উপন্যাস : হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,২১,২২
কলমে :চন্দ্রা।
পর্ব:২১
পূবের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করা রবির কিরণ আর উত্তরের বিশাল আম, কাঁঠালের বাগান থেকে ভেসে আসা বিহগ-বিহগীর খুনসুটিময় কলতান ধ্বনিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিদ্রাদেবী চোখের পাতা ছেড়ে প্রস্থানের পাঁয়তারা করছে।নাকে সুড়সুড়ি অনুভূতি হওয়াতে ক্লান্ত চোখের পাতা মেলে ধরে রিতি। ঘুম ঘুম চোখে ঝটকা খায় তখনি।গায়ে পায়ে অসম্ভব ওজনে নড়া চড়া দায়। বিরূপাক্ষ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাকে। উন্মুক্ত বুকের পশমে রিতির নাকে মুখ শিরশির করে উঠতে ছোট্ট পাখির ছানার মতো বিরূপাক্ষের প্রশস্ত বুকে নড়ে চড়ে উঠলো সে।বিরূপাক্ষের ঘুম আলগা হয়। চোখের উপর রোদের সোনালী আলো।একমুহুর্তে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে। হাতের বাঁধন আলগা হতেই রিতি পরিমরি করে উঠে যায় কম্বল সমেত।ভেবে পায়না বিরূপাক্ষ,গত রাতে দুজন দুই কম্বলে শুয়েছিলো তাহলে একটার মধ্যে দুজন গেলো কখন।একেতো দূর্বল শরীর তায় আবার মোটা কম্বলের প্যাঁচঘোঁচ।তাল সামলাতে না পেরে পরে গেলো রিতি দুরুম করে।ভেবেছিলো কোমরটা বুঝি গেলো কিন্তু না নিজের কোমর তো ঠিকই আছে তবে কি অন্যের বুকের পাঁজর গ্যালো?
ব্যাথা বিরূপাক্ষ পেয়েছে বেশ খানিকটা।রিতির ওজন নেহায়েৎ কম নয়। কিন্তু কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত রিতিকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে স্নেহ ভরা মোলায়েম কন্ঠে বলল,এত ছটফটে ক্যানো তুই মেয়ে?একটু সাবধানে চলবি তো,দেখলি ক্যামন ব্যথা পেলি?
রিতি বিস্ময়ে দুই বার চোখে পলক ফেললো। মানুষটার ঘুম ভাঙা মোটা কন্ঠঝংকার রিতির কানে ঘি,মধু ঢাললো শত সহস্র মণ।সব ভুলে ভাবলো রিতি,এত শ্রুতিমধুর কন্ঠঝংকার? একবার যদি খাওয়া যেতো, জীবনে আর অন্য আহারের প্রয়োজন পরতো না বোধহয়।
কি ব্যাপার চলছে বলবি আমাকে বুড়ি?রিতির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো জয়া।
কোন ব্যাপারের কথা যেনো বলছো? নির্লিপ্ত রিতি চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে।
কিছুই জানিস না তুই? একেবারে যে গাছ থেকে পরছিস তার মানে কি? উষ্মার সাথে বলে জয়া।রিতি টুলে বসা অবস্থায় ঘুরে জয়ার হাত ধরে বলে মুচকি হেসে,,এত মাইন্ড ক্যানো খাচ্ছো বিজয়া দেবী?একটু বুঝিয়ে বলো না ক্যানো?
আদিখ্যেতা হচ্ছে আবার?
এই জয়া বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। সোজাসাপ্টা কথা বলো বলছি না হলে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না। নিজের রসিকতায় নিজেই শব্দ করে হেসে উঠলো রিতি।জয়া চোখ পাকায়,আবার দাদাভাই এর নকল করছিস।নাম ধরে ডাকছিস আমাকে? দাঁড়া বলবো ঠাকুর পো কে।শাসায় জয়া।
হুহ্,,কি এমন লাটের বাট তোমার ঠাকুর পো?কে পাত্তা দেয় আর কে গায় বাঁধায়?
