হিমির_বিয়ে(২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
-আগামী মাসে তোর বিয়ে।
-আপনার মাথা ঠিক আছে? চেনা নাই জানা নাই একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে যাবো। আমার কিসের কমতি আছে হ্যাঁ?
– আমি তোর বাবা ভুলে যাস না। তোর ভালোমন্দ আমরা ভালো বুঝি।
– অসম্ভব! আমি কোনো ভাবেই মানতে পারবো না।
– তুই না মানলে কখনো আমাদের পরিচয় দিবি না। ভেবে নিবি তোর বাবা,মা,বোন সবাই তোর জীবন থেকে মরে গেছে।
-এইটা কেমন কথা বাবা? আমার লাইফের সিদ্ধান্ত আমার নেওয়ার অধিকার নাই? কাকে নিয়ে সংসার করবো কে আমার মত থাকতে পারবে তা আমার ভাবা অন্যায়?
– দেখ আমি মেয়ের বাবাকে কথা দিয়েছি। আর তাছাড়া আমার একটা সন্মান আছে। ওই মেয়েকে বিয়ে করলে তুই জীবনে সুখি হতে পারবি।
– আমি ভালোবাসি একটা মেয়েকে। বিয়ে করলে ওকেই বিয়ে করবো। কখনো ঠকাতে পারবো না। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো।
-দেখ ওসব প্রেম ভালোবাসা দুদিনের মাত্র। তোর ভালোই তো আমরা চাই। মেয়েটা ডিভোর্সি মেয়ে তাই বলে কি ওর জীবন নাই? ডিভোর্সি মেয়েরা সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না? ওদের কি অধিকার নাই সংসার করার?
– বাবা আমি তা বলছি না। আমি একজন গ্রাজুয়েট ছেলে,আমার স্টাটাস ভালো। আমি মুখ দেখাবো কি করে। আর তাছাড়া আমি তানহা নামের এক মেয়েকে ভালোবাসি।
– রাখ তোর ভালোবাসা। কথা ফাইনাল। আর একটা কথাও শুনবো না।
– আমিও বললাম বিয়ে করলে তানহাকেই করবো। সম্ভব না অন্য কাউকে বিয়ে করা।
– বেয়াদব। আমার মুখের উপরে কথা বলিস?
খাবার টেবিলের বসতে পারলাম না। বসে থাকলে বাবার সাথে এক পর্যায়ে তর্কে জড়িয়ে যাব। বাসায় এসে আমার ভুল হয়েছে।আসলে আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা। বাবা কেন এমন করতেছে তা একমাত্র সে জানেন। কিছু বললাম না। বাসা থেকে আস্তে বের হয়ে গেলাম। বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছিলাম কিন্তু আগামীকাল ভোর হওয়ার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। আমি চাইনা কোন ধরনের ঝামেলা হোক। আমার পক্ষে সম্ভব না বাবা যে মেয়েটির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে তাকে বিয়ে করা। আমি তো বলেই দিয়েছি বিয়ে করলে তানহাকেই করব।
আর তানহা আমাকে কল দিয়ে ওসব বললো কেনো আমার জানা নেই। হয়তো তানহা কোনো বিপদে পড়েছে তাই আমার কাছ থেকে সরে যেতে চাইছে।
অথচ তানহা আমার বিপদে সব সময় রয়েছে।আমার যেকোনো ভাবে তানহার সরে যাওয়ার ব্যাপারটা খুঁজে বের করতে হবে। আর তানহাকেও আমার খুঁজে বের করতে হবে। কেন হঠাৎ করে আমার সাথে লুকোচুরির খেলা খেলতেছে?কেন আমাকে বলল তাকে ভুলে যেতে? আমি তো তানহাকে ভালবাসি, তানহাকে নিয়ে সারাটি জীবন পাড় করে দিবো বলেই তাকে ভালোবেসেছি। আর তানহা আমায় নিয়ে সংসার করবে বলেই আমার হাতটা ধরেছে। হঠাৎ করে কেন তানহা আমাকে ছেড়ে যেতে চাইল? হঠাৎ করেই বা আমার কাছ থেকে ষাট হাজার টাকা নিল কেন? আমার কাছে সবকিছু লুকাচ্ছে কেন?ওর বিপদ হলে আমাকে জানাচ্ছে না কেন। আমি জানি তানহা আমাকে প্রচন্ড ভাবে ভালবাসে। তানহা আমাকে কখনোই ভুলতে পারবে না। যদিও আমার জীবন থেকে সরে যায় তবুও তার লাইফে অন্য কাউকে গ্রহণ করতে পারবে না। আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছে। ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলো না।
আমি কালই বাসা থেকে চলে গিয়ে তানহার বাসায় যাবো। আমার জানতেই হবে তানহার সমস্যা কি? আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছে? ও তো জানতো একটা দিন কথা না হলে আমার ভালো লাগে না। সারাক্ষন মনটা অস্থির থাকে। আমি তানহাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। প্রতিটা মুহুর্ত তানহা আমার মাঝেই থাকে।
ভোর বেলা ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হবো,তখনই আমার ছোট বোন পিছন থেকে টেনে ধরলো….
