হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,০২,০৩

0
687

উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,০২,০৩
কলমে: চন্দ্রা
পর্ব:০২

পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রাণাধিক বন্ধু শশীশেখরের সাথে ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘঠে প্রভাকর রায় চৌধুরীর।শশীশেখর হালদার বন্ধু পুত্রকে নিজের পুত্রের মতো দেখলেও সে ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার পর তার বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে শশীশেখর হালদার নিজেই গুটিয়ে গিয়েছিলেন ঐ সম্পর্ক থেকে।প্রভাকর রায় চৌধুরী ও তেমন একটা গ্রাহ্য করতেন না। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী শশুর মহাশয় বেঁচে থাকতে তাঁর বন্ধুকে যে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন সেটাই বহাল রেখেছেন। বিভিন্ন পালা-পার্বণে নিজে গিয়ে প্রণাম করে আসেন বৃদ্ধ মানুষটিকে। ছোট্ট ত্ররিতিকে নিজের সন্তানস্নেহ দিতে ভূলতেন না কখনো।ত্ররিতিও বড়মা নামক মানুষটিকে পেলে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিতো। বয়স কম হলে কি হবে দাদুর মুখে শুনে শুনে ওবাড়ির সাথে নিজের ভাবী সম্পর্কটা বুঝতে পেরে মনে মনে লজ্জায় পরে সে।আগে তবুও স্কুল থেকে ফেরার পথে বা বিভিন্ন পূজায় যেতো ও বাড়িতে কিন্তু এখন যেতে লজ্জা লাগে যদি ঐ মানুষটির সাথে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়?যার একটা ফটো এখনো অতি যত্নে লুকানো আছে রিতির আলমারিতে।
চৌধুরী বাড়িতে আরো একজন নারী আছে যার সাথে রিতির খুব ভাব।বৌদিদি বলে ডাকে রিতি কিন্তু বয়সের ফারাক বেশি হলেও সমবয়সী সখীর মতো গল্প করে দু’জনে।প্রভাকর চৌধুরীর একমাত্র বোন অল্পবয়সে বিধবা হয়ে যখন বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তখন তাঁর ছেলে রঘুনাথের বয়স ছিলো আট বছর। অল্পদিনের মধ্যেই স্বামীর শোকে আত্ম হননের পথ বেছে নেন রঘুনাথ এর মা। রূপের তখনো জন্ম হয়নি। অন্নপূর্ণা দেবী একমাত্র ননদের সদ্য মাতৃহারা ছেলেকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন।সেই থেকে রঘুনাথ মামাবাড়িতে নিজের বাড়ির ছেলের মতো মানুষ হয়েছে।জয়া রঘুনাথের স্ত্রী।
সেদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রভাকর রায় চৌধুরী ভাগ্নে রঘুনাথ কে দিয়ে ডাকালেন শশীশেখর হালদার কে। নিজের বন্ধুপুত্রের শরীর খারাপ শুনে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে। এতদিন বাদে রূপকে দেখে না চিনলেও রূপ ঠিকই চিনে নিয়েছিলো দাদুকে।তাইতো স্থান কাল ভূলে টুপ করে প্রণাম করে বসে।শশীশেখর অচেনার দৃষ্টিতে তাকায়।হাসছে রূপ। রঘুনাথ জটলা খোলে,দাদু চিনলে না তো?আমাদের ছোট সাহেব গো।কত কোলে কাঁধে নিয়েছো এখন চিনছো না?
শশীশেখর অবাক হয়ে তাকায়, এতদিন কতকিছুই না শুনেছে মানুষের মুখে । কিন্তু শশীশেখরের বিশ্বাস ছিলো এমন ভক্তি পরায়ণ মায়ের ছেলে কখনো বখে যেতে পারেনা তা সে যতই শহুরে সভ্যতায় গড়ে উঠুক। মুখে হাসি টেনে বললেন, বেঁচে থাক দাদু।ঠিক বলেছো রঘু দাদু ভাই সাহেবই বটে তোমার ছোট ভাইটি।রূপ হেসে আলিঙ্গন করে দাদুকে। বৃদ্ধ মানুষটির বুক থেকে একটা ভার নেমে যায় তৎক্ষণাৎ।

কেবিনে ঢুকতেই প্রভাকর রায় চৌধুরী প্রণাম তো করতে পারলেন না কাকা বাবুকে।হাত ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন নিজের ব্যবহারের জন্য।ছেলে,পুত্রবধু হারা শশীশেখরের বুকের ভেতরে আত্মাভিমানে যে দ্বার রুদ্ধ হয়েছিল সেটা উন্মুক্ত হতে সময় লাগলো না।পুত্র স্নেহে অশ্রু সিক্ত হলো কোঠর গত নয়ন দুটি।

পদার্থ বিজ্ঞান বইটা টেনে পড়ছিলো রিতি।গ্রামে রাত নয়টা মানে অনেক রাত মনে হতো যখন সেখানে বিদ্যুৎ লাইন চালু হয়নি।সৌর বিদ্যুৎ এর আলোয় ঝলমল করছে রিতির ঘড়টা।কি যেনো মনে পড়াতে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো রিতি,পিসি,,,ও পিসি গো,,,পিসি,,,,
আটপৌরে ঘিয়ে রঙের সুতি শাড়ির আঁচল টা মাটিতে টানতে টানতে ছুটে আসেন বছর পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নেরএক বিধবা মহিলা।
কি হলো মা এমনে ডাকতিছিস ক্যান?