তাই না?দুজনে হাত ধরে রাত করে বাড়ি ফিরছিস? আবার একটু আগে দেখলাম একজন গলায় বুকে সিঁদুর নিয়ে ঘুরছে,সেতো এমনিই। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো জয়া। লজ্জায় রিতির শ্বাসরোধ হওয়ার জোগাড়। আপনিই মাথাটা নত হয়ে আসে লাজে।জয়া এবার হাসে প্রসন্ন হাসি রিতির মুখখানি উঁচু করে ধরে আবেগী কন্ঠে বলে,, বলেছিলাম না আমি,এমন রূপ যে একবার দেখবে সে তো পাগল হবেই।এমন প্রতিমা বিসর্জন হয়না রে বুড়ি।সারা জীবনের জন্য হৃদয়ের মন্দিরে অবস্থান করে স্বমহিমায়।ভালো বাসার প্রতিযোগিতায় তুই হারবি গো-হারান দেখিস একদিন রূপেরই জয় হবে।জয়া আপন মনে হাসতে থাকে।রিতিকে নিচে নামার কথা বলে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।বৌদিদির ঠোঁটের স্বস্তির হাসির তীর রিতির বুকে এফোড় ওফোড় ভেদ করে।তীব্র সে যন্ত্রণা।চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। উচ্চারণ করে ঠোঁট কাঁপিয়ে,,
“আমি তো ঠকিনি কারণ আমি ভালো বাসতে পেরেছি,ঠকেছে তো সে ,সে ভালোবাসতে পারেনি”
(শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
*******
কাজটা কিন্তু ভালো করো নাই লিকু ভাই। তোমার এই কাজের জন্য যদি আমার দলীয় কোনো সমস্যা হয় তাইলে কিন্তু ছাড় দিবো না আমি।অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নিজের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে আমির শেখ। এবার উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান প্রভাকর রায় চৌধুরীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী সে।লিকু সরদারকে এক কথায় নিজের দলে নিয়েছিলো শুধুমাত্র আপন স্বার্থে। দেখতে স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ আমির শেখ। পঞ্চাশ এর কাছাকাছি বয়সে এতটা আভিজাত্যের ছোঁয়া আর রূপের জৌলুস যে ত্রিশ বছরের যুবক বললে ভুল হবে না। এমনিতে বড় পরিবারের ছেলে তিনি তার উপর দশ বছর বিদেশ করে ভালোই কামিয়েছেন।এখন ব্যবসা করেন শহরে, বিভিন্ন ব্যাবসা তার।বেশ কয়েক বছর বাবা ,দাদার তৈরী রাজনৈতিক পথে হাঁটছে কিন্তু কোন তাল করতে পারেনি প্রভাকর রায় চৌধুরীর কারনে।নেশা দ্রব্যের পক্ষে তিনি নয় কিন্তু দলের স্বার্থে এখন মেনে নিয়েছেন।মেনে নিচ্ছেন।দু চারটে খুন খারাবি করতে হলেও দ্বিমত পোষণ করবে না।প্রয়োজনে নিজের নবনির্মিত ইঁটের ভাটায় মানব দেহ পুড়বে।গুম হয়ে যাবে খুন গুলো। কিন্তু সহজে কেউ হত্যাকারীদের দলে নাম লেখাতে চায় না।
কিন্তু তুমি জানো ভাই আমি কিয়ের লাইগা এমনটা করছি আর তুমিও তো ঐ মাইয়ার ভালো চাও না।সভয়ে বলে লিকু।
হ্যা ভালো চাইনা তাই বলে তুমি এখনি একটা আহম্মকি করবা? তুমি জানো না ঐ চৌধুরীর চেয়ে তার পুত্র বধুর জনপ্রিয়তা কতো?সারা এলাকার মানুষেরে কাজ কাম দিয়ে সে তো মহান হয়ে গেছে।এমন কেউ নেই যাকে ঐটুকু মেয়ে সাহায্য করে না।ভাগ্য ভালো কাল ছেলে গুলো নিজেদের ফেস দেখায় নি।এখন একটা কিছু হইলে সব টার্গেট আমার আর আমার দলের ছেলেদের উপর পরবে।স্বতেজে বললো আমির। পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন দিয়ে টান দেয়।একরাশ নিকোটিন এর ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে ওঠে বাহির ঘড়ের পুরো কামরাটি।পাশে সটান দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষী আসলাম এর চোখে ভীতি সঞ্চার হয় কারন তার মনিব ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলেন না কখনো। ইদানিং শুরু করেছেন তাও যখন একান্ত মুড অফ থাকে।আর তার প্রভাব পরে দেহরক্ষী দের উপর। কিন্তু আজ কিছুই হলো না।চোখ ছোট করে অত্যন্ত কঠিন কন্ঠে বললো আমির,, আসলাম সবাইকে সতর্ক থাকতে বইলো।ঐ মাইয়া চুপ করে থাকবে না।এখনি পুলিশ কেলেঙ্কারির ঝামেলা যেনো না হয়।
