উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩২
কলমে:চন্দ্রা
এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিষধর সর্পের মতো বিষাক্ত কিন্তু সাপের সাথে তাদের পার্থক্য একটাই সাপকে তার ফণায় হাত বুলিয়ে কখনো ও বশে আনা যায় না অথচ এইধরনের মানুষদের সাথে ভালো কথা বলে, সুন্দর আচরণ করে তাদের তালে তাল মেলালে দারুন বশ্যতা স্বীকার করে। আমির শেখ খানিকটা এই চরিত্রধারী মানুষ।
ভালোর ভালো,আর মন্দের যম।সকালের সেই অপমান এখনো হজম করতে পারেনি সে। সারাদিনে একফোঁটা দানা দাঁতে কাটেনি একফোঁটা জল মুখে স্পর্শ করেনি । অনুগত ভৃত্য এবং সহোচরেরা সব ভয়ে সিঁটিয়ে আছে,,এই বুঝি তাদের মধ্যের কারো প্রাণটা হ্যাচকা টানে কেড়ে নিলো ক্রোধউন্মত্ত প্রভুটি।
আসলাম এসে দাঁড়ায় আমির শেখের পাশে। সার্বক্ষণিক সঙ্গী সে।মাথা নুইয়ে ডাকলো মৃদু স্বরে,,,ভাই।এমন করে না থেকে কিছু একটা বলেন। একবার শুধু আদেশ করেন কি করতে হবে? নিজের জান বাজি রাখবো ভাই।
আমির শেখের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না আসলামের কথায়। চোখ বুজে পরেই রইল ইজি চেয়ারে।
ভাই ভাবি সাহেবা খুব চিন্তায় আছেন। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান ভাই। আসছিলেন একবার আমি ফিরায় দিয়েছি উনাকে।
লিকু সরদারকে খবর দাও আসলাম। জরুরী মিটিং ডাকো।ঢাকার নেটওয়ার্ক কাজে লাগাও। কিন্তু নিজে কিছু কইরো না।চোখ বন্ধ রেখেই নিচু কন্ঠে বললো আমির শেখ।
আসলাম মনে মনে শঙ্কিত হয়ে পরে।সে জানতো এমন কিছুই হয়তো ঘটবে,,
ভাই লিকু ভাই বাইরেই আছে।ডাকবো তারে?
হুম ডাকো। ওহ্ দাঁড়াও আগে বিবিজানের সাথে দেখা কইরে আসি। তিনি নাকি পেরেশানি তে আছেন।আগে ঘড় ঠিক করি,পরে দেখবো পর।
আসলাম সরে দাঁড়ায়।আমির শেখ মন্থর গতিতে হেঁটে যায় অন্দর মহলের দিকে।
আসলাম সেদিকে তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। রক্তের খেলায় মত্ত হতে চলেছে তার প্রিয় আমির ভাই। কিন্তু রক্ত ঝরবে কতজনের আর বুক খালি হবে কোন মায়ের তার হদিস জানে না সে।
*****
রাতের সাথে বাড়ছে কুয়াশার স্রোত আর তর তর করে বেড়ে চলেছে শীত। বকুল গাছটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে দুই মানব মানবী।কথা বার্তায় মনে হবে,নিত্য তাদের এই অভিসার।
বহুকাল ধরে যেনো চলে আসছে এমন কুয়াশাস্নান। মাটিতেই লেপ্টে বসে আছে দুজন।
যখন প্রচন্ড মৃত্যু ভয়ে দুচোখের জল ছেড়ে দিয়েছিলো নিরুপমা তখনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে দুটি অক্ষরের একটা ফিসফিসানি শব্দ,,,নি…রু।নিরুপমা চোখের পাতা গুলো জোরে চেপে রাখে সেই ডাকটা শুনে।চোখ খুললেই বোধহয় এই মোহময় স্বর উধাও হবে। মুখের উপর চেপে রাখা হাতটা ততক্ষণে শিথিল হয়েছে।ঐভাবেই ঢলে পরে মানুষটার বুকের উপর।ভাবে মনে মনে,,এমন সৌভাগ্য আমার নয় গো,, তোমার বুকের উপর মৃত্যু সে তো শত শত জনমের পূণ্যির প্রয়োজন।অতটা আমি কোথায় পাবো?
