হিজিবিজি (৯ম পর্ব)

0
1014

গল্পঃ #হিজিবিজি (৯ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

আচ্ছা একটু ছুঁয়ে দিলে কি আমার ভেতরের লালিত অভিমানটা হালকা হয়ে যাবে?
নাকি আমার মধ্যে ক্ষোভ নামক অনূভুতিটা চলে যাবে?
তাকে তো একটা না একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত!
আজ পর্যন্ত সে আমাকে কতো শতবার বোকা বানিয়েছে, তার অভিনয়ে আমাকে পরাজিত করেছে অথচ আমি একবারও তার কাছে জিততে পারলাম না।
পরাজয়টা সবসময়ই আমার ছিল। কিন্তু সত্যিই কি সবকিছুর জন্য আজ আমি পরাজিত? নাকি সব পরাজয় মিলিয়ে আজ আমি বিজয়ী!
এই যে এই একটা মানুষ আমার, শুধু আমার!
জাবেরের দিকে তাকিয়ে আছি আর সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার চোখ ভাজ করে মিরমির করে তাকিয়ে আছে! চুলগুলো উল্টোদিকে লেপ্টে যাচ্ছে। সত্যিই এই মানুষটা শুধু আমারই থাকবে।
আমি নিচে তাকালাম,আমার কনিষ্ঠা আঙ্গুল তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সাথে ছুঁই ছুঁই প্রায়। ইচ্ছে করে আমি শেষ পর্যন্ত সেই আঙ্গুলটা উপরে ছুঁয়েই ফেললাম। তারপর সেটা যে ইচ্ছে করে রেখেছি তা যেন বুঝতে না পারে তার জন্য আমি নড়েচড়ে বললাম..
___ আপনি বাড়িতে যাবেন কখন?

ঠিক তখন জাবের তার পুরোটা হাত আমার হাতের উপর রাখলো। হয়তো বুঝে গেছে কাজটা ইচ্ছে করে করেছি। কিংবা তার মধ্যেও প্রচন্ড আকুলতা বিরাজ করছিল হাতটা ধরার৷ তাই সুযোগ পেয়ে সেটাকে হাতছাড়া করেনি। আর জাবের ভালো করেই জানে আমি তার ব্যপারে সবকিছু জেনে গেছি। শ্রেয়া আর আহানকে সে এখানে এনেছিল শুধুমাত্র আমাকে সব জানানোর জন্য। কিন্তু আমি যে সবকিছু জানি সেটা বুঝতে দিচ্ছিনা আপাতত।
জাবের আমার হাতের সব আঙ্গুলের ভাজে নিজের হাতটা গুটিয়ে শক্ত করে ধরে বললো …
___ বাড়িতে যাচ্ছিনা আপাতত, একসাথে অনুষ্ঠানের পরে বউকে নিয়ে যাবো।

আমি প্রথমত তার হাতের দিকে খেয়াল করলাম,পরবর্তীতে খেয়াল করলাম এবার জায়গামতো এসেছে। বউকে নিয়ে যাবে সেটা ওর মুখ থেকে বের হয়েছে। মানে সে হয়তো বুঝতে পারছে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু সেটা তো ভাবতে দেওয়া যাবেনা। এতো সহজ হলে হবে না। আমি আমার হাতটা ছিটকে সরিয়ে নিলাম।
জাবের অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি রাগী চেহেরায় বললাম..
___ আপনি তারাতাড়ি আমাদের বাসা থেকে যান। বিরক্ত লাগছে। আর আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলবো সমস্যা নাই। আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আছে,তাকে বিয়ে না করলে কিভাবে হবে বলেন? আর আমারও বয়ফ্রেন্ড আছে। আপনি বিদায় হলে আমি বাবাকে সুন্দরমতো সব বলতে পারবো। তখন বাবা বাধ্য হয়ে আমার ভালোবাসাকে মানতে হবে। আর হ্যাঁ আপনার ফেইসবুক একাউন্ট খোলেছিলাম সব কিছু জানানোর জন্য কিন্তু বলা হয় নি বরং উল্টো কান্ডকারখানা হয়ে গেলো,তার জন্য দুঃখিতে। খুব তারাতাড়ি আমার ভালোবাসার সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবো।

আমার কথা শুনে জাবের চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হুহুহু করে হেসে উঠলো। হেসেই হেসেই যাচ্ছে একনাগাড়ে। আজব হাসির কি বলেছি। নাকি বুঝে গেছে আমি মিথ্যা মিথ্যা বলছি। ওরে কি জব্দ করার কোনো ওয়ে নাই?
সে এতো এতো মিথ্যা বলেছে এখন তার কাছে সবকিছুকেই মিথ্যা মনে হবে। নাহ কিছু একটা ব্যবস্থা করা লাগবে।

বাসায় পৌঁছে জাবের কিচ্ছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমাকে বললো..
___ছাদে যাবে?

