উপন্যাস : হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩১
কলমে: চন্দ্রা।
ও মা,নে এবার একটু ছাড়তো আমায়।নিজে কাপড়টাও ছাড়িসনি।হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে মা। (কথাগুলো অন্নপূর্ণা দেবী বললেন রিতিকে।)
পেট আমার খিদে তোমার লেগেছে? এবার পা টা নাড়িয়ে দ্যাখোতো ব্যাথা কমেছে কি না?
ভেষজ গাছ গাছালির তৈরী তেল মালিশ করছে রিতি অন্নপূর্ণা দেবীর পায়ে। দুপুরে বাথরুমে পা পিছলে পরেছিলেন।বা পাটা সামান্য ফুলেছে।
এইতো নড়ছে । তুই যা তো এখন।একটু কিছু মুখে দে। নিজের পা নাড়াতে লাগলো অন্নপূর্ণা দেবী।
রিতি বিরক্ত সূচক শব্দ করে মুখ দিয়ে,,,
অত নেড়ে চেড়ে দেখাতে হবে না।আমি জানি তুমি জোর করে করছো।কতটা ফুলেছে আর ব্যাথা হয়নি? তুমি বললেই মানবো আমি?
কি যে তুমি করো না বড়ো মা,একটু সাবধানে চলবে তো নাকি?
শুধু শুধু মুখ চালাস নে।এখনো ডাক্তার হোসনি যে,দেখেই সব বুঝে যাবি। আমার কিন্তু রাগ হবে।মধুর হাসি তাঁর মুখে অথচ কন্ঠে ছদ্ম উষ্মা।
আর ডাক্তার! পড়াশোনা এরকম চললে কম্পাউন্ডার ও হতে পারবো না দেখো।
এত মুখ চললে পড়াশোনা হবে কি করে বল?একই ভাবে বললেন অন্নপূর্ণা দেবী।
রিতিও হাসে,,,আমি শুধু মুখ চালাই না।হাত ও চলছে দেখো না।আর রাগ করবে বেশ কথা।এত হাসতে হবে ক্যানো হ্যা?মুখ রাখবে গম্ভীর।হি হি হি
নিজের চালাকি ধরা পরায় রিতিকে টেনে নেন নিজের কাছে। রিতির অগোছালো চুলে বিলি কেটে বলেন,,তুই ভালো করেই জানিস তোর সাথে রাগ করতে পারি না আমি, তাইতো দিনে দিনে এত খামখেয়ালি পনা দেখাচ্ছিস বল?
বড়োমার বুকে মাথা রেখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো রিতি।লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,,, খামখেয়ালি পনা তোমরা সবাই দেখিয়ে চলেছো তোমার ছেলের সাথে।তার ভুক্তভোগী হচ্ছি আমিও। ছেড়ে দাও না তার মতো করে। শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছো!তার যেথায় সুখ সেথায় যাক না?
সে যদি যেচে পরে কষ্ট পায় তো তার দ্বায় আমাদের নয়।রইলো বাকী তোর কথা?তুই এখানে আমার কাছে থাকবি। দরকার নেই আমার অমন ছেলের যেখানে যায় যাক।
গম্ভীর গলায় বলেন অন্নপূর্ণা দেবী।
রিতি অনুধাবন করে, আগের রাগটা ফেইক হলেও বড়োমার এই গাম্ভীর্য অভিনয় নয়।
নিজের ছেলেকে দূরে সরিয়ে অন্যের মেয়েকে কোলে টানছো ক্যানো বড়োমা? তুমি জানো না এক গাছের ছাল অন্য গাছে কখনোই লাগে না।আমি কি তোমাকে তোমার ছেলের মত ভালোবাসতে পারবো?
এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না ঠিকই কিন্তু এক গাছের কলম অন্য গাছে লেগে কত সুন্দর ফুল,ফলে ভরিয়ে দেয় দেখিস নি?