অখিলেশ অস্থির হয়ে নিরুপমার মুখে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে ডাকে,,এই নিরু! নিরুপমা,, শরীর খারাপ করছে তোমার ?কি হয়েছে বলো আমাকে?নিরু আস্তে ধীরে চোখ খোলে মানুষটার যে ভীষণ তাড়া সবকিছুতেই।একটু অসুস্থ হওয়ার ভান ধরে বুকে পরে থাকবে সে সুযোগ ও দিতে চায়না আজ। ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ায় নিরু।
আসলে আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমার বারান্দায় আলো জলছে তাই,,, কৈফিয়ত দিতে বললো অখিলেশ।নিরু নির্বিকার।
আমি কি জানতে চেয়েছি ক্যানো এসেছো?
না মানে,,,মুখে আঁধার নামে অখিলেশের।
তোমার হাতের নিকোটিনের দুর্গন্ধ খুব লেগেছে আমার। শ্বাস তো প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।মারতে চাও আমায়?
অখিলেশ সন্তোর্পনে সরে বসে।নিরু অনুধাবন করে শুষ্ক হাসে।সে একটু এগিয়ে বসে গা ঘেঁষে। হঠাৎ হাত বাড়ায় অখিলেশ এর বুকের দিকে। অনুসন্ধান চলে কিছু একটার। অখিলেশ অবাক হয় না একটুও।কারন নিরু তো এমনই নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিস নিজেই খুঁজে নিয়ে হাসিল করতে জানে। ভিখারির মতো হাত পেতে বা চেয়ে নেওয়া তার নীতি বিরুদ্ধ।
****
নিজের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিরূপাক্ষ।রাগে দুঃখে চোখ দুটো জলছে তার। পাশেই ফোনটা ভাইব্রেশন হচ্ছে।কল করেছে বনলতা কিন্তু বিরূপাক্ষ এখন কথা বলার মতো অবস্থাতে আছে বলে মনে হয়না।তার পিতা কি করে পারলো অন্য বাড়ির একটা লোভী,চতুর মেয়ের সামনে নিজের ছেলেকে অপমান করতে,,
কিছুক্ষণ আগে রিতি অন্নপূর্ণা দেবীর ঘড়ে প্রবেশ করতেই ক্ষনকাল বিলম্ব না করে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পরে সে।গিয়ে দেখলো রিতি বসে আছে বাবার সামনে আর তার হাতে যে নীল রঙের ফাইলটা ছিলো সেটা বাবার হাতে। তিনি সাইন করছেন হাসি মুখে। বিরূপাক্ষ দ্রুত হাতে টেনে নেয় সেটা। ছেলের এমন অনাহুত কর্মে প্রভাকর রায় চৌধুরী বিস্মিত হলেন খানিক,রাগ হলো তারচেয়ে বেশি।তথাপি তিনি শান্ত স্বরে বললেন,,,এটা কি হলো?
বিরূপাক্ষ বাবার অগ্নিচক্ষুর তোয়াক্কা না করে নিজের অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিতির দিকে।রিতি তার দিকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বিরূপাক্ষ তাকাতেই রিতি চোখ নামিয়ে নেয়,,,
বাবা তুমি কি জানো এটা কিসে সাইন করছো?এই মেয়েটা তার ছলাকলায় তোমাদের ভুলিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে আর তোমরা তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করছো?
প্রভাকর রায় চৌধুরী আর স্থির থাকতে পারেন না। উচ্চ স্বরে বলে ওঠেন,,,চুপ করো বেয়াদ্দব ছেলে, নিজের বাক্য সংযত করতে শেখো।এই তোমার উচ্চ শিক্ষার ধরন?এই তুমি মানুষ হয়েছো?কার সামনে কাকে কি বলতে হয় সেটাও শেখোনি?
