হিউবট (থ্রিলার),পর্ব:০১

0
2199

গল্পঃ-হিউবট (থ্রিলার),পর্ব:০১
লিখা- সুহাসিনী

“ছয়মাসের একজন ভদ্রমহিলার ডেলিভারি করাতে এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু বাচ্চার কন্ডিশন দেখে মনে হচ্ছে -একেবারে পুষ্ট একটা বাচ্চা। তাড়াতাড়ি ডেলিভারির ব্যবস্থা করতে হবে, শান।”

ডাক্তার এন্থনি চিন্তিত মুখে শানকে কথাগুলো বলে বাকি সবার সাথে জরুরি আলাপ সেরে ফেললেন। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটার পেট স্বাভাবিকের চেয়েও দ্বিগুণ। মাত্র ছয় মাসের বাচ্চার আকার কীভাবে এত বড় হতে পারে, সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। শান ধীর পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। শুকিয়ে কঙ্কালসার, ঠোঁটদুটো কালো হয়ে এসেছে। চোখেমুখে যেন মৃত্যুর হাতছানি। মাঝে মাঝেই খিঁচুনিসহ চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। শান ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞাসা করলো,
-আপনার নাম কী?
-দিপা।
-আপনার বাড়ির লোক কে এসেছে?
– আমার মা। বাইরে বসে আছেন উনি।
এইটুকু উত্তর দিতে গিয়ে দম আটকে আসার উপক্রম দিপার। শান আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে চলে আসে। চেয়ারে প্রায় একশো কিংবা একশো বিশ বছর বয়স্কা ভদ্রমহিলা বসে আছেন। শান বেশ খানিকটা অবাক হয়। দিপার বয়স বড় জোর বাইশ হতে পারে। সেখানে এই বুড়ির সন্তান সে কীভাবে হয়! বিজ্ঞানের যাবতীয় ব্যাখ্যাই তার কাছে হার মানে। ওদিকে ডাক্তার এন্থনি যাবতীয় সব গুছিয়ে ফেলেছেন। ছয়মাসের কনসিভ, ডেলিভারি করানোটাও যেমন কঠিন, বাচ্চা নষ্ট করাটা তার চেয়ে আরও কঠিন। ডাক্তার এন্থনি কড়াভাবে খ্রিস্টান ধর্ম পালন করেন। ডেলিভারির আগে একবার বুকের দু’পাশে, ঠোঁটে নিজের হাত ছুঁইয়ে নিচ্ছেন। সেখানে শানকেও যেতে হবে। কিন্তু মনের ভিতরকার কনফিউশান দূর না করে কাজে মনোযোগ দেবে কীভাবে সে!
বয়স্কা মহিলাটিকে অকস্মাৎ সে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,
-আপনি দিপার কে হন?

ভদ্রমহিলা একেবারে অল্পবয়সী মেয়েদের মত জবাব দিলেন,
– ভেতরে দিপা তো বললো। আমি ওর মা।
-আপনার নাম?
-ওসানা।
-ডেলিভারির সব ফর্ম পূরণ করেছেন তো?
– জ্বি, করেছি। আমার মনে হয়, দিপার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এই বলে ওসানা সোজা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত হাঁটতে হাঁটতে রিসিপশনের দিয়ে এগিয়ে গেলেন। শুধু স্থির দাঁড়িয়ে রইল-শান। এটা কীভাবে হতে পারে! একজন বয়স্কা মহিলার শরীরে এত শক্তি থাকতেই পারে না।

শানের মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। দ্রুত ও.টি রুমে ঢুকে পড়তে হলো তাকে। দিপাকে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওর গলা, মুখ ঘেমে একাকার। মনে হচ্ছে যেন, উচ্চ ওয়াটের অনেকগুলো বাতির ভিতর কাউকে রাখলে যেমন চর্বির মত উনিয়ে পড়ে, ঠিক সেরকমই। দিপার মা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, নরমাল ডেলিভারি করাতে হবে । অবশ্য বাচ্চার যেরকম কন্ডিশন, নরমাল হলেও বিশেষ সমস্যা হবে।না। ডাক্তার এন্থনিসহ বাকিরাও কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্ত শান নিজেকে স্থির করতে পারছে না। এই মানসিক অবস্থায় সে কাজ করতে পারবে না। বোকার মত কেবল নিষ্পলক চেয়ে আছে দিপার দিকে। এই শরীরে কাঁটাছেঁড়ার সাহস দেখাবে কী করে!
ডাক্তার এন্থনি খেয়াল করলেন, দিপার পেট কাঁচের মত প্রায় স্বচ্ছ হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। সামুদ্রিক স্বচ্ছ মাছের মত করে বাইরে থেকেই ভিতরের বাচ্চা,নাড়িভুড়ি সব স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। আর সেই সাথে ছয় মাসের বাচ্চা! কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে আছে সে। এত বিভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি কেউ কখনো হয়নি। নার্স দুটো রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে বটে। এন্থনি আর সাহস পাচ্ছেন না হাত এগিয়ে নেবার।