জি আচ্ছা ভাই,, আসলাম কুর্নিশ করে বেরিয়ে আসে ঘড় থেকে।আমির দু পা এগিয়ে যায় কাঁচুমাচু হয়ে থাকা লিকুর দিকে অত্যন্ত কুটিল স্বরে বলে,, দাঁড়ি তো এমনে পাকে নাই লিকু ভাই।ঐ হাঁটুর চেয়ে ও কম বয়সী মেয়েটার বুদ্ধির ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবেনা তুমি।বয়সের বুদ্ধি কাজে লাগাও।নইলে আমার মসৃন রাস্তায় সেধে যে কাঁটা বিছিয়ে যাবে তাকে অবশ্যই আমার সরাতে হবে।সে যেই হোক।দল কিংবা বেদল।
মনে মনে মা বাপ তুলে একটা গালি দিলো লিকু। রোষের অনলে জ্বলতে থাকে,, দুই দিনের পোলা আমারে চোখ রাঙানি দেস?তর বাপ কুনো দিন চোখ তুইল্যা চায়নাই আমার দিকে।তোরে ত দেইখা নিমু আমি খালি এট্টু সময় দে হারামজাদা।
বৃথা আস্ফালন লিকুর মনের মধ্যে থাকা বাক্য স্বরতন্ত্রীর সাহায্যে বাহিরে আনার দুঃসাহস নেই তার।হজম করেই নিলো মুখবুজে।
স্কুলের মাঠের দুম দুম আওয়াজে চৌধুরী মহল কাঁপছে। এলাকার ছেলেপুলে নাচছে। একটু পরে শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান।অভি,অহনা প্রদীপের সাথে আগেই পৌঁছে গিয়েছে মাঠে।অন্য সবাই রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রইং রুমে।রিতির অপেক্ষা।সে এখনো সাজছে। রাহুল গিয়ে তারা দেয়,,এত সেজে কি হবে বলোতো রিতি? তোমার যা ভাগ্যে আছে তা তো অলরেডি হাসিল করে নিয়েছো। বাঁ চোখে হাত চেপে ফিরলো রিতি রাহুলের দিকে,,অন্য চোখটাও লাল হয়ে গেছে।
সে কি চোখে আবার কি হলো তোমার?ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে রাহুল।
কি যে পরলো দেখো না?কি যন্ত্রনা হচ্ছে। রাহুল রিতির হাতটা চোখের ওপর থেকে সরিয়ে নিজের দুহাত এগিয়ে দেয়।
এত বড়ো পোকা ঢুকেছে?মাই গড!পোকারই বা কি দোষ বলো এত সুন্দর চোখ দেখলে একটু তো প্রেমে পরবে,একটু তো ঝাঁপাঝাঁপি করবে পদ্ম লোচন সরবরে।রসিকতা করে রাহুল।রিতি রাহুলের হাতে একটা থাপ্পর মারে আস্তে,,অন্যের দুঃখ দেখলে খুব সুখ লাগে না?
আরে দাঁড়াও পোকা বাবাজি মোটেও বের হতে চাইছে না। খুব সন্তোর্পনে যত্ন সহকারে পোকা টা বের করলো রাহুল।রিতি পুনরায় চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে আসে রাহুলের সাথে।ড্রইং রুমে সুমি এবং জয়া দাঁড়িয়ে আছে।
এই হলো তোর ?চল চল।বললো সুমি।
রূপ দা কোথায় গেলো বৌদিদি?বললো রাহুল।
এই মাত্র বেরিয়ে গেলো হন্তদন্ত হয়ে। উপরে গিয়েছিলো রিতিকে ডাকতে।না ডেকেই ফিরে এলো।কোনো কথা না বলেই বেড়িয়ে গেল।বললো জয়া চিন্তিত সুরে।
ও আচ্ছা,পাংচুয়াল মানুষ কি না!চলো তো দেখি গিয়ে। রাহুল বললো হাঁটতে হাঁটতে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ।এত এত জনতার ভীড়ে রিতির চোখ দুটো শুধু একজনকেই খুঁজছে কিন্তু কোথায় সে?আজকে গান গাইতে রাজি হয়েছে শুধু তাকে শোনাবে বলে। কিন্তু সে কি শুনবে না রিতির এই বিরোহী হৃদয়ের আর্তি মেশানো সুর।তাহলে যে বৃথা হবে আজকের এই গান গাওয়া।সময় যাচ্ছে,রাত বাড়ছে।অহনা,তিতলির ডুয়েট পারফরম্যান্স হয়ে গেছে এখন তো রিতির নামটা এনাউন্সমেন্ট হবে যেকোনো মুহূর্তে।কারো কাছে জিজ্ঞেস করতেও অস্বস্তি বোধ হচ্ছে রিতির। অবশেষে ঘোষণা করা হলো রিতির নাম, নিজের অস্বস্তি, লজ্জা ঝেড়ে প্রদীপকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,,
প্রদীপ দা , তাঁকে তো দেখছি না? কোথায় গেলো তুমি জানো?
