উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,২৮,২৯
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:২৮
লিকু সরদার এর পুরোনো টিনের চালা দেওয়া ঘড়টা থেকে মাঝে মাঝে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ভেসে আসছে। বৃদ্ধ লিকু ভুলে গেছে তার এহকাল পরকাল। একদিন জবানের জবাবদিহিতা যে করতে হবে তাও বোধহয় বিস্মৃত হয়েছে সে।এমনকি যে সন্তান এখনো চোখের সামনে সুস্থ্য ভাবে ঘুরছে তার মৃত্যু কামনা করছে দাঁত কিড়মিড় করে,,,
ঐ শু**রের বাইচ্চা আমার বাড়িতে যেন আর না আসে।তাইলে অরে শাবল দিয়া কুপায়ে মারুম কইলাম। আমার ভিডায় থাইকা আমার লগে দুশমনি ?
লিকুর স্ত্রী স্বামীকে একসময় ভয় পেতেন আজরাইলের মতো।সেই ভয় বছরের পর বছর ধরে ক্ষয় হতে হতে অবশিষ্ট নেই তেমন। তবুও লিকুকে তিনি বিশ্বাস পান না। লোকটার নিজের তো মানসম্মান বলতে কিছু নেই অন্যেরটাও রাখতে জানে না।ঘড়ভর্তি মানুষের সামনে চুলের মুঠি ধরে মারতেও বাঁধবে না এই বয়সে এসেও। তিনি স্বামীর প্রতি বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ নাকরেই বললেন গলাটা খাদে নামিয়ে,, আমনের আল্লার দোহাই লাগি,এমন কইরা চিল্লাইয়েন না।পোলাডা হুনলে ক্যাচাল হইবো।
তেলে বেগুনে জলে উঠে লিকু সরদার। হাতের কাছে থাকা সরিষার তেলের কাঁচের শিশিটা ছুড়ে মারে স্ত্রীর দিকে।ভাগ্য সহায়,মহিলা দ্রুত সরে গিয়েছিলেন শিশিটা উড়ে গিয়ে লেগেছে বাঁশের খুঁটির সাথে।শিশি ভাঙার উচ্চ শব্দে উঠোন থেকে ছুটে আসে লিকুর মেজ ছেলে।সে এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপের গালিগালাজ শুনছিলো।মাকে টেনে ঘড় থেকে বাহির করে দিয়ে পিতাকে বললো,,আব্বা হুদাই মালামাল ভাইঙ্গো না।পারলে ছোড পোলার সামনে গিয়া কিছু কও।এমনে বাপ ভাইয়ের লগে শত্রুতা করতে না করো তারে।
লিকু সর্দারের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে,,মুখ কাঠিন্যে মুড়িয়ে বলে,,,জানোয়ারডার লাইগা আমার এত বড়ো পরিকল্পনা নষ্ট হইয়া গ্যাছে।না হইলে গত কালই চৌধুরীর পোলার কল্লাটা নিজের হাতে দুইভাগ করতাম লগে ঐ মাষ্টারনীরে।ওরে ছাড়ুম না আমি। দরকার হইলে দুনিয়ার থাইকা নাই কইরা দিমু।খিটখিট করে খানিক হেসে নেয় লিকু সর্দার।হাসি নাকি ইঁটের ভাটার পরিবেশ দূষণ কারী কালো ধোঁয়া বোঝার কায়দা নেই। পিতার মুখে এমন কথা শুনে ভরকে যায় মেজ ছেলে টা।সে তার ডাকাত বাপের কুকর্ম সচোক্ষে দেখেনি কখনো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আঁতকে উঠলেন লিকুর স্ত্রী।ছোট ছেলেটা যে তার বড়ো আদরের।কি করবে ভেবে পায়না।
কালো মসৃন পিচঢালা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে বড়ো সাইজের লোকাল বাসটা।গন্তব্য নড়াইলের কোনো একটা জায়গা।
বাসে উঠে পর পর দু’বার বমি করে নেতিয়ে পরেছে রিতি।প্রায় গোটা রাত জাগ্রত থাকা আর গুমরে কাঁদার ফলে মাথাটা আগে থেকেই ভারী হয়ে উঠেছে।তার উপর খালি পেটে পেট্রোল পোড়ার ঝাঁঝালো গন্ধে নাড়ি ভুড়ি উগরে এসেছিলো। সকালের ব্রেকফাস্ট এর জন্য অর্ডার করা খাবার টুকুও পরে রয়েছে হোটেল রুমে। ছুঁয়ে ও দেখেনি রিতি। বিরূপাক্ষর দিকে ভূলেও তাকায়নি।সেটা কি বুক ভরা অভিমান নাকি প্রচন্ড ঘৃনায় হৃদয়ের গহীনে ক্ষতর জন্য জানিনা।তবে হোটেল রুম থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বিরূপাক্ষের কিছু কথার উত্তর দিয়েছিলো সিক্ত ঝাঁঝালো কন্ঠে।রাতে রিতির প্রত্যাখ্যানে অপমানিত হয়ে বিরূপাক্ষ বেরিয়ে গিয়েছিলো রুম থেকে।একবারো পেছনে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে হয়নি ওর।যদি দেখতো তাহলে দেখতে পেতো প্রত্যাখ্যানের যে তীব্র যাতনা ওর নিজের বুকে বইছে তার চেয়ে অধিক দহনে জলছে মেয়েটা।বাকি রাতটুকু হোটেল লবিতে ঝিম মেরে পরে থেকে যখন সকালের সূর্যের দেখা মিললো তখন নেশার ঘোর অনেকটা কেটেছে বিরূপাক্ষের।বুঝতে পারলো গত রাতে ডিনার সেরে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে কোল্ড ড্রিংস নিয়েছিলো ওতেই হয়তো এলকোহোল ছিল। তারপর ঝিম ঝিম মাথায় রুমে ফিরে রিতির সাথে,,,ওহ নো। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে বিরূপাক্ষ।