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রিতি। এদের বুঝিয়ে লাভ নেই।
****
আমির শেখের বৈঠক খানায় থমথমে পরিবেশ।পিনপতন নীরবতা যাকে বলে ।একটা মাছি পরার শব্দও নেই সেখানে।স্বয়ং প্রভাকর রায় চৌধুরীর পদধূলি পরেছে। চাট্টিখানি কথা নয়।নানা ধরনের ফল,ফলাদি এবং শুকনো খাবারের প্লেট ভর্তি করে রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে।একপাশে প্রভাকর রায় চৌধুরী বসে আছেন, পাশের চেয়ারে রঘুনাথ ।চোখ দুটো তার রক্ত জবার রং ধার করে এনেছে।রঘুনাথের ক্রুর দৃষ্টি ঘুরছে আমির শেখের আশে পাশের লোকজন এর প্রতি। সেখানে মুখ নিচু করে লিকু সরদার দাঁড়িয়ে।
টেবিলের অন্যপ্রান্তে আমির শেখ বসে আছে অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে।প্লেটের খাবার ছুঁয়েও দেখলেন না প্রভাকর রায় চৌধুরী। নিজের ভেতরের আভিজাত্য পূর্ণ সেই গমগমে সুর বের করলেন যে স্বরের ভয়ে শত্রু পক্ষের হৃদয় প্রকম্পিত হয়।যে সুরে হাজারো মানুষ তাদের আস্থা,ভরসা খুঁজে পায়।
কি হে আমির,,এত জরুরি তলব ক্যানো?সেধেই শত্রু পক্ষকে সাদর সম্ভাষণ?তা,, জরুরী কথাটা বলার জন্য তোমার আরো সময় চাই?আমি কিন্তু অত সময় দিতে পারবো না।
গলায় গম্ভীরতা থাকলেও ঠোঁটে সুদৃঢ় তাচ্ছিল্য ভরা হাসি হাসি।
আমির শেখ নড়ে চড়ে বসলো। নিজের সার্বক্ষণিক হাসি ঠোঁটের কোনে লেগেই আছে তার,,,
মি:রায় চৌধুরী, আপনি যে আমার আমন্ত্রণ রক্ষায় আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন তার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি।
ভ্রুদ্বয় মৃদু কুঞ্চন করে তাকালেন প্রভাকর রায় চৌধুরী,, ঠোঁটের হাসি অব্যহত রেখে বললেন,, তোমার আমন্ত্রণ রক্ষার্থে এসেছি কি না জানি না।তবে হ্যা নিজের স্বার্থ রক্ষায় মাঝে মধ্যে শত্রুর গুহায় প্রবেশ করতেই হয়।
***
আসবো রূপ? দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চায় অখিলেশ।
আমার রুমে প্রবেশ করতে তোর পারমিশন লাগবে?
আগে একবার এসেছিলাম, ফোনে কথা বলছিলি তাই বিরক্ত করিনি।বিরূপাক্ষের পাশে বসে অখিলেশ।
কি রে আপসেট লাগছে তোকে?কিছু কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো অখিলেশ।
নাহ! তেমন কিছু না।তিতলির সাথে কথা হলো।উদাস সুরে বলে বিরূপাক্ষ।
অখিলেশ যেনো নিভলো একটু।বিরূপাক্ষের প্রতি তিতলির একতরফা ভালোবাসার প্রতক্ষ্যদর্শী সে নিজেই।একসময় মনে হতো বিরূপাক্ষ ও বুঝি তিতলিকে ভালোবাসে।এমনকি বন্ধুমহলে বা কলেজ পাড়ায় কথাটা বেশ আড়ম্বরের সাথেই আলোচিত হতো। বিরূপাক্ষ হেসে উড়িয়ে দিলেও তিতলি সেই আলোচনা, সমালোচনা সাদর সম্ভাষণে কুড়িয়ে নিতো।
হ্যা!আমাকেও কল করেছিলো কিন্তু ধরতে পারিনি।কি হয়েছে বলতো? এখন ফোনে পাচ্ছি না। বললো অখিলেশ।
ওর আশির্বাদ হয়ে গিয়েছে কাল। সামনের মাসে বিয়ে।ছেলে আমেরিকা সেটেলড্।বৌকে সেখানেই নিয়ে যাবে।
এত সহজে রাজী হয়ে গেল তিতলি? অবাক হয় অখিলেশ।
কিছুক্ষণ আগে,,,
বনলতার সাথে কথা শেষ করেই দেখলো বিরূপাক্ষ তিতলির পনেরো টা মিসড্ কল।কলব্যাক করবে তখনি পুনরায় রিং বাজে।
হ্যা তিতলি বল ক্যামন আছিস?
