হিজিবিজি (১০ম পর্ব শেষ)

0
1650

গল্পঃ #হিজিবিজি (১০ম পর্ব শেষ)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

এই দিকটায় দুজন সমান হলাম।
আজকে তো আরো সমান হবে। জাস্ট অপেক্ষা!
জাবেরকে আমি ডাকলাম না,ঘুমিয়ে থাকুক সে।
আমি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিলাম।
তারপর শ্রেয়াকে ফোন করে জেনে নিলাম সবকিছু ঠিকঠাকভাবে তৈরি করছে কিনা।
শ্রেয়া জানালো সে এখন থেকেই সব রেডি করে রাখতেছে।

আমি মনে মনে সব সংলাপ এবং এক্টিং গুছিয়ে রাখছিলাম,কোনো ভুল হওয়া যাবেনা।
এদিকে জাবের এখনো ঘুমাচ্ছে। রাতে কখন ঘুমিয়েছিল আল্লাহ জানে! এখনো উঠছেনা কেন?
আর মা আমাকে বারবার বলতেছে জাবেরকে নাশতা দিতে৷ কিন্তু সেতো ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ আমার মনে পড়লো কালকে তাকে কিভাবে জাগিয়েছিলাম! উফফ মনে হতেই কেমন লজ্জা লাগছে।আজকে এটা করা যাবেনা। তাহলে যে ধরা পড়ে যাবো। এমনি কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারিনা।

তারপর শ্রেয়ার সাথে আমার চললো ডেকোরেশন। সে আমাকে দেখাতে লাগলো কিভাবে কি করতে হবে। তার কাজে আমি মুগ্ধ প্রায়।

গেলাম আম্মুর কাছে,আজকে আম্মুকে সব সত্যি কথা বলতে হবে। আম্মু সকালের সব কাজ শেষ করে মাত্র একটু অবসর হলো। আমাকে দেখেই আম্মু বললো..
___ রিতা সরিরে বিয়েরদিন এতো ঝামেলা হয়েছে।
তুই হয়তো আমার উপর রেগে আছিস।
আসলে জাবের আমাদের সব জানিয়েছিল। তোকে জানানো বারণ ছিল, তুই শুনলে নাকি বিয়ে করতিনা।

আম্মুর কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হলাম,আমি আম্মুকে সব বলতে এলাম আর আম্মুই ইতিহাস শুরু করলো। তার মানে উনি সবই জানেন। যাক ভালোই হলো। এরপর আমি বললাম..
___ আম্মু এসব রাখো। আমিও এখন সব জানি। কিন্তু জাবেরকে আজকে একটা সারপ্রাইজ দিবো। তাই আমি আগে আগে যাবো আর পরে তুমি জাবেরকে বলে দিও আমি যেখানে গেছি সেখানে চলে যেতে।

___ জাবেরকে তুই সারপ্রাইজ দিবি নাকি সে তোরে সারপ্রাইজ দিবে?

___ সে দিবে মানে? আমি দিবো। আজ অব্দি সে-ই সব চমক দেখিয়েছে। আজকে না হয় আমিই দেখালাম।

___ হুম দেখা তাহলে। জাবের এখনো উঠেনি?

___ না উঠেনি তো।

___ আচ্ছা শুন উঠলে তুই নিজ দায়িত্বে খাওয়াবি কিন্তু, আমি একটু শুবো।

___ আচ্ছা ঠিক আছে। আর আম্মু আমি গেলাম।

রুমে গিয়ে দেখলাম তিনি উঠেছেন। তারপর ডাকলাম তারাতাড়ি নাশতা করতে।
সেও চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে আসলো।
আর আমি গোসল করতে গেলাম। এসে দেখলাম জাবের রুমে নেই।
আমার টেবিলের উপর একটা চিরকুট আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম নাহ তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। আস্তে করে চিরকুটটা খোললাম।
সেখানে লেখা..

“” আম চত্বরে আসবা একটু””

জাবের পুরনো প্রেমে ফিরতে চাচ্ছে, কারণ প্রেমের প্রথমদিকে সেখানে বসে আমরা গল্প করতাম।
কিন্তু এখন তো যাওয়া যাবেনা। চিঠিটা দেখেনি এমন করে জায়গামতো রেখে দিলাম। জাবের এতে আরো অবহেলা ফিল করবে।
তারপর তারাতাড়ি রেডি হয়ে রওয়ানা দিলাম, যাওয়ার আগে আম্মুকে ঠিকানা দিয়ে বললাম, জাবের রুমে আসলে যেন তাকে সেখানে যেতে বলে।
বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে জাবের দেখবে তাই রান্নাঘর দিয়ে পেছন দরজা মাধ্যমে বের হলাম।

গিয়েই সেখানে আহানকে দেখলাম। আমাকে দেখেই ইশারা করলো সবকিছু ঠিকঠাক আছে। শ্রেয়া ওইদিকে সব তৈরি করছে, কোনো সমস্যা নাই।

তারপর একজন নীল পাঞ্জাবীওয়ালাকে পাশাপাশি বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম জাবের কখন আসে। এই লোককে আহানই ভাড়া করে এনেছে।
এর মধ্যে আহান একবার জাবেরকে ফোন দিয়েছে,জাবের বলেছে তার আসতে আধঘন্টা লাগবে।