রাতের ঘটনা মনে পরতেই পুরো নেশা ছুটলো আর বিরূপাক্ষ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো নিজের রুমের দিকে। নেশার ঘোরে মস্ত বড় ভুল হয়েছে তার।হুরমূর করে দরজা খুলে শান্ত হলো কিছুটা।রিতি মুখ মুচছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বিরূপাক্ষ। আয়নার রিতিকে যেনো খুব মলিন দেখালো।
সংকোচ আর অপরাধ বোধ নিয়ে এগিয়ে গেলো রিতির দিকে।কোনো রকমে উচ্চারণ করলো,সরি,,, আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে রে,,
কান্নাটা দলা পাকিয়ে ওঠে রিতির গলার কাছে।শত শত কেঁচোর কুন্ডলীর মতো ঘিনঘিনে অনুভূতি হয় তার,,,
এখনো আমি তোমার স্ত্রী রূপদা,,
কিন্তু আমি তো তোকে,,
রিতি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে বিরূপাক্ষ কে থামিয়ে দেয়,,
কিন্তু তুমি রিতি ভেবে রিতিকে কাছে টানোনি।
আসলে আমি নেশার ঘোরে এমনটা করেছি বিশ্বাস কর।। আকুলতা ঝরে পরে বিরূপাক্ষের স্বরে।
রাতের আঁধারে নেশায় আসক্ত হয়ে নিজের কৃত কর্মের দ্বায় সারাজীবনের জন্য আমার মাথায় তুলে দিতে তুমি? প্রেমহীন দৈহিক সম্পর্কের মানে জানো তুমি? নিজের স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হতাম আমি। বেঁচে থাকতাম কি করে বলো?
রিতি,,, বাচালতার একটা সীমা আছে। মুখে যা আসে তাই বলবি?গলা চড়িয়ে ধমক দেয় বিরূপাক্ষ। নিজের দিকে টেনে ঘুরিয়ে নেয় রিতিকে।রিতির অশ্রু বিহীন দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। বিরূপাক্ষ হতাশ হয়ে নিজের উত্তেজনাকে সামলে নেয়,,,
একবার আমার দিকে তাকা না বুড়ি,,,,, আকুল আবেদন বিরূপাক্ষের।
রিতির বুকটা ব্যাথায় টনটন করে ওঠে এমন স্নেহের সম্ভাষণে।
আমি তোমাকে ঘৃনা করতে চাই না রূপদা।অমন পাপ করার আগে যেনো মরণ হয় আমার। কিন্তু ছুঁতে এসো না আর আমাকে।নিজেই বেহায়া হয়ে যাই।রেডি হয়ে নাও।বেড়োবো আমরা।
বিরূপাক্ষ ছেড়ে দেয় রিতিকে।ধীরলয়ে ওয়াশ রুমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
সকালের নাস্তা রুমে দিয়ে গেলে বিরূপাক্ষ একবার বলেছিলো রিতিকে খেয়ে নিতে। কিন্তু রিতি খায়নি এমনকি কোনো প্রকার উচ্যবাচ্য ও করেনি।
কিন্তু কি আশ্চর্য যাকে ছুঁতে মানা করেছিলো,যার উপর ক্রোধ,আত্মাভিমান কিংবা ঘৃনায় সকালের খাবারটা পর্যন্ত খায়নি।একটু দুর্বল হতেই চলন্ত বাসে ক্যামন পরম নির্ভরতায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সেই মানুষটির বুকের পাশে মাথা রেখে। একবার বুঝতেও পারছে না সদ্য ব্যান্ডেজ মুক্ত হাতটা একভাবে থাকার ফলে ব্যথায় টনটন করছে বিরূপাক্ষের। কিন্তু ও সরাবে না হাতটা তাহলে যে রিতির ঘুমে ব্যঘাত ঘটবে কিংবা গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে জানালার কাঁচে আঘাত পাবে।
*****
সকালে পূজা সেরে মন্দির থেকে সবে ঘড়ে ঢুকলো জয়া। আবার ছুটতে হবে রন্ধনশালায়। কাজের মাসি আটা মেখে সবজি কেটে রেখেছেন।ওকে নিজের হাতেই বানাতে হবে জলখাবার।শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছেনা জয়ার।মাথাটা থেকে থেকে ঝিম ঝিম করে ওঠে।কিছু খেলেও বমি বমি ভাব হয়। কিন্তু জয়া কাউকে বলে নি কথাটা।চাপা স্বভাবের মেয়ে গুলো এমনি হয় তায় আবার অভিমান ভর করেছে বুকের মাঝে।যাকে আপন মনে করে নিজের সকল খুঁটিনাটি বলতো সময় পেলেই তার সাথেও আজকাল কথা বলে না জয়া।মনে মনে ভাবে কঠিন অসুখ হয়তো হোক, আত্মঘাতী হয়ে মহাপাতকী হওয়ার চেয়ে এভাবে রোগে শোকে মরে যাওয়াই ভালো তাহলে অন্তত শ্রাদ্ধ শান্তি টুকু কপালে জুটবে।তাও বা জুটবে কি করে নিজে যে নিস্ফলা বৃক্ষ। জয়ার এমন মূর্খের মতো বোকা সোকা ভাবনা দেখে হয়তো সৃষ্টিকর্তা হেসে লুটোপুটি খান।মনে মনে বলেন,,এত সাদাসিধে হতে নেই মেয়েটা?