যাক অবশেষে পেলাম তোকে!লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো তিতলি।
সরি রে।আমি কথা বলছিলাম। তারপর বল।বললো বিরূপাক্ষ।
রূপ গতকাল আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো।বয়স তো কম হলো না।বাড়ি থেকেও চাপ দিচ্ছে কি করবো বল?
বিরূপাক্ষের বুকের ভেতর ক্যামন যেনো খচ করে উঠলো। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সহাস্যে বললো,,, অভিনন্দন দোস্ত!এত ভালো একটা খবর তুই আজ দিচ্ছিস আমাকে?তোর তো শাস্তি পাওনা হয়ে গেলো রে!রেডি থাকিস।উচ্ছাস প্রকাশ করে বিরূপাক্ষ।
আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে রূপ!গলা ধরে আসে তিতলির।
বিরূপাক্ষের উচ্ছাসে ভাঁটার টান।ওপাশে তিতলির নাক টানার শব্দ।
তিতলি প্লিজ!তুই আমার সবকিছু জেনে বুঝেও একথা বলছিস?আমি হয়তো তোকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে উঠতে পারিনি।
বিরূপাক্ষের কোমল স্বরে ওপ্রান্তে ফোঁপানির আওয়াজ বাড়ে। কিছুক্ষণ কাটে মৌনতায়।
কি বুঝিনি বল?বুঝেছি বলেই নিজের এমন জীবন্ত মৃত্যু মেনে নিয়েছি। কখনো নিজের ভালোবাসার টানে আর আবেগের বশে যাতে তোর পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াই তার জন্য এই ব্যবস্থা।আমিও মানুষ রূপ।কখনো যদি সহ্য করতে না পেরে তোকে আবার চেয়ে বসি?এই ভয় থেকে বাঁচতে আজ শূন্য মনে অন্য একজনের ভবিষ্যত এর দাম্পত্য জীবন আঁধার করতে চলেছি।তারপরেও বলবি আমি বুঝিনি তোকে?
আমি মরলে কোথাও না কোথাও তুই অপরাধবোধে ভুগবি রে।নইলে আমার কষ্ট রাখার জায়গা নেই।কবেই জীবন থেকে মুক্তি নিতাম!কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে তিতলির।
তিতলি,,বাবু শোন আমার কথা প্লিজ!এমন করিস না।দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়।
রূপ এখনো সময় আছে।একটু ভাবলি না আমার কথা। এতকিছু জানিস বুঝিস।এত বুদ্ধি তোর। একবার ভাবলি না আমি যে তোকে ছাড়া রিক্ত,নিঃস্ব, শূন্য।কান্নায় ভেঙে পড়ে তিতলি। বিরূপাক্ষ নির্বাক।যেদিন কুয়াশা মোড়ানো হিমশীতল নিশিতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে বিরূপাক্ষকে প্রথম এবং শেষ বারের মত প্রেম নিবেদন করে বিনিময়ে প্রত্যাখ্যান পেয়েছিলো তিতলি সেদিনো এভাবে কাঁদেনি মেয়েটি।
বিরূপাক্ষ অপেক্ষা করে ক্ষনকাল।বুকটা তারও হু হু করে ওঠে।কিছু না হোক বন্ধু তো। ধাতস্থ হতে সময় দেয় তিতলিকে।মেয়েটা এতটাও দূর্বল নয় জানে সে। কিন্তু হৃদয় যেখানে ভেঙে চুরমার সেখানে মনের জোর থাকে কি করে?
