#হিউবট (পর্বঃ-০৩)
লিখাঃ- সুহাসিনী
গাড়ি চলতে শুরু করে। গাড়ির পেছনের গ্লাসের ভিতর দিয়েই শান পিছনে চেয়ে দেখে, দিপার লাশের বাক্সটা টানতে টানতে ওসানা ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের মৃত্যুতেও তার পরনে লাল গাউন। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। দরজার সাথে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দেড় বছর বয়সী আরেকটা বাচ্চা ছেলে। হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে ওসানার দিক। কী ভয়ংকর দৃশ্য সে!
শান যখন বাসায় ফিরে এলো, রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। ওর স্ত্রী লিনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কলিংবেলের শব্দে ঘুমের ঘোর নিয়েই দরজা খুলে দিলো। শানের নিজের কাছেই ভীষণ অপরাধবোধ লাগছে। সাধারণত রাতে ডিউটি থাকলে লিনাকে সে বলেই যায়। নাহলে ফোন কল দিয়ে জানিয়ে দেয়। কিন্তু আজ সারাদিনে একবারও মেয়েটাকে কল দিতে পারেনি সে। কিছুটা সংকোচ নিয়েই লিনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ঘুমিয়ে গেছিলে?
– তুমি জানো না?
-সরি লিনা। আজকে হাসপাতালে মর্মান্তিক একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। তুমি জানো? একটা মেয়ের লাশ ফেলে রেখেই তার মা চলে গেছিল।
লিনার ঘুমের আচ্ছন্নতা নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। বড় বড় চোখে সে শানের দিকে ফিরে তাকালো। এইতো মাত্র মাস ছ’য়েক হতে যাচ্ছে, দুজন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ডাক্তারি পেশার প্রতি মুগ্ধ হয়েই শানের এত কাছাকাছি আসা তার। অথচ সেই ডাক্তার যে রাতদিন হাসপাতাল নিয়েই পড়ে থাকবে, সেটা আবার কে জানত! তবে সেসব নিয়ে লিনার আপত্তি নেই। কোনো মা তার সন্তানকে মৃত অবস্থায় কীভাবে ফেলে যেতে পারে, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না তার। গলা ঝেড়ে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো-
– এটাও কী সম্ভব!
শান মাথা দুলায়। তারপর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া বিস্তারিত ঘটনার সবটাই তাকে শেয়ার করে। এমনকি লাশ নিয়ে ভিতরে টেনে নিয়ে যাবার ব্যাপারটাও। সন্তানের মৃত্যুতে মায়ের চোখে জল নেই!
লিনা অবাক সুরেই বললো,
– তুমি এত সহজে কীভাবে সব এড়িয়ে চলে এলে?
– তবে?
-আমার ওসানা নামের ভদ্রমহিলাকে মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। নিশ্চয় মানসিকভাবে অসুস্থ তিনি। অথবা অন্যকিছুও হতে পারে। কোনো পিশাচিনী, যে দিপাকে আটকে রেখেছিল নিজের কাছে।
– ধারণাটা ভুল করোনি একেবারে। আমারও এখন সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে কী করা যায়, সেটাই বুঝতে পারছি না আমি।
– তোমাদের সব ডকুমেন্টস পেপার কার কাছে থাকে?
– কালাম ভাই।
– উনার সাথে যোগাযোগ করো। এখনি। আমার ভয় হচ্ছে, মহিলাটা না জানি বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি না করে ফেলে।
-এত রাতে?
-তোমার সমস্যা হলে নাম্বার ডায়াল করে দাও, আমিই কথা বলে নিচ্ছি।
লিনাকে আর কথা বলার প্রয়োজন পড়ল না। শান নিজেই কালামের সাথে কথা বলে যাবতীয় ডকুমেন্টস মেইলে নিয়ে নিয়েছে। লিনা সাম্প্রতিক বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স শেষ করেছে। বর্তমানে থিসিস চলছে তার। একেবারে নিছকভাবেই হঠাৎ ওসানার ব্যাপারে আগ্রহ অনুভব হচ্ছে তার।
দুজনে ডকুমেন্টস থেকে দিপার বিষয়ে এই মধ্যরাতেই বিস্তর বিশ্লেষণে নেমে পড়ল। কারো চোখেই আর ঘুম নেই, প্রেম নেই। দুচোখে, ঠোঁটে, মুখে কেবলই অজানা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। তার শেষ কোথায় কে জানে!
দিপার ফাইলে অভিভাবকের জায়গায় ওসানার নাম লিখা। ওসানা মেহতা। বাবার নাম দেওয়া নেই। অবশ্য ফর্মে শুধুমাত্র অভিভাবকের কথাই বলা আছে। দিপার রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। আরও টুকটাক হাবিজাবি তথ্য। খুব একটা কাজে লাগবে না এখন আর।
শান হতাশ হয়ে বসে আছে। লিনাও চুপচাপ। হঠাৎ ওর মনে হলো, ওসানার এনআইডি কার্ডের নাম্বার তো ফর্মে থাকবার কথা। ভাবতে না ভাবতেই সে হুড়মুড়িয়ে আবারও ল্যাপটপের স্ক্রিণে চোখ রাখলো। ওসানার কার্ড নাম্বার! সাথে ব্যাংকের কার্ড থেকে বিল প্রদানের তথ্য। আপাতত এটাই অনেক বড় বিষয়।
তৃপ্তির খুশি নিয়ে সে শানকে বললো,
– কাল একবার আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে। ও প্রশাসনে চাকরি করে। এই কার্ডের তথ্য দিয়ে আমরা ওসানার ব্যাপারে আশা করি কিছুটা হলেও জানতে পারবো।
পরদিন সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা নাগাদ দুজনে সিআইডি গোয়েন্দা আরিফের সাথে দেখা করতে গেল। এনআইডি কার্ড দিয়ে যেকোনো মানুষের তথ্য বের করার অধিকার তাদের আছে। লিনার কাছে সমস্ত কিছু শোনার পর আরিফ ওদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়। তারপর নাম্বার দিয়ে খোঁজ করতে দেখা গেল এই নাম্বারটি ভুল। মানে এনআইডি কার্ডের যে নাম্বার দেওয়া হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণই ভুয়া। লিনা এবং শান একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আরিফ তখন বললো,
– ব্যাংক তথ্য কখনো ভুল হবে না। দেখছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করো।
অবশেষে ব্যাংক তথ্য থেকে ওসানার বেশ কিছু রহস্যজনক বিষয় জানাও গেল। ওসানা মেহতার বাবার নাম সঞ্জয় মেহতা। সনাতন ধর্মাবলম্বী। জাতীয়তায় পাওয়া গেল- ভারতীয় (মুম্বাই)। একজন ভারতীয় মহিলা বাংলাদেশে বাস করছে, কত বছর ধরে কে জানে! ওসানা মেহতার বয়স ১০৯ বছর। অথচ ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্কা মহিলাদের মতই তার চলাফেরা!
তথ্যগুলো জানার পর আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই। যেন এইসব না জানাই ভালো ছিলো একরকম। তথ্যগুলো সমাধানের চেয়ে আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আসলেই কোনো মানুষ সে! নাকি শয়তানের পূজারি!
আরিফের অফিস থেকে বের হয়ে শান সোজা হাসপাতালে চলে গেল। আর লিনা বাসায়। কিন্তু বাসায় থেমে থাকে না সে। সুজানার সাথে কথা বলা দরকার। গত দু বছর ধরে ভারতে পড়াশোনা করছে সুজানা। ওর মাধ্যমে নিশ্চয় কোনো তথ্য জানা যাবে। সুজানাকে বেশ কয়েকবার কল দেবার পরও পাওয়া গেল না। ফোন রেখে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য বিছানায় যেতেই অপর পাশ থেকে সুজানা আবার কল ব্যাক করে। এরপর ওর কাছে ওসানার সমস্ত তথ্য দিয়ে তার খোঁজ লাগাতে বলে।
সুজানার পরীক্ষা থাকায় এইমাসে বাইরে বের হতে পারবে না সে। তবে লিনাকে জানিয়ে দেয়, খুব শীঘ্রই ওসানার ঠিকানায় খোঁজ লাগাতে যাবে। আপাতত এইটুকুই ভরসা।
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার আগে শানের মন আবার টেনে নিয়ে গেল ওসানার সেই রহস্যঘেরা বাসায়। আবারও সেই পথ, সেই দূরুত্ব, লিনার অপেক্ষা। তবে আজ তাকে জানাতে ভোলেনি শান। দুজন পরামর্শ করে একসাথেই বের হয়েছে। পথে ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে। পথ যত কমতে থাকে, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অনুভূতি ততই বাড়ছে দুজনের।
অবশেষে দীর্ঘ সময় পর ওসানার বাসার কিছু দূর সামনে এক ভদ্রলোককে দেখে থেমে যায় শান। চল্লিশের কাছাকাছি হবেন ভদ্রলোক। শান জিজ্ঞাসা করলো,
– ভাইজান, আপনার বাসা কি এখানেই?
ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
– কেন বলুন তো? আর এত রাতে আপনারা কারা? আশেপাশে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।
-আসলে আমাদের একজন আত্মীয়ার বাসা খুঁজছি আমরা। ওনার নাম ওসানা মেহতা। অনেকদিন আগে এসেছিলাম। এখন মনে করতে পারছি না।
– ও আচ্ছা। কিন্তু এই নামে আশেপাশে কারো বাসা আছে কি-না বলতে পারবো না। এখানে কারো সাথেই খুব একটা খাতির নেই কারো। অভিজাত মানুষদের বাঙলো সব। যে যার ইচ্ছেমতো ছুটি কাটাতে আসেন। বাড়ির সীমানা বিশাল বিশাল এরিয়া জুড়ে। দেখতেই পারছেন। কে কার খোঁজ রাখবে, বলুন দেখি?
উপয়ান্তর না পেয়ে শান আবার তাকে বললো,
– উনার মেয়ের নাম দিপা। দিপা মেহতা। গতকাল দিপা মারা গেছে। সেই খবর পেয়েই এসেছি। এখন ওসানা আন্টির কাছে কল দিলেও নাম্বার বন্ধ।
ভদ্রলোক ক্ষণিক সময় মাথা চুলকালেন। স্মৃতির ঠুলি থেকে কিছু বের করে আনবার প্রচেষ্টা। অনেক ভেবে ভেবে হঠাৎই টিউবলাইটের মত তার ঠোঁটের কোণও যেন জ্বলে উঠলো। খুঁজে পাবার তৃপ্তিতে ঠোঁটে প্রশস্ততার চিহ্ন। তিনি বললেন,
– দিপা! হ্যাঁ, চিনি তো। বছর তিনেক আগে একবার আমার বাগানের দিকের রাস্তায় দেখা হয়েছিল। সেবারই শেষ। মেয়েটা মারা গেছে! কই- আশেপাশে কারো মারা যাবার খবর তো পাইনি! ওর সাথে ছ’মাস বা বছরে হয়তো একদিন দেখা হয়েছে। “ভালো-মন্দ” এতটুকুই জানাশোনার প্রশ্ন হত। আশেপাশেই কোথাও বাসা হতে পারে। আমি তো নিশ্চিত বলতে পারবো না ভাই। তবে খোঁজ নিয়ে জানাবো।
ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে চলে যায়। শানও আর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করে না। মৃত্যুর আগে দিপা জানিয়েছিলো, সে খুব একটা বাইরে বের হতে পারতো না। সেখানে মানুষের সাথে খাতির হবার সম্ভাবনা না থাকারই কথা। সর্বশেষ তিন বছর আগে বাইরের কোনো মানুষ তাকে দেখেছে! এটাও বিশ্বাস করার মত কোন কথা? তবুও বিশ্বাস করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র এই দিপার রহস্য জানতেই তার এবং লিনার এতদূর ছুটে আসা। ভদ্রলোককে সে ইচ্ছেকৃতভাবেই জানায়নি- দিপার বাসা সে নিজেই চিনে। কিন্তু এর বাইরের ভিন্ন কোনো গল্প পাবার জন্যেই এই নিছক প্রশ্নোত্তর পর্ব মাত্র।
ওসানার বাসার সামনে এসে দরজার পাশে আর দাঁড়ায় না কেউ। আশেপাশে কোনো কবর নেই। শ্মশান নেই। মৃত্যুর শোকও নেই। পাশের একটা জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে। ভিতর থেকে মৃদু শব্দে কোনো একটা ইংলিশ গানের সুর ভেসে আসছে। কোনো জনমানুষের আওয়াজ নেই।
প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবেই কেটে যায় ওদের। তবু কোনো আওয়াজ নেই। অগত্যা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। লিনা খাবার খেতে পারে না তেমন। শান খায়, কিন্তু হজম করতে পারে না। উগরে বের হয়ে আসে। কিছু একটা ভয়ংকর গল্প আছে। সেই গল্পকে আড়াল হতে দেওয়া যায় না।
দুই একদিন পর পরই শান ওসানার জানালায় গিয়ে কান পাতে। প্রথম কয়েকটা দিন গানের সুর শোনা গেলেও এরপর একেবারে নিস্তব্ধ। তবুও যায় সে। কীসের নেশা, নিজেও জানে না। বেশ কিছুদিন এভাবেই নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে চলে যায়।
কিন্তু সপ্তাহ দুই পর একদিন হঠাৎ একটা জানালা খোলা থাকে। ঘর ভর্তি হালকা আলো, গানের শব্দ অত্যন্ত নিম্ন ভলিউমে, সেইসাথে আরও একটি রোমাঞ্চকর রহস্যময় শব্দ। শানের কেমন দম আটকে আসছে। এটা উচিত হবে না, এটা উচিত হবে না- নিজের মনকে বলতে বলতেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে উঁকি দিয়ে তাকায় জানালার কোণা দিয়ে। বিছানায় পঁচিশ কিংবা ত্রিশ বছর বয়সী একটা ছেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আর তার উপর ওসানা! ওসানার নগ্ন দেহ। বিছানার পাশেই খুলে রাখা একটা গাউন! ওসানার চোখ দুটো নিষ্পলক চেয়ে আছে ছেলেটির দিকে।
মুহুর্তেই বমি চলে আসে শানের। চোখ নামাবে নাকি এই রহস্যের সন্ধান করবে- সেটা বোঝার আগেই মাথা চক্কর দেয় তার। কী ভয়ংকর! কী নোংরা সেই চোখ!
(চলবে…)