রঘুনাথ হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়েছে ওয়াশ রুম থেকে।ইতোমধ্যে পটু হাতে স্বামীর পরনের পোশাক সাজিয়ে রেখেছে বিছানায়। রঘুনাথ তোয়ালে খানা সোফায় ফেলে বললো জয়াকে,,,
তোমার কি শরীর খারাপ?দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছো যে?
এতদিনে নজর পরলো?বলবো না, মরে গেলেও না। অভিমান ভারী হয় জয়ার তবে কথাগুলো স্বরতন্ত্রীর গহ্বরেই বিলীন হয়ে যায়।
কি হলো জয়া কথা বলো?
কথা বলে না জয়া বেশ কয়েকদিন কথা বলে না রঘুর সাথে। সেই রাতের পর জয়ার মুখে তালা লেগেছে।চোখ ছাপিয়ে অশ্রু আসে জয়ার। দরজার দিকে হাটা দিতেই রঘুনাথ হাত টেনে ধরে জয়ার।একদম বুকের সাথে মিশে দাঁড়িয়েছে জয়া। নিজের দু-বাহু প্রসারিত করে পেছন থেকেই বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে জয়াকে।কানের কাছে মুখ নিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে,,এমন করছো ক্যানো তুমি?আমি তো বলেছি আমার ভুল হয়েছে,ক্ষমা করো না!এভাবে কথা বলা বন্ধ করতে আছে?
কথা ফোটেই না জয়ার ঠোঁটে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে সে।
যে রাতে বিরূপাক্ষ চিলেকোঠার ছাদে বসে রঘুনাথ কে ব্লাকমেইল করেছিলো সেই রাতে ভাইকে কিছু বলতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ঘড়ে এসে নিজের ক্রোধটুকু শান্ত শিষ্ট পতিব্রতা স্ত্রীর উপর প্রয়োগ করেছিলো।জীবনে প্রথম বারের মতো ভালোবেসে নয় আঘাত দেওয়ার জন্য ছুঁয়েছিলো জয়াকে।পর পর দুটো চড় মেরেছিলো জয়ার দুই গালে।পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে কিন্তু ধনুক থেকে তীর আর মুখ থেকে থুথু বেরিয়ে গেলে যেমন ফেরানো যায় না,তেমনি কাউকে আঘাত করা হয়ে গেলে শত চেষ্টা করেও সে দাগ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায় না মন থেকে।
কাঁদছে জয়া। রঘুনাথের বুকে তোলপাড় শুরু হয়েছে।জয়াকে এইটুকু ছুঁলেও যে অনাবিল প্রশান্তি বুক ছুঁয়ে যায়, অর্পিতাকে দেহের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে নিলেও তো সে প্রশান্তি আসেনি কোনো দিন তার।তবে সত্যিই কি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে অজানা অপরিচিত দুটি মানুষের দুটি হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যায় কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে?
