#হিউবট (থ্রিলার),পর্বঃ-০৪ শেষ
লিখাঃ- সুহাসিনী
বিছানায় পঁচিশ কিংবা ত্রিশ বছর বয়সী একটা ছেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আর তার উপর ওসানা! ওসানার নগ্ন দেহ। বিছানার পাশেই খুলে রাখা একটা গাউন! ওসানার চোখ দুটো নিষ্পলক চেয়ে আছে ছেলেটির দিকে।
মুহুর্তেই বমি চলে আসে শানের। চোখ নামাবে নাকি এই রহস্যের সন্ধান করবে- সেটা বোঝার আগেই মাথা চক্কর দেয় তার। কী ভয়ংকর! কী নোংরা সেই চোখ!
নিজের মুখ চেপে ধরে দ্রুত রাস্তায় চলে আসে শান। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। একজন বয়স্কা মহিলার অল্পবয়সী ছেলের সাথে এইরুপ বিভৎস দৃশ্য ঠিক হজম হলো না ওর। গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা বাসায় ফিরে আসে সে। লিনা দরজা খোলা রেখেই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে আছে। শানের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো,
– এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
-ওসানা!
– হ্যাঁ, ওসানার সম্পর্কেই বলবো তোমাকে।
– তুমিও জেনে গেছো?
– আমি নাহয় জানলাম। কিন্তু তুমি হঠাৎ এরকমভাবে জিজ্ঞাসা করছো কেন? কী হয়েছে তোমার?
– আমি আজ ওসানাকে একটা অল্পবয়সী ছেলের সাথে…!
শান আজকের সমস্ত ঘটনাই লিনাকে শেয়ার করে। কিন্তু এতসব কিছু জানার পরেও লিনার ভিতর কোনো ভাবান্তর নেই। যেন এটাই হবার ছিলো। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সে বললো,
– ব্যাপারটা দেরিতে হলেও এটাই হবার ছিলো শান। মিস ওসানা কোনো সাধারণ মানুষ নয়। সে একজন হিউবট।
-হিউবট! মানে?
– মানুষের শরীরের রোবটিক্স বিহেভিয়ার। সুজানা আজ আমাকে জানালো, ওসানার আসল বাড়ি মুম্বাইয়ে। সেখানে ওর বাবা মা কেউই জীবিত নেই আর। তাকে বাড়ির বাইরে আনা হত না। মূলত এক অদ্ভুত জীবাত্মা নিয়ে তার জন্ম। মানুষের গর্ভে জন্ম নিলেও রোবটের মতই মস্তিষ্ক এই ওসানার। তুমি ওর থেকে যেকোনো তথ্য নিমিষেই পেয়ে যাবে। এরকম একজন হিউবট ছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়। তিনিও মহিলা ছিলেন। গত কয়েক বছর আগে সেখানকার সরকার তাকে মেরে ফেলেছে। এখন এই একজনই আছে। ওসানা। ওসানার বিষয়ে ওর পরিবারও তেমন বুঝে উঠতে পারেনি কখনো। ওর বাড়িতে ওসানার ভাইয়ের ছেলে রাজীব মেহতার সাথে কথা বলে সুজানা জানতে পেরেছে- উনি যখন ছোট ছিলেন, তাও প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে হঠাৎই ওসানা উধাও হয়ে যায়। রাজীব ওর বাবার থেকে ছোটবেলায় শুনে এসেছে, একবার ওসানার বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। কিন্তু সেদিনই পাত্রের সাথে ওসানা নাকি কিছু অদ্ভুত আচরণ করে। এরপর আর বিয়ের ব্যাপারে কথা ওঠেনি। বিষয়টা কী ছিলো, তা কেউই জানে না।
শান অবাক হয়। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সেও সোফায় বসে পড়ে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে,
– এখন আমাদের কী করণীয়? এই মহিলা কি শক্তিশালী?
-হ্যাঁ, অবশ্যই শক্তিশালী। তার শরীরে রোবটিক্স শক্তি আছে। তুমি, আমি শক্তিতে পেরে উঠবো না। ওসানা নিজের শরীরের কোষ দিয়ে মানুষের গর্ভে ভ্রূণ তৈরির ক্ষমতা রাখে। এটা ওই দক্ষিণ কোরিয়ার মহিলাটি চেষ্টা করেছিল। তার আগেই সরকার তাকে মেরে ফেলেছে।
– তাহলে এই মহিলাকে আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো?