শোন রূপ আমি তোর পিছু ছেড়েছি তোর ঐ জংলি লতাপাতার জন্য নয়।রিতি মেয়েটা খুব ভালো।ওকে তুই ঠকাস নে প্লিজ।যাকে চিনিস না,জানিস না তার জন্য এত দায়িত্ববোধ,এত দরদ তোর?আর যে রত্ন না চাইতেও পেয়েছিস তার এত অযত্ন অবহেলা করিসনা। আমার কথাটা একটু ভেবে দ্যাখ,ঠকবি না।ও মেয়ে তোর উপযুক্ত হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছে প্রাণপনে।মনটা তার মেরেই ফেলেছিস, কিন্তু পঁচতে দিস নে রূপ।
তিতলি থাক না এসব কথা। নিজেকে নিয়ে একটু ভাব এখন।বললো বিরূপাক্ষ।
ফোসকা পরলো তো।যা খুশি কর। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস,, তুই যদি ভালো না থাকিস,আমি কিন্তু নিজের আবেগ সামলাতে পারবো না বলে দিলাম।কি করবো নিজেও জানি না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল তিতলি।
লাইনটা কেটে দিলো তিতলি।
আমার মনে হয় তিতলি ঠিক বলেছে রূপ। তুই আরেকবার ভেবে দ্যাখ। নির্লিপ্ত গলায় বলে অখিলেশ।
তোরা সবাই মিলে বনলতার বিরুদ্ধাচরণ করছিস ক্যানো বলতো অখিল?আমি তোদের বন্ধু,,রিতি নয়।আমি যাকে নিয়ে ভালো থাকবো তোরা ও তাকেই চাইবি সেটাইতো স্বাভাবিক।
বিরূপাক্ষের গলায় বিরক্তির প্রকাশ টের পায় অখিলেশ।শুষ্ক হেসে বলে,,,সে তো অবশ্যই। কিন্তু আমার মনে হয়।তোকে কেউ ঘুরাচ্ছে।
প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি বিরূপাক্ষের,,
মানে কি ?
তুই বলিস মেয়েটা তোর গতিবিধি,নড়ন চড়ন সব লক্ষ্য করে,সব জানে।তার মানে সে তোর আশেপাশেই আছে তাহলে দেখা না দিয়ে কানামাছি খেলছে ক্যানো তোর সাথে?
বিরূপাক্ষের মসৃন ললাটের ভাঁজ লক্ষ্য করে পুনরায় বলে অখিলেশ,,দেখা করতে বল তোর বনলতাকে,আজ নয়তো কাল।দেখে নে একবার আসলেই কি সে তোর সেই বনলতা নাকি বনলতার অন্তরালে অন্য কেউ?
অখিলেশ এর কথাগুলো মনে ধরে বিরূপাক্ষের। মুখমণ্ডল ঝলমল করে উঠল কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। পুনরায় ভ্রুদয় কুঁচকে বলে,, কিন্তু আমি তাকে অবিশ্বাস বা সন্দেহ কোনোটাই করতে চাই না।সে দেখা করতে রাজি হয়েছে তো।
******
তুমি ভাবলে কি করে তোমার এই অন্যায় প্রস্তাবের সমর্থন করবে প্রভাকর রায় চৌধুরী। নিজের অতীত ভুলো না বাচ্চা। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এখনো রাজাকারদের লিষ্টে তোমার বাবা, দাদার নাম পাওয়া যাবে তা ভুলো না। কঠিন কন্ঠঝংকার প্রভাকর রায় চৌধুরীর।
আমির শেখ থমথমে মুখে বসে আছে বুকের উপর দুহাত বন্ধন করে।
