনেক মেয়ে দুর্দান্ত ব্যবসা করছে।”
“সায়নের আব্বুর কাছে আমার কিছু চাইতে ইচ্ছা করে না,দাদা। ও সবসময় বলে,আমার যা লাগে আলমারি থেকে যেন নিয়ে নিই,কিন্তু আমার একদম ইচ্ছে করেনা।”
“তোমার নিজের অ্যাকাউন্টেইতো অনেক টাকা জমার কথা বোন।”
“ভাবী, মা আমার নামে ফ্ল্যাট ভাড়ার যে টাকা রাখে,আমি তা ছুঁয়েও দেখিনা,দেখবোও না। যে বাড়িতে আমার দাদাভাই এর অধিকার নেই, সে বাড়ি আমার বাড়ি কখনো হতে পারে না।”
“পাগল মেয়ে। আমিতো ইন্জিনিয়ার মানুষ, তোর ভাবীও,আমাদের দিন ভালোই চলে যায়। কেন তাহলে এসব হাবিজাবি ভাবিস?”
“না দাদাভাই, কিছুতেই ও ফ্ল্যাটের ভাড়া আমি নিতে পারবো না। এইতো বেশ আছি,খাওয়া-পরার তো কোন অভাব নেই। ”
আনিলা আসলেই খুব বেশি সাধারণ থাকে। চাহিদাশূন্য মানুষ।
বাবুকে রেণু কোলে করে নিয়ে এসে আনিলার কাছে দেয়।
“বাবুর ঘুম ভেঙে গেছে, ধরো ওকে, আমি একটু তোমার প্রিয় চপ বানাই।”
আনিলা বাবুকে বুকে চেপে ধরে। বাবুর মুখ একদিকে একটু কাত হয়ে থাকে, মুখ দিয়ে লালা পড়ে মাঝে মাঝে, কারো দিকে তাকায় না, হঠাৎ হঠাৎ দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলে।
রেণু এক বাটি স্যুপ আনিলার হাতে দিয়ে যায়। আনিলা খুব যত্ন করে ভাইপো কে খাওয়াতে থাকে।
“দাদাভাই, সুমনটাতো একদম উচ্ছন্নে চলে গেছে। মা সেদিন কান্নাকাটি করছিল, ড্রাগ ধরেছে বোধ হয়। আমার বাপ-মায়ের ছেলে কি আর হবে,বলো দাদাভাই? ”
“আনিলা, বাপ-মাকে নিয়ে কথা বলতে নেই। সমালোচনা করে কোন লাভ আছে বল? বাপ-মা’র দোষে বাচ্চা কাচ্চা নস্ট হলে আমার বা তোর ভাবিরও নিশ্চয় কোন পাপ আছে। নইলে বাবুর এ অবস্থা হবে কেন?”
“দাদাভাই! কার সাথে কার তুলনা কর? বাবু অসুস্থ, নস্ট নয়। আর সুমন মাথা থেকে পা পর্যন্ত নস্ট ছেলে।”
লকার ভাঙার ঘটনার পর প্রায় ছয়মাস চলে গেছে। সুমন এখন ভয়ংকর বেয়াদব, বেপরোয়া। জোহরা বাধ্য হয়েছেন তার নামে অ্যাকাউন্ট খুলতে, মাসে মাসে ফ্ল্যাট ভাড়ার টাকা সেখানে জমা রাখতে। তাও ছেলের সাধ মেটে না। আরও টাকা লাগবে। জোহরা বেগমকে সে ইদানিং শাসাচ্ছে,বোনদের ভাগও তার নামে লিখে দিতে।দুই বোনই মহা বড়লোক।
“তোর লজ্জা লাগলো না এই কথা বলতে? নিজের দুই বোনকে হিংসা? কুলাঙ্গার কোথাকার? ”
“আমার ভাইকে যখন ঠকাতে পেরেছ তারই ভাগের জমি,গয়না হজম করে,তখন তোমার দু’ মেয়েকে আমি ঠকাতে পারবো না কেন? আর আমি হলাম ছেলে, আমার অর্ধেক পাবে ওরা। আস্ত আস্ত ফ্ল্যাট ওদের নামে কেন?”