হাসছে রিতি,পিসি তুমি এইভাবে দৌড়ে আসলে ক্যানো?আমি তো ভাবলাম টিভি দেখতে দেখতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে গেছো।

পিসি কপট রাগ দেখিয়ে বলে,আমি ভাবলাম শরীলডা আবার খারাপ হইলো কিনা।একি এখনো দুধটুকু খাওনাই মা?শরীল সারবো ক্যামনে কও তো?খাও খাও।
দুধ ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে তাড়া লাগায় সুমিতা দেবী।

রিতি আহ্লাদ করে বলে,ওরে আমার পিসিমনি এই উঁচু উঁচু একগ্লাস দুধ আমি খাইতে পারিবো না। তুমি অর্ধেক টা খেয়ে আমাকে দাও।
সুমিতা দেবী চোখ পাকায়, ফাঁকিবাজ মাইয়া কোথাকার,গ্লাসে উঁচা উঁচা কইরে দুধ রাহোন যায়?খালি হাবিজাবি কথা।
রিতি খিল খিল করে হেসে ওঠে,পিসি তুমি খেলে খাও না হলে তোমার দুধের গ্লাস নিয়ে যাও।
বিপাকে পড়েছেন সুমিতা দেবী,এই দ্যাকো আমার এঁটো খাইবা ক্যান মা,তুমি খাও ,পরে আমি খায়া নেবো।

আমার এঁটো তুমি খাবে আর তোমারটা খেলে কি আমি তোমার মতো কালো আর মোটা হয়ে যাবো পিসি?

সুমিতা দেবী রিতির রসিকতা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালেন না।এই মেয়ের মাথায় গন্ডগোল আছে কি কি সব বলে।একছুটে রান্না ঘড়ে গিয়ে আরেকটা গ্লাস নিয়ে আসেন।
রিতি নাক কুঁচকে দুগ্ধ পান করে মনে মনে মজা পায় পিসিকে জব্দ করতে পেরে।
মূলত সুমিতা দেবীর গায়ের রং এমনই ফর্সা যেটা সাংসারিক , মানসিক দুশ্চিন্তা এবং বৈধ্বব্য দশাও ম্লান করতে পারেনি আর মোটা সে মোটেই নয়।রোগা পাতলা টিং টিংয়ে দৈহিক গঠন তাঁর।

দুধ শেষ করে গ্লাসটা রাখতেই শশীশেখর হালদার গলা খাঁকারি দিয়ে রিতির ঘড়ে ঢোকেন।রিতির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমিতা দেবী জ্যাঠা মহাশয়কে দেখে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়।রিতির পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলে শশীশেখর বাবু,দিদি ভাই অতবড়ো অসুখ থেকে উঠলি সবে, এখনি এত রাত জেগে পড়তে হবেনা তোকে।

রিতি আকাশ থেকে পরে,কি বলছো দাদুভাই?দেড়মাস পরে আজই স্কুলে গেলাম। পরীক্ষা তো এসেই গেলো এখন না পড়লে খাতায় বড়ো সড়ো কয়টা গোল্লা পাবো বুঝলে?শেষে লোকে বলবে,মা,বাবা ছিলেন হাইস্কুলের টিচার আর তাদের মেয়ে দেখো পড়াশুনার গুষ্টি চটকে খেয়ে ফেলেছে। পরীক্ষার খাতায় হাঁস মুরগির ডিমের বিজনেস শুরু করবো দাদু।
শশিশেখর নাতনীর কথায় বড়োই সন্তুষ্ট হন। মেয়েটার লেখাপড়ার আগ্রহটা পেয়েছে ঠিক বাবার মতো।
কিন্তু দিদি ভাই সব হবে।আগে নিজে তো সুস্থ হও।

হ্যা পড়াশোনা ছেড়ে শুয়ে বসে থেকে সব ভুলে যাই আরকি।শেষে বর যদি বিদ্বান হয় দেখা গেলো বাসর রাতে খাট থেকে লাত্থি মেরে নিচে ফেলে দিয়ে বলবে,স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি এমন মেয়ের জায়গা আমার খাটে হবেনা।এরকম অশিক্ষিত,গন্ডমূর্খ বউ চাইনা আমি।ছেলে মেয়ে গুলো সব ব-কলম হবে।

শশিশেখর হা হয়ে আছেন।নাতনী তাহার বড় হয়ে উঠেছে।সুমিতা দেবী রিতির কথার ধরন দেখে মানে মানে আগেই কেটে পড়েছিলেন।মেয়েটার মাথায় সত্যিই গন্ডগোল হয়েছে।

সবুজ শ্যামলে ঘেরা চন্ডীনগর গ্রামটি ।পাশ ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে ঘোলাটে জলের চিত্রা নদী (কাল্পনিক নাম)প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বসবাস গ্রামে। গ্রামের দক্ষিণ দিকেই নদী ।নদীর এপাড়ে চন্ডীনগর ওপাড়ে মথুরাপুর। আধুনিকতার ছোঁয়া এবং স্কুল কলেজ যাবতীয় সবকিছু ওপাড়েই মানে মথুরা পুরে।সেখানে বিদ্যুৎ লাইন চালু হয়েছে বছর কয়েক হলো। আশেপাশে চার পাঁচ গ্রামের ছেলে মেয়েরা মথুরাপুরে স্কুল কলেজে যায়।আগে দুটো স্কুল ছিলো একটা গার্লস স্কুল এবং অন্যটা হাইস্কুল। গার্লস স্কুলে ছেলেরা পড়তে পারে পঞ্চমশ্রেণী পর্যন্ত। কয়েকবছর হলো প্রভাকর রায় চৌধুরী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে অবতীর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন।এক জায়গাতেই মথুরাপুর স্কুল এন্ড কলেজ।