*****
সকাল সকাল অফিসে ছুটেছে অখিলেশ।অন্যদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে যায় বুটিক হাউসে। সেখানে সুমির সাথে ভাব হয়েছে বেশ।সুমিই সবকিছু বুঝিয়ে শিখিয়ে দেয়।রিতির বান্ধবী কি না,রিতির মতো বুদ্ধিমতি না হলেও আন্তরিকতার প্রতিযোগীতায় দু বন্ধুর প্রতিযোগিতা সমানে সমান।এর চেয়ে ও ভালো,ওর চেয়ে এ ভালো। অন্যদিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে যায়নি অখিলেশ। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে স্কুলের সামনে।কি এক দূর্নিবার টানে জানেনা সে।স্কুলের চারিধারে দেয়াল না থাকায় তাকালে দেখা যায় সবকিছু। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে অকারণে। তারপর আশাহত হয়ে ফিরে যায় নিজের গন্তব্যে। দোতলার টিচার্স রুমের রাস্তা মুখী জানালা থেকে বিমর্ষ মুখে সরে যায় নিরুপমা।তাকে ছাড়তে হবে এ গন্তব্য নইলে আবার অপমানিত হবে চরম ভাবে।যে দায়িত্ব নিতে ভয় পায় তাকে দায়িত্বে আবদ্ধ করতে গিয়ে নিজেকে হেনস্থার সর্বো নিচে নামাতে আর পারবে না নিরুপমা।
এতদিন শহরে থেকে থেকে যে স্মৃতির দহনে দগ্ধ হয়েছে প্রতিনিয়ত। দুঃখের দিনে সুখের স্মৃতিগুলো একটা মানুষকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে বারে বারে।সেইসব সুখস্মৃতির তাড়না থেকে বাঁচতে চির পরিচিত,জন্ম থেকে অভ্যস্ত শহুরে পরিবেশ ছেড়ে একপ্রকার পালিয়েই এসেছে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা পাড়াগাঁয়ে।এখানে বদলি নিতে কম সময় বা কম জবাবদিহি করতে হয়নি নিরুপমাকে।এমনকি একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতটাও অনিশ্চিত করে ফেলেছে সে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক।কথায় আছে,,যেখানে গেলে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
****
মাঝে কেটে গেছে আরো একসপ্তাহ। গতকাল লক্ষীপূজাও মিটলো ভালোয় ভালোয়।রিতি সেদিন বাড়িতে ফিরেই বিরূপাক্ষের ঘড় থেকে নিজের সবকিছু নিয়ে আগে ঘড়ে ফিরে গিয়েছিলো। অন্নপূর্ণা দেবীর আকুতি মিনতি পারেনি তাকে বিরূপাক্ষের ঘড়ে রাখতে। অবশেষে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো তাঁর কাছে।ছেলের ঘড়ে না থাকুক একই বাড়িতে তার চোখের সামনে যে আছে সেই ঢের আনন্দের বিষয় অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে।রিতি বিরূপাক্ষের সাথে আগে তাও দু চারটে যা কথা বলতো এখন আর তাও বলে না। রাতের গভীরে কফি নিয়ে যায়না আর।ঔষধ কিংবা খাবারের জন্য তাগাদা দেয় না।তবে একটা কাজ সে রিতিমত করে চলেছে ক’দিন যাবত।ভোরে সবার অলক্ষ্যে বিরূপাক্ষের ঘড়ে ঢুকে ওর আঘাত পাওয়া হাতটায় কি একটা উদ্ভট গন্ধ যুক্ত তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে ম্যাসাজ করে অতি সন্তর্পণে। সজাগ বিরূপাক্ষ অনুভব করে রিতির এই আদরমাখা সেবা যত্ন। কিন্তু মুখে বলে না কিছুই। আজকাল রিতির সাথে সেধে কথা বলতেও তার জিভ ভারী হয়ে নড়া চড়া বন্ধ করে দেয়।তাইতো রিতি আসার আগেই ঘুম থেকে উঠে দরজাটা খুলে,কান খাড়া করে অপেক্ষা করে কখন শুনবে সেই কাঙ্খিত পদধ্বনি।
অন্যান্য দিনের মতো সন্ধ্যার একটু আগেই ফিরলো রিতি।আজ সাথে অখিলেশ ও আছে।সবে বসার ঘড়ে পা দিয়েই একটা ঝটকা খায় অখিলেশ।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দরজাতেই। এতক্ষণ দুজনে কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো হেসে হেসে।রিতি অখিলেশের সাড়া না পেয়ে পিছনে পাশে তাকিয়ে দেখলো অখিলেশের দৃষ্টি বসার ঘরে এটে আছে। মৃদু ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিতি সেদিকে,,,
নিরুপমা দি,,অখিল দা আপনি চেনেন নাকি ওনাকে?
হ্যা না মানে চলো?
কি হ্যা না?কোনটা ধরবো আমি?
ততক্ষণে ছোট্ট অদ্রিকা দৌড়ে এসে অখিলেশের পা জড়িয়ে ধরেছে,,
আঙ্কেল তুমি আর যাওনি ক্যানো আমাদের বাসায়? তোমাকে কত খুঁজেছি আমি! অভিযোগের শেষ নেই অদ্রিকার।
রিতি তো অবাক।এই ফুটফুটে বাবুটা নিরুপমা দিদির? আওড়ায় মনে মনে।
অখিলেশ ততক্ষনে কোলে তুলে নিয়েছে অদ্রিকাকে। কিন্তু রিতি অন্য হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। মেয়েটার মুখায়বয়বের সাথে অখিলদার মুখের আদল টা যেনো ভীষণ মেলে।
*****
অখিলদা সত্য কথাটা কি তুমি বলবে নাকি আমি খুঁজে বের করবো?কড়া সুরে বললো রিতি। ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে।অখিল পরেছে মহা বিপাকে।এই মেয়ে যেভাবে ধরেছে বিশ্বাস জনক কিছু একটা বলতে হবে।নইলে ছাড়বে না।
দ্যাখো বোনটি,,,,
থাক,,আমি দেখে নিয়েছি অখিলদা।এখন শুনতে চাই। আপনার এই দেবদাসের মতো উদাস হয়ে চলাফেরার মূল কারনটা কি নিরু দি?
আসলে হয়েছে কি রিতি,,,,
হ্যা হ্যা,,,আমি তো আসলটাই শুনতে চাই।গলা চড়িয়ে বলে রিতি।
এত কিছু জেনে কি লাভ আছে বলো?
রিতির গলা খাদে নামে,,,
লাভ,লস এত হিসাব পরে করবো।আগে যা জানতে চাইছি বলেন?