আজ তুমি দু’পয়সার মালিক হয়েছো ঠিকই কিন্তু ভুলে যাও ক্যানো তোমার বাপ আমার জমিতে কামলা খেটেছে একসময়।সেটা বেশি দূরের কথা কথা নয়। ভুলে গিয়েছো তুমি?একটা কথা শুনে রাখো,,, ময়ূর পুচ্ছ পরলেই কাক কখনো ময়ূর হয়না। তোমাকে জনগণ চায় না সেটা বোঝো না।আর আমি তাদের উপর তোমার বোঝা চাপিয়ে দেবো তেমন রাজনীতি আমি করি না। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে প্রভাকর রায় চৌধুরীর ঠোঁটে।পাশে বসে রঘুনাথ নিজের গোঁফে তা দিয়ে ফিচেল হাসে।
নিজের কর্মচারী এবং দেহরক্ষীদের সম্মুখে এমন অপমান আমির শেখকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো মুহূর্তেই।এত এত অপমান সে ভাবতেও পারেনি।বুক থেকে হাত দুটো আগেই টেবিলের নিচে চলে গিয়েছে।সে দুটো দেখলে যে কেউ একটা একটা করে শিরা উপশিরা গুলো গুনে বের করে দিতে পারতো। চোখদুটো দিয়ে যেনো ইটের ভাটার চুল্লী জ্বলছে।
তাহলে আমির,,আশা করি উত্তর পেয়ে গ্যাছো? তুমি বুদ্ধিমান ছেলে,ম্যাট্রিকে তিনবার ফেল করলেও ব্রেইন তোমার খুব শার্প ,এর চেয়ে বেশি নিশ্চয় বুঝাতে হবে না?আর একটা কথা,,, আগুন ভাটাতেই সীমাবদ্ধ রাখবে। নাহলে শেষে অকাল অন্ধ হয়ে যাবে।
আর কালবিলম্ব না করে নিজের দু চারজন অনুসারীদের নিয়ে প্রস্থান করেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।
এখানে আমির শেখ শুধু এবারের নির্বাচনে তাকে সাপোর্ট করার প্রস্তাব রেখেছিল প্রভাকর রায় চৌধুরীকে।এই সামান্য প্রস্তাবে এমন অসামান্য অপমান পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি।
প্রচন্ড ক্রোধে গর্জে ওঠে আমির শেখ।তখনি পুনরায় প্রবেশ করে রঘুনাথ।সেই পুরোনো হিংস্র নজরে কক্ষের সবাইকে প্রতক্ষ্য করে একবার।সেই টেবিলের উপর দুহাত ভর দিয়ে উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,, আমির শেখ,, তোমার চেলা চামুন্ডা গুলো কে একটু সামলে চলতে বলো।না হলে ইলেকশন অব্দি অপেক্ষা করতে পারবো না আমি।তার আগেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে তোমার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। নিজের দেহের ব্যাথা নিশ্চই মিলিয়ে যায়নি এখনো।
দরজার দিকে পা বাড়িয়ে পুনরায় ফিরে তাকালো,,আর একটা কথা,, আমার ভাইয়ের দিকে ফের যদি কেউ শকুনের নজর দেয় তো মা সিংহ বাহিনীর দিব্যি,,তাকে আমি শকুনের আহার বানিয়ে তবে শান্ত হবো।মনে রেখো কথাটা।
কিছু মনে করবো ক্যানো বল। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবি না।বললো বিরূপাক্ষ।
যাক তাহলে। শুনে খুশি হলাম।
আচ্ছা চল ছাদে যাই। শিশির মেশানো হাওয়ায় গায়ে মেখে সিক্ত হয়ে আসি।দাহ তো তোরও কম নয়। রসিকতার আভাস বিরূপাক্ষের কন্ঠে। অখিলেশ সেটা গায়ে মাখলো না। বললো অনুরুপ রসিকতায়,,,
আমার সাথে সিক্ত হয়ে লাভ কি তোর?শুধু শীতলই হবি, উষ্ণ যে করতে পারে তাকে নিয়েই না হয় যা।ডেকে দেই?