বৈশাখের মধ্যভাগ।আকাশে গনগনে কাঠ ফাটা রোদ্দুর।আবাদি জমির মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে মথুরাপুর গ্রামের মেইন রাস্তাটি।পিচঢালা চওড়া রাস্তায় রোদের তেজ পরে আগুনের তাওয়ার মতো তাপ উঠছে। দুই পাশে সমতল ভূমি থেকে রাস্তার উচ্চতা প্রায় পনেরো ফিট।এত রোদের মধ্যেও রাস্তার দুই পাশে অবারিত পাঠক্ষেত গুলো সবুজের খেলায় মেতেছে যেনো।সে দৃশ্য অবশ্যই মনোমুগ্ধকর।যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজের দোল আর দোল। রাস্তার দু’পাশে বেশ দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশমনি এবং ছাল, চামড়াহীন অর্জুন বৃক্ষগুলো।এখন যেখানে অগ্নিকুন্ডের তাপ পরন্ত বিকেলের ম্লান সূর্যালোক সেখানে এক মোহময় স্বর্গপুরীতে পরিনত হয়।এই ভরদুপুরে রাস্তার দক্ষিণ সীমানায় দুটো রংচঙে ছাতা এগিয়ে আসছে। ছাতার নিচে মালিক দু’জনের পোশাক দেখে বোঝাই যায় তারা স্কুল থেকে ফিরছিল।যেখানে খালের সাথে নদী মিশিয়ে দেওয়ার জন্য কালভার্ট তৈরী হয়েছে সেখানে আসতেই ছাতার নিচে মেয়ে দুটোকে ডাকলো কেউ কালভার্ট এর নিচ থেকে,এই খুকী একটু দাঁড়াও। এমনিতেই গরমে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় দুজনের তার উপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত আহ্বান মোটেও ভালো লাগলো না ওদের।স্যান্ডেলের রবার ভেদ করে পিচের থিম যেনো সমস্ত শরীরময় নৃত্য করছে। অগত্যা
মেয়ে দুটি থেমে গিয়ে দেখলো খালের পাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে আসছে কেউ একজন।আগন্তুকের চেহারাটা স্পষ্ট হতেই বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শুরু হয়েছে রিতির,
এই রোদের মধ্যে মানুষটা করছেটা কি?পরনে কালো কাপড়ের হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট,গায়ে ছাই রঙের গোল গলার টি শার্ট টা ঘামে ভিজে আটো সাটো হয়ে মিশে আছে।ফর্সা মুখটা গরমের তেজে লাল রংয়ে পরিনত হয়েছে। এলোমেলো কয়েক গোছা চুল কপালে ঘামের সাথে লেপ্টে আছে।
রাস্তার উপরে উঠে হাফাচ্ছে সে।যা রোদ পরেছে। হাঁফাতে হাঁফাতেই বললো সে,
সরি তোমাদের দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য।বাই দা ওয়ে , তোমাদের ব্যাগে খাওয়ার জল হবে? আমাদের জল শেষ বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
রিতি এবং সুমি তো অবাক।জল খাওয়ার জন্য এভাবে ছুটে এসেছে?হ্যা এই রোদে হেঁটে হেঁটে পানীয় জলের সার্ভিস দিচ্ছি (মনে মনে বললো রিতি)
কিন্তু ওখানে কি অত মহামূল্যবান কাজ করছে? নিচে উঁকি দিয়ে দেখলো প্রদীপদা বরশি দিয়ে এই ভরদুপুরে মাছ ধরছে।প্রদীপদা তো আবার মানুষটার লেংটা কালের প্রাণের বন্ধু। একেবারে মানিক জোড় যাকে বলে। ব্যপারটা বুঝলো রিতি, ভাগ্যিস আজ টিফিন পিরিয়ডে চলে আসছে না হলে জলের বোতলটা ফাঁকা হয়ে যেতো।জল পানে ব্যস্ত রূপ ।প্রদীপ ততক্ষনে নিজেদের মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে আকাশ মনি গাছের ছায়ায়।
কিরে রিতি এই চুন্নিটার সাথে মিশে স্কুল পালিয়েছিস?সুমিকে ইঙ্গিত করে বললো প্রদীপ।সুমি রাগত চোখে তাকায়।
রিতি সে কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,
দেখি কি শোল, বোয়াল ধরেছো?নিজেই প্রদীপের হাতে থাকা প্লাষ্টিকের ব্যাগটা ফাঁক করে উঁকি দিলো।
প্রদীপের মুখটা চুপসে যায় কারন সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র দুটো কই মাছের বাচ্চা পেয়েছে।

এই মাছের জন্য রোদের মধ্যে ভাজা ভাজা হচ্ছো? মাছের এত আকাল পরেছে ? বিরক্ত প্রকাশ পায় রিতির স্বরে।

প্রদীপ কিছু বলার আগে রূপ খালি বোতলটা এগিয়ে দেয় রিতির দিকে,ধন্যবাদ খুকী,জলের জন্য।

আমি রিতি ।খুকী নই ।ধীর স্বরে উচ্চারণ করে রিতি।রূপ থমকায় কিছুক্ষণের জন্য।কোথাও কি শুনেছে এই শ্রুতিমধুর কন্ঠঝংকার?খুব চেনা চেনা লাগছে স্বরটা।