চিন্তিত দেখায় প্রদীপকে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,,না রে,একটু আগে এসে বললো বাইকের চাবি দে।সে কি অগ্নিমূর্তি?সাথে যেতে চাইলাম আমাকে তেড়ে মারতে এলো।বললো,যাবে আর আসবে।আমারো আর এদিকের ঝামেলায় খেয়াল ছিলো না।এখন তো চিন্তা হচ্ছে ফোনটাও ধরছে না। আচ্ছা তুই যা।আমি দেখছি ভালো করে গাইবি কিন্তু।যা।রিতি এগিয়ে যায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও।তার আর সুর সাধার ইচ্ছে নেই কিন্তু বড়োমা,জেঠু,বৌদিদি এবং পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ বসে আছে তার গান শুনবে বলে,, অবশেষে গাইলো রিতি নজরুল সঙ্গীত।রিতি যে ভালো ভজন গায় জানতো পূজা কমিটির ছেলেরা। অনুরোধ করলো একটা ভজন গাইতে।একেতো মন অস্থির তার উপর এখনো মানুষটাকে দেখলো না।প্রদীপ দা ও কোথায় চলে গেলো,,,
শ্যাম তেরি বংশী পুকারে রাধা নাম
শ্যাম তেরি বংশী পুকারে রাধা নাম,,,
লোগ করে মিরাকো ইউহি বদনাম।
,,,,,,,,
,,,,,,
শ্যামকো দিওয়ানা সারা ব্রীজ ধাম লোক করে মীরা কো ইউহি বদনাম,,,
একমনে গেয়ে চলেছে রিতি। গানের ভেতরে স্বশরীরে প্রবেশ করেছে বুঝি।তিতলির চোখে জল।হুট করে কেউ কানে কানে কছু বলতেই ঝট করে উঠে যায় প্রভাকর রায় চৌধুরী তাঁর বন্ধুকে নিয়ে। রাহুল ও বেরিয়ে যায় হন্ত দন্ত হয়ে দর্শকদের সারি থেকে কানে বাজতে থাকে রিতির গাওয়া শেষ লাইন টুকু,,
রাধা কা ভি শ্যাম হতো মীরা কা ভি শ্যাম।অদৃশ্য কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে করুন মিনতি জানায় রাহুল।হোক সে বনলতার কিংবা রিতির।দুজনে না হয় মীরা আর রাধা হবে কিন্তু বিরূপাক্ষ রূপী কৃষ্ণের দেহের প্রান তুমি কেড়ে নিও না ঠাকুর।
করতালিতে ফেটে পরে উচ্ছল জনতা সবার উদ্দেশ্যে মস্কার করে দ্রুত পায়ে নেমে আসে রিতি। কাউকেই তো দেখছে না। কোথায় গেলো সব।মনটা কু গাইছে।একটু ফাঁকা জায়গায় যেতেই সুমি এসে জড়িয়ে ধরে রিতিকে কাঁদছে সে,,রিতি তোর রূপ,,,
কথা শেষ করতে পারে না সুমি।রিতি হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয়।কন্ঠে কাঠিন্য এনে দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করে,, কিছু বলবি না সুমি।আমি কিছুই শুনতে চাই না।আমি তাঁর কাছে যেতে চাই এই মুহূর্তেই।
রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে ছিল রিতির অপেক্ষায়। নির্লিপ্ত ভাবে গিয়ে গাড়িতে ওঠে রিতি।ভেতরে জয়া বসে কাঁদছে।গাড়ি চলছে আপন গতিতে, উদ্দেশ্য জেলা শহরের নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল।রিতির মুখের দিকে চেয়ে কারো কিছু বলার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে।এ যেনো পাথুরে দূর্গ কিছু বললেই গলে খসে ধ্বসে ধ্বংস করে দেবে সবকিছু।
চলবে,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।
উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:২২
আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি,
মন বান্ধিবি ক্যামনে,,,,,,,
আমার চোখ বান্ধিবি,মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি ক্যামনে,,,,
বিধাতা তার সৃষ্টিকে খুব বুঝে শুনে সৃষ্টি করেছেন।যেমন,মসৃন ত্বকের আবরণে, তুলতুলে মাংসের আস্তরণে আর কটকটে শক্ত হাড়ের ভেতর স্থাপন করেছে হৃদয়,মন।যাতে কোনো ভাবে বেসামাল হয়ে কখনো বেরিয়ে না যায় মানব দেহের গভীর প্রাচীর থেকে। কিন্তু তিনি কি জানেন এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বস্তুটির নাম হলো মন। সবকিছুর আগে সেটা বেরিয়ে ছুটে যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।না মানে বাঁধা না মানে বারণ।হাড়, মাংস , চামড়ার কঠিন বাঁধন তাকে কখনো রুখতে পারে না।