– ভাই এই সাতসকালে কই যাচ্ছিস? আর এভাবে লুকিয়েই বা জাচ্ছিস কেন?
– লুকিয়ে যাচ্ছি না। অফিস থেকে কল দিয়েছে, আর তাছাড়া বাবার সামনে থেকে যেতে চাই না। আমি অতটা বাধ্য নই তার সবটা মেনে নিব।
– মাকে তো বলে যাবি। খালি মুখে কেউ সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়?
– মাকেই বা কি বলবো? মা সেও কাল থেকে আমার সাথে তেমন কথা বলছে না। আমি জানি না কি অন্যায় করেছি। কেনো হঠাৎ করে বাবা মায়ের এত পরিবর্তন। বাবার সাথে মায়ের ঝামেলা হয়েছে,তাই বলে তার শাস্তি আমি কেন পাবো?
– ভাই রাগ করিস না। বাবার কারনে মায়ের মন ভালো নেই। আচ্ছা দাড়া আমি একটা কিছু নিয়ে আসি তুই খেয়ে তারপরে বের হ।
আমি আর না করতে পারলাম না। কথা হাতে করে নাস্তা নিয়ে আসলো সেগুলা খেয়েই বাসা থেকে বের হলাম। বের হওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম মা পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার চলে যাওয়া দেখছে। আমি আর পেছনে ফিরলাম না। আসার সময় কথা বলে দিলো পৌঁছে যেনো তাকে জানাই।
কাঠ ফাটা রোদ্দুর, আর সেই সাথে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ একটা বিরক্তিমাখা মুহুর্ত। অন্যান্যদিন এতটা বিরক্ত লাগেনি যতটা বিরক্ত আজ লাগতেছে।বাবার কথাগুলো বারবার কানে বেজে উঠছে। তার কথা না মানলে নাকি সবাইকে মৃত ভাবতে হবে।
আরে আমি তো সবাইকে ভালোবাসি। আমার তো মা বাবা আর ছোট বোন ছাড়া কেউ নাই। ওদের মৃত ভাববো কিভাবে? বাবা এমন সর্ত কিভাবে দিলো? আমার পরিবার তো আমার পৃথিবী। ওদের জন্য আমি কলিজা ছিড়ে দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু তানহাকেও ভালোবাসি, আমি কাউকেই ছাড়তে পারবো না। আমার সবাইকেই লাগবে।
আমার জানতে হবে বাবা কেনো এই মেয়ে নিয়ে পড়ে আছে। কি কারনে বাবা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলো। আগে তো বাবা আমার পছন্দের বাইরে যান নি। কখনো একঘেয়েমি করেন নি। সবার মতামত নিয়েই একটা কিছু করেছে।কিন্তু এবার তিনি স্ট্রং। সে যেটাই ভেবেছে সেটাই করতে হবে। আমিও দেখি কিভাবে বাবা আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দেয়।
ট্রেন থেকে নেমে সোজা তানহাদের বাসার দিকে রওনা হলাম। কাধের ব্যাগটা যেনো আমায় নুইয়ে দিচ্ছে। বেশ খানিক পথ হাটলাম। ইচ্ছা করেই হেটেছি। কিছুই ভালো লাগছে না। তাই হেটে হেটেই সামনের দিকে আগাচ্ছি। সিগারেট টানছি কিন্তু মন মত ধোঁয়া বের হচ্ছে না। আশ্চর্য এমন হচ্ছে কেন? একটা ফেলে আরেকটা জ্বালাচ্ছি, কিন্তু মন মত নেশা মিটছে না।
আমার সিগারেট টানা দেখতে নাকি তানহার বেশ ভালো লাগে। আমি সিগারেট টানলে নাকি ধোঁয়া সহ্য করতেও পারে। অথচ অন্য কারো ধোঁয়া নাকে আসলেই নাকি রাগে গজগজ করে। আমি ওর কথায় বেশ অবাক হই। মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে অবাক না হয়েই পারি না। একদম পাগলি একটা মেয়ে। তানহাদের বাসার সামনে গিয়ে নক করলাম। বেশ কয়েকবার নক করার পরে তানহার বাবা দরজা খুলে দিলেন।
– আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আঙ্কেল?