দিন দুয়েক পরে, সন্ধ্যা উতরেছে সবে চৌধুরী মহলে বসার ঘড়ে বৈঠক চলছে।ঘড়োয়া বৈঠক বললে ভুল হবে না। বৈঠকের মূল কেন্দ্রবিন্দু রূপ আর বিষয়বস্তু হলো রূপের শুভ বিবাহ।
দুপুরের দিকে এমন একটা ছোট মিটিং চলছিলো চন্ডীনগরে হালদার বাড়িতে।আজ বহুদিন পর প্রভাকর রায় চৌধুরী ওবাড়িতে পা রেখেছিলেন।শশীশেখর হালদার এর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং মৃত পিতার অন্তিম ইচ্ছার কথাটা যাতে বাস্তবে রুপ নেয় তার জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন।শশীশেখর ও এতদিন অন্তর্দহনে দগ্ধ হচ্ছিলেন এটা ভেবে যে, প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেওয়া কথাটা বোধ হয় রাখতে পারলেন না।প্রভাকরের কথায় মনের কোণে আশার সঞ্চার হলো। তবুও তিনি বললেন,দেখো বাবা,এই মুহূর্তে দিদিভাইয়ের বিয়ের বয়সটাও হয়নি। রূপ দাদুভাই সবে পড়াটা শেষ করলো।এত তাড়াহুড়া ক্যানো তবে?
কাকা বাবু, আমার শরীরটা তেমন ভালো নয়,তাতো আপনি জানেন।খোকার ও যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাই আমি চাই আপনার সামনে বাবার ইচ্ছে টা যেনো পূরণ হয়।
তোমার ছেলের সাথে কথা বলেছো এই ব্যাপারে?
এখনো বলিনি।তবে ওর অমত হবে না।দাদুকে ও ভীষণ ভালোবাসতো।

আবেগের বশে ভুল করোনা প্রভাকর ।ছেলে তোমার শহুরে সভ্যতায় মানুষ। নিজের পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে।শেষে বিরম্বনার শেষ থাকবেনা। আমার দিদি ভাইয়ের সুখের চেয়ে কোনো কিছুই দামী নয় আমার কাছে।

নাতনীর ভবিষ্যতের ভাবনায় মনে মনে দ্বিধান্বিত হলেও মৃত বন্ধুর কথাটা স্মরণ করে অবশেষে মত দিয়ে দিলেন প্রভাকরের কথায়।

বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে রূপ বিস্মিত।কি প্রতিক্রিয়া এই মুহূর্তে দেখানো উচিত বুঝে উঠতে পারলো না।তথাপি খুব শীতল গলায় বললো,বাবা এই মুহূর্তে বিয়ে শাদীতে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রভাকর রায় চৌধুরী হুংকার ছাড়লেন, সম্ভব অসম্ভব তোমার কাছে জানতে চাইলো কে?
আমিতো শুধু কথাটা তোমাকে জানালাম।আজ পনেরোই বৈশাখ ,আগামী বাইশে বৈশাখ তোমার আর ত্ররিতির বিয়ে । সেভাবে তৈরী হও।বন্ধু বান্ধব দের ডেকে নাও।
রূপের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো এবার। উচ্চ স্বরে বলে,আমি পারবোনা এই বিয়ে করতে।আমাকে কি খেলার পুতুল মনে হয় তোমাদের? একটা চৌদ্দ পনের বছরের বাচ্চা মেয়েকে আমার বিয়ে করতে হবে?এটাও সম্ভব? একরত্তি একটা মেয়েকে তোমরা আমায় গছিয়ে দিচ্ছো।ওই মেয়ে কখনো খাপ খায় আমার সাথে। বন্ধুদের কাছে মান সম্মান থাকবে এই মেয়েকে বিয়ে করলে?লোকেই বা কি বলবে ? বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী অবশেষে বাল্য বিবাহ করলো?
রঘুনাথ ও তার স্ত্রী জয়া এগিয়ে যায় রূপের দিকে। থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আজ তো অনেক দিনের রাগ ক্ষোভ ঝাড়তে চায় রূপ।

পড়া শেষে চুল গুলো আঁচড়ে নিচ্ছিলো রিতি।মাস তিনেক আগে টাইফয়েড হয়ে চুল পড়ছিলো খুব। তখন পিসিমা মাথাটা ন্যাড়া করে দিলো।ঘন কালো চুলে মাথাটা ভরে উঠেছে ঠিকই কিন্তু সেই জ্বরে চেহারার যে লাবণ্যটুকু হারিয়েছে সেটা এখনো ফেরত আসেনি।
দাদু ঘড়ে ঢুকতেই ফিরে তাকায় রিতি। তিনি বিছানায় বসে কাছে ডাকেন রিতিকে। ধীরে সুস্থে দুপুরের কথাটা তোলেন।রিতি হঠাৎ আনমনা হয়ে পরে।হতে পারে সে সবে মাত্র কৈশরে পদার্পন করেছে। না ফোঁটা কুড়ি কিন্তু সেই রুদ্ধ কুঁড়ির সমস্ত টা জুড়ে রয়েছে ঐ মানুষ টা।রিতি হয়তো প্রেম বুঝেনা কিন্তু কারনে অকারণে যে, আজকাল মানুষটিকে ভেবে শিহরিত হয় সেটা তবে কি?

কি হলো দিদিভাই,আমি কি তবে কথা দিয়ে ভুল করলাম?

