হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,১৯,২০

0
408

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,১৯,২০
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:১৯

*****
এমন অনেক সময় আসে যখন মানুষ মন মাঝারে সযত্নে লালন করে রাখা মানুষটিকেও চোখে হারানোর বদলে দুচোখে দেখতেও পারে না।সে সামনে আসলে অসহ্য লাগে আবার আড়ালে গেলে অধৈর্য লাগে।একটু দেখার তৃষ্ণায় মনটা খাঁ খাঁ করে।এই অসহ্য আর অধৈর্য লাগা পর্যন্ত ঠিক আছে,এর সঠিক লজিক ও হয়তো আছে কিন্তু ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় তার আসলে- নকলে কিসের তৃষ্ণা?কি রূপে এই খাঁ খাঁ করা তৃষ্ণার নিবৃত হবে, তার আসল লজিক কে দেবে?

মেটে আলু চেনেন তো?শরৎ বাবুর পুঁই মাচার বরজ পোতার মেটে আলু।
আশেপাশের শুভাকাঙ্ক্ষী,হিতকাঙ্খী অনেকে হয়তো বোঝাবে যে তার মনের মধ্যে কে আছে কিন্তু কেউ তো আর ঐ মেটে আলুর মতো খোন্তা,কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে চামরা, মাংস,হার পাঁজর ভেদ করে হৃদ পিণ্ডটাকে তুলে এনে,তাল শাশের মতো চোখ দুটো তুলে তাতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেনা হৃদয় জুড়ে আসলে কে আছে।বুক জুড়ে কিসের শুন্যতা, সমগ্র দেহ মনে কিসের এত তৃষ্ণা?
এতক্ষণ ধরে বিরূপাক্ষের কথাই বললাম।সে বিদেশ থেকে ছুটে এসেছিলো রিতিকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে বনলতার ভালোবাসার লতায়পাতায় নিজেকে যুক্ত করে বন্দী হবে বলে। এ কদিন সেটাই বার বার ভেবেছেও তাই। অচেনা অজানা বনলতাকে দেওয়া কথা কবে পালন করতে পারবে সেই ভাবনায় বার বার নিজেকে আনমনা করেছে।একবার দেখার আশা মনে লালন করেছে কিন্তু আজ যখন সত্যিই বনলতাকে পাওয়ার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকেই মনের মাঝে শুধুই রিতি ঘুরছে।চোখের তারায় রিতি জ্বলছে।

রাত অনেক।দিনটা মেঘাচ্ছন্ন থাকায় রাতটা অন্যদিনের তুলনায় বেশী শীতল আজ।এই শীতেই বোধহয় শীতকালের শুরুটা হবে। মেঝেতে নিত্যরাতের মতো গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে রিতি।ঘড়ে ঢুকেই একটা পাতলা কম্বল রিতির গায়ের উপর মেলে দিয়েছিলো বিরূপাক্ষ।তারপর পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসেছে সকালে প্রাপ্ত সেই নীল খামের চিঠিখানি নিয়ে। পুরোটা পড়েছে বার দুই।হাতে ধরা চিঠি এবং খামটা, দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ যেখানে উজ্জ্বল আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে রিতির ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা।

সকালে একটু দেরীতেই ঘুম ভেঙেছিলো বিরূপাক্ষের।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য প্রসাধন সামগ্রী মিশিয়ে নিচ্ছিলো গালের মসৃন ত্বকে।সুরের উচ্ছল তরঙ্গে ঘড় ভরিয়ে প্রবেশ করলো রিতি,,

রূপদা,তোমার নামে চিঠি এসেছে গো। বনলতার চিঠি।

বিরূপাক্ষের হাত থেমে যায়। বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের মতো ঝটকা খায় দেহ।রিতির বলা কথাটা ঠিক বুঝতে পারে না।

কি হলো এতো কি ভাবছো?এই নাও তোমার বনলতা দেবীর নীল খামের পত্রখানা।

বিরূপাক্ষের ডান হাতটা টেনে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে বলে রসিকতা করে,,চিঠিতেই এমন কাঁপা কাঁপি শুরু করলে?অন্য সময় কি করবে মান সম্মান রাখবেনা দেখছি।হি হি হি।
ঘড় ছেড়ে রিতি বেরিয়ে যেতেই হাতের দিকে নজর দেয় বিরূপাক্ষ।নীল চকচকে খামের উপর, প্রেরকের জায়গায় বনলতা নামটা স্থির হয়ে টানছে বিরূপাক্ষকে। প্রাপকের ঠিকানায় বিরূপাক্ষের এই ঠিকানাটা নামসহ।বনলতা নামটার উপর একবার নিজের আঙ্গুল ছোঁয়ায় বিরূপাক্ষ।সে এক অন্যরকম অনুভুতি।ধীরে সুস্থে খামটা খুলে দেখে নেয় লেখা গুলো, সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে মেয়েলী হাতের লেখা, কয়েক লাইনের লেখাগুলো ক্যামন জানি চেনা চেনা লাগে,মনের ভুল ভেবে নিজেকে আস্বস্ত করে।সম্মোধন হীন লেখা পড়তে শুরু করে শুরু থেকে,,,