আমি মুখ বাকিয়ে বললাম।
___আপনার সাথে ছাদে যেতে আমার বয়েই গেছে। আমার কাজ আছে,হুহহ!

জাবের একা একা চলে গেলো। আমার ইচ্ছে করছে যেতে কিন্তু যাওয়া যাবেনা।

আজকে অতীতের যত স্মৃতি ছিল সবগুলো নাড়া দিলাম। হঠাৎ করেই তখন একটা চিঠি দেখে আমি তারাতাড়ি সেটা হাতে নিয়ে খোললাম। জাবেরের দেওয়া প্রথম চিঠি। চার বছর আগে যখন সে আমাদের বাড়িতে এসেছিল আর আমি তখন থেকেই তাকে ভালোলাগার ইঙ্গিত দিতাম কিন্তু সে পাত্তা দিতোনা। অতঃপর দশমদিন আমি কালো একটা ড্রেস পরে তার সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম,তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এর কিছুক্ষণ পরেই সে আমাকে এই চিঠিটা দিয়েছিল। আর তখনই জেনেছিলাম তার প্রিয় রঙ কালো। পরবর্তীতে জেনেছিলাম সে আমাকে তখনই ভালোবেসে ফেলে। যদিও এরপর কিছুদিন লুকোচুরি প্রেম চলেছিলো কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের ভালোবাসার জানান,মনের সবরকম অনুভূতির প্রকাশ হয়েছিল। তবে দুটো মনের মিল হয়েছে সেদিনই। দিনটা আমার কাছে সবচেয়ে খুশির ছিল!
চিঠিতে লিখেছিল..

“”রিতা ১০ দিন হয়ে গেছে অথচ আমি তোমার দিকে একবারও মনযোগ দিয়ে তাকাইনি। আজকে শুধুমাত্র কালো রঙটার জন্য আমি তোমাকে খেয়াল করলাম! তোমার কাজল কালো চোখ দুটো প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট! প্লিজ আমার সামনে এসোনা আর, পাগল হয়ে যাবো!””

তার চিঠিটার দিকে খেয়াল করে দেখলাম সেই তারিখটা আগামীকাল চার বছর পূর্ণ হবে। ওহহ শিট এটা আগামীকালই কেন হতে হলো!
দুইদিন পরেও তো হতে পারতো৷
তারপর আরো অনেকগুলো পুরনো জিনিস পেলাম।
এগুলো আগে রোজ দেখতাম,তার প্রতিটা লেখার উপরে হাত বোলাতাম। বুকে জড়িয়ে কতরাত ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু দুই বছর ধরে এগুলো দেখা হয়না,মনে ছিল না চিঠিগুলোর কথা। আজ আবার সবকিছু জেগে উঠলো।

আমি তখনই শ্রেয়ার সাথে কথা বললাম। তারপর দুজন জাবেরকে জাস্ট একটা মোটামুটি ধাক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা করলাম। শ্রেয়ার দেওয়া আইডিয়াটা মন্দ না। কিন্তু আমি শ্রেয়াকে বললাম..
____জাবের আর আমার জীবনের আগামীকাল একটা স্পেশাল দিন যেটা আমি অনেকদিন পরে সিলেব্রেট করতে চাই কিন্তু এখন তো এটা সম্ভব হচ্ছেনা। যদি সিলেব্রেটই করি তাহলে আমাদের পরিকল্পনা বৃথা ।কিন্তু পরিকল্পনা বৃথা হওয়া যাবেনা। অথচ কালকের দিনটা আমাদের জীবনের সেরা একটা দিন। কি করবো বলো দেখি?

শ্রেয়া তারপর আরেকটা আইডিয়া দিলো যেটা শুনে আস্বস্ত হলাম৷ যাক মেয়েটার অনেক বুদ্ধি। তাইতো এতদিন জাবের আমাকে নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছে। সব শ্রেয়ার দেওয়া পরিকল্পনা ছিল। মেয়েটার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হবে।

এদিকে আমার কথামতো শ্রেয়া জাবেরকে ফোন করে বলেছে..
___ জাবের তুই তো বলেছিলি রিতাকে সবকিছু বলতে,কিন্তু সবকিছু বলার পরে সে সেগুলোকে একদম সিরিয়াসভাবে নেয়নি। কারণ ওর নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে। তার পক্ষে তোর সাথে সংসার করা সম্ভব না। আর সে তোকে বিশ্বাস করেনা,আমি অনেকবার বলেছি তোর কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই,তুই রিতাকে ভালোবাসিস। কিন্তু রিতা এসব কথা বিশ্বাস করেনা৷ আর রিতা বলেছে তোর সাথে কাল রিতার চূরান্ত কথোপকথন হবে, আর তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে তোকে পরিচয় করিয়ে দিবে। চলে আসিস সময়মতো।