“বাড়ি আমার নামে। আমি আমার ইচ্ছেমতো ভাগ বাটোয়ারা করবো।দরকার হয়, তোকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিব।একটা ফুটো পয়সাও পাবি না।”
“ঠিক ওইদিনই তুমি ছবি হয়ে যাবে জননী। কিরা কেটে বলছি।”
জোহরা বেগমের হাত-পা কাঁপতে থাকে। সুমন এখন একটা দানবের নাম। সে সবই পারে।
আরিশা ভয়ে এ বাসায় আসে না। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো,আরিশা তার বাপ-মাকে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে তার বাসায় যেতে। কারণ সপ্তাহ দুয়েক আগে সুমন যেয়ে তুমুল হল্লা করে এসেছে আরিশার সাথে। টাকা আর গয়না দাবী করেছে। ছুরি দেখিয়েছে।চৌদ্দ ভরি গয়না সে আরিশার গা থেকে খুলে নিয়েছে বুকে ছুরি ধরে। গলার হার-কানের দুল-আংটি,চুড়ি,সব মিলে চোদ্দ ভরি। এসময়ে কাজের ছেলের গোপন ফোন পেয়ে আরিশার স্বামী তার তিনজন ষন্ডা টাইপের কর্মচারী নিয়ে হাজির। একটু পরে পুলিশ। এক রাতে হাজতে থেকে খালাস। তাকে ছাড়িয়ে আনার ইচ্ছা সামাদ সাহেব, অশ্রু, আনিলা কারোর ছিলোনা, জোহরা বেগমের আহাজারিতে এবং এক পর্যায়ে ছোট জামাইএর পা জড়িয়ে ধরাতে আরিশারা মামলা তুলে নিয়েছে। সেদিন থেকে আরিশাদের সাথে সবার সম্পর্ক শেষ। আরিশা প্রচন্ড খেপেছে মায়ের উপরে।
“এমন ছেলের জন্য এতো নাটক। ওকে তো আমি ক্রসফায়ারে দিতে চেয়েছিলাম। এখন ছাড়া পেয়ে ড্যাঙ ড্যাঙ করে ঘুরবে, গলায় এবারে ছুরি ধরেছিল, এরপর গুলি করবে। তোমার তাতে কি আসে যায়?ননীগোপাল তোমার কোলে থাকলেই হলো। আজ থেকে কেউ তোমরা আমার বাসায় এসো না,আমিও যাবো না।”
এতো কিছুর পরেও একদিন জোহরা গিয়েছিলেন আরিশার বাসায়। সন্তান স্নেহ বলে কথা। কমপ্লেক্সের দারোয়ান তাঁকে গেটের ভিতরে ঢুকতেই দেয়নি। সাহেব-মেমসাহেবের কঠিন নিষেধ আছে। হাজার গলাবাজিতেও কাজ হয়নি।
সামাদ সাহেব একদিন বলে বসলেন,”সবই আমাদের দুজনের কর্মফল।”
অশ্রুর পুলিশ মামার সাথে তাঁর একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল রাস্তায়। কেউই কাউকে চিনতে পারতেন না
এতোদিন পরে,কিন্তু মামার সাথে অশ্রু থাকায় সামাদ সাহেব পালানোর পথ পেলেন না।পুলিশের বড় কর্তা নিচু কিন্তু অবিশ্বাস্য কঠিন গলায় তাঁকে বেশ দুটি কথা শুনিয়ে দিলো।
” এতো জঘন্য একটা লোকের সাথে আপাকে কিভাবে বিয়ে দিয়েছিলেন আমার আব্বা? লোক চিনতে এতো বড় ভুল করলেন তিনি! একই সাথে চোর,ডাকাত,ঠগবাজ,ঘুষখোর। এতো নির্লজ্জ,মিথ্যাবাদী,ভণ্ড আমি আমার পুলিশ জীবনে দেখিনি। প্রতারণার দায়ে শ্বশুর বাড়ি ঢুকাতে আমার দু’মিনিট সময় লাগতো,অশ্রুর অনুরোধে হলো না। কাপুরুষ,কেঁচো একটা।”
অশ্রু শুনতে পায়নি কথাগুলো। সে বাপকে সালাম দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। অশ্রুর মামা একদলা থুথু সামাদ সাহেবের পায়ের কাছে ফেলে বড় বড় পায়ে হেঁটে অশ্রুর কাছে চলে গেলেন।
ইদানিং মৃত্যুভয় জেঁকে বসেছে সামাদ সাহেবের। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও লাভ হচ্ছে না। সারাজীবনের অপকর্মের ছবি সারাক্ষণ মনের পর্দায় ভাসে। বিশেষ করে অশ্রুর বিষয়টি। তাঁর প্রথম সন্তান। কিভাবে আদরে-যত্নে মানুষ হওয়ার কথা ছিল আর কিভাবে হলো! হাজার তওবা করলেও এই গুনাহ মাফ হবে?