নিজের অপমানে বিরূপাক্ষ জ্বলে ওঠে বারুদের মতো,,
বাবা আমাকে নিয়ে এত কিছু না বলে আগে তোমাদের বিশ্বস্ত জোচ্চোর মেয়েটার খবর নাও।ক্যানো সে সপ্তাহে তিন দিন শহরে যায়? সারাদিন কি এত কাজ শহরে তার।আর নিহার আঙ্কেলের ছেলে রাহুলের সাথে কিসের এত হাসাহাসির সম্পর্ক তার,,,
থামো অসভ্য ছেলে। নিজের বৌয়ের খবর তুমি বাপের কাছ থেকে নিতে এসেছো?এতই যখন গোয়েন্দাগিরি করো তো নিজে ক্যানো খবর নাও না তোমার ঘড়ের বৌ কোথায় কি করে বেড়ায়? একটা মেয়ের সম্মন্ধে কি ভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানো না তুমি?আর একটা কথা বললে তোমাকে থাপড়ে সিধে করবো আমি।
উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।রিতি অসহায়ের মতো দরজার দিকে তাকায়,মনে মনে প্রার্থনা,বড়োমা এসে থামিয়ে দিক এই প্রলয়।
ছেলে পুনরায় মুখ খুলতে যেতেই বাবা থাপ্পর দিতে উদ্যত হন,,রিতি উঠে হাত ধরে থামায় তাঁকে,,মিনতি করে অশ্রুসজল চোখে,,
জেঠু একটু শান্ত হও।এমন করলে শরীর খারাপ করবে তোমার?
রিতির কথা বিরূপাক্ষের ক্রোধের অগ্নিতে ঘি ঢাললো যেনো,,,তেড়ে আসে রিতির দিকে,,
এই অসভ্য মেয়ে ,,, তুই আমাদের বাবা ছেলের মধ্যে কথা বলিস কোন সাহসে? থাপ্পর দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেবো একদম।
অন্নপূর্ণা দেবী চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে ঘড়ে ঢুকলেন,,বিরূপাক্ষের কথাগুলো শুনে গিয়ে রিতিকে ধরেন।সে নড়ছে না একটুও।শুধু চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরছে অশ্রু হয়ে। অন্নপূর্ণা দেবীর সকল আশা নিভিয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে এই ছেলে।
বাবা, মায়ের কথা, বংশের মানসম্মান এর কথা যে ছেলে ভাবে না।সে কখনোই সুপুত্র নয়। তোমার মতো একটা ছেলে না হয়ে এই মেয়েটার মতো একটা মেয়ে যদি তোমার মায়ের গর্ভে জন্ম নিতো তাহলে আমরা বেশি গর্ববোধ করতাম। বেরিয়ে যেতে হয় তুমি যাও এ বাড়ি থেকে,,,ও যাবে না কোথাও।
বিরূপাক্ষ হাতের ফাইলটি ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসে ও ঘড় থেকে। ভীষণ রোষানলে পুড়তে থাকে।মা বাবার জীবনে ওর প্রয়োজন নেই।ভাবতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
আসলে কি তাই?নাকি রিতির সাথে অন্যকারো হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি কল্পনা করে তার এ অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে?রিতির সুখের সাগরে অন্যকারো ডুব সাঁতার কল্পনা করে এ দগ্ধতার সৃষ্টি হয়?
কিন্তু এই রকম নির্বোধ জাতীয় কিছু লোক বুঝতেই চায়না নিজে অন্য মেয়ের সাথে হেসে হেসে পার করে দিতে পারে সারাদিন,স্বপ্ন দেখতে পারে সংসারের অথচ বৌ অন্য কারো সাথে হেসে কথা বললেও গাত্রদাহ হয়। কিন্তু ক্যানো?ব্যাথা কি তাদের নেই?জলুনী কি তাদের হয়না?
দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠে দাঁড়ায় বিরূপাক্ষ ফোনটা নিয়ে কল করে একটা জায়গায়। কিছুতেই এই অপমান ভুলবে না সে।যার জন্য নিজের মা, বাবার কাছে আজ এতটা ঘৃণার পাত্র হতে হলো তাকে শেষ না করে ক্ষান্ত হবে না সে।এ বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে কোনো নাম নিশানা থাকলে চলবে না ঐ মেয়ের।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বিরূপাক্ষ।
এভাবে কি খুঁজছো,,আমাকে বলো?
নিরুপমা হাত থামিয়ে বলে,,, অনেকদিনের অব্যবহারে জায়গা টা কি আমার অচেনা হয়ে গেলো অখিল?নাকি অন্য কারো ব্যবহৃত হওয়ায় আমার আয়ত্বে নেই?
অখিলেশ নিরুপমার বা হাতটা নিজের বুকেই চেপে ধরে বললো মৃদু হেসে,,, তোমার অপছন্দের জিনিস খুঁজলে কি এখানে পাবে?
অখিলেশ ডান হাতে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিরুপমার হাতে দেয়,,
এটাই খুঁজছো তো?নাও।
নাহ্।তুমিই একটা ধরিয়ে নাও। তোমার এখন প্রয়োজন তাই নয় কি?