কি বলে সম্বোধন করা উচিত হবে জানি না তাই বিনা সম্বোধনে শুরু করছি ক্যমন?গোবিন্দের কৃপায় সুস্থ আছেন আশা করি।
আচ্ছা আপনার কি আমার কথা মনে আছে?নাকি বিস্তৃত হয়েছেন ক্ষণকালের পরিচয়ে মারাত্মক এক অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনার কারনকে?মনে আছে কি বাদল মুখর সন্ধ্যায় অনিচ্ছায় দেওয়া কথাকে?সে কথা কি আঁধারেই বিলীন হয়েছে নাকি এখনো আমার মনের মতো আপনার মনেও দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে?যাক সে কথা, আমি কোনো কৈফিয়ত চেয়ে ঔদ্ধত্ত্ব দেখাবো না।আমি জানি,আপনি বিদেশ থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে দেশে ফিরেছেন। আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বিন্দু বিসর্গ পর্যন্ত জানি আমি। শুধু একটিবার দেখতে চাই আপনাকে।অবশ্য যদি আপনি বিরক্ত না হন।এই টুকু অনুগ্রহ কি করবেন না?এই ক বছরে একমূহূর্তের জন্যেও আমি আপনাকে ভুলিনি।এমন কোনো বিজয়া দশমী আসেনি যেদিন আপনার চরণের উদ্দেশ্যে প্রণাম করিনি।এমন কোনো দিন,রাত আসেনি যে সিঁথিতে সিঁদুর দেইনি।এত কিছুর বিনিময়ে এইটুকু চাওয়া কি পূরণ করতে পারেন না?

অপেক্ষায় থাকবো আমি।

বিজয়া দশমীর অগ্রীম প্রণাম রইলো।ভালো থাকবেন।

প্রণামান্তে,,

বনলতা।

চিঠিটা পড়েই বিরূপাক্ষ অধীর হয়ে বার বার খামের ভেতর বাহির,চিঠির এপিঠ ওপিঠ দেখতে লাগলো কিন্তু না কোনো ঠিকানা তো দেয়নি মেয়েটা?তাহলে কি কেউ মজা করছে তার সাথে?রিতিই কি কল কাঠি নাড়ছে? চিৎকার করে ডেকে উঠলো রিতির নাম ধরে,,

কি হলো?বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন ,এভাবে ডাকলে তাঁরা ভাববে বিরূপাক্ষ ছেলেটা বিদেশে থেকে থেকে একটা বেশরম তৈরী হয়েছে।গুরুজন,ছোট জন মানেনা বৌকে ডাকে চিৎকার করে।

এই তোর বকবক বন্ধ করবি? দিন দিন সাহস বেড়েই চলেছে তাইনা?এই চিঠি তুই লিখেছিস? আমার সাথে মজা করতে চাস?

হ্যা!না মানে আমি কি তোমার প্রেমলতা?সরি বনলতা।আমি কি তোমার বনলতা যে চিঠি লিখবো?ঝাঝ মিশিয়ে বললো রিতি।
বিরূপাক্ষের ক্রোধ বাড়ে।রিতির বা হাতটা মুচড়ে পিছনে নিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে বলে,,,
চিঠিটা তোর কাছে উড়ে এলো তাইনা?নিজেই করেছিস এইসব।বল?না হলে এতদিন কোনো যোগাযোগ রাখেনি আর বাড়িতে আসতে না আসতেই সে মেয়ে চিঠি লিখলো?সব তোর বাহানা আমাকে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য তাইনা?
হাতের ব্যাথায় চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে রিতির।

হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেয় কোনমতে,অশ্রু মুছে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায় বিরূপাক্ষের হালকা রক্তিম চোখে।মুখে টেনে আনে মৃদু হাসি তারপর বিরূপাক্ষের বুকের বাপাশে নিজের ডান হাতের পাঞ্জাটা আলতো করে চেপে ধরে।হঠাৎ এমন দেখলে মনে হবে দুজনে জনম জনম ধরে এমন নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। বিরূপাক্ষ রিতির হঠাৎ পরিবর্তনের মানে বুঝতে পারে না।চোখ দুটো ছোট করে পড়তে চায় রিতির চোখের ভাষা কিন্তু সে অপারগ।
শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠঝংকার শোনা যায় রিতির,,, নিজের ললাটে বা হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে বলে,,আমার এইখানে যদি তুমি থাকো,তবে তোমার এখানটায় বিরূপাক্ষের বুকের বা পাশটা ইঙ্গিত করে,আমার আসন নিজের হাতে সযতনে তৈরী করেছেন বিধাতা। সেখানে আমিই শুধু বসবো,শুবো ,যা খুশি তাই করবো।তার জন্য কোনো ছলনার প্রয়োজন পরবেনা রিতির।