যাক অপেক্ষা চলছে। হঠাৎই দেখলাম জাবের আসছে,সেও আজ নীল পাঞ্জাবি পরেছে। আমি জাবেরের দিকে তাকিয়ে আমার পাশের ছেলেটার দিকে তাকালাম। ধ্যাত জাবেরের দিকে তাকিয়ে এখন ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তাকাতে হবে মাস্ট। আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম
___ এক্টিং শুরু করেন।

ছেলেটা আমার কথামতো বলতে শুরু করলো..
___ এইই বেইবিইই তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড সে আসছেনা কেন! আর কতক্ষণ বসে থাকবো? আমার অধৈর্য্য লাগছে, তোমাকে বিয়ে করতে তার কাছে বলা লাগবে কেন আজব! চলো আজই আমরা বিয়ে করে ফেলি!

জাবের আমাদের দুজনকে দেখছে আর ছেলেটার সব কথা শুনছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আমি তাকে শুনিয়ে বলতে লাগলাম..
___ এই যে সে এসেছে। কথা বলো!

জাবের কাঁদো কাঁদো চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচন্ড রাগও দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ জানে কিনা কি বলে বসে। তবে তাকে দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। নিজেকে কোনোভাবে কন্ট্রোল করলাম।
কিন্তু আমার ধারণা ভেঙে দিয়ে জাবের বললো..
___ সুখে থাকো রিতা, আমি চলে যাচ্ছি।

তখন ছেলেটা বলে উঠলো
___ আরে ভাই আপনার সাথে কথা ছিল আমি রিতাকে আজকেই বিয়ে করবো। তার জন্য তো আপনাকে দরকার।

___ ভাই আপনারে দিয়া দিলাম, যান। বিয়ে করেন গিয়ে। কেউ কিছু বললে জানিয়েন ওকে?

বলেই হনহন করে জাবের চলে গেলো। আমি ভেবেছিলাম সে ওভার রিয়েক্ট করবে কিন্তু কম রিয়েক্ট করলেই কি! আমি জানি তার কলিজাটা মনে হয় ফেটে যাচ্ছে। বুঝুক এবার মজা!
তার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম, বেশিনা মাত্র একটু সহ্য করো আমি আসছি! এমনিতেও তোমাকে বেশিক্ষণ কষ্ট দিতে পারবোনা। আমারও যে কষ্ট হয়।

এদিকে আহানকে ইশারা করলাম জাবেরকে নিয়ে যেতে। আহান দৌঁড়ে জাবেরের পেছনে পেছনে গেলো।

তারপর আমি ছেলেটাকে তার কথামতো পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে তারাতাড়ি একটা রিকশা করে শ্রেয়াদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। গিয়ে দেখি শ্রেয়ার বাসার সামনের দরজাটা জাস্ট খোলা। বাকি সব বন্ধ,আমি শ্রেয়াকে ডাকলাম।
শ্রেয়া ভেতর থেকে জবাব দিলো..
___ রিতা তুমি বাথরুমে গিয়ে তারাতাড়ি তৈরি হও,আহান মনে হয় জাবেরকে নিয়ে এখনি চলে আসবে।

আমি তার কথা মতো তারাতাড়ি করে তৈরি হতে লাগলাম। চার বছর আগে চিঠিতে লিখেছিল আমাকে কালো ড্রেসে দেখলে সে পাগল হয়ে যায়। সেটা কালকেও হয়েছিল আবার আজকেও হবে!

১০ মিনিটে আমি একদম পাক্কা তৈরি হয়ে শ্রেয়ার রুমের দরজায় নক করলাম।
কিন্তু দরজা খুলছেনা। উফফ দরজা খুলছেনা কেন?
আমি বারবার পেছনে তাকাতে লাগলাম জাবের এর মধ্যে এসে পড়লে কি হবে?
ওও আল্লাহ শ্রেয়া তারাতাড়ি দরজা খোলো। আমি পেছনে তাকালাম তখনই দরজা খোলে গেলো আর আমার সারা শরীরে গোলাপের পাপড়ি পড়ছে। আমি অবাক হয়ে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম..
___ এসব কি শ্রেয়া জাবের আসলে এটা হওয়ার কথা…

পুরোটা বলতে পারলাম না, আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার সামনে হাটু গেড়ে হাতে হাতে এতগুলো গোলাপ নিয়ে জাবের!
বুঝতে পারছি না কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি হলো?
আমি শ্রেয়া আর আহানের দিকে তাকালাম। তারা হাসছে। মানে এরা দুজন আমার সাথে বেঈমানী করলো। আমাকে বলে শেষ পর্যন্ত কিনা জাবেরের সাথেই হাত মিলালো। আর আমি আবারও হেরে গেলাম!