আমি জানি এবার জাবেরের অবিশ্বাস করার কোনো পর্যায় নেই। আর আমি রিকশায় শেষ সময় যে ব্যবহার করেছি এটাও এখন তার মাথায় কড়া নাড়বে।
তার ভয়াবহ অবস্থাটা দেখতে মন চাচ্ছে,আমাকে এতো কষ্ট দেওয়ার ঠেলা এবার বুঝুক।
আমি ফোন হাতে নিয়ে সিঁড়ির কাছ থেকে কথা বলা শুরু করলাম। ছাদের লাইট অফ অথচ চাঁদের আলোয় কতো আলোকিত হয়ে আছে। আমি অনেকদিন হলো রাতের বেলা ছাদে আসিনা, আমি বরাবরই ভীতু একটা মানুষ, আজকে জাবের আছে বলে আসছি।
আমাকে দেখেই জাবের চোখমুখ মুছে তাকালো। আমি তাকে না দেখার ভান করলাম।
আমি ফোন কানে এমনি এমনি বলছি, শুনো কালকে তুমি নীল পাঞ্জাবি পরে আসবা। কারণ তোমাকে নীল রঙে ভীষণ মানায়। তোমাকে সবার চেয়ে সুন্দর লাগতে হবে, আর আমি এমনিতেও জানি আমার বয়ফ্রেন্ড পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট ছেলেটা।

এর মধ্যে জাবের বললো..
___রিতা তোমার সাথে আমার কথা আছে।

আমি মোবাইলটা কান থেকে সরিয়ে বললাম..
___ ওহহ আপনি তো ছাদে আসছেন আমার খেয়াল ছিল না। আমি কথা বলতেছি এখন কিছু শুনতে পারবোনা।

বলেই আমি আরো কিছু কথা বলতে বলতে নেমে গেলাম। যতক্ষণ জাবের শুনতে পাবে ততক্ষণ বকবক করে রুমে এসে একা একাই হাসতে লাগলাম। বিকেলে এমনি এমনি কথা বলে ধরা পড়ে গেছিলাম। অবশ্য এখন জাবের ভাব্বে বিকেলে সত্যিই আমি কথা বলছিলাম, আর ওই ফোন কেটে যাওয়ার এক ফাঁকে আম্মুর ফোন আসছিল।
আর তখন সে জানতো আমার জীবনে কেউ নেই। কিন্তু এখন তো জানতে পেরেছে কেউ আছে। তাহলে সবকিছুতেও এখন তার মাইন্ড অন্য রকম হবে।

খাবারদাবার শেষ হলো কিন্তু এর ভেতর আমি জাবেরের দিকে ইচ্ছে করেই তাকাইনি। সে একটু জ্বলুক পুড়ুক। রুমে গিয়ে তার আগে আগেই আমি গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

যদিও আজকে আমার চোখে ঘুম নেই। শুধু ভাবছি কালকে কিভাবে শুরু করবো। তবে শ্রেয়া সব ম্যনেজ করবে, এই জন্য আমি নিশ্চিন্ত। জাবের অনেক্ষণ সোফায় বসে রইলো। সে আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি তাকে পেছন দিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি,আজকে কিছু শোনা যাবেনা। যদি ইমোশনাল কিছু বলে আমি এখনি ইম্প্রেশ হয়ে যাবো আর আমার কালকের পরিকল্পনা কোনোটাই সফল হবেনা।

জাবেরের কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘন্টা দুই চলে গেলো নিরবতা। হঠাৎ জাবের ফোনে ভাঙা গলায় বলতেছে..
___ বাবা আমি কালকে বিকেলে চলে আসবো।

ওপাশ থেকে কি বলছে তা শুনতে পাচ্ছিনা,কিন্তু জাবের বলতেছে..
___ অফিস তো ছুটিই। কিন্তু আমার ভালো লাগছেনা এখানে। মাকে দাও মার সাথে আমার কথা আছে।

তারপর একটু নিরবতা,হয়তো শশুড় আব্বা কিছু বলতেছে।
যার জবাবে জাবের বললো.
___ আরে বাবা কিছুই হয়নি,রিতার সাথে ঝামেলা হবে কেন? মা ঘুমিয়ে গেলে আমি রাখছি, কালকে আসবো।

যাক তাহলে জাবের সত্যিই সিরিয়াস, দেখুক কেমন লাগে! আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেওয়ার সামান্য ফল এটা। জাবেরের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আর আমার তো মরে যেতেই ইচ্ছে করছিলো। কতো কষ্টই না আমাকে দিলো।
এর মধ্যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম খেয়াল নেই।
পরেরদিন সকালে উঠে দেখলাম জাবের সোফাতেই ঘুমিয়ে আছে। ঘাড় বাঁকা হয়ে আছে, ঘুম থেকে উঠে সিউর ঘাড় নড়াতে পারবেনা। কালকে আমি এই সিচুয়েশনে ছিলাম আর আজকে জাবের এভাবে আছে। এই দিকটায় দুজন সমান হলাম।
আজকে তো আরো সমান হবে। জাস্ট অপেক্ষা!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here