রিতির এমন দৃঢ়তায় বিরূপাক্ষ রাগ করা ভুলে অবাক হয়ে যায়।রিতি হেসে ওঠে শব্দ করে,,,
এত ভেবে চুলগুলো ফেলোনা রূপদা। তোমার বৌয়ের টেনে তোলার জন্য তো কিছু অবশিষ্ট রাখো।
হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় রিতি। বিরূপাক্ষ আরো একবার চিঠিটা মেলে ধরে দৃষ্টির সম্মুখে।
ঘুমের মধ্যে রিতি পাশ ফিরে শুতেই বিরূপাক্ষের ঘোর কাটে।রিতির গায়ের কম্বল সরে পেটের এবং পায়ের কাছে কিছু অংশ দৃশ্যমান হয়েছে। বিরূপাক্ষ উঠে গিয়ে আবারো কম্বলটা ঠিক করে দিতেই রিতি উঠে বসে।চোখটা ডলে নিয়ে হাই তুলে বলে ভাবলেশহীন ভাবে,,
রূপদা এতরাত হলো এখনো ঘুমাওনি তুমি?
কি ব্যাপার বলোতো এক বৌয়ের চিঠি হাতে নিয়ে অন্য বৌয়ের শরীর দেখছো?মতলব কি তোমার?শয়তানি হাসি হেসে ভ্রু নাচায় রিতি। বিরূপাক্ষ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।রিতির এমন লাগামহীন কথাবার্তায় অস্বস্তি বোধ করে,,

কপাল তো তোমারই রূপ দা। মানুষ একটা পায়না আর তোমার দু, দু’টো বৌ।এপাশে ফিরলে একটা ওপাশে ফিরলে একটা।দুই পাশে দুই স্ত্রী সুন্দরী,হট, আকর্ষণীয় ফিগার,আর,,,
রিতির নির্লজ্জের মতো বাক্য বানে অতি ঘৃনায় বিরূপাক্ষের মুখ দিয়ে ছিঃ কথাটা বেরিয়ে আসে।উঠে দাঁড়াতে গেলেই হ্যাচকা টানে নিজের অতি নিকটে বসিয়ে নেয়, মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে ফিসফিসিয়ে,এ্যাতো ছিঃ ছিৎকার ক্যানো করছো?দুজনে রাতের অন্ধকারে একঘড়ে কি করছি বাইরের কেউ জানে?সবাই জানে বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী তার বৌয়ের সাথে একঘড়ে থাকছে।কেউ কি জানে ,তার বৌয়ের পালঙ্কে ঠাঁই হয়নি? মেঝেতে ঘুমায়?
বিরূপাক্ষ হত বিহ্বল,,কি হয়েছে এই মেয়েটার।এমন ধারা কথা তো আগে শোনেনি রিতির মুখে?

এত রাগ করোনা রূপদা।ভেবে দ্যাখোতো এমন লাজ লজ্জা হীন রসিকতা তোমার সাথে কখনো করেছি? করিনি তো?স্বামী পরিত্যাক্তা তো হয়েই আছি।ডিভোর্স হয়ে গেলে তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন লোকে কি বলবে জানো?
আঙুল দেখিয়ে বলবে,ঐ দ্যাখ বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী যায়।
আমি হবো,,,এক্স ওয়াইফ অফ বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী।হা হা হাহা।
স্বামীর আদর, সোহাগের ভাগ পেলাম না, কিন্তু প্রাক্তন কথাটা সম্পূর্ণ রুপে বয়ে বেড়াতে হবে।ক্যানো?ক্যানো ক্যানো ক্যানো?

কলার ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দেয় বিরূপাক্ষকে।
কঠিন করে শাসিয়ে বলে,এত কেয়ার করতে আসবে না। মায়ায় পরে গেলে তাতে তোমারই ক্ষতি। দৌড়ে গিয়ে ওয়াশ রুমের দরজা বন্ধ করে দেয় রিতি। বিরূপাক্ষ মেঝেতে ইসলাম বসে থাকে অথর্বের মতো।বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার।
উঠে পা বাড়ায়।ওয়াশ রুমের দরজায় কান পাতে। সেখান থেকে ঝর্ণার জল পরার শব্দ ছাপিয়ে ভেসে আসে নারী কন্ঠের চাপা কান্নার শব্দ।বিরূপাক্ষের বুকটা টনটন করে ওঠে।ওথাল পাথাল করে ওঠে হৃদপিণ্ডটা।
হাতে থাকা চিঠি সহ খামটা মুষ্ঠির ভেতরে দুমরে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে এক ছুটে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।