অখিলেশ আরেক দফা অবাক হয়,,সে ভেবেছিলো নিরু বোধহয় এগুলো নিয়ে ফেলে দিয়ে বলবে,,আর কখনো খাবে না। আমার গন্ধ সহ্য হয়না।
কিন্তু না,অখিলেশের ভালো মন্দে এখন আর নিরুর কিছু যায় আসে না।নিরুর অলক্ষ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অখিলেশ।
ভাবলেশহীন ভাবে বলে প্যাকেটটা যথাস্থানে চালান করে দিয়ে বলে,,
থাক,লাগবে না। তোমার সহ্য হবে না।
নিরু হাসে রুক্ষ হাসি। গাছের পাশ দিয়ে একচিলতে আলো এসে পরেছে তার মুখে।সেই আলোয় অখিলেশ লক্ষ্য করে করে নিরুর হাসি।ভেবে পায়না এই রস, কষ,বর্ন, গন্ধহীন হাসির কারণ,,,
আমার তো কতকিছুই সহ্য হয়না অখিল,, কিন্তু মানিয়ে নিতে না পারলে ও মেনে তো নেই।এই যেমন,, তোমার মুখে সেই অগোছালো দাঁড়ি, মাথায় আলুথালু রুক্ষ চুলের বাহার,, সিগারেটের আগুনে পোড়ানো কালো হয়ে যাওয়া আমার প্রিয় লালচে আভাযুক্ত ঠোঁট দুখানি। সবচেয়ে বড়ো কথা যে দুর্গন্ধের ভয়ে আমি কখনো পাবলিক বাসে উঠতেই পারতাম না।সেই নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধ এখন তোমার গায়ের আমাকে পাগল করা ঘ্রানটাও গ্রাস করে নিয়েছে।
অখিলেশ শোনে শুধু,, উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না,, উত্তর তো তার সাজানোই আছে।যার জন্য এত পরিপাট্য ছিলো একসময় সেই যখন নেই তাহলে পরিপাট্য ধুয়ে কি জল খাবে?
রাগও হয় মনে মনে,,মেয়ে জাতটাই অন্যরকম বোধহয়,,যে পাত্রে যায় সেখানকার আকার ধারণ করে। স্বামীর সোহাগের চিহ্ন বয়ে বেড়াবে অথচ,,প্রেমিকের স্মৃতি রোমন্থন বন্ধ করবে না।
যাক সে কথা,,বিয়ে ক্যানো করোনি?বয়সটা তো বসে নেই?
কে বললো বিয়ে করিনি?অবাক হওয়ার ভান করে অখিলেশ।
নিরুর ভেতর মুচড়ে ওঠে।কি এক ভোঁতা গভীর যন্ত্রণায় বুকটা টনটন করে উঠলো মুহুর্তেই। নিজেকে সামলে নিলো আপন মহিমায়,,,ফ্যাকাসে কন্ঠে বললো,, কিন্তু সেদিন মা যে বললো,,,নিরুর বুকে আশার আলোর সলতেটা শেষ হয়নি এখনো, শুধু তেল ফুরিয়েছে।একটু তেল ঢাললেই আবার মোলায়েম আলোয় আলোকিত হবে চারপাশটা।দৃঢ় বিশ্বাস তার,আর যাই হোক অখিলেশ মিথ্যা বলবে না।
বলেছিলাম বুঝি?মনে নেই তো।বাদ দাও।একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
হুম।
অদ্রিকার বাবা মানে তোমার হাজব্যান্ড,তিনি কি আছেন?আমতা আমতা করে বলে অখিলেশ
নিরুর চোখ জলে ওঠে,,, কিন্তু কিছু বলে না।
সেদিন মামনি বললো,,ও নাকি ওর বাবাকে দেখেনি কখনো! তুমি ও শাঁখা সিঁদুর পরো না। তিনি কি বেঁচে নেই?
বালাইসাঁট,,,,এমন কু লক্ষ্যুনে কথা মুখে এনো না,,, তিনি বেঁচে আছেন। আমার সন্তানের পিতা সে। তাঁর হাতের সিঁদুর কপালে জোটেনি আমার তাই তো পরিনা। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন, ভালো থাকবেন। আমাদের সাথে হয়তো নেই কিন্তু তিনি যে আছেন এইটুকুই শান্তি। উত্তেজিত হয়ে পরে নিরু।
অখিলেশের নিজ মুখনিঃসৃত দুরবাক্যের জন্য নিজেরই অনুশোচনা হয়,, নিরুপমার হাত দুটো ধরে জোর করে,, কাঁপছে নিরু,,
আমি ক্ষমা চাইছি নিরু। আমার এভাবে বলা উচিত হয়নি।প্লিজ শান্ত হও।প্লিজ!