দাদু ভাই,অনেকবছর পরে আজ সামনে থেকে দেখেছি উনাকে। অত সুন্দর মানুষটার পাশে আমাকে মানায় না। কত পড়াশোনা করেছেন,সেখানে সব শিক্ষিত,সুন্দরী মেয়েদের চলাফেরা ,তাঁর যদি কারো প্রতি মন লেগে থাকে? তখন কি হবে দাদু? চাঁদকে দূর থেকে দেখলে যতটা শান্তি , কাছে গেলে ততটা হবে কি?
শশীশেখর মৃদু হাসলেও নাতনীর কথার গভীরতা টুকু অনুধাবন করেন, কিন্তু এটুকু বিশ্বাস তিনি করেন তাঁর দিদি ভাইয়ের সৌন্দর্যের কাছে অন্য সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাবে শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের শ্রেষ্ঠ চরিত্র মা যার আছে তার কি আর মতামত বলতে কিছু থাকে? সেদিন বাড়ির সবার সম্মুখে কোন তর্জন গর্জন ই কাজে আসেনি রূপের ।তাইতো বউ ভাতের দিনে সবার অলক্ষ্যে অবিবেচক এর মতো একটা কাজ করে বসলো সে। বিবাহের শেষে বিদায় বেলায় যখন বৃদ্ধ দাদু সজল নয়নে রিতির হাতটা। রূপের হাতে সপে দিলেন রূপ অস্ফুট স্বরে বলল,জীবনটা আমার বরবাদ করে ছাড়লো।
উপরে যিনি অদৃশ্য হয়ে বসে আছেন তিনি মুচকি হেঁসে সে কথার প্রতিউত্তরে বললেন হয়তো,বরবাদ নয় বৎসো, তোমার মনের বরবাদ জমিন আজ থেকে আবাদ করে দিলাম,,

চলবে,,,

উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে:চন্দ্রা।

পর্ব:০৩

চৌধুরীর বাড়ির অন্দর মহলে জনসংখ্যা বেশী না হলেও সবসময় সেটা মুখরিত থাকে জনসমাগমে। বাড়ির গিন্নিদের মিশুকে স্বভাবের কারণে অন্য বাড়ির মহিলাদের যাতায়াত ছিলো অবাধে।কেউ বলতে পারবে না যে, চৌধুরী গিন্নির কাছে কেউ কিছু চেয়ে আজ পর্যন্ত খালি হাতে ফিরেছে।
আজ চৌধুরী বাড়ির অন্দর মহলে প্রায় শখানেক আত্মীয় স্বজনদের ভিড় কিন্তু এত মানুষের ভিড়েও নিস্তব্ধ অন্ধকার পুরীতে পরিনত হয়েছে আলোয় ঝলমলে প্রাসাদটি।কারো মুখে কোন কথা নেই।শিশুরা পর্যন্ত তাদের স্বভাবসুলভ চিৎকার চেঁচামেচি করতে ভুলে গিয়েছে। অন্নপূর্ণা দেবী কতক্ষন বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে এখন শান্ত হয়ে গিয়েছেন। প্রভাকর চৌধুরী আরাম কেদারায় চোখ বুজে পরে রয়েছেন। নিকটাত্মীয় যারা রয়ে গিয়েছেন তাঁরাও বিমর্ষ।মামি শাশুড়ির পায়ের কাছে বসে নিঃশব্দে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে জয়া।
অন্নপূর্ণা দেবী বললেন জয়াকে, এখানে বসে কাঁদলে চলবে না মা, মেয়েটার কাছে যা।ক্ষয়-ক্ষতি যা হওয়ার,তা তো ওরই হলো।ওকে একটু সামলা মা।
রিতি কাউকে কাছে যেতে নিষেধ করেছে মামিমা,এই বয়সে এমন প্রত্যাখ্যান কেউ সইতে পারে?পাথর হয়ে গেছে মেয়েটা।গলা ধরে আসে জয়ার।