******
আজ বিজয়া দশমী।সকল মেয়ে এবং মহিলারা লাল পাড় ওয়ালা সাদা শাড়ি পরেছে। এবছরের মতো মায়ের শেষ খাওয়া মর্ত্যলোকে। অঞ্জলির সময় আসন্ন।চন্ডীনগর মানে রিতিদের গ্রাম থেকে এসেছেন বেশ কয়েকজন ভোগ প্রসাদ নিয়ে।সুমি এসেছিলো গতকাল।
নিজেদের গ্রাম সম্পর্কীয় কয়েকজন বৌদি,কাকিমা,জেঠিমার সাথে কুশলাদি বিনিময় করছিলো রিতি। রাহুল, অখিলেশ, বিরূপাক্ষ এলো ধুতি পাঞ্জাবি পরে।মহিলারা মাথায় কাপড় টেনে দিলেন সসম্ভ্রমে।রিতি অবাক মুগ্ধতায় তাকিয়ে রইল বিরূপাক্ষের দিকে।চন্দন রঙের পাঞ্জাবি আর খয়েরী রঙের ধুতি পরে ব্যক্তিত্ববান পদক্ষেপে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে সে।সে এক রাজকীয় চলন ভঙ্গি। দেখলেই গর্ববোধ জাগে মনে।এই তো সুপুরুষ,হোক না গায়ের রংটা একটু চাপা।
নিয়তি বৌদি বললো গায়ে ধাক্কা দিয়ে,,এই রিতি আমরা পাঁচ সাত জন আছি ভাই অমন করে তাকিয়ে থাকিস না।

ঘোর কেটে লজ্জায় রক্তিম হয় রিতির সমস্ত অবয়ব।তখনি ফিচেল হেসে বিরূপাক্ষ ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় মন্দিরে।

চৌধুরী বাড়ির একটা রেওয়াজ আছে সেই পূর্ব পুরুষদের আমল থেকে।যখন মন্দিরের এত চাকচিক্য ভাব ছিলো না স্থায়ী মন্দিরটাও ছিলো না। শুধু পূজার সময় গোলপাতার ছাপড়া তুলে পূজা হতো। চাঁদা দিতো গ্রামের সবাই এক টাকা,আট আনা এমন কি এক পোয়া চালও দিতো কেউ কেউ। এখনকার মতো ব্যান্ডপার্টি বা সাউন্ড বক্স বাজতো না,মুচি পাড়া থেকে ঢাক নিয়ে আসতো ঢাকি।সেটাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু রেওয়াজ ছিলো একটা, দশমীর শেষান্তে যখন সিঁদুর খেলা হতো তখন বাড়ির পুরুষেরা তাদের স্ব স্ব স্ত্রীর সিঁথি নতুন করে রাঙিয়ে দিতো সিঁদুরে।ছাপড়ার জায়গায় ইট পাথরের মন্দির উঠেছে।পূজায় এসেছে নতুন নতুন জাঁক জমক কিন্তু এখনো সেই সিঁদুর দান নিয়মটি সচলই রয়ে গেছে।

দশমীর সমাপ্তি ঘটেছে। অনেক মহিলারা চোখের জল ঝরিয়ে মায়ের পায়ে মানত নিবেদন করছেন।এ কদিনে কোনো ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দিস মা,এমন কথাও বলছেন অনেকে ভাসছেন নয়ন জলে।যেনো সত্যিই মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়িতে চলেছে।

প্রভাকর রায় চৌধুরী নিজে অন্নপূর্ণা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে বিরূপাক্ষ কে রিতির সামনে দাঁড়ানোর আদেশ করেন। রঘুনাথ আগে ভাগেই দাঁড়িয়ে পরেছে জয়ার সামনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরূপাক্ষ দাঁড়ায় রিতির সামনে।দুজনের চোখে চোখ পরে।গোপনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি নত করে রিতি। পুরোহিত মহাশয় মায়ের পায়ের প্রসাদি সিঁদুর তুলে দেন প্রভাকর চৌধুরীর হাতে।

অবশেষে বিরূপাক্ষের পালা।কৌটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু আঙুলে সিঁদুর ছোঁয়ানো তো দূর রাগে সর্বাঙ্গ জলছে তার। একবার সিঁদুর পরিয়ে যে ফ্যাসাদে জড়িয়েছে তাকে আবার?

শত শত ঔৎসুক্য দৃষ্টি তাদের দিকে কারন ওদের সিঁদুর দান শেষ হলেই সবাই মেতে উঠবে সিন্দুরে আবির নিয়ে। রাঙিয়ে দেবে সমস্ত দেহ। মন্দির প্রাঙ্গন লালে লাল মিলে মিশে মেতে উঠবে রক্তিম ছোঁয়ায়।