কিন্তু দিপা মেয়েটার করুণ আর্তনাদ তাকে চুপ থাকতেই বা দেয় কী করে।
এই ভয়ংকর মুহুর্তেও তিনি আগ্রহ এবং অনাগ্রহের ভিতর অবশেষে ডেলিভারি সম্পন্ন করলেন। বাচ্চাটার গায়ের রঙ ঝলসে যাওয়া খয়েরি রঙের। হাত-পা ভয়ংকর রকমের শক্ত। ডাক্তার এন্থনি শঙ্কিত হয়ে গেছেন। একটা মানুষের গর্ভে এমনও সন্তান জন্ম নিতে পারে, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। জিনগত ত্রুটির কারণে অনেক রকম পার্থক্য হয়, আবার শরীর বিকলাঙ্গও হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে এমন অদ্ভুত রঙের লৌহ গঠনের শরীর কীভাবে সম্ভব! তাও আবার মাত্র ছয় মাসে! নার্স দুজন নিষ্পলক চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। ওদের ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু এন্থনি না বলা অব্দি যেতেও পারবে না। হাজার হোক, চাকরি বলে কথা।

শান অপেক্ষায় আছে, এরপর আসলে কী ঘটতে পারে- সেটাই দেখার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। দিপার বাচ্চা ছেলেটা একটুও কাঁদলো না, ব্যথায় নড়লো না। শুধু চুপচাপ যেভাবে যে রাখছে, সেভাবেই শান্ত হয়ে রইলো। মাঝে মাঝে হাত পা নেড়ে বোধহয় জানান দিচ্ছে, সে জীবিত।

আরও প্রায় কিছুক্ষণ পর মনের ভিতর একরাশ প্রশ্ন নিয়ে শান দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু বাইরে আর বের হওয়া হলো না। দিপার আর্তনাদ! সে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখা গেল, দিপা বুকের উপর চেপে ধরে চিৎকার করছে। ডাক্তার এন্থনি দ্রুত তার পালস পরীক্ষা করলেন। কিছু ত্রুটি নিশ্চয় আছে। কিন্তু মাত্র ডেলিভারির পেশেন্ট। তাকে এই মুহুর্তে কীভাবে এক্স-রে কিংবা আল্ট্রাসনো করবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না। অবশ্য দিপার প্রতিক্রিয়া দেখে কিছু স্বাভাবিক বিষয়ই মনে হয়। এত জটিল একটা ডেলিভারি হলো, তবু তার যেন বিন্দুমাত্র ব্যথাই লাগেনি।

এন্থনি ভ্রু কুঁচকে শানের দিকে তাকালেন। তারপর কম্পিত সুরে জিজ্ঞাসা করলেন,
-পুলিশকে জানাবে?

শান সহসা জবাব দিতে পারে না। খুব সম্ভবত রহস্যের কোনো জাল কেটে কেটে বের হবার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু রহস্যের জবাব মিলে না কোনোভাবেই।
সে বললো,
– পুলিশে রিপোর্ট করলে তারা এই ছোট বাচ্চাটিকে ল্যাবে পাঠিয়ে দেবে। হতেও পারে তাকে কেটেকুটে একেবারে শেষ করে দেবে। তখন মিসেস দিপার কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন স্যার?

এন্থনি মাথা দুলায়। এমন সম্ভাবনা থাকতেও পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে সম্ভাব্য আর কিছু মাথায়ও আসছে না কারও। ওদিকে দিপার করুণ আর্তনাদ। কাঁদো কাঁদো স্বরেই দিপা বললো,
-আপনাদেরকে আমি একটা কথা বলতে পারিনি। আমার কিছু কথা শুনবেন, প্লিজ? আমি শুধু আপনাদের দুজনকেই বলতে চাই।

ডাক্তার এন্থনি নার্স দুজনকে বাইরে যেতে নির্দেশ দিলেন। ওরা চলে যেতেই দিপা ইশারায় আরও কাছে ডেকেয়া নিলো শানকে। এন্থনিও পিছু পিছু এগিয়ে এসেছেন। দিপা বললো,
-ছোটবেলা থেকেই আমার মা আমাকে খুব একটা বাইরে যেতে দিত না। কতদিন পর আমি বাইরের আলো দেখলাম, আমি নিজেই জানি না। আপনারা আর যাই করুন, আমার বিষয়ে পুলিশকে জানাবেন না। আমি অবিবাহিত। তারপরেও আমার পেটে আমার বাচ্চা ! কোনো ছেলের সাথে কোনোদিন সম্পর্কও ছিলো না। এমনকি কখনো শারীরিক সম্পর্কও হয়নি। তবু আমার পেটে এই বাচ্চা কীভাবে এলো, আমি নিজেও জানি না। মাকে যেদিন জানালাম, আমার মা অদ্ভুতভাবেই খুশি হলেন। কিন্তু বাইরের মানুষকে জানাতে নিষেধ করে দিলেন। আপনারা পুলিশকে জানালে, মানুষ আমাকে নিয়ে কটুক্তি করবে। ওইসব আমি সহ্য করতে পারবো না।

এই পর্যন্ত বলে দিপা দম নিলো। শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। হয়তো আরও কিছু বলতে পারে মেয়েটা। কিন্তু পেরে উঠছে না। প্রবল খিঁচুনিসহ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া শুরু করলো সে। শান আর কাল বিলম্ব না করে অক্সিজেন মাস্কটা ওর মুখে লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না।৷ তার আগেই দিপা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। একরাশ রহস্য রেখেই মেয়েটা মারা গেল। পেটের স্বচ্ছতা আস্তে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে তার। পাশেই ছোড় বাচ্চাটি নিষ্পলক চেয়ে আছে দিপার নিথর দেহটির দিকে..

–চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here