আজ পূর্ণিমা।গগনে চাঁদ তারার মেলা।বড় সাইজের জানালার কাঁচ ভেদ করে একফালি চাঁদের আলো পরেছে রিতির মুখে। পুরোনো আমলের কালো কুচকুচে আব্লুস কাঠ নির্মিত পালঙ্কের পায়ার সাথে হেলান দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সে। কোলের উপর ডান হাতে ধরা স্বামী প্রদত্ত চিঠি খানি।বার কয়েক পড়েছে । কিন্তু অনুভূতি একই রকমের।যন্ত্রনা একটু কমও না বেশীও না।এই ঘড়ের শুধু পালঙ্কটাই একটু পুরোনো আমলের ।অন্যসব জিনিস, আসবাবপত্র গুলোর প্রতি পরোতে পরোতে আধুনিকতার ছোঁয়া।রূপ নিজে পছন্দ করে একেকটা জিনিসপত্র এনে সাজিয়েছে নিজের ঘড়টা।
নিজেদের খামার বাড়ি থেকে টাটকা গোলাপ, রজনী গন্ধা, গাঁদা,ডালিয়া এনে ফুলসজ্জার জন্য সাজানো হয়েছে পুরো ঘড়টা।কেউ কি এই ঘড়খানা সাজানোর সময় ভেবেছিলো এখানে আজ সুখের আর্তনাদের চেয়ে বিরহের অন্তর যাতনা বেশী হবে?বুঝলে হয়তো এমন ভাবে রিতির বিরহের চিতার আগুনে কেউ ধুপ ছিটাতো না।উঠে দাঁড়ায় রিতি।শরীরটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে তার ।গা ভর্তি নতুন পুরোনো মিশেলে ভরি সাতেক সোনার গহনা। বৌভাতের বেনারসী এখনো সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে আছে শরীরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বেডের সাথে লাগোয়া ছোট টেবিলের সামনে। দামী ফ্রেমে রূপের হাস্যরত ছবিটা জ্বল জ্বল করছে।হৃদমোহিনী চাহনিতে তোল- পাড় হয়ে যায় রিতির ভিতর বাহির। বেশীক্ষণ সেদৃষ্টি সইতে পারেনা সে।মুখটাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়।এযেনো শুধু ছবি নয় রক্তে মাংসের সাকার মানুষটা। এতক্ষণে সংযমের বাঁধ ভেঙে মনের দুকূল ছাপিয়ে জল গড়ায় গন্ডোদেশ বেয়ে।বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলে রিতি,
ক্ষমা করো আমায়।আমিই লোভের বশে নিজের সীমাটা ভুলে গিয়েছিলাম।বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়েছি।তাইতো হাতের সাথে মনটাও পুড়ে ছারখার হলো। কিন্তু একবার সমনে দাঁড়িয়ে কথা বলে দেখতে ,অতটাও অবুঝ আমি নই।মেয়েরা যে অতি অল্প বয়সে অনেক বেশি পরিনত হয়।সামনে দাঁড়িয়ে শুধু মুক্তি ক্যানো একবার চাইলে প্রাণটাও হাসতে হাসতে দিয়ে দিতাম।কতটা উঁচুতে তোমার আসন পেতেছি তুমি যদি জানতে তাহলে নিজেকে এভাবে ছোট করে যেতে না আমার কাছে। তোমার অপমান যে,বিষের ছোবল মারছে আমার বুকে।তুমি কারো কাছে কমিটেড এটা আমাকে ক্যানো বললে না?তাহলে তোমাকে দেশান্তরী হতে হতোনা। নিজের জন্য যত্ন করে ঘড় সাজিয়েছো সেই ঘড়ে আমিই তোমাকে বাস করতে দিলাম না,এই অপরাধ বোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। কতকিছুই বলার ছিলো,একটি বার সুযোগ ক্যানো দিলেনা বলো?যে কথা গুলো বলার সময়টুকু আমাকে দিলে না সেই কথাগুলো শোনার জন্য একদিন মরিয়া হয়ে উঠবে তুমি কিন্তু সেদিন আমি কিছুই বলবোনা ‌। কিছুই না। সেদিন কিন্তু কাঠিন্যের অপবাদটা আমায় দিতে পারবেনা।
চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় রিতি। নিজেকে শান্তনা দেয়,যে তার নারীত্ব কে অপমান করে, সামান্য বালিকা ভেবে মানসম্মান পদদলিত করেছে তাঁকে ভেবে চোখের জল ফেলবে না।

পরেরদিন,
সূর্যটা সবে পূব আকাশে ডগমগে হয়ে উঠেছে।শশীশেখর হালদার প্রবেশ করলেন চৌধুরী বাড়ির মূল ফটক দিয়ে।এবাড়িতে সবাই এখনো জাগেনি। ভেতরে বসার ঘড়ের দামী ঝারবাতিটা জলছে তখনো।জয়া উঠে সবে চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে অন্নপূর্ণা দেবীর ঘড়ের দিকে যাচ্ছিলো।অন্দর মহলের দরজায় দাদুকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।এক রাতেই মানুষটার চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে ।মুখটা বিভ্রান্তি আর কাঠিন্যে থমথম করছে।জয়ার বুকটা কেঁপে ওঠে আসন্ন ভাঙনের আশঙ্কায়।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঠিকই কিন্তু অন্যদিনের মতো দাদু আজ মিষ্টি হেসে আশির্বাদ আর শুভকামনার ফুলঝুরি ঝরালেন না।শুধু জয়ার নত মস্তকে কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা ছোঁয়ালেন।
সামনে এগিয়ে সোফায় বসতে দিয়ে জয়া ছুটলো মামা -মামীর ঘড়ে।

সকাল নয়টা ,
চৌধুরী মহলের বসার ঘরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো কথা বলেই মানানো যায়নি শশীশেখর বাবুকে। তাঁর মুখায়াবয়বে এমন ক্রোধ আগে কেউ কখনো দেখেছে বলে মনে হয়না। তিনি কারো কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে প্রভাকরকে শুধু বললেন,তোমাকে তো আমি আগেই বলেছিলাম ছেলের মতামত নাও। আমার দিদিভাইয়ের সুখের সাথে আমি কোন কিছুই সওদা করতে পারবো না। কিন্তু এটা কি করলে তুমি ?কি করে গেলো তোমার ছেলে? বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে তোমরা?এই বৃদ্ধ বয়সে সারা জীবনের লজ্জায় ফেললে আমাকে।কোনমুখে দাঁড়াবো মেয়েটার সামনে বলো?গলা ধরে আসে তাঁর। অসহায়ের মত আধো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রভাকর রায় চৌধুরী। ছেলের বৌয়ের এই পরিনতিতে তিনি বিচলিত কি না জানি না তবে ছেলের যে মৃত্যু যোগ রয়েছে সে চিন্তায় তিনি শংকিত। অন্নপূর্ণা দেবী কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করছেন বারবার,রিতিকে যেনো নিয়ে না যায়।এবাড়িতে তার কোনো অযত্ন হবে না। মেয়ের মতোই থাকবে।শশীশেখর বাবু জানেন কথাটা কতখানি সত্য তথাপি তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল, কিছুতেই আর এবাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না তিনি। কিছুতেই প্রাণাধিক দৌহিত্রীকে এখানে রেখে যাবেন না। তবে শর্ত দিয়েছেন রিতি যদি কখনো নিজে থেকে আসতে চায় এবং রূপ যদি তার ভুল স্বীকার করে রিতিকে মন থেকে সন্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনে তবেই সে এবাড়িতে আসবে নয়ত না।