মাতার আকুতি,পিতার অগ্নিদৃষ্টি, বন্ধুদের উৎসাহ, উপস্থিত জনতার আগ্রহান্বিত দৃষ্টিতেও বিরূপাক্ষ টললো না।সে কিছুতেই এই মেয়ের ব্যাপারে একই ভূল দ্বিতীয় বার করবে না।অবজ্ঞার যাতনায় রিতির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,কোনোমতে মুখে বলে,,একটিবারই তো রূপদা।দাওনা পরিয়ে সিঁদুর টুকু।আসছে বছর এ সৌভাগ্য আমার নাও হতে পারে।প্লিজ।
এমন মিনতি ফেলা বিরূপাক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে তিন আঙুলে এক চিলতে সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে তোলে রিতির সিঁথি। কৃতজ্ঞতা,প্রশান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রিতি। কতদিনের স্বপ্ন,সাধনা তার এমন একটি বিজয়া দশমী। মায়ের কাছে আর বিশেষ কিছুই চাওয়ার নেই।সে তো প্রতিটি দশমীতে এটুকু প্রাপ্তি মানত করেই চোখের জলে মায়ের পা ধুইয়েছে।দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে।চোখ মেলে দ্যাখে আরাধ্য মানুষটি, নেই স্থান ত্যাগ করেছে ইতিমধ্যে।

বিকালে স্নান সেরে পোশাক পরিচ্ছদ পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে বিরূপাক্ষ।সারাদিনে যা ধকল গেলো!
রাতে স্কুলের মাঠে যাত্রাপালার আয়োজন করেছে পূজা কমিটির ছেলে পুলেরা।সারাদিনে মোবাইল ফোনটাকে ছোঁয়ায় সময় হয়নি।অন লাইন হতেই একটা ম্যাসেজ টোন বাজে। আননোন নাম্বারের ম্যাসেজটা ওপেন করতেই শিড়-দাড়া টনটনে হয়ে লোমকূপ গুলো খাড়া হয়ে যায় বিরূপাক্ষর,
রিতিকে যখন সিঁদুর দিচ্ছিলো তখনি তোলা ছবিটা তাও খুব কাছে থেকে।ছবির সাথে লেখা রয়েছে এমন একটি স্বপ্ন দেখি রাত দিন।

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে :চন্দ্রা।

পর্ব :২০

“পাপে ছাড়ে না বাপেরে” কথাটার সঙ্গে হয়তো গ্রামে বসাবাসকারী জনেরা বেশি পরিচিত।স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোজখ হয়তো মৃত্যুর ওপারে আছে।সেটা কেউ দেখে এসে বলেছে এমন প্রমাণ হয়তো নেই। কিন্তু আমিও দ্বি-মতে যাব না।অত জ্ঞান নেই আমার কিন্তু একটা কথা খুব ভালো ভাবে বলতে পারি এবং বিশ্বাস করি,

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর,
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক
মানুষেই তা সুরাসুর।।