পিচ ঢালা মসৃন পথ কেটে ছুটে চলেছে রিতিদের গাড়ি।জয়া কেঁদে কুটে গুম মেরে আছে।রিতির পাথর দৃষ্টি সম্মুখের রাস্তায়। কিন্তু মন তার ঘুরছে হাসপাতালের ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ মাখা কোনো একটা কামরায়।যেখানে নিশ্চল হয়ে শায়িত আছে তার প্রাণ ভ্রমর।হ্যা প্রাণ ভ্রমরই তো।কেউ না জানুক রিতির মনতো জানে তার প্রাণের মাঝে নিত্য কার বসবাস।কে বিচরণ করে অহর্নিশি।চোখে জল নেই ঠিকই কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তো বাঁধ মানছে না।ফোনে কথা বলেছে সুমি প্রদীপের সাথে। বিরূপাক্ষ কে জেলা শহরের হাসপাতাল থেকে বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল এর জরুরী বিভাগে পাঠানো হয়েছে।তারা পৌঁছোয় নি এখনো।
রিতির সজাগ শ্রবণ ইন্দ্রীয় শুধু শুনে চলেছে, বিরূপাক্ষ সম্মন্ধে সুমি এবং জয়ার কথোপোকথন।
******
খুশি ধরছে না লিকু সরদার এর বাড়িতে। তিন কেজি গরুর মাংস এনেছে সে।পালের রাজ হাঁস জবাই করেছে।তিন মেয়ে এসেছে জামাই, বাচ্চা কাচ্চা সহ।সেমাই পিঠা দিয়ে খাবে হাঁসের ঝাল ঝাল মাংস।ছোট ছেলেকে বলেছিলো বউ বাচ্চা নিয়ে আজ মেজ ভাইয়ের ঘড়ে খেতে। কিন্তু ইকরাম সরদার খেতে যায়নি।তার বাবা এই শেষ বয়সে এসে যে হিংসাত্মক খেলা শুরু করেছে তাতে হয়তো তাঁর অবশিষ্ট জীবন টুকুও যাবে পাপ ভোগ করতে করতে গারদের ওপারে। কিন্তু ইকরাম কিছুতেই চৌধুরী পরিবারের কারো ক্ষতি হতে দেবে না।নুন খেয়ে নেমকহারামি সে করতে পারবে না।
আমির শেখের বৈঠক খানায় চলছে দলীয় আলাপ আলোচনা।লিকু সরদার নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে বসলো এক কোনায়।
আমির সাহেব নিজের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আদান-প্রদান এর মাঝেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ইশারা করেন দেহরক্ষী আসলাম কে।
আসলাম লিকুকে কিছু একটা বলতেই পাশের ফাঁকা চেয়ারটাতে উঠে বসে মেঝে ছেড়ে।দলের লোক গুলো বৈঠক খানা ত্যাগ করতেই আমির শেখ লিকুর সামনের চেয়ারে বসে,,,,
শুনলাম নাকি খুব আমোদে আছো লিকু ভাই? বাড়ির খাওয়া দাওয়ার আড়ত মিলাইছো?তা এত খুশি কিসের জন্য? পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো আমির শেখ।
লিকু বুঝতে পারলো না আমির শেখ এর মনের ভাব গতি আজকাল কার মানুষ জনই এমন হাসতে হাসতে বাপের বয়সী মানুটাকেও অপমান করতে পারে। তবুও মনের মতো প্রশ্ন শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,, তেমন কিছু না আমির ভাই।অনেক দিন হইলো পোলা মাইয়া গুলারে নিয়া ভালো মন্দ খাইনা তাই আর কি?
আল্লাহকে ডাকো লিকু ভাই চৌধুরীর ছেলে যেনো সহি সালামতে ফিরে আসে,নইলে তোমার সাধের ভালো মন্দ খাওন জেলের টয়লেটে ফেলতে হবে। হঠাৎ করে রোষে ফেটে পরে আমির শেখ।
লিকুর হাসির ঝলক দপ করে নিভে যায় এমন অনাকাঙ্খিত আক্রমনে,,
কিন্তু ভাই আমি তো হেই পোলারে কিচ্ছু করিনাই। এক্সিডেন্ট করছে।আমতা আমতা করে লিকু।
সেটা তুমি জানো,আমি জানি।ওদের জানানোর জন্য ঐ ছেলের সুস্থ হয়ে ফিরতে হবে।নইলে তোমার সাথে আমারো জানাজা পরাবে রঘুনাথ।তাকে তো এখনো চেনো না তুমি। কাল রাতেই আমাকে ফোন করে থ্রেট দিয়েছে।বড়ো বড়ো নেতারা চলে তার কথায়। ভাইয়ের জন্য মানুষ খুন করতে হাত কাঁপবে না একটুও।ও হলো বিলেতি কুত্তার মতো বুঝলা।মামার পালিত কুত্তা।
আমির শেখ চোখের তারায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরিয়ে বেরিয়ে যায় বৈঠকখানা থেকে।আধোমুখে বসে থাকে লিকু, তার পাকস্থলীতে অবস্থান রত বাহারী খাবার উর্ধ্বগামী। বেরিয়ে আসবে হয়তো।
গতকাল রাতে সবাই যখন বসার ঘরে অপেক্ষা করছিলো রিতির জন্য। তখন বিরূপাক্ষের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে।ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ভেসে আসে মেয়েলী কন্ঠ।বিরূপাক্ষের সর্ব শরীরে বয়ে যায় শীতল শিহরণ,এ যে সেই সুর,,,যে সুরে একদিন সে বিমোহিত হয়ে পরেছিলো ঘন জঙ্গল আচ্ছাদিত কর্দমাক্ত মেঠো পথে।
সবার অলক্ষ্যে স্টাডি রুমে প্রবেশ করে কথা আগায় বিরূপাক্ষ।চার মিনিট পনেরো সেকেন্ড এর মাথায় লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে অপর প্রান্তে থাকা বনলতা নামধারী মেয়েটি।