ঠান্ডা বেশ ভালোই পরবে এবছর।দাদুভাইয়ের জন্য কিছু গরম কাপড় আনিস তো নিরু। বিছানায় কম্বল পেতে দিয়ে বললেন অনিতা দেবী।
ল্যাপটপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই উত্তর দেয় নিরু,,হ্যা মা। তোমারও তো লাগবে।
বিকেলে অখিলেশ এসেছিলো। বেশকিছু সময় থেকে চলে গেল। দাদুভাই তো ওকে ছাড়তেই চাইছিল না। ছেলেটাকে দেখলে চোখের জল বাঁধ মানে না আমার।আদ্র স্বর অনিতা দেবীর।
কিবোর্ডের উপর নিরুপমার আঙুল থামে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।নাহ্ আজ আর কাজ হবে না।দফারফা শেষ।
বাবুকে একটু সামলে রেখো মা।ওকে পেলেই এভাবে বিরক্ত করে।কি জানি কি হয়তো বিরক্ত হয় মুখে বলতে পারে না।যে চাপা স্বভাবের মানুষ। অস্ফুটে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিরু।
আমার তো তা মনে হয়না বাপু।যতক্ষন থাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে লেপ্টে রাখে।
তবুও মা,, অদ্রিকার অভ্যেস হয়ে গেলে বিপদ হবে।পরে সামলাতে পারবে না। বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পাবে।প্রয়োজনে একটু শাসন করলেই পারো।
সে তুমি করো মা,, অতটুকু মেয়েকে ধমকে কোন লাভ আছে?এতবড়ো বুঝবান মেয়েকেই বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না আজও।যে মেয়ে জন্ম থেকে আজ অবধি বাপ কি জিনিস,দেখতে কেমন হয় বুঝলো না,সে তো স্নেহ পেলেই ঝুঁকবে তাকে আমি রুখতে পারি না।আর রক্তের টান বলেও তো একটা ব্যপার আছে।
নিজের কথায় নিজেই সচকিত হন অনিতা দেবী।
নিরুপমা অসহায়ের মতো উচ্চ স্বরে বলে,,
আহ্ মা একটু চুপ করো না তুমি?এভাবে খুঁচিয়ে কি লাভ পাও শুনি? আমি তো পাথর নই, মানুষ।কটা দিন সময় দাও,এই ঠিকানা ছাড়ছি আমি।
নিরু বেরিয়ে আসে রুম থেকে,,অনিতা দেবী অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।দু ফোঁটা জল গড়ায় তাঁর চোখ ফেটে,,আজও রাতে খাবে না মেয়েটা।এভাবে কি মানুষ বাঁচে?যা করার আমিই করবো মা।তোর কষ্টগুলো আমি বেচেই দেবো দেখিস এবার। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে চোখের জল মুছে নেন অনিতা দেবী।
*****
রাতে খাওয়ার পর ছাদে গিয়েছিলো বিরূপাক্ষ।বনলতার সাথে কয়েকমিনিট ফোনালাপ সেরে ঠান্ডার কাছে পরাজয় স্বীকার করে সবে নেমেছে দোতলায়। হঠাৎ হাসির রোল কানে আসতেই ঘুরে তাকায়।বাবা, মায়ের রুমের সামনের করিডোরে পশ্চিমমুখী হয়ে ফোনে কথা বলছে রিতি।হাসির তালে শরীর দুলছে লাউ লতার মতো।বিরূপাক্ষের গা জ্বলে ওঠে অমন হাসির বহর দেখে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসতেই আগ্রহ বাড়ে আরো ভালো করে শোনার। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার পশ্চিম দিকে।
শরীর হীম হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিরু।পাতলা শাল খানি কখন যেনো সরে গেছে গা থেকে বুঝতেই পারে নি।ভালো করে জরিয়ে নেয় সেটা। সামনের এক টুকরো উঠোনের শেষ প্রান্তে একটা বহু পুরোনো বকুল গাছ।বলতে গেলে এবাড়ি থেকে বেরোনোর পথের শুরুতেই গাছটা।হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি গাছের ওপাশে দেখে চমকে ওঠে নিরু।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার শেষ সীমানায়।ভয়,আশঙ্খা এবং কৌতুহল মিলে যেনো উত্তেজনা বাড়তে থাকে।না মূর্তিটি নড়ছে না আর।ঘড়ের সামনে জ্বলে থাকা আলোয় ছায়াটা খুব ভালো দেখা যাচ্ছে।ছায়াটা যে পুরুষ মানুষের তা বুঝতেই গায়ে কাঁটা দিলো নিরুর। অঘটনের ভয়ে নাকের নিচে ঘাম জমতে শুরু করেছে রিতিমত।গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইছে না অথচ পা দুটো চলছেই। দেখতেই হবে কে এই এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে?কি তার অভিসন্ধি?