কর্মফল কখনো মানুষকে ফাঁকি দেয় না সেটা হোক ভালো কিংবা খারাপ।আর খারাপ কর্ম করে করে অভ্যস্ত ব্যক্তি, সহজে সে তার কর্ম ভোলে না।পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার পরেও প্রতিশোধ স্পৃহা তার মধ্যে থেকেই যায়।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় গ্রন্থ “রামায়ণ” যেটি রচনা করেছিলেন বাল্মীকি মুনি। কিন্তু এই মুনি বরের অতীত কর্ম কিন্তু একদমই ভালো ছিলো না।তিনি ছিলেন ডাকাতদের সর্দার কিন্তু নিজের মধ্যে পূণ্য জাগরিত হওয়ায় সেই গভীর পাপ ছেড়ে হয়েছিলেন পূণ্যাত্মা বাল্মীকি।অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সকল ধর্মীয় গ্রন্থ গুলো অধ্যয়ন করলে এমন নজির অনেক পাওয়া যাবে।যারা খারাপ থেকে ধর্মের কারণে এবং বিবেকের তাড়নায় এমন সৎজন হয়েছেন যে ভালোর কোনো শেষ নেই। কিন্তু সব চোরে তো আর ধর্মের কাহিনী পছন্দ করে না।তার কারণ,
বহুবছর আগে প্রদীপের বাবা যাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের একজন আইনের ফাঁক ফোকর গলে সদ্য বেরিয়ে এসেছে জেল থেকে। কিন্তু জেল খাটলে কি হবে তার ভেতরের পাপ বেড়েছে বৈ কমেনি। এতবছর পর জেল খেটে আসা লিকু সরদার দেখলো তার অতি আদরের বড়ো ছেলেটা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফেঁসে পুলিশের গুলিতে মরেছে। কিন্তু লিকু সরদার মনে করে তার পেছনে একমাত্র হাত রয়েছে প্রভাকর রায় চৌধুরীর।বয়সের ভারে নুইয়ে পরলে কি হবে আত্মা তো আর বৃদ্ধ হয় না।আর পাপাত্মা তো সবার উর্ধ্বে।স্ত্রীকে জরিয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত অগ্নিচোখে প্রতিজ্ঞা করলেন লিকু সরদার শত্রুর বংশ নির্বংশ করে তবে ক্ষান্ত হবেন।যোগ দিলেন রায় চৌধুরী দের বিরোধী দলের সাথে।সামনে নির্বাচন। প্রভাকর রায় চৌধুরীর একমাত্র ছেলেও এখন বাড়িতে এই সুযোগে কিছু একটা করবেই লিকু সরদার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে যখন লিকুর ছেলে নিহত হলো তখন অনেক বর্ষীয়ান লোকেরা বলাবলি করছিলো ,লিকু নাকি কোন এক সময় দূরে কোথায় ডাকাতি করতে গিয়ে এক মায়ের সামনে তার নিরপরাধ ছেলেকে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে হত্যা করেছিলো।এই নাকি তার কর্মফল। কিন্তু লিকুকে বোঝাবে কে? ঘড়ের শত্রু বিভীষণ কথাটা তো আর এমনি এমনি আসেনি।লিকু সরদার এর ছোট পুত্র ইকরাম সরদার হয়েছে তেমনি।রক্ত সবসময় মানুষ কে বেইমানি শেখায় না।
কর্ম ইমান আনতেও সাহায্য করে।
রিতির তাঁতকলে কাজ করে ইকরাম সরদার।গত বছর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে জেলা শহরে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধরে পরে কিডনীতে পাথর হয়েছে।তখন ইকরামের স্ত্রী রিতির হাত পা ধরে কেঁদে পরে সাহায্যের জন্য। স্কুল,গ্রাম এবং সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে অবশেষে দু লক্ষ টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসে রিতি।সেই ইকরাম সরদারই এখন রিতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত গুপ্তচর। নিজের ভাই বোনেরা যেখানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো সেখানে অন্য মানুষ যদি এমন সাহায্যের হাত বাড়ায় তাহলে কৃতজ্ঞতা বোধ আপনা আপনি এসে যায়। কোনখানে কোন আড্ডায় জুয়া খেলা হয় আর কোথায় নেশার জিনিস খেয়ে পুরুষেরা সংসারের বারোটা বাজায় রিতির কাছে সব খবর আসে আর সেগুলো রিতি রঘুনাথ এর মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে নির্মূল করার চেষ্টা করে নিজের গ্রুপ নিয়ে।
এসব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বহুবার না করেছে রঘুনাথ কিন্তু মেয়ে কথা শোনে না।
দেশের যুব সমাজ ধ্বংস হলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।তাইতো এই বিপদজনক উদ্যোগ।

******
সন্ধ্যেয় আড্ডা জমেছে দোতলার বারান্দায়। মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসেছে ছেলে মেয়ে গুলো।মেলায় গিয়েছিলো ওরা। সেখান থেকে কিনে এনেছে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক তেলে ভাজা খাবার, সাথে রিতির তৈরী চা,কফি। জম্পেশ আড্ডার টপিকস হলো আগামী কাল স্কুল মাঠের বড়ো প্যান্ডেলে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাইরের নামী বেনামী কন্ঠ শিল্পী,নাট্য শিল্পীরা আসবে।তার জন্য একটা বড়ো মাপের বাজেট থাকে প্রতিবছরই।এবারো থাকছে। আগামীকাল সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,পরশু রাতে যাত্রাপালার মাধ্যমে এবারের পূজার সকল অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি।তো এখন আলোচনার প্রধান বিষয় হলো রিতির গান গাওয়া।সে নাকি ভারী সুন্দর গান গাইতে পারে শুনেছে অখিলেশ।তারই তোষামোদ চলছে।রিতি রাজি হয়নি কোনোমতেই।অহনা নাচবে অনুষ্ঠানে কথা দিয়েছে।
কথা বার্তা চলাকালীন রিতির ফোনে ম্যাসেজ এলো টুং টুং শব্দে।। বিরূপাক্ষ সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছিলো কিন্তু নজর ছিলো রিতর দিকে।সে সুবাদেই দেখলো ম্যাসেজ ওপেন করতেই রিতির ফর্সা মুখটা ক্যামন লালচে আভা ধারন করছে। বিরূপাক্ষ বাদে আর কেউই বিষয়টি খেয়াল করেনি।রিতি বললো সবার উদ্দেশ্যে,,
তোমরা গল্প করো আমি এলাম বলে।

তোমাকে তো এখনি ছাড়ছিনা বোনটি।আগে বলো কাল গানের শিল্পীদের লিষ্টে তোমার নামটা কি থাকছে?না হলে নো নড়ন চড়ন। অখিলেশ নাছোড়বান্দা।

বৌ মনি রাজি হয়ে যাওনা প্লিজ।বললো অহনা।

একে একে সবাই বললো যখন রিতি কোনমতে হ্যা বলে নিচে নামার সিঁড়ি ভাঙলো।

এই রিতি এই ভরসন্ধ্যায় যাস কোথায়?সুমি বললো জোরে।

আসছি বললাম না? বিরক্তি প্রকাশ করে রিতি।দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মূল দরজার দিকে।সুমি বুঝতে পারে কিছু তো একটা হয়েছেই।