কিন্তু বিরূপাক্ষের ভালো লাগার চেয়ে অস্থিরতা যেনো বেশি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তৃষ্ণা পায় ভীষণ।রিতিকে দেখার তৃষ্ণা।স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে সবার সামনে দিয়ে তড়তড় করে উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে।রিতিকে একবার দেখবার অভিপ্রায়ে। কিন্তু সে তৃষ্ণা অচিরেই অফুরন্ত ঘৃনায় পর্যবশিত হয়।যা সন্দেহ করেছিলো তাই ঠিক হলো? রাহুল রিতিকে গভীর ভাবে চুম্বন করছে।রাগে ক্ষোভে কেঁপে ওঠে বিরূপাক্ষের অস্থিমজ্জা।ফিরে আসে দরজা থেকেই। প্রদীপের কাছ থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে পরে উদ্দেশ্য হীন ভাবে।তারপর যা ঘটার তাই ঘটলো।যানবাহন কখনো মানুষের মন মানসিকতা বোঝে না।বুঝলে হয়তো বিরূপাক্ষের অতবড়ো বিপদটা ঘটতো না।
অনেক সময় দেখা বা শোনায় ঠিক থাকলেও বুঝার ভূলে অনেক বড়ো বিপদের সম্মুখীন হয় মানুষ। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখলে যে সন্দেহটা দূর হতো সামান্য তম দূরত্ব অতিক্রম না করায় সেই সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয়।
রিতি যখন চোখের যন্ত্রণায় ছটফট করছে,আর রাহুল স্নেহ পরায়নতা দিয়ে সেই কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছে তখনি বিরূপাক্ষ রাগে ক্ষোভে ফেটে পরলো ভূল বুঝে?একই স্থানে ত্রিপল অনুভূতি, বিধাতার খেলা বোঝা সত্যিই দায়।
******
বুকের উপর পুরু ব্লাঙ্কেট টেনে তার উপরে ব্যান্ডেজ করা হাতটা রেখে ঘুমিয়ে আছে বিরূপাক্ষ।দখিনের জানালায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিতি। ছলছলে আঁখি দুটি বিচরণ করছে বিরূপাক্ষের মসৃন মুখমন্ডলে।সদ্য কামানো শ্মশ্রুতে নীলচে আভা শ্যাম বর্ণের ত্বক যেনো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।চারদিন পরে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে ওরা।এসেই নাপিত ডাকিয়ে চুল কাটিয়ে, দাঁড়ি কাটিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে সবাই।ডান হাতের দুটো হাড় চটেছে।সারতে সময় লাগবে মাসখানেক। মাথায় আঘাত টা গুরুতর না হলেও আশঙ্কা কম ছিলো না।ডান হাঁটুতে ও কেটেছে বেশ খানিকটা। ব্রীজের উপর এক পাল্টি খেয়ে খালে পরায় বেশী ক্ষতি হয়নি বিরূপাক্ষের নইলে একজীবনের সাধ চিরতরে নির্মূল হতো তার।
কিন্তু প্রদীপের সদ্য কেনা সাধের বাইকটা বোধহয় আর কোনো ডাক্তারেই ঠিক করতে পারবেন না।সেটা গড়াগড়ি দিতে দিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।এখন ভাঙরি বেঁচে পাপড় খাওয়া ছাড়া গতি নাই।
এই চার দিন রিতি দিন রাত এক করে খেয়াল রেখেছিল বিরূপাক্ষের।কারো বারণ শোনেনি পরে রয়েছে হাসপাতালে। কিন্তু যার জন্য এত উতলা,এত দুশ্চিন্তা সেই বিরূপাক্ষ একবারো কথা বলেনি ওর সাথে।ফিরে তাকায় নি রিতির দিকে।এই অনাহুত অবহেলার কারন জানে না রিতি।এতটা অবজ্ঞা প্রাপ্তির কি কাজ সে করেছে জানে না।
রাত বারোটায় একটা এন্টিবায়োটিক দিয়ে তারপর ঘুমের ভান করে শুয়ে পরবে রিতি।ঘুমতো ইদানিং ছুটি নিয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে রিতির তিনদিন আগে বিরূপাক্ষের আচরণ মনে করে,,,
দূরঘটনার একদিন পরে যখন জ্ঞান ফিরলো বিরূপাক্ষের বাড়ির সবাইকে দেখলো দূর্বল,স্বচ্ছ চোখে।রিতির পানে দৃষ্টি পরতেই স্বচ্ছ চোখ দুটো ক্যমন কঠিন হয়ে গেলো।রিতির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো রাহুল।ব্যপারটা তার চোখ এড়ালো না।রিতির পাথর চোখ ছাপিয়ে বইলো লোনা জলের ধারা। রাহুলের উদ্যোগে রিতিকে বিরূপাক্ষের কাছে রেখে বেরিয়ে গেলো সবাই। কিন্তু রিতির জন্য যে কি পরিমান অসম্মান সেখানে অপেক্ষা করছিলো সে সম্মন্ধে অবগত ছিলো না কেউই,রিতি এগিয়ে গিয়ে বিরূপাক্ষের বা হাতটা ছুঁতেই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো বিরূপাক্ষ,