মা তোমাকে কতবার বলেছি ও কথা আর মুখে আনবে না। নিরুপায় নিরু।
কিন্তু মা এভাবে তোকে রেখে আমি কিভাবে চোখ বুজবো বল? একবার তো কথা বলি ছেলেটার সাথে! মেয়েকে বোঝান অনিতা দেবী।
না মা,, তুমি ই তো বললে ওর ঘড় সংসার হয়েছে।সে এখন অন্যের ভালোবাসার মানুষ। এখন আর সময় নেই মা।যখন সময় ছিলো তখন আমি ভিক্ষুকের মতো তাড়িত হয়েছি।দূর দূর করে তারিয়ে দিয়েছে নিজের জীবন থেকে।আর পারবো না মা।পারবো না। কোন মুখে ওকে আবার চাইবো বলো? কাঁদে নিরু। অসহায় মায়ের চোখেও জল।
ওকে পাওয়ার কথা চিন্তায় আনাও যে ঘোর পাপ মা।
কিন্তু মা তুই একা একটা মেয়ে কিভাবে পার করবি এত বড়ো জীবনটা বল?যাকে ভালোবেসে জীবনের সকল সুখ,মোহ ত্যাগ করেছিস, তাকে তুই চাইতেই পারিস এতে পাপ নেই।মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন অনিতা দেবী।
নিরু ঘুমন্ত অদ্রিকাকে বুকে চেপে গুমরে কাঁদে।মুখের বুলি ফুরায়। এতদিন যে বাসনা ছাইচাপা হয়েছিলো বুকের ভেতর। মানুষটাকে দেখার পরে তা ধিকি ধিকি জলছে শুধু।পোড়া বুকটা তার আর কত পুড়বে কে জানে?
অনিতা দেবী নিজে কাঁদেন কিন্তু মেয়েকে কোনো শান্তনা বানী শুনান না।গত কয়েকবছর যাবত দেখছেন একমাত্র আদরের কন্যা রাতের আঁধারে ঘুমায় কম, কাঁদে বেশী।যে মেয়ের চোখে কখনো অশ্রু আসার সুযোগ দেয়নি সে মেয়ে এখন অশ্রু সমুদ্রে হাবুডুবু খায়।
বুনু সমুদ্রের বুকে জলের অভাব নেই কিন্তু তৃষ্ণা মেটাতে কি সক্ষম বলো? আমার বুকেও তেমনি নিরুর নামে ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র বইছে কিন্তু তার এক কণাও তাকে দিতে পারিনি আমি। যতটুকু দিয়েছি তাতেই সে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলো।আর পোড়াতে চাই না।
সে স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালো আছে,ভালো থাকুক।একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অখিলেশ।রিতি বিভোর হয়ে শুনছিলো এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া অখিলেশ এবং উচ্চ বিত্ত পরিবারের মেয়ে নিরুর প্রেমকাহিনী।কি পাগলের মতো ভালোবেসে মেয়েটা নিজেকে সঁপে দিয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটির হাতে।যে হাতটি শেষ অবধি তার হাতটি আঁকড়ে ধরতে পারেনি।
চলবে,,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।
উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে :চন্দ্রা।
পর্ব:২৯
রূপ সাগরে রূপের নেশায়, মত্ত রইলি চিরকাল,,,
যেদিন চোখের পাতা অলস হবে, চিনবি সেদিন পরকাল।
একজন পুরুষ কি শুধু রূপের মোহে পরকিয়া বা পর নারীতে আসক্ত হয়?নাকি এর পেছনে আরো গুরুহ কোন কারন নিহিত থাকে?
মাতৃ পিতৃহীন রঘুনাথ যতই কাজ কর্মে লিপ্ত থাকুক জয়াকে কখনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয়নি।একজন স্বামী হিসেবে নিজের দায়িত্ব,প্রেম, ভালোবাসা দিয়ে তাকে পরিপূর্ণ করে রেখেছে সবসময়। অতিশয় রুপবতী না হলেও উজ্জ্বল শ্যাম গাত্র বর্ণের জয়ার চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। একবার তাকালে শত্রুও মোহে পরে যাবে ও চোখের। রঘুনাথ তার মামা মামির পছন্দে জয়াকে বিয়ে করলেও হাতে গোনা কয়েকদিনের মধ্যেই গভীর মায়ায় পরেছিলো।ভালোবাসাটা হয়েছিলো তারচেয়ে গভীর। কিন্তু কি এমন ঘটলো যে ভালোবাসার সেই গভীরতার মাঝেও অতল নদীতে বালুর চর জাগার মতো বিতৃষ্ণার আস্তরণ পরলো?তবে এত বছরের সংসার জীবনে একটা নতুন মুখ,একটা নতুন প্রাণের অভাবে সব মিথ্যা মরীচিকাময় হয়ে যাবে। ভালোবাসা, দায়িত্ব সেবা,যত্ন তবে কিছুই না?নাকি রঘুনাথের অত্যধিক ষড় রিপুর তাড়না বা ঝলমলে রূপের নেশা? কিন্তু রঘুনাথ বিয়ের আগে বা পরে কখনো কোনো মেয়ের দিকে নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছে এমন কথা কোনো শত্রু ও বলতে পারবে না।বিজয়া এমন এক রমনী যে মুখবুজে, হাসিমুখে সব সইতেই পারে।প্রতিবাদ নামে কোনো শব্দ আছে বলে তার বিশ্বাস হয়না।মা,বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই বৌদিদের সংসারে উচ্ছিষ্টের মতো পরে থেকেছে কিন্তু কর্ম করেছে কাজের লোকেদের মতো। বিয়ের পরে এ বাড়ির রান্নাঘরকে তার ধ্যানজ্ঞান বানিয়ে নিতে সময় লাগেনি। নিজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ কাউকে দেয়নি।
পতিদেবের অন্য নারীর আসক্তির কথা যেদিন জেনেছিলো সেদিন ঠাকুর ঘরে উপুড় হয়ে পরে কেঁদেছে সবার অগোচরে। তবুও পতির কোনো দোষ দেয়নি,দোষ দিয়েছে নিজের।নিজেই তো অপয়া,বাজা মেয়েমানুষ।স্বামীকে বেঁধে রাখার মতো তার গুন নেই।এতবছরেও একটা সন্তানের মুখ যাকে দেখাতে পারলো না সে কি করে বৌয়ের মুখ চেয়ে বসে থাকবে?