আরে রাহুল বাবু উদ্দেশ্য যদি দৃঢ় হয় তাহলে সফলতা আসবেই।এত চিন্তা ক্যানো করছেন? সবকিছু ঠিকঠাক হবে দেখবেন।আজ জ্যাঠা বাবুর কাছ থেকে সই সাক্ষর নিয়ে কাজ কিছুটা এগিয়ে নেবো আর রইলো বাকী বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী।সেটাও হবে একটু সবুর করুন আর বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।আমরা সব কিছু পাল্টে নতুন করে যাত্রা শুরু করবো।
রিতির এহেনো কথায় বিরূপাক্ষের পা থমকে যায়।তবে কি সত্যিই তাদের সম্পত্তির লোভে রিতি এখানে পরে আছে?এবাড়ির কাউকে ভালোবেসে পরে নেই এখানে। স্বামীর ঘড়ে দাঁড়িয়ে প্রেমিকের সাথে ভবিষ্যত পরিকল্পনা? দারুন!
বিরূপাক্ষ রিতির কাছ ঘেঁষার আগেই দরজার ভারী পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রিতি। বিমূঢ় এর মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিরূপাক্ষ। এলোমেলো চিন্তা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।সেকি এগিয়ে গিয়ে আটকাবে এই দূর্মতি নারীকে। বাবার মতো বিচক্ষণ মানুষ ও কি এর ছলাকলা কিছুই ধরতে পারছে না?মা তো নাহয় স্নেহে অন্ধ। বিরূপাক্ষ আর ভাবতে পারে না,প্রবল রোষে এগিয়ে যায় পিতার শয়ন গৃহাভিমুখে।একে রুখতেই হবে,,প্রয়োজনে পিতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে এই লোভী মেয়েটার অকাজ গুলো। কিন্তু বুকের ভেতর এত তোলপাড় চলছে করানো?আর কিসের এত ধুকপুকানি?সেতো চায়ই রিতি এখান থেকে বিদায় হোক যেনোতেনো প্রকারে।তবে মনের মাঝে খুশির ফোয়ারার বদলে দুঃখের আগুন ক্যানো জ্বলছে তার?
শব্দ হীন পায়ে হালকা আলো আঁধারির মাঝে এগিয়ে বকুল গাছটির কাছে যেতেই পেছন থেকে অত্যন্ত রুক্ষ কঠিন হাতে কেউ একজন মুখ চেপে ধরেছে সজোরে ,সাথে নাকেও হালকা চাপ পরতেই চোখে ফোঁটে মৃত্যুর ভয়।এই বুঝি খেলা সাঙ্গ হলো তার।ঘ্রানেন্দ্রীয় সংকুচিত হয়ে আসে নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধে।এমন জীবন মরনের মাঝামাঝি থেকেও গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে নিরুপমার। নিকোটিনের গন্ধে ওর বমি পায় সবদিনই। এতকিছুর পরেও নিরু উপলব্ধি করতে পারে,,শত্রু তাকে একহাতে বেষ্টিত করে অন্য হাতে মুখ চেপে ধরে আছে শুধু।বাজে কোন ছোঁয়া নেই কিন্তু কোমলতা আছে অনেক খানি।স্বস্তিতে চোখ বোজে,যাক,, বেঘোরে প্রাণটা গেলেও সম্ভ্রমটুকু হয়তো বাঁচবে।সেই একটাই আরাধ্য পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ তাকে ছুঁয়েছে ভাবলেই গা ঘিন ঘিন করে ওঠে ঘৃনায়,,,,, কিন্তু এ ছোঁয়ায় ঘিনঘিনে কোন অনুভূতি নেই ক্যানো?হয়তো মৃত্যুর কাছাকাছি বলেই,,,,
চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।