আমাকে তুই ছুঁবিনা। অসভ্য মেয়ে কোথাকার। হতভম্ব রিতি ভাবলো অসুস্থ শরীরে ভুল বকছে মানুষটা। হতভম্ব হয়ে দেখলো স্যালাইনে রক্ত উঠেছে।সেটা ঠিক করতেই আবার ফুঁসে উঠলো বিরূপাক্ষ।রিতি উঠে দাঁড়ায়, নিজের কান্না রোধ করে বলে কাঁপা গলায়,,
নিজের শরীরের এই অবস্থায় এত উত্তেজনা ঠিক নয়। তুমি না চাইলে তোমার কাছে আসবো না। তবুও শান্ত হয়ে যাও প্লিজ।দেখেছো তো বড়মা, জেঠুকে?এক রাতেই কি অবস্থা হয়েছে মানুষগুলোর? তোমার কিছু হলে তাঁরা বাঁচবে না। ওনাদের জন্য হলেও শান্ত হও প্লিজ।
তাহলে তুই বেরিয়ে যা। আমার সামনে আসবি না।তোর মুখ দেখলেও ঘৃনা হচ্ছে আমার। গলা কাঁপছে বিরূপাক্ষের।
রিতির বুকটা অসম্ভব ভারী হয়ে আসে।কি যা তা বলছে বিরূপাক্ষ বুঝতে পারে না রিতি কিন্তু এতটুকু তার কাছে স্পষ্ট হয়,এসব অসুস্থতার ঘোরে বলা কথা নয়।
আচ্ছা তুমি না চাইলে আসবো না।
এত অল্পতে রিতির এই মেনে নেওয়াতেই বিরূপাক্ষের ক্রোধ দ্বিগুণ হয়,,
শুধু এখানেই নয়।আমি বাড়িতে গিয়েও তোর মুখ দেখতে চাই না।আজই চলে যাবি তোর নিজের বাড়িতে।
সে হবে না। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যেতে পারবো না।এই শর্ত আমাকে দিতে পারো না তুমি।দৃঢ় স্বরে বললো রিতি।
আমি মরি বাঁচি তোর কি যায় আসে?তুই তো তোর জায়গা গুছিয়ে নিয়েছিস।আলাগা পিরিত দেখাতে আসিস ক্যানো আর।তোর মতো মেয়ের কি আর সঙ্গীর অভাব হয়?
অপমানে রিতির সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে। কিন্তু কথা বাড়াতে চায়না। চোখ মুছে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
রিতি কথা রাখেনি,এই চার দিনে একবারও বিরূপাক্ষের চোখের সামনে থেকে সরেনি, ছুঁয়েছে অসংখ্য বার। কিন্তু বিরূপাক্ষ তেমন কিছু না বললেও তাকায় না রিতির দিকে। বসার ঘড়ের বড় দেয়াল ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দে সম্বিত ফেরে রিতির।বিরূপাক্ষের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে।আজ চার দিন পর বিরূপাক্ষ তার দিকেই তাকিয়ে আছে ড্যাবডেবে চোখে।কিছু কি লাগবে?নাকি বাথরুমে যাবে?ভেবে মরিয়া হয়ে ছুটে আসে রিতি,,
কিছু বলবে?লাগবে কিছু তোমার?
খিদে পেয়েছে খুব,,,। মৃদু স্বরে বলল বিরূপাক্ষ।
রিতি স্বাভাবিক হয়।শুধু মৃদু হাসে। সামনের টেবিল থেকে খাবার ভর্তি প্লেট,বাটি সব এনে রাখে বেডের লাগোয়া ছোট টেবিলে।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিরূপাক্ষ,,
এত খাবার এনে রেখেছিস কার জন্য?
সেই সন্ধ্যে বেলায় ঘুমিয়েছো,ডিনার করেছিলে? তোমার খিদে পাবে সেতো জানি।আমি ও খাইনি নাও উঠে বসো তো।মুখ চালিয়ে খাও ঔষধের সময় হয়ে গেছে।তারপর আমি খাবো।বিরূপাক্ষকে ধরে উঠাতে গেলে বাঁধা দেয় সে,,,
থাক,,আমি পারবো। স্বাভাবিকভাবেই বলে বিরূপাক্ষ কিন্তু “ইজি টু সে বাট ডিফিকাল্ট টু ডু”তো আর সাধে বলে না লোকে।রিতিই ধরে উঠায় অবশেষে,,,
এত জেদি ক্যানো তুমি?পেলে তো ব্যাথা?নিজে তো করবেই আমি তো আর থাকবো না সবসময়! তোমার বনলতা দেবীও দু চারদিনে আসছে না। খাবারের ঢাকনা উঠায় রিতি,,,এই দেখো তোমার পছন্দের সব কিছু।গপগপ করে খেয়ে নাও তো।মৃদু হাসি লেগেই আছে রিতির ঠোঁটে।
এত ভারী খাবার?এই রাতে?তুই বরং দু’টো স্যান্ডুইস আর একটু কফি করে নিয়ে আয় না।হয়ে যাবে আমার।না হয় মাকে ডেকে দে একটু। অসহায় ভাবে বলে বিরূপাক্ষ।রিতির চোখে জল আসে।তথাপি নিজের হাসি বজায় রেখে বলে,,ওতে অনেক ঝামেলা রূপদা, আজ নাহয় আমিই খাইয়ে দেই?একা খেতে পারবেনা বলে বলছো তো? তোমার হাতে ব্যাথা তো।দেই না একটু খাইয়ে?রিতির করুন আর্তি বিরূপাক্ষের বুকে বাজে ভীষণ ভাবে,,
রিতির বুকে খুশির দোল। নিজের হাতে আজ খাইয়েছে রূপকে। মানুষটা তার সাথে আগের মতোই সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করছে,এর চেয়ে বড় পাওনা কি হতে পারে?
গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে চুলায় আঁচ বাড়িয়ে দেয় রিতি।কফি খাবে বিরূপাক্ষ।
মনটা কি আজ খুব ভালো বোনটি?
আচমকা কারো কথা শুনে বুক কেঁপে ওঠে রিতির কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে অখিলেশ।রিতি সেদিকে তাকিয়ে বুকে থুরথুরি দেয়,,,
অখিল দা এভাবে এতরাতে কেউ কথা বলে?কপট রাগ দেখায় রিতি।
সরি সরি,,আমি বুঝতে পারিনি তুমি ভয় পেয়ে যাবে।
ঝলমল করে ওঠে রিতির মুখটা।
কফি খাবেন অখিল দা?
না না ভাই মাফ করো।এতরাতে কফি খেলে আর ঘুম হবে না।তুমি বরং বরের জন্য নিয়ে যাও, নিজের জন্যেও রেখো।নাহলে ঝিমুনি আসবে।
অখিল দা,, আপনি কিন্তু বেশ পাকনা বুড়ো হচ্ছেন।চোখ রাঙায় রিতি।হাসতে হাসতে বিদায় নেয় অখিলেশ।
বিরূপাক্ষের ফোনে কল এসেছিলো।এই তিনটি দিন রেগুলার আসে ঐ কাঙ্ক্ষিত নাম্বারের কলটা।বিরূপাক্ষের মুখটা তখন বসন্তের পলাশ বনের মতো লালচে হয়।রিতি কফির মগটা বিরূপাক্ষের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের বিছানা পাতে মেঝেতে।
বনলতা ফোন করেছিলো।সে তোর সাথে কথা বলতে চায়। কফির মগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বললো বিরূপাক্ষ।
রিতির হাত থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,,, আমার সাথে কি বলবে সে?
আমি কি জানি?কথা বলে দ্যাখ!
আচ্ছা নাম্বারটা দিও আমি ফোন করে নেবো।মৃদু স্বরে বলল রিতি। পুনরায় বলে,,
একটা কথা বলবো তোমায়? তিনি যে সত্যিই তোমার বনলতা তার প্রমাণ পাবে কি করে? তুমি তো তাকে চেনো না।দেখলে চিনতে পারবে?কেউ কি ঠকাচ্ছে তোমাকে?
রিতির কথাটা হয়তো মনঃপুত হলো না তাই অধৈর্য স্বরে বলল,,,তোর যত ফালতু অনাসৃষ্টি কথা বার্তা। আমার বউ আর আমি চিনবো না?
সত্যিই চিনবে তো? তীক্ষ্ম স্বর রিতির।
চিনবো বৈ কি।না চিনলে তুই চিনিয়ে দিস।তোর তো আবার অনেক বুদ্ধি।হা হা হা।
বিরূপাক্ষের স্পষ্ট কটাক্ষে কষ্ট হয় রিতির। কিন্তু বিনিময়ে শুষ্ক হেসে ঘড়ের উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পরে নিজের বিছানায়। বিরূপাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ তারপর বললো নির্লিপ্ত গলায়,,,তুই খেলি না রাতে?না খেয়েই শুয়ে পরলি?
রিতি উঠে উপর থেকে নিজের কম্বলটা নিয়ে বলে,, আমার এমন দু এক বেলা না খেয়ে থাকার অভ্যেস আছে রূপদা। একবেলা না খেলে মরবো না আমি।আর কথা বাড়ায় না বিরূপাক্ষ। অভুক্ত রিতিকে দেখে বুকটা টনটন করে ওঠে ঠিকই কিন্তু পুনরায় অনুরোধ বা আদেশ করতে অরুচি হয় তার।রিতির চোখের জলে বালিশ ভিজে ওঠে।একটু আন্তরিকভাবে কি খেতে বলতে পারতো না সে?রিতি তো পারেনি তাকে অভুক্ত রেখে নিজে খেতে।
বিরূপাক্ষ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ,, বনলতার প্রতি একটা অদ্ভুত টান সৃষ্টি হয়েছে দুদিনেই।সে রিতির সাথে কথা বলে ডিভোর্সটা করিয়ে নিতে বলেছে। কিন্তু বাবা,মা,দাদুভাই মানবে কি?না মানুক সবাই, রিতি তো বলেছে সে নিজেই বনলতার সাথে মিলিয়ে দেবে যেকোনো উপায়ে। বিরূপাক্ষ সেটাই চায় যত দ্রুত সম্ভব বনলতা কে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। তাহলেই তো বিরূপাক্ষ আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে তাকে কারন স্ত্রী হিসেবে সে শুধু বনলতাকেই মানে।
চলবে,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।