তবে কি প্রেম, ভালোবাসা,পতিনিষ্ঠা, কোনোকিছুর দাম নেই?সন্তানই কি সব একটা সংসারে?হয়তো হ্যা,নয়ত না।
*****
রায় চৌধুরী বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড বেঁধেছে।
সকালের জলখাবার তৈরির জন্য ব্যাস্ত ছিলো জয়া।রিতি তখন হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিতে ব্যস্ত।হঠাৎ মাথাটা ভীষণ ভাবে ঘুরে উঠতে রিতিকে আঁকড়ে ধরে জয়া।পরিবর্তে রিতিও জয়াকে ধরলো ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে দুজনে মিলে মেঝেতে বসে পরেছে।
পরিবারের অতি পুরাতন ডাক্তার বাবু জয়াকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। বাঁ হাতের নাড়ি দেখলেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে, অতঃপর তার পাকা গোঁফের তলায় মিটমিট হাসি দেখে অত্যধিক উৎকন্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কুঁচকানো ললাট খানিক মসৃন হলো।রিতি ডাক্তারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো,, অধৈর্য হয়ে প্রথমেই বলে উঠলো স্থান কাল ভুলে,,ও কাকা,মনে মনে মিছরি একাই খাবে, নাকি কিছু বলবে বাপু?
রিতির এহেনো বাক্যব্যয়ে বিরূপাক্ষের বিরক্তি লাগে খুব। জয়ার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।
অত অধৈর্য হলে চলবে মা জননী?সবুরে মেওয়া ফলে জানো না?হা হা হা। স্বভাব সুলভ হাসেন ডক্টর বাবু।
অতশত বুঝিনা কাকু,,, তোমার মেওয়া নিয়ে তুমি বাসায় ফিরো আগে বলো তো ঘটনা কি?বললো রিতি।
আহা,,ডাক্তার এত কথা খরচ না করে আসল কথাটা বলো দেখি।আর যদি হাসপাতালে নিতে হয় তো সে ব্যবস্থাও করি।প্রভাকর চৌধুরীও অধৈর্য হয়ে পরেন।
না না চৌধুরী,, হাসপাতালে তো যেতেই হবে,বৌমার শরীর অত্যধিক দূর্বল কি না।তবে এ যাত্রায় থাক, বাড়িতেই আরাম করুক না হয়।
এত ভাব ভনিতা দেখার বা শোনার তর সইছে না রিতির।গ্লাস থেকে জল নিয়ে জয়ার নাকে মুখে ছেটাচ্ছে সে।আগে জ্ঞানটা তো ফিরুক।ডাক্তার কাকু বুড়ো হচ্ছেন তো, তার মাথাটা হয়তো কাজ করছে না।নইলে পাশে অজ্ঞান অসুস্থ রোগী রেখে কেউ এত তামাশা করে ?এসই ভাবছে আর নিজের কাজ করছে রিতি। তখনি শুনলো অতি কাঙ্খিত বাক্যটি।মনে মনে যেটা ধারনা করেছিলো রিতি সেটাই হয়েছে। মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্রী সে। এটুকু বুঝবে না?তবে বিরূপাক্ষের উপস্থিতিতে নিজের মতো করে কিছু করতে পারেনি তাছাড়া বৃদ্ধ অভিজ্ঞ ডাক্তার কাকা হাতের পালস্ চেক করে যেটা গ্যারান্টি সহকারে বলতে পারেন। এখনকার একজন নব্য ডাক্তার বোধহয় অতটা পারবেন না পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া।ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।রিতি জ্ঞানহীন জয়ার বুকের সাথে নিজের বুক মিশিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে,,,ও বৌদিদি শুনেছো তুমি? তুমি মা হবে গো?কত দিনের সাধ তোমার,আজ গোবিন্দ পূরণ করতে চলেছেন। আমার স্নেহে ভাগ বসাতে কেউ একজন আসছে শুনেছো? এবার তো ওঠো।ওকে বলে দিও,ওর মা,বাবা আমাকে যতটুকু যা দিয়েছে আমি ওকে তার শতসহস্র গুন বেশি আদর,স্নেহ, ভালোবাসা দেবো।