রিতির নিরাভরণ বেশভূষায় দিকে তাকিয়ে জয়ার বুকটা ভেঙে আসে। গতকাল এমন সময়ও মেয়েটার চোখে কত রঙিন স্বপ্নের অনুভূতি ছিলো।আজ সেখানে সর্বহারা নিঃসঙ্গতা।

এমন করিস না বোন আমার।আমরা কি তোর কেউ নই? কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে জয়ার।যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল তখন কতটুকুই বা বয়স রিতির। ছটফটে স্বভাবের ছোট মেয়েটি যতটুকু সময় এবাড়িতে থাকতো বৌদিদি বৌদিদি করে পাগল করে ছাড়তো।সেই প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল মেয়েটার জীবনে এমন ঝড় আসবে কখনো কেউ ভেবেছে কি?

বউদিদি,তোমরাই আমার সব। তিনি কেউ হননা আমার।আগে যেমন ছিলাম এখনো তেমনি থাকবো।বৌদিদি ডাকটাই ভালো।দিদি ভাই আর ডাকা হলোনা। কিন্তু এখানে থাকতে বলোনা। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাবো তাহলে। তুমি কি চাও তোমার ছোট বোনটা আত্ম মর্যাদা হারিয়ে এখানে পরে থাকুক? তাঁর কোনো দোষ দেওয়ার স্পর্ধা নেই আমার।তিনি বিদ্বান, বুদ্ধিমান ব্যক্তি।যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে মঙ্গলময় হবে সবার জন্য।
সকালে যে গহনা গুলো শরীর থেকে খুলে রেখেছিলো সেগুলো জয়ার দিকে দিতে দিতে স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বললো রিতি।
আঁচলে চোখ মুছলো জয়া। কিইবা বলার আছে তার।কে শুনবে তার কথা । ছোট ভাইয়ের চেয়েও যাকে অধিক স্নেহ দিয়ে এসেছে সে ই এমন ‌কাজটা করলো?
দুহাতের আজঁলাতে রিতির মুখখানি বন্দী করে বললো,এমন লক্ষী প্রতিমার মতো মুখখানি যার চোখে পড়লো না,অনাদরে পায়ে ঠেললো তাকে বুদ্ধিমান বলিস না দিদি।সে যে চরম মূর্খ , একদিন তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে‌‌।

হাতে শাঁখা পলা, সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে আছে এখনো, সাধারণ একটা সুতি শাড়ি পরে সিঁড়ি দিয়ে নামছে রিতি, পেছনে জয়া বসার ঘরে উপস্থিত সবাই সেদিকেই তাকিয়ে আছে।গতকালও এই ছোট্ট মেয়েটাকে দামী শাড়ি গহনায় অপূর্ব লাগছিলো।আজ সে জ্যোতিটুকুও ম্লান হয়েছে।নিরাভরণ রিতিকে দেখে চোখ জালা করে ওঠে শশীশেখর সহ চৌধুরী দম্পতির। রঘুনাথ দৌড়ে এসে রিতির হাত ধরে সিঁড়ির শেষ ধাপটা নামায়,
দাদাভাই, আমি একটুও দূর্বল হইনি জানো?আমাকে হাত ধরে নামাতে হবে না। শান্ত মৃদু স্বরে বলল রিতি।
ছোট বেলায় তুই যখন এবাড়িতে ঘুমিয়ে যেতি,তোকে কাঁধে করে হাঁটু কাঁদার মধ্য দিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসতাম।তখন নিজের সমস্ত ভার আমার উপর ছেড়ে দিতি।এখন ক্যানো দাদা ভাইকে বিশ্বাস,ভরসা করতে পারছিস না বুড়ি(ছোট থেকে বুড়ি বলে ডাকে)।থেকে যা না!মনে আছে একবার পাখির ছানার জন্য কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলি? নিজে গাছ বেয়ে তোকে পাখির ছানা এনে দিয়েছিলাম?দাদাভাই আছি তো,ওকে ঠিকই বেঁধে ছেদে নিয়ে আসবো তোর কাছে।
তুমিও এই কথা বলছো দাদাভাই?যে আমাকে চায়না তাকে ধৃষ্ঠতা ক্যানো দেখাবো বলো?ওনার দিকটা কেউ ভাবছো না। আমার মতো অসুন্দর, অশিক্ষিত মেয়েটাকে তাঁকেই গছিয়ে দিতে হলো? তিনি নিজেও কি কম শাস্তি পেলেন বলো? আমার তো তোমারা সবাই আছো আর তাঁর বেলায়?এতদিন একা ছিলেন আজো একাই রয়ে গেলেন। তুমি আমার দাদাভাই ছিলে,আছো,থাকবে সেজন্য কোনো অসাধ্য সাধনের প্রয়োজন নেই তো।
রঘুনাথ বুঝতে পারে একরাতের ব্যবধানে তার ছোট্ট বুড়িটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে।