এক বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে “জোহরা মন্জিলে”।
সামাদ সাহেব স্ট্রোক করেছিলেন। এখন শয্যাশায়ী। খাইয়ে দিতে হয়, টয়লেটে নিয়ে যেতে হয়। একজন তরুণ এইসব কাজ করে দেয় বটে,তবে প্রসন্ন চিত্তে না। বেতন নেয় অবশ্য প্রচুর। সেই সাথে কথায় কথায় বখশিশ তো আছেই। খরচ অশ্রু বহন করে। একজন ফিজিওথেরাপিস্টও আসেন। তিনি রেণুর দুলাভাই, অর্থাৎ অশ্রুর ভায়রা। ভদ্রলোক অসম্ভব দক্ষ, যত্নবান,কিন্তু হাজার অনুরোধেও তিনি ফি নিতে রাজি নন। ভায়রার বাবার কাছ থেকে টাকা নেওয়া তাঁর কাছে এথিকস বিরোধী। তাছাড়া অশ্রু ভাই আর রেণু আপাইতো তাঁর স্ত্রী শানুকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন। এমন ভায়রার বাবার কাছ থেকে ফি নেওয়াও গুনাহ।
সামাদ সাহেব শোনেন,তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে,গোঁ গোঁ করে দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলতে চান, অশ্রু আসলে ব্যাকুল হয়ে তার হাত চেপে ধরে থাকেন।
জোহরা বেশ কয়েকমাস আগে নির্জনে অশ্রুর দু’হাত চেপে ধরে ক্ষমা চেয়েছেন। সাথে হাউমাউ কান্না। আসলে জীবনে তারুণ্য, শারীরিক শক্তি, ক্ষমতা, ঐশ্বর্য যে ক্ষণস্থায়ী, জীবনের যে বিভিন্ন অধ্যায় আছে,তা জোহরা ভুলেই গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তাঁর রাজত্ব একই ভাবে চলবে, চলতেই থাকবে,এই সুখ আর ক্ষমতার কোন শেষ থাকবে না।
জোহরা তাঁর নিজের নামের ফ্ল্যাট অশ্রুকে লিখে দিয়েছেন।আর পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বাবুর নামে। রেণুকে নিজের পনেরো ভরি গয়না। অশ্রু বিনিত গলায় এসব নিতে জোর অস্বীকার করেছে। তারা দুজন ইন্জিনিয়ার, বেসরকারি নামকরা প্রতিষ্ঠানে আছে, প্রচুর বেতন। তাদের অভাব নেই। আব্বা-আম্মা নিজেদের ফ্ল্যাটে
ভালো থাকলেই সে সুখী।
জোহরা অশ্রুর কথা কানে তুলেন নি। ফ্ল্যাট অশ্রুর নামেই করেছেন। বলেছেন, “জোর করার মুখ আমার নেই বাবা। তোর যেদিন খুশি,সেদিনই চলে আসবি। এই পিশাচ মহিলাকে যদি পারিস,ক্ষমা করে দিস।”
রেণু বাধ্য হয়েছিল গয়নাগুলো নিতে।
বাবু বাঁচেনি। অশ্রু -রেণু অনেকদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। আনিলা পাগলের মতো কান্নাকাটি করেছিল। আরিশা আর সুমনের মতো মানুষও শোকে কয়েকদিন মুহ্যমান ছিল ভাইপোর মৃত্যুতে। সামাদ সাহেব বুক চাপড়াচ্ছিলেন আর বিচিত্র শব্দ করছিলেন। জোহরা বেগমের আন্তরিক বুক ফাটানো কান্নায় অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই, আসলে এই কান্নায় মিশে ছিল অনেক কিছু _বাবুকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন সময়ে বলা জোহরার নানা কটু কথার জন্য প্রবল অনুশোচনা ও লজ্জা, যেমন পাগল,লুলা,সাক্ষাৎ শয়তান ইত্যাদি, নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা, সারাজীবনের নানা কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা, আরিশার জঘন্য মন-মানসিকতা আর কাজকর্ম, সুমনের একশত ভাগ বখে যাওয়া, এতো ঘটনার পরেও তাঁর প্রতি অশ্রু -রেণুর দায়িত্ব পালন, তাদের কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়ার লজ্জা, সবকিছুই মিশে ছিল এই হৃদয় বিদারী কান্নার মধ্যে।
অনেক পরে জোহরা রেণুকে বলেছেন,”বাবুর নামে আমার রাখা টাকাটা কোন ভালো কাজে দান কোরো। আমি মন্দ,টাকাটাও মন্দ ভাবে আয় করা, কিন্তু মা, বাবুর জন্য আমার নিয়তটা মন্দ না।”
বাবু মারা যাওয়ার দুই মাস পরেই হার্ট অ্যাটাক করলেন জোহরা। অপারেশন লাগলো। অশ্রু, তার দুই মামা রক্ত দিলো। রেণু বাকী রক্ত জোগাড় করে দিলো।
একই গ্রুপ হওয়া সত্ত্বেও দুই জামাই আর সুমন দিলো না। তাদের ভয় লাগে।
আনিলা তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সব টাকা দিয়ে
দিয়েছে বাবুর নামে গড়া ফাউন্ডেশনে। জোহরার দেওয়া টাকা,আনিলার টাকা, অশ্রু -রেণুর টাকা,রেণুর ভাই -বোনদের দেওয়া টাকা আর বাবুর নানার দেওয়া একটুকরো জমিতে খুব ভালো ভাবে শুরু হয়েছে ফাউন্ডেশনটি। সব দায়-দায়িত্ব নিয়েছে আনিলা। কোনো শিশু যেন চিকিৎসার অভাবে না মরে। আসিফ মানুষটার চরিত্র সুবিধার না হলেও বৌএর কাজ কর্মে সে বাধা দেয়না। আনিলাকে সে খুবই ভালোবাসে। সবসময়ই বাসতো। কিন্তু বিকৃত জৈবিক চাহিদা তাকে পথভ্রষ্ট করে। আনিলা আসিফের সাথে বোনের সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানেনা।
আরিশার বর এখন আর বৌকে খাতির করেনা। বৌকে প্রায় বলে,”তোমার নজর ছিল টাকাপয়সা,বাড়ির দিকে। ভুল করে সব দিয়ে দিয়েছি। এখন নিজের পথ মাপো। আর বাচ্চা -কাচ্চার কথা ভাবনাতেও এনোনা।তোমার -আমার বাচ্চা কেউটের ছানা বই অন্য কিছু হবে না। ” বলতে গেলে আরিশার সব গয়নাই কেড়ে নিয়েছে চামারটা। আবার বিয়ে করার ইচ্ছা বোধ হয়। আরিশার থাকলো গুলশানের বিশাল ফ্ল্যাট আর পঞ্চাশ লক্ষ মতো টাকা, সামান্য কিছু গয়না, মায়ের দেওয়া ফ্ল্যাট, টাকা,গয়নাগাটি।
আরিশার শ্বশুর তাঁর ব্যবসার একটি বড় অংশ পুত্রের প্রথম স্ত্রী আর নাতনির নামে লিখে দিয়েছেন। বিশেষ করে সবচেয়ে লাভজনক পরিবহন ব্যবসা।তাঁদের অবর্তমানে বৌমা আর তার মেয়ের যেন এতোটুকু সমস্যা না হয়,তার সব ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। আরিশা ও তাঁর স্বামী ধানমন্ডির ওই বাসায় নিষিদ্ধ।