রিতির চোখের অশ্রু সমানে পরছে ফোটায় ফোটায়। কাঁদছেন অন্নপূর্ণা দেবী। তাঁর চোখেও আনন্দাশ্রু। শান্ত শিষ্ট জয়া,যে সাত চড়েও রা কাটেনা। অন্নপূর্ণা দেবী নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন তাকে।নিজে পছন্দ করে ভাগ্নে বৌ করে এনেছিলেন জয়াকে।জয়া মান রেখেছে তাঁর।গরীব ঘড়ের মেয়ে হলেও গৃহ কর্মে নৈপুণ্যে এবং আচার আচরণে কখনো সেটা প্রকাশ পায়নি।রঘুনাথের একজন বংশ ধরের জন্য কত জায়গায় কতো মানত করেছেন তিনি কিন্তু একটা সন্তানের জন্য পুনরায় ভাগ্নের বিয়ের কথা মনেও আনেননি।
বিরূপাক্ষ নিঃশব্দে বেড়িয়ে পড়লো ঘড় থেকে। দাদাভাই কে একবার ফোন করতে হবে।
******
নিরুপমার ছোট্ট শোবার ঘড়ের ছোট্ট বারান্দায় একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে অখিলেশ। এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে অকারণে।অল্প সময়ের মধ্যেই কি সুন্দর গুছিয়ে ফেলেছে জায়গাটা। ঝকঝকে লাগছে সব কিছুই।সাধেই কি মেয়েরা বলে,আমাকে শুধুমাত্র একটা ঘড় দিও আমি পরিপূর্ণ একটা বাড়ি দেবো।হ্যা ঘড়!একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অখিলেশ। নিরুপমার সেদিনকার সেই আকুতি ভরা চাহনি আজো তার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণের সঙ্গী হয়। সামান্য এক টুকরো ঘড় চেয়েছিলো মেয়েটা নিজের আত্মসন্মান, লজ্জা, সংকোচ বিসর্জন দিয়ে, বিনিময়ে সে কি দিয়েছে?মিথ্যা কিছু শান্তনা বাণী,আর নিস্বার্থ প্রেমিক সেজে প্রেমিকার বিয়েতে মত দিয়েছিলো।আসলে কি নিরুর ভালোর চিন্তা করে নাকি নিজের অপারগতা ঢাকতে অমনটা করেছিলো। সামনের টেবিলে ধোঁয়া উঠা গরম লাল চা আর ছোট প্লেটে কয়েকটা বিস্কুট। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় অখিলেশ।কারন অনিতা দেবী এসে পরেছেন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে।ঘড় থেকে ভুড় ভুড় করে ধূপের ঘ্রান আসছে। শোয়ার ঘড়ের এক কোনায় ছোট্ট সিংহাসন পেতে সেখানেই নিত্য পূজা সারেন অনিতা দেবী।
মাসিমা মামনি ঘুমিয়েছে।আমি তাহলে উঠি আজ।বলে অখিলেশ।
আরেকটু বসো বাবা নিরুপমার সাথে দেখা করে যেও।এখনি এসে পরবে হয়তো।পাশের চেয়ারে বসে বললেন অনিতা দেবী।
অখিলেশের মনের অব্যক্ত ইচ্ছেটাও এটাই কিন্তু অধিক দর্শনে যে মায়ার পাল্লায় টান পরে।পরের জিনিসে মায়া,মোহ ভালো নয়। ছোট্ট অদ্রিকার প্রতি দুদিনেই ক্যমন টান পরে গিয়েছে তার।মেয়েটাও আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান কিন্তু ও কি জানে,এই আঙ্কেলই একদিন কতবড়ো দুঃখ দিয়েছে ওর মাকে,কি ভীষণ ঠকিয়েছে প্রেমে পাগল প্রায় এক প্রেমীকে। নিজের মনেই প্রলাপ বকে অখিলেশ,ঘোর কাটে অনিতা দেবীর প্রশ্নে।অনিতা দেবী উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছেন অখিলেশের হালকা পাংশুটে চোখের দিকে।যেখানে স্মৃতির ছাই ভস্ম আসল রং টুকু মলিন করে রেখেছে। অখিলেশ যেনো প্রশ্নটা বোঝেনি এমন ভাবে তাকায়,,,আজ্ঞে মাসিমা বুঝিনি কি বললেন?
বলছি বিয়ে থা করেছো কত বছর হলো তোমার?
আজ্ঞে মাসিমা ওটা আর হয়ে ওঠেনি!