নিরু লম্বা করে শ্বাস নেয়।অনেকটা স্থির এখন,,অখিলেশের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। অখিলেশ বসে থাকে আধোমুখে,,এত বয়স হলো এখনো সঠিক জায়গায় সঠিক বাক্যের প্রয়োগ শিখলো না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জিত। কিন্তু একটা ব্যাপার খুবই বুকে বাজে তার,যে স্বামী, স্ত্রী সন্তানের খবর নেয়না সেই স্বামীর প্রতি এখনো কতো টান নিরুপমার অথচ একদিন তাকেই নিরু চোখে হারাতো।কিই না করেছিলো তাকে পাওয়ার জন্য।
অনেক রাত হয়েছে,তুমি এখন যাও প্লিজ,, স্কুলের নাইট গার্ড মাঝে মধ্যে এদিকে আসেন, আমাদের এখানে এভাবে দেখলে খারাপ ভাববে।নিরুর কন্ঠের রুক্ষতায় চমকে ওঠে অখিল। দুঃখ ভালো করেই দিয়েছে নিজের অজান্তেই। কিন্তু নিরুপায় সে।নিরুর চোখের জল দৃষ্টি এড়ায়নি তার।উঠে দাঁড়িয়ে বলে,, আচ্ছা যাও ভালো থেকো।নিরু উল্টো ঘুরে দ্রুত পা বাড়ায়,, অখিলেশ নিজের দুঃখের সঙ্গী সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা ধরিয়ে লম্বা টান দিতেই ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে নিরু,অখিলেশের মুখ থেকে জলন্ত সিগারেট টা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। ঘটনার আকস্মিকতায় অখিলেশ বিস্মিত।
খবরদার আর কখনো এসব মুখে নিয়েছো তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।অন্যকে জ্বালিয়ে সুখ হয়নি তোমার? নিজের দেহ জ্বালাতে হবে?বোবা কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে নিরুপমার।
সেই পুরোনো ঝাঁঝালো মেজাজের নিরু ফিরে এসেছে। অখিলেশের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি নিরুপমার ঠোঁট দুটো কাঁপছে কান্নার তোড়ে।
আচমকা দুহাতে নিরুকে টেনে নিয়ে ওর প্রকম্পিত ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠগত করে নেয় অখিলেশ। কিছু মুহূর্ত চলে দীর্ঘ চুম্বন।সেই বহুদিনের বহু কাঙ্ক্ষিত সুখ যেনো ফিরে এসে জুড়ে বসেছে আবার।
নিরু দৌড়ে চলে গিয়েছে নিজের ঘড়ে। অখিলেশ দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে তাকিয়ে। সিগারেটের টুকরোটা তখনো জ্বলছে।সে হাঁটু গেড়ে বসে জলন্ত সিগারেটের টুকরোটা হাতে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়।একটা টান দিয়ে অবহেলায় ধোঁয়াটুকু মুখ মুক্ত করে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,বন্ধু ঐ নেশার কাছে তোর নেশা কিছুই না।রাগ করিস না প্লিজ। দূরে ছুড়ে ফেলে হাঁটতে শুরু করে গন্তব্যের দিকে। বহুকাল পরে এমন শান্তির পরশ মেলেনি তার।
*****
সকালের ঝরঝরে আলোয় আলোকিত চারপাশ। নিত্যদিনের মতো প্রজ্জ্বলিত ধুপকাটির সুগন্ধিতে ঘুম ভাঙল বিরূপাক্ষের।সাথে আবছা আবছা প্রভাতী সংগীত ভেসে আসছে মন্দির থেকে।রিতির এই সুর খুব মনোযোগ সহকারে শোনে বিরূপাক্ষ।আজো তার অন্যথা হলো না।গত রাতের সেই সর্বনাশা ক্রোধটা খানিক প্রশমিত হয়েছে কিন্তু একেবারে মিলিয়ে যায়নি।নিজ প্রতিজ্ঞার কথা বিস্তৃত হয়নি সে। কিন্তু আজ কোনো কোন্দল করবে না রিতির সাথে।