সুমনের বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সব বাড়াবাড়ির অবসান ঘটলো দায়ের কোপে নিজের বাড়িতে,কাজের মেয়ের হাতে।
এককালে জোহরার খুব ইচ্ছা ছিল, তাঁর ছেলেমেয়েদের ছবি পেপারে ছাপা হোক। সুমনের ছবি দেশের সব সংবাদপত্রে কয়েকদিন ধরে রমরমা খবরসহ ছাপা হলো, দুএকটা ম্যাগাজিনেও ছাপা হলো। সবাই ছিছিক্কার করলো,কেউ থুথু ফেললো। বুয়েটের ছাত্র হয়ে এতো নোংরা? আনিলা-আরিশার স্বামী যার যার বৌকে কথা দিয়ে ধুয়ে ফেললো।
পাহাড় সমান কষ্টের মধ্যেও জোহরা একটু স্বস্তি পেলেন কি?
কিছুই ভালো লাগেনা। খেতে ইচ্ছা হলে খান,নতুবা না। রেণু বা আনিলা প্রতিদিন ই এসে সাধ্যমতো চেষ্টা করে তাঁকে খাওয়াতে। চুল বেঁধে দেয়,গল্প গুজব করে।জোহরা চুপ করে বসে থাকেন।
জীবনের কতোটুকু অংশ আর অবশিষ্ট আছে? প্রায় পুরো অধ্যায় কেটে গেলো অমানুষের মতো… আকণ্ঠ লোভ,হিংসা,স্বার্থপরতা,মিথ্যাচারিতা,ঠগবাজি করে।
জীবন নাটকের শেষ অংকে এসে খুব মানুষ হতে ইচ্ছা করে।
অশ্রু আসে।
“আপনি এখন পর্যন্ত কিছু খাননি? সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। শুকিয়ে কি অবস্থা আপনার! রেণু, স্যুপটা খাইয়ে দাওতো। উঠুন, স্যুপটা খান। আপনার পছন্দের খাবারগুলো রেণু নিজে রেঁধে এনেছে, উঠুন, খান। আমাদের দিকে তাকান। আমাদের বাবুও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের বুকের ভেতরেও দগদগে ঘা। এই ঘা কখনো শুকাবে না। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকলে চলবে? ”
“আমি সুমনের শোকে শুয়ে থাকি,কে বললো তোকে? আমার আসলে কিছু ভালো লাগে নারে। আর আমি এখন মরলেও ক্ষতি নেই, আমাকে কারোর দরকার নেই। ”
“কে বললো, আপনাকে কারোর দরকার নেই? ”
“অশ্রু, ঠাট্টা করছিস বাবা?”
“মোটেও না। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে, বাবুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব। অনেক কাজ। এখন শুয়ে থাকলে চলবে?কেমন দাদী আপনি?”
অনেকদিন পরে জোহরা চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন।
“কেমন করে আমাকে আর তোদের বাপকে ক্ষমা করলি অশ্রু -রেণু?কেমন করে আমাদের এতো খেয়াল করিস তোরা? অশ্রু, সেই ছোট্ট বেলার মতো আমাকে আবার ডাকবি মা বলে? সত্যি ই আমাকে মা ভাবতে পারবি?”
অশ্রু চুপ করে থাকে।
জোহরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অশ্রু জোহরা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। তারপর অস্ফুট গলায় ডাকে,”মা।”
সমাপ্ত