মলিন শুনায় অখিলেশ এর স্বর। কিন্তু একজনের মলিন কন্ঠস্বর সামনে বসা অন্য জনের মাথা থেকে যে অনেক মণ ওজনের পাথরের মতো ভারী দুশ্চিন্তার বোঝাটা নামিয়ে দিলো তা বোধহয় এই ত্রিশোর্ধ যুবকটি বুঝলো না।যদি বুঝতে পারতো তাহলে ঐ বৃদ্ধা প্রায় রমনীর মনের মধ্যে যে প্রশান্তির সমীরণ বইতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে তার কিছুটা ফাঁকফোকর গলে অখিলেশের বুকেও লাগতো।
*****
বসার ঘড়ে সন্ধ্যার জলখাবার খাচ্ছে সবাই।যে যার মতো কথায় ব্যস্ত হলেও টপিক একটাই বাড়িতে অনেক অনেক বছর পরে নতুন অতিথি আসছে। রঘুনাথ প্রায়শই এসময় বাড়িতে থাকে না। কিন্তু আজ আছে কি এক অদৃশ্য টানে।বেশ কদিন হলো হাসিখুশি রঘুনাথকে কেউ দেখেনি।ক্যমন একটা গম্ভীর হয়ে থাকতো।আজ সেই পুরোনো রঘুনাথ ফিরে এসেছে।বাড়ি থেকে সারাদিন ফোন করেও কেউ তাকে পায়নি। অবশেষে ফিরেছে সেই শেষ বিকেলে।ক্লান্ত,শ্রান্ত হয়ে কিন্তু এত পরিশ্রম সে কোথায় করেছে জানে না কেউ।জানে শুধুমাত্র বিরূপাক্ষ।তার দাদাভাই ইদানিং সব কাজ ফেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার রূপনগরের রাজকন্যা রূপবতী অর্পিতাকে।যার ছলনায় গুনবতী স্ত্রীর প্রতি নজরই উঠতে চলেছে।
যাইহোক রঘুনাথ গেট দিয়ে ঢুকতেই খুশির খবরটা পেলো কাজের ছেলে গণেশের মুখে।সে ছেলে হাসিতে গদগদ হয়ে বললো,,,বড়দা বাবু খুশির খবরখান শুনিছেন?
রঘুনাথ ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায়,,
আপনি বাপ হতি চলিছেন।
রঘুনাথ গণেশের মুখের এই খুলনার ভাষাটা শুনে একসময় অত্যধিক কৌতুক বোধ করতো এবং একটা কথা বার বার শুনতে চাইতো আজো পুনরায় শুনতে চাইলো তবে রসিকতা করে নয়।আত্মার তাড়নায় আবার শুনলো কথাটা।
না একমূহুর্তও আর কোথাও দাঁড়ায়নি রঘুনাথ। ছোট্ট বেলার মতো একছুটে দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ির তিন ধাপ করে লাফিয়ে উঠে গেলো উপরে।কোনো ক্লান্তি অবসন্নতা তাকে ছুঁতে পারলো না।জয়া ঝিম মেরে আঁখি মুদে বসেছিল বিছানায়। রঘুনাথ এর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললো। এবার তার বুক ফেটে কান্না এলো বাঁধ ভাঙা কান্না। একবার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে বোধহয় সকল জালা জুড়োতো।বিধাতা বুঝি জয়ার মনের কথা বুঝলো। রমনীর মনের কথা তার আপনার পুরুষ বুঝবে না তা কি হয়। রঘুনাথ কোনো কথা বললো না। হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো জয়াকে। জয়ার বাঁধ ভাঙা কান্নায় দেওয়াল গুলিও কেঁপে উঠলো।শত সহস্র চুম্বনে সিক্ত হলো জয়া। বহুদিন বাদে নিজের খায়েস মিটিয়ে বৌকে আদর করলো রঘুনাথ।জয়াও আজ ছোট্ট খুকিটি হয়েছে সব কিছুই ভালো লাগছে তার।জীবন আসলেই মধুর। কখনো কখনো বেদনাবিধুর না হলে এই মধুময় স্বাদটুকু উপলব্ধি করতে পারতো না কেউ।
বুঝলি জয়া আমার রিতি মা এবাড়িতে আসার পরে সবকিছুই ভালো হচ্ছে। একজনের সৌভাগ্যে যে দশজনে খায়। বললেন অন্নপূর্ণা দেবী। বিরূপাক্ষ রঘুনাথের পাশে বসে ছিলো মায়ের কথায় বিরক্তি নিয়ে একবার তাকালো অনতিদূরে বসা রিতির দিকে।
মা সন্তান আসছে দাদাভাই আর বৌদিদির এতেও তুমি অন্যের গুন দেখছো?
তো আর কার গুন দেখবো বাবা? এতবছর এত জায়গায় মাথা কুটেছি কই কিছুই তো হলো না আর বাড়িতে মেয়েটার পা পরতে না পরতেই এত বড়ো সুখসংবাদ?
হ্যা হ্যা কার কপালে কে খায় কে জানে? তাচ্ছিল্যের সাথে বলে বিরূপাক্ষ।
তুই আর এভাবে লাগিস নাতো রূপ। আমাদের একজন নতুন অতিথি আসছে তাকে আসতে দে আগে।বলে প্রদীপ।রিতি শুধু শুনছিলো কথাগুলো এবার উত্তর দিলো নিরুত্তাপ ভঙ্গিমায়,,,প্রদীপদা নতুন অতিথি একজন আসছে না গো আসছে দুজন।একজন দুচোখ মেলে পৃথিবীর সব রঙ দেখবে অন্যজন নিজের দুচোখের তারায় আরেকজনকে পৃথিবীর সকল রঙ দেখাবে।রিতির কথার আগা মাথা বুঝতে পারে না কেউই।সবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার আগে রিতি উঠে পরে,,বৌদিদি আমি কিচেনে যাই দেখি ওরা কি করছে,,,,,
চলবে,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।