অবশেষে ধূতির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে শশীশেখর হালদার পৌত্রীকে নিয়ে যখন চৌধুরী বাড়ির মূল ফটক দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন তখন ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটাটা দশটা ছুঁই ছুঁই করছে।

রঘুনাথ এসেছিলো রিতিকে পৌঁছে দিতে।তার মন ভারাক্রান্ত। মেয়েটাকে স্নেহ দিতে কার্পণ্য করেনি কখনো।তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী রিতি। একবার স্কুলে হাতের লেখা না নেওয়ায় ফলে নতুন স্যার দু ঘা বেত মেরেছিলো ।রিতি কোনো কথা না বলে ছুটে গিয়েছিলো চৌধুরীদের কাছারীতে। রঘুনাথ হিসাব নিকাশ করা অবস্থায় দেখে রিতি ছুটে আসছে।মেয়ে কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন কান্নার কারন জানতে পারলো রঘুনাথ তখন কোনো উচ্চবাচ্যটি করলো না বোনকে কোলে নিয়ে সোজা গিয়ে মামীমার কোলে ফেললো।দুই মাসের মাথায় সেই শিক্ষক বদলী নিয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলো। কিন্তু বদলীর কারনটা শুধুমাত্র জেনেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী।দিনে দিনে রিতি বড়ো হয়েছে। চৌধুরী বাড়িতে যাতায়াতও কমেছে। রঘুনাথের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ততা বাড়ায় তেমন খোঁজ খবরও রাখতে পারেনি। কিন্তু রাখীপূর্ণিমায় সময় করে রাখীটা নিতে ভোলেনি সে।সেই স্নেহের বোনের এই দুর্দিনে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই রঘুনাথের।শাস্তি যাকে দেবে তার পিঠে বেত্রাঘাত করলে কালসিটে তো নিজের বুকেই পরবে।মামার চোখ ফাঁকি দিয়ে শহরে কাজের কথা বলে কতবার ছুটে গিয়েছে ভাইয়ের কাছে। শুধু একটি বার দেখার আশায়। বিদায়ের সময় চোখে জল ঝরেনি এমন দিনের কথা রঘুনাথ বলতে পারবে না।

লৌহ কাষ্ঠ নির্মিত বড়োসড়ো মাপের চৌরী (চারপাশে বারান্দাযুক্ত ঘড়)ঘড় রিতিদের।প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বেশ কিছু টাকা খরচ করে এই ঘড়খানি তুলেছিলেন শশীশেখর বাবু।ঘড়ের চারপাশে চারটি বারান্দা।উপরেও শোবার জায়গা আছে। গ্রামবাংলায় এই ঘড়কে দেড়-তলা টিনের ঘড় বলা হয়।
বেশ কয়েকজন মহিলা জড়ো হয়েছে সামনের বারান্দায়। বারান্দার একপাশে পাতা খাটে বসে বিলাপ করছিলেন সুমিতা দেবী।তাকে সান্তনা দিতেই এত মহিলার সমাগম।সান্তনাও দেবেন আবার ফ্রিতে মজাও নেবেন কেউ কেউ।বড় উঠোনের সামনে রিতি দৃশ্যমান হতেই সুমিতা দেবী দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রিতিকে।রিতি পিসিকে সান্তনা দিতে দিতে এগিয়ে যায় ঘড়ের দিকে। সকলে শোকে কাতর কিন্তু রিতি নির্বিকার। গতকাল থেকে কেউ রিতির চোখে অশ্রু দেখেনি এমনকি ওবাড়ি থেকে আসার সময় ও না।

বারান্দায় উঠে হেসে বলে উঠলো,পিসি,,,ও পিসি,,,,কি হলো তোমার ?কাল চলে গেলাম বলে কাঁদলে আর আজকে ফিরে এসেছি তাতেও কাঁদছো?তোমাকে নিয়ে তো পারিনা।এই দ্যাখো আবার কাঁদে,,আমি কি মা, বাবার মতো পটল তুলেছি যে মরা কান্না কাঁদছো?সুমিতা দেবী রিতির মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলেন,মরবে তো তোর শত্তুর (শত্রু)।

কান্না থামাও এবার।কাল থেকে ঘুম হয়নি বুঝলে? এখন একটা লম্বা ঘুম দেবো।বেশ তো পুটে উচ্ছে (ছোট করলা)মেয়েকে বরবটি চিঁচিঁঙ্গার মতো লম্বা চওড়া জামাই দেখে বিয়ে দিলে।মিটলোতো সাধ? এবার আমাকে বেশী বেশী করে বরবটি,চিঁচিঁঙ্গার ঘন্টো রেঁধে খাওয়াবে যেনো কুমড়োর মতো হৃষ্টপুষ্ট হতে পারি বুঝলে।হাসতে হাসতেই বললো রিতি।
সুমিতা দেবী ভেবেছিলেন মেয়েটা হয়তো সইতে পারবে না। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম না ভেবে সস্তি পেলেন খানিকটা।তার অবচেতন মন ভেবে নিলো, বাচ্চা মেয়ে হয়তো ব্যাপার টাকে গুরুত্ব দেয়নি।
পিসিকে শান্ত করে ঘড়ে ঢুকে কপাট দিলো রিতি।সে এখন কাঁদবে। নিজের ভেতরের কষ্ট, অপমান চোখের জলে ধুয়ে সাফ করবে।মন প্রান খুলে কাঁদার জন্যেওতো উপযুক্ত একটা স্থান চাই। কিন্তু কাউকে চোখের জল দেখিয়ে সমবেদনায় উহুরে,, আহারে,,, করতে দেবেনা।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here