রিতির উপর রাগ তার দীর্ঘস্থায়ী হয়না।কারন অজানা। অনেক রাতে বনলতার সাথে কথা হয়েছে। আগামীকাল দেখা করবে বনলতা। ভাবতেই দেহের ভেতর ক্যামন একটা ভালোলাগার শীতলতম স্রোত বয়ে চলেছে।যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো সেই সুন্দর বনের কাছেই একটা দর্শনীয় স্থানে দেখা করবে বনলতা। বিরূপাক্ষ ফুরফুরে মেজাজে ব্রেকফাস্ট করে সবার সাথেই। গতকালের ঘটনার পরেও এমন নির্লিপ্ত ভাব ভীষণ ভাবায় রিতিকে। বিরূপাক্ষ রিতির দিকে একপলক তাকিয়ে ক্রুর হাসে মনে মনে,,,ভাবে,,
বনলতার সাথে দেখা করে আসার পথেই তোর ব্যবস্থাটা পাকাপোক্ত করে আসবো,আর মাত্র দুটো দিন এ বাড়ির খাবার খা আয়েশ মিটিয়ে।
খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললো বিরূপাক্ষ রিতির উদ্দেশ্যে,,রিতি আমার জন্য কফি নিয়ে আয় তো।
আছ বেশ কয়েকদিন পরে বিরূপাক্ষ রিতির সাথে কথা বললো স্বাভাবিক ভাবেই।
রিতি অবাক হয়ে যায় এমন আহ্বান শুনে। প্রভাকর চৌধুরীর মুখটা কিন্তু থমথমে। তিনি নিজের ঔরষজাত সন্তানের বৈশিষ্ট্য খুব ভালো ভাবে জানেন আর এটাও জানেন গতরাতে তিনি যে কঠিন ব্যবহার করেছেন বিরূপাক্ষের সাথে,তার ফল ভুগতে হবে এই মেয়েটাকে।
রিতির স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে তাই নিজের খাওয়াটা শেষ না করেই উঠে পরলো।কফি বানিয়ে নিয়ে দ্রুত পদে চলে গেলো বিরূপাক্ষের ঘড়ে।ও জানে রূপদা আর যাই হোক নিজের অপমান অত সহজে ভোলার মানুষ নয়।ঝড় একটা উঠবেই জানে, কিন্তু কতবড়ো মাপের ঝড় সেটা জানে না রিতি
রিতির হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে আয়েশের সাথে ছোট্ট চুমুক দিলো বিরূপাক্ষ।
রিতি বেরিয়ে যাচ্ছিলো আটকালো বিরূপাক্ষ,,,
শোন তোর সাথে আমার কথা আছে,,
রূপদা আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।পরে বললে হতো না? বিনয়ের সাথে বলে রিতি।
না আগে আমার কথা শুনে যা। স্বাভাবিক ভাবেই বললো বিরূপাক্ষ।রিতি অবাক,,এত নরমাল বিহেভিয়ার?মানা যাচ্ছে না।
ঠিকাছে বলো। মৃদু হাসি রিতির ঠোঁটে।হাসছে বিরূপাক্ষ ও।
কাল আমার কেবিনেট থেকে সুন্দর একটা শার্ট প্যান্ট ব্লেজার বের করে রাখিস তো ঘসে মেজে। মিটমিট হাসি বিরূপাক্ষের ঠোঁটে।
ক্যানো বলতো?রিতি কনফিউজড।
যাবো দেখা করতে।তোর তো আবার পছন্দ,রুচি সবই ভালো।সে যেনো একপলকেই পছন্দ করে নেয়।
রিতির ললাটের ভাঁজ মিলিয়ে গেলো,,প্রচ্ছন্ন হেসে বললো,,,
সেই কথা,, আচ্ছা তুমি না হয় পাঞ্জাবি পরে যেও।ওতে তোমাকে মানায় ভালো। সুন্দর,সৌম্যকান্তি,প্রাণবন্ত লাগে।
তাই?সত্যি বলছিস? আচ্ছা তুই তাহলে দেখে শুনে একটা দিস।
রিতি সায় জানিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে বেরিয়ে যায় দরজা খুলে।
রিতির বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিরূপাক্ষের মুখের হাসির ধরন পাল্টে যায় মুহুর্তেই। তারপর বলে আপন মনে,,
হাসছিস তো,,হেসে নে হেসে নে।তোর ব্যবস্থা করেই তবে ফিরবো আমি,,,,
চলবে,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।