এদিকে জাবের বলতেছে..
___ আমাদের ভালোবাসায় আর কতো হিজিবিজি চলবে? এবার তো সবকিছুর সমাধান হোক। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি রিতা৷ তুমি শুধুই আমার।

জাবেরের মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি যেন সবকিছু ভুলে গেলাম। আমার বুকে যেমন যেন একটা ধুকধুকানি শুরু হয়ে গেলো, আর সেটা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি,আমি চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। আচ্ছা মানঅভিমানের পালা এবার শেষ হলে দোষ নেই তো। কেন এতো অস্থির হচ্ছি,এই মানুষটাকে তো আমি ভালোবাসি,কি দরকার অযথা কষ্ট দেওয়ার!
আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে জাবেরকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম।

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম মনে নেই, হঠাৎ দেখলাম আহান আর শ্রেয়া পেছনে হাসতেছে। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। এ আল্লাহ তাদের সামনে এটা কি হলো।
তারপর যখন সবকিছু স্বাভাবিক হলো সবাই মিলে কেক কাটলাম। আমি শ্রেয়াকে বললাম.
___ এটা ঠিক হয়নি।

এই কথার জবাবে জাবের বললো..
___ জিত আমারই সবসময় কিন্তু প্রকৃত প্রাপ্যটা তোমার! শুধু তোমাকে পেতে এতো পাগলামি। আর তোমার কি করে মনে হয় আমার দুজন বন্ধু আমাকে কষ্ট দিবে। আর যে ছেলেটাকে বয়ফ্রেন্ড সাজিয়ে এনেছো সে আমার কাজিন! ওরা সবসময় আমার বুঝলে? আমার খারাপ সময়ে ওরা আমার পাশে ছিলো, তাই ওদের স্থান আমার বুকে!

___ তাই না? তাহলে আমার স্থান কোথায়?

___ তোমার স্থান আমার কলিজায়!

আমি লজ্জায় জাবেরের বুকে মুখ লুকালাম। নাহ এখন আর রাগ অভিমান, কিংবা প্রতিশোধের দরকার মনে হচ্ছেনা। এমনিতেও আমি কেন যেন এই অল্প কষ্টটা দিতে গিয়েই নিজে কষ্ট পেয়েছি। যদিও সেটা দিতে পারিনি। মোট কথা আমি কোনো কাজই ভালো করে করতে পারিনা। তবে তাতে আর আমার আফসোস হচ্ছেনা কারণ আমি আমার ভালোবাসায় সার্থক। আমি বারবার হেরে গিয়েও জিতে গেছি৷
আজ থেকে আমরা দুজন শুধুই দুজনের, লুকোচুরি আর হিজিবিজি গল্পে নয় আমাদের ভালোবাসা এখন থেকে চলবে প্রকাশ্যে !
.
.
.
.
.
.

২০ বছর পর

জাবের অফিস থেকে এসে খাবার খাচ্ছে, আমি পাশে বসে আছি। সেসময় আমার বড় ছেলে জিসান খুব পরিশ্রান্ত অবস্থায় সেখানে এসে বলতে লাগলো..
___ মা মা তুমি কালকেই তোহা’দের বাড়িতে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে।

জাবের জিজ্ঞাসা করলো
___ কিরে তোহা কে?

___ বাবা তোহা আমার ভালোবাসা, আমি তাকে দুই বছর ধরে মনেপ্রাণে ভালোবাসি, কিন্তু কিছুদিন আগে তাকে আমি এক ছেলের সাথে বসে কথা বলতে দেখেছি,প্রায়ই ওর ফোন ওয়েটিং পাই। তারপর আমিও ওরে দেখিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে এরকম শুরু করি। পরে জানতে পারি আসলে ওর তেমন কোনো রিলেশন নেই কারো সাথে। কিন্তু সে আমার উপর রেগে আছে,তাই তার বাবা-মার কথামতো বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে। আমি তাদের বাসায় গিয়ে ক্ষমা চাইতে চেয়েছি কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি। বাধ্য হয়ে আমি ওর হবু জামাইকে আমার এক বন্ধুর বাসায় বেঁধে রেখেছি।
বাবা তুমি আর মা কালকেই তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে।

আমি জিসানকে জিজ্ঞাসা করলাম..
___কিরে তোর বয়স কতো?

জিসান রাগী চেহেরায় জবাব দিলো..
___অতশত বুঝিনা আমি চাই কালকেই তোমরা যাবে। আমি এখানে বিয়ে না করলে মরে যাবো। বিয়ের পরে আমি তোহাকে মেনেজ করে নেবো সমস্যা নাই। কিন্তু বিয়েটা আমার তার সাথেই হওয়া চাই।

বলেই জিসান ফুসফুস করতে করতে চলে গেলো।
আমি জাবেরের দিকে তাকিয়ে বললাম..
___ওগো এসব বলছে আমার ছেলে?

জাবের খাওয়ার মধ্যেই হেসে উঠলো আর বললো..
___ শুনো ছেলেটা তোমার নয়, ছেলেটা আমার!
মনে পড়ে ২০ বছর আগের কথা?

জাবেরের কথা শুনে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছিনা। ছেলে তার বাবার চরিত্রের খেতাব প্রাপ্ত হয়েছে! এএ খোদা আমার ছেলে এখন কেমন গল্প শুরু করতে যাচ্ছে!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here