বিরূপাক্ষ এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো ব্যাপারটা। এতক্ষণ ধরে যাকে রাজি করাতে পারেনি ,কি এমন ম্যাসেজ আসলো যে,যাওয়ার জন্যে হ্যা করে দিলো। বিরূপাক্ষ উঠে গিয়ে নিজের ঘড়ের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল রিতি একটা পাতলা শাল মুড়ি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। মন্দিরের সামনে বাবা, আঙ্কেল,আন্টি,মামা,আরো বেশ কয়েকজন মুরুব্বিদের আলাপ আলোচনা চলছে। বিরূপাক্ষ বুঝলো উনাদের চোখে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই অল্প ঠান্ডাতেও শাল জড়িয়েছে আপাদমস্তক।ভ্রুদ্বয় খানিক কুঁচকে আসে বিরূপাক্ষের। মনের মধ্যে সন্দেহ বাসা বাঁধে। কিসের জন্য এত লুকোচুরি?দেখলো রাস্তায় গিয়ে কাউকে ফোন করলো রিতি তারপর হেঁটে মিলিয়ে গেলো রাস্তার পশ্চিম দিকের অন্ধকারে।

এভাবে অন্ধকারে চলাচল কইরো না লিকু ভাই। এখন তো আর চক্ষে আগের মতোন তেজ নাই তোমার।

খ্যাক খ্যাক করে বিশ্রী ভাবে হাসে লিকু সরদার।বিড়িতে একটা টান দিয়ে কেঁশে উঠে। ধীরে ধীরে বলে,,
কস কী হারু? চোক্ষের ত্যাজ নাই বইলা কি আন্দাজ ও গ্যাছে গা?কি ভাবোস আমারে তোরা, চুল দাঁড়ি পাকছে বইলা কি শক্তি,বল ফুরাই গ্যাছে?চাপা ক্রোধ প্রকাশ পায় লিকুর কথায়। বৃদ্ধ হারুন একটু চমকে উঠে।শত হলেও এককালে ডাকাত দলের সর্দার ছিলো লিকু।সেই তেজ এখনো কিছুটা বর্তমান,,

এত চ্যাতো ক্যা ভাই?কইলাম তো তোমার ভালোর লাইগ্গাই।হাত ধরে মানানোর চেষ্টা করে হারুন।বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ফিল্টার টা দূরে ছুড়ে মারে লিকু। বাতাসের সুমুখে তা জোনাকির আলোর মতো জ্বলজ্বল করে।
দু’জনের মধ্যে চলে শলা পরামর্শ।লিকুর মনে বাড়তে থাকে ক্রোধ আর উত্তেজনা সাথে বেড়ে চলে কুয়াশাচ্ছন্ন শারদীয়া নিশি।

রাতের গভীরতার সাথে সাথে মানুষের ও হয়তো নিদ্রা গভীর হয়েছে। চৌধুরী মহলে কোনো সাড়াশব্দ নেই।নিশুতি রাতের আঁধার ভেদ করে ভেসে আসছে মেলার মাঠ থেকে গমগমে শব্দ। বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে হয়তো শুধু ঘুম নেই বিরূপাক্ষের চোখে।গলা পর্যন্ত কম্বল টেনে শুয়ে আছে রিতি।আজ পালঙ্কে শুয়েছে।নিচে শুতে দেয়নি বিরূপাক্ষ। গভীর ঘুমের নিঃশ্বাস পড়ছে তার। বিরূপাক্ষ রিতির ঘুমন্ত দূর্বল মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।

তখনকার ঘটনাটা মনে পরতেই বার বার ভয়ে শিউরে উঠছে সে। হঠাৎই মনে পরলো গুরুদেবের বলা সেদিনের কথা গুলো।সবাই যখন প্রণাম শেষ করে বসলো তখন তিনি নিজের কাছে ডাকলেন বিরূপাক্ষ এবং রিতি কে।রিতির বাঁ হাত এবং বিরূপাক্ষের ডান হাতটা টেনে নিয়ে পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলেন মিনিট পাঁচেক।তার পর অতি ধীরে শান্ত স্বরে বললেন বিরূপাক্ষ এবং রিতির উদ্দেশ্যে,দাদুভাই উপরে বসে যিনি কল কাঠি নাড়ছেন তিনি রক্ত মাংসের দেহ দিয়ে তাঁর প্রিয় মানব সৃষ্টির সময় ভাগ্যটা নিজে হাতে লিখে দেন।যা পরিবর্তন করা কখনোই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় তবে হ্যা প্রতিরোধের জন্য কিছু বিশেষ পন্থার নির্দেশ অবশ্যই দিয়েছেন।জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটি একত্রে তিনি নিজের হাতে রেখেছেন। মানুষ তো উসিলা মাত্র।বিবাহ শব্দটি শুধু মাত্র দুটি মানব-মানবীকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়নি দাদুভাই।বরং অনেক মহৎ,বৃহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিবাহ নামক সংস্কারের সূচনা হয়েছে।এই যে আমার দিদি ভাইকে যে তোমার জোড় হিসেবে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা তারো কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আমি জানি,শুনতে চাও সে কথা?
উপস্থিত সবার উৎসুক দৃষ্টি ভেদ করে বিরূপাক্ষের হ্যা সূচক কথাটি শুনতে চান গুরুদেব।বিরূপাক্ষ উদ্বিগ্নতা লুকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ে।মৃদু হাসেন গুরুদেব,,,