– ভেতরে আসো। (সালামের উত্তর দিলো না। চোখমুখে গম্ভীর একটা ভাব)
– আঙ্কেল বাসায় কেউ নাই?
– না
– তানহা বা আন্টি কোথায়?
– জানি না।
– কি বলছেন? জানেন না মানে?
– দেখো আমি এতসব কিছুই জানি না। গতপরশু রাতে তানহা আর ওর মা আমাকে ঘুমের অবস্থায় রেখে বাসা থেকে বের হয়েছে। সেই থেকে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিন্তু পাচ্ছি না। থানায় জিডি করে নাম্বার ট্রেক করালাম তবুও হদিস আমি পাচ্ছি না। এখন আমি তোমায় কিভাবে বলবো ওরা কোথায়? আমায় তো কিছুই বলে যায়নি। না হয়েছে কোনো ঝামেলা বা না হয়েছে কোনো সমস্যা।
– হঠাৎ করে এভাবে যাওয়ার মানে কি? তানহার নানাবাড়ি খোঁজ নিয়েছেন?
– হ্যাঁ নিয়েছি। তারা কিছুই জানে না। বরং তানহার নানাবাড়ির লোকজন আমায় অনেক কিছু শুনিয়েছে।
– আঙ্কেল তানহা আমাকে গতকাল সন্ধ্যায় ফোন দিয়েছিলো?
– কিহ? কি বলে ফোন দিয়ে?
– বলেছে আমাদের আর কখনো যোগাযোগ হবে না। তারপরে ফোনটা কেটে দিয়েছে আর আর ফোন দিয়ে পাইনি।
– দেখো রিয়ান সহ্যের একটা লিমিট আছে। আর পারছিনা।
– আঙ্কেল আপনার হেল্প পেলে আমি ওদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি।
– কেমন হেল্প?
– তা আপনায় আমি পরে জানাবো।
তিন দিন হয়ে গেলো এখনো তানহা বা ওর মায়ের কোনো খোঁজ মিললো না। ছুটি আর মাত্র দুই দিন আছে। এই দুই দিনে কিভাবে ওদের বের করব? শহর তো আর ছোট না। টুকটাক কাছের সকল রিলেটিভদের কাছে খবর নিয়েছি,তারা কেউ ওদের সম্পর্কে জানে না।
তানহার বাবার সাথে হয়তো ঝামেলা হতে পারে তাই বলে আমাকে দূরে সরিয়ে দিবে?
ছুটি শেষ অফিসে জয়েন করেছি। রাতে বাসায় এসে দেখি আমার বাবা মা আর কথা আমার বাসার পাশের বাসায় বসে আছে। আমি আসার সাথে সাথেই কথা এসে বললো…
– তোর জন্য অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে আর তুই এখন আসলি?
– কাজ শেষ হবে তারপরে তো আসবো?
ওরা বাসায় আসলো। আমি ফ্রেশ হয়ে বাজারে গেলাম বাজার করতে। বাসায় তেমন কিছু একটা নেই।
রাতে খাবার শেষে বাবা আমাকে ডাকলেন…
– তুই হঠাৎ করে চলে আসলি কেনো? আমাকে তো কিছু বলে আসলি না।
– দরকার ছিলো তাই চলে আসছি? আর আপনার কথা শুনবো বাসায় থেকে?
– শোন তুই যতই এড়িয়ে যাস না কেন তোর ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। আমাকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করবি না!
– আপনি যা করার করেন, আমি কোনো ভাবেই ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না। ডিভোর্সিদের সমাজে কেউ ভালো চোখে দেখে না। আর ওই মেয়ে ভালো হলে ডিভোর্স দিবে কেন? ভালো মেয়েরা কখনো ডিভোর্সি হতে পারে না।
বাবা আমার গালে কষে থাপ্পড় দিলো। মনে হলো কান ফেটে গেলো। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বাবা বললেন..
– তুই একটা আস্ত বড় বেয়াদব। কষ্ট করে এই মানুষ করেছি? মানুষকে সন্মান করতেও শিখিস নি? তুই যে মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিস তোর সেই মা কিন্তু একজন ডিভোর্সি ছিলো। আমি কিন্তু সেই ডিভোর্সিকেই বিয়ে করেছিলাম আমার নিজ ইচ্ছায়। হয়তো এতদিন তুই জানতি না। কিন্তু এখন জেনে রাখ তুই একটা ডিভোর্সির সন্তান।
বাবার মুকে কথাটা শুনে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো।
আমি আর কথা এতদিন জানতাম না, আমার মা’ও একজন ডিভোর্সি। যিনি আমার মা….
[চলবে……]