– ওর মস্তিষ্কের একেবারে সামনে আঘাত করতে হবে। এদের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে রোবটিক্স বুদ্ধিমত্তা থাকে। ওটাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারলেই আমরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। আমি আরিফের সাথে কথা বলেছি। আমরা একসাথেই ওসানার বাসায় যাবো। আর সেটা খুব দ্রুতই। কারণ আজ তুমি ওসানাকে যেভাবে দেখেছো, আমার সন্দেহ- ওসানা তার বংশবিস্তারের চেষ্টা করছে।
– তবে তো এখনই যাওয়া উচিত। আমি কিন্তু প্রস্তুত আছি।
কিন্তু লিনা রাজি হয় না। পরদিন কোনোরকমে কাটিয়ে ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে তারা তিনজনে আবার ওসানার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আজ রাস্তায় বিশেষ মানুষজন নেই। একরকম সুবিধাই হলো বটে। সাথে কেউই মোবাইল ফোন নেয়নি। কে জানে, এই মহিলাটি কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে বুঝে নেয় কি-না। প্ল্যানিং অনুযায়ী আরিফ এবং লিনা আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। অন্যদিকে শান গিয়ে কলিংবেল চাপলেও ভিতর থেকে ওসানা কোনো সাড়া দেয় না। বেশ কয়েকবার চাপার পর অবশেষে সে এসে দরজা খুলে দিলো। তারপর কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
– কে আপনি? কী চান?
শান ভীষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানায়,
– আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ডাক্তার শান।
ওসানা তাকে না চেনার ভান করে জবাব দিলো,
– ডাক্তার শান বলতে?
-আপনার মেয়ে দিপার ডেলিভারি করেছিলাম কয়েক সপ্তাহ আগে…
– ও আচ্ছা, হ্যাঁ বলুন।
-উনার কিছু রিপোর্ট দেওয়া বাকি। আপনি তো না নিয়েই চলে এসেছেন। সেটাই দিতে এলাম।
-হুম, দিন।
-আপনি জানেন? আপনার মেয়ের শরীরে যকৃত ছিলো না। তারপর দিপার যে ছেলে, মানে আপনার কথায় যার নাম সনো। তার গায়ের রঙ কিন্তু যকৃত রঙেরই ছিলো।
ওসানা বিরক্ত হয়। গলা খাকিয়ে সে বলে ওঠে,
-আপনি রিপোর্টগুলো দিন। এত কথা শুনতে ইচ্ছুক নই।
-আমি কি ভিতরে এসে বসতে পারি? একটু পানি খেতাম।
-এখান থেকে বের হয়েই সোজা সামনের দিকে যে বাঙলোটা আছে, ওটার পাশেই একটা টিউবওয়েল আছে। খেয়ে নিতে পারবেন। এবার রিপোর্টগুলো দিন তো।
– সনোকে একবার দেখে যেতে পারি?
-আপনি এত কথা বলছেন কেন?
এই বলে ওসানা ওর দিকে হাত বাড়ানোর জন্য এগিয়ে আসতেই পাশ থেকে আরিফ এসে লোহার শক্ত হাতল দিয়ে সজোরে ওর মাথার সম্মুখপ্রান্তে আঘাত করলো। হাতলের আঘাতে ওসানা ক্ষণিক মুহুর্ত স্থির চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়লো মেঝেতে। অদ্ভুতভাবে ওসানার শরীরের বাহ্যিক চামড়ার বর্ণ পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কিন্তু চামড়ায় বিশেষ সংকোচন হলো না। ওসানার নেতিয়ে পড়া শরীরটা লিনা এবং আরিফ টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসে। আর শান ভিতরের ঘরগুলোতে সনোকে খুঁজে যাচ্ছে। বিশেষ কোনো রান্নাঘর নেই। কয়েকটি নীল এবং হলুদ রঙের বোতল, তাতে বেশ কিছু মেডিসিন রাখা। একটা বিশাল ড্রাম বাক্স। খাঁচায় আবদ্ধ একটা দেড় ফুট সাইজের প্রজাপতি। এর আগে তার জীবনে শান এতবড় প্রজাপতি দেখেনি। খাঁচার পাশেই হাই ডোজের গ্রোথ মেডিসিন! গতকালের জানালার পাশের সেই ঘরটাতে ঢুকতেই যন্ত্রপাতির ভ্যাপসা উগ্র গন্ধ নাকে এলো শানের। বিছানায় একটা নিষ্ক্রিয় শরীর! গতকালের ছেলেটাই হবে হয়তো। শান এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করলো। শক্ত হয়ে আছে।
দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম তার।
আরিফকে ডেকে ভিতরে নিয়ে যাবার কথা বলার জন্য বাইরে আসতেই সে দেখতে পেল-ওসানার শরীরের নিম্নাংস থেকে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। চোখ মুখ আংশিক চামড়া, আংশিক ইস্পাত ধাতুর মত দেখাচ্ছে তার। আরিফ ওসানাকে জিজ্ঞাসা করছে,
– দিপার শরীরের যকৃত কীভাবে উধাও হলো? আপনিই সরিয়েছেন, তাই না? সে তো আপনার মেয়ে ছিলো। বিন্দুমাত্র মায়া হলো না নিজের মেয়ের জন্য?
ওসানা নিজের শরীর চেপে ধরে চিৎকার করে জবাব দিলো,
-না, হয়নি। সে আমার মেয়ে নয়। বাইশ বছর আগে ওকে ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম। ওর জন্য কেন মায়া থাকবে আমার? আর ওর যকৃত আমি সরাইনি। সনোই খেয়ে ফেলেছে। সনোকে এতবড় হতে গেলে তো দিপাকে মরতেই হত।
-বিশ্বাস করি না। আপনার সব কথা মিথ্যে।
-আমি মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস না হলে আমার ঘরে গিয়ে দেখে আসো। সনোর লাশ পড়ে আছে। মানছি, ছোটবেলা থেকে আমি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠিনি। আলাদা জিন, আলাদা শারীরিক গঠন। আমার জন্মের সময় মা মারা গেছে। বাবা আমাকে লুকিয়ে রাখতেন! ওরা মরবার পর আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কেউ আমাকে দেখতে পারেনি। আমি পালিয়ে চলে এসেছিলাম। এর আগে নারায়নগঞ্জ থেকেছি। আর বছর চব্বিশ হলো এই বাসায়। দুটো বুড়ো-বুড়ির থেকে কিনেই নিয়েছি। কিন্তু আমিও তো মানুষই! আমার শরীরের ক্ষুধা নেই? আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না? মানুষের সামনে যেতে পারিনি। ওদের সাথে মিশতে গেলেই আমার শরীরে স্পর্শ লাগলে ওরা বলত- আমার শরীর এত শক্ত কেন। আমি নাকি নারী নই, রোবট মহিলার মত। হাসাহাসি করত।
একটু থেমে ওসানা আবার বলতে লাগলো,
– দিপা আমার কাছেই বড় হয়েছে। ওকে বুঝিয়েছি, আমিই ওর মা। মায়া থেকে নয়, আমার কথা বলার সঙ্গীর প্রয়োজন ছিলো ভীষণ।
তারপর একদিন দক্ষিণ কোরিয়ার এক মহিলার ব্যাপারে জানতে পারলাম। আমি চাইলেই আমার কোষ থেকে ভ্রুণ তৈরি করতে পারি। তবে তার জন্য মানুষের গর্ভ লাগবে। ব্যস! দিপা ছিলো তো। আমার জন্মের সময় আমার মায়ের শরীরেও হয়তো যকৃত ছিলো না। দিপার না থাকাটা অস্বাভাবিক?
সনোকে হাই ডোজের গ্রোথ হরমোন দিলাম। তার উপর সে তো আমারই জিন থেকে তৈরি মানুষের গর্ভে বাড়ন্ত সন্তান। এত অল্পদিনে ওর শরীর তো বাড়লো। কিন্তু ও বাড়লো না। কাল আমি একটু অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আফসোস! সনোর শরীর সেটা সহ্য করতে না পেরে..
ওসানা আর কথা শেষ করতে পারে না। সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।
আরিফ, শান, লিনা নির্বাক চেয়ে আছে ওসানার দিকে। এর পরের শেষ না গল্প বুঝতে আর কারো বাকি নেই। কিন্তু ওসানার গল্পটা কি আদৌ সত্য! আসলেই হিউবটের মাধ্যমে এমন কিছু সম্ভব? সে প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। তারা তিনজনেই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এর মধ্যে কে বিশ্বাস করেছে, আর কে বিশ্বাস করেনি- তার প্রমাণ চোখের ভাষাও দিতে পারছে না।
সমাপ্ত