সে তোমাকে সর্বদা তোমার কামে সাথ দেবে,ক্রোধে নিবৃত করবে,জরা ব্যাধিতে সেবিকা হবে, দুঃখ দৈন্যে সান্তনা দেবে, শুধু নিজের হৃদয়ে তোমার আসন নয়, তোমার হৃদয়েও নিজের আসন গড়বে,সর্বপরি মহাদেব যেমন সৃষ্টিকে বাঁচাতে সমস্ত গরল পান করে নীল কন্ঠ হয়েছিলেন তেমনি তোমার মৃত্যু যন্ত্রনা নিজে ভোগ করে তোমাকে নতুন জীবন দান করবে।স্ত্রী যে মায়ের আরেকটা রূপ।এই তোমাদের ভবিষ্যত দাদুভাই।গুরুদেবের হাতে মুঠিতে বিরূপাক্ষের হাতটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে।মৃদু হাসেন গুরুদেব,,,

ভয় পেও না দাদু ভাই। চিন্তার কোনো কারন নেই। তোমার পত্নী যেমন তোমার অকাল মৃত্যু যোগ কাটাতে পারবে তেমনি তুমিও ভালোবাসা,প্রেম,ভক্তি,সেবা, একনিষ্ঠতা দিয়ে তাকে জড়িয়ে রেখো। মরণের কি সাধ্য আছে পূন্যবানের বুক শূন্য করবে?

বিরূপাক্ষ মনে মনে ভীত হয়ে এতদিন ভেবে চলেছিল গুরুদেব এর কথা গুলো।মনে মনে ভেবে পাচ্ছেনা তার মৃত্যু যোগ খন্ডাতে পারবে কে?সে কি রিতি নাকি বনলতা?কারো অনিষ্ট সে চায়না কিন্তু অনিষ্ট যা হওয়ার তাতো হয়েই গিয়েছে।আগে জানলে কখনো বিয়েই করতো না। শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবনের ঝুঁকি।তবে কি বিরূপাক্ষের স্ত্রী হিসেবে ঝুঁকিটা বনলতার প্রাপ্য?
না না একটা অচেনা অজানা মেয়ের অমঙ্গল চিন্তা বিরূপাক্ষ করতে পারে না।তবে কি রিতি?

নাহ্,,,
হালকা তন্দ্রা ঘোরে মৃদু চিৎকার দিয়ে আঁতকে উঠে বিরূপাক্ষ।রিতির কোনো ক্ষতি সে সইতে পারবে না।কোনো ভাবেই না।আজই তো প্রাণটা প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো,যখন অনেক খুঁজে মোবাইলের ফ্লাসলাইটের আলোয় দেখলো গ্রামের পশ্চিম সীমান্তে ভাঙা পুরাতন ব্রিজের পাশে ধুলো বালিতে পরে রয়েছে রিতির নিথর দেহটা।হৃদপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন যেনো মুহুর্তের জন্য থেমে গিয়েছিলো বিরূপাক্ষের।তার আগেই কয়েকজনকে দ্রুত গতিতে চলে যেতে টের পেলো নৌকায় চড়ে।নদীর জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে কারা চলে গেলো সেদিকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না সে।ক্যানো,কি কারনে অত রাতে রিতি ওখানে গেলো এখনো তার সদুত্তর পায়নি বিরূপাক্ষ।ঐ মুহুর্তে রিতির মাথাটা নিজের কোলে তুলে শুধু একবার ফোন করেছিলো প্রদীপকে। সেখান থেকে গ্রামের ডাক্তার এর বাড়িতে নিয়ে রিতির জ্ঞান ফিরতেই তবে বাড়িতে ফিরেছে দুজনে।রিতির মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি বিরূপাক্ষ।ও শুধু একটাই অনুরোধ করেছে,বাড়িতে যেনো এই দূর্ঘটনার কথাটা কেউ না জানে। বিরূপাক্ষ কথা দিয়েছে কেউ জানবে না।ঘাড়ে শক্ত কিছু একটা দিয়ে আঘাত করায় জ্ঞান হারিয়েছিলো এখন ঠিক আছে জেনে নিশ্চিন্ত বিরূপাক্ষ।তবে এই গভীর রহস্যের উদঘাটন না করে শান্তি